বন্যা ও তার প্রতিকার
কলমে – অভিজিত ঘোষ ( বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয় )
■ ভূমিকা:-
সভ্যতার সেই আদিম যুগ থেকেই মানুষের মনের একটা কোনায় ভয়ের জায়গা করে নিয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রকৃতির খেয়াল খুশি মতো চলা এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনজীবনে নিয়ে আসে দুর্ভাবনার কালো ছায়া। কয়েকটি স্থানকে প্রায় করে দেয় জনশূন্য। আবার কোথাও মানুষদেরকে করে দেয় গৃহহীন, খাদ্যহীন। গৃহহীন খাদ্যহীন নর নারীরা দুর্যোগের তাণ্ডবে কাঁদতে থাকে আর সেই কান্নার অন্তরালে যেন দাঁত বের করে হাসতে থাকে প্রকৃতি। প্রকৃতি যেন উপভোগ করে এই সমস্ত দুর্দশা পীড়িত নর – নারীদের কান্না। এই সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম হলো বন্যা।
■ বন্যা ও তার বিধ্বংসী রূপ:-
নদী বা বাঁধের জল যখন পূর্ণ হয়ে তার দুকুল ছাপিয়ে যায় তখন তা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে প্রবেশ করে, তখনই তাকে বলা হয় বন্যা। এই বন্যার তান্ডব লীলা যে কি ভীষণ, তা সেই স্থানের মানুষজনেরা একেবারে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে। এছাড়াও তাদের জীবনে একটা অভিজ্ঞতা স্বরূপ হয়ে থাকে এই বন্যার তাণ্ডব। যখন কোনো অঞ্চলে বন্যা হয় তখন সেই অঞ্চলের কাচা বাড়িগুলি ভেঙে পড়ে বন্যার প্রকোপে। এছাড়াও পাকা বাড়িগুলিরও আংশিক ক্ষয়ক্ষতি হয়, এমন কি ধসেও পড়ে অনেক ক্ষেত্রে। কখনো কখনো এই বন্যার তান্ডব লীলা এতটাই ভয়ংকর হয় যে তা ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায় অনেক মানুষ এবং গবাদি পশুদেরও। গৃহহীন সেই মানুষেরা খাদ্যের অভাবে ও বাসস্থানের অভাবে মাথায় হাত দেয় আর ঠিক এই সময়েই বন্যার বিধ্বংসী রূপ চোখে পড়ে মানুষজনের।
■ বন্যার কারণসমূহ:-
সেই প্রানচীন কাল থেকেই বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্ধকারের ঘনাঘটা প্রভাব ফেলে রয়েছে এই পৃথিবীর বুকে যার প্রভাবে পৃথিবী আজও আতঙ্কিত, স্তম্ভিত। এই বন্যা হওয়ার পিছনে কি কি কারণ বিদ্যমান রয়েছে তা জানার আকাঙ্ক্ষা মানুষের বহু পুরাতন। এ নিয়ে গবেষণারও অন্ত নেই। এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। সে সমস্ত গবেষণাগুলি থেকে বন্যার কয়েকটি কারণ জানা যায়। বন্যার এই কারণগুলি হল নিম্নরূপ-
প্রথমত:- নদীর স্রোতে ভেসে যায় পলি বালি নুড়ি পাথর ইত্যাদি দ্রব্যাদি। দীর্ঘদিন ধরে নদীর চরে এই সমস্ত পলি বালি সঞ্চিত হতে হতে একসময় নদীর গভীরতা হ্রাস পায়, এবং নদীর গভীরতার হ্রাস প্রাপ্তি থেকে নদীর জল ধারণ ক্ষমতাও লোপ পায়। তখন নদীর দইকুল ছাপিয়ে জল পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রবেশ করে, এবং বন্যার সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয়ত:- নদীর পার্শ্ববর্তী তীরগুলি নদীর স্রোতে ক্ষয় হতে থাকে। এইভাবে ভূমিক্ষয় হতে হতে একসময় নদীর পাড়ে ভূমির ধস নামলে তখন নদীর জলপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। এবং এই বাধা থেকে নদীর জল পাশের গ্রামগুলিতে প্রবাহিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করে।
তৃতীয়ত:- অনেক সময় নিম্ন চাপের ফলে ৭ থেকে ৮ দিন টানা বৃষ্টিপাত হয়। এই অতি বর্ষণের ফলেও অনেক সময় পুকুর, ডোবা, পথঘাট, ড্রেন, নালা ইত্যাদি জল নিষ্কাশনের উপায় গুলি পূর্ণ হয়ে যায়, এর ফলেও বন্যা প্রকটিত হয়ে থাকে।
চতুর্থত:- বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি হয়। এবং তখন নিম্নবর্তী অঞ্চলগুলি এবং নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে জলের আধিক্য জনিত কারণে বন্যা হয়ে থাকে।
■ বন্যার কুফল:-
বন্যার নাম শুনলেই আমাদের প্রাণ দেহ খাঁচা থেকে যেন বেরিয়ে আসে। মনে হয় যেন বন্যা নয়, হাজার হাজার মানুষের শোকাহূতি, মুমূর্ষদের মর্মাহত চিৎকার, ক্ষুধিত মানুষদের হাহাকার, এবং হাজার মানুষের স্ত্রী, পুত্র, পিতা, মাতা হারানোর ক্রন্দন। বন্যা হলে তা জনজীবনে বেশ ভয়ংকর প্রভাব ফেলে। যেমন-
- বন্যা হলে কয়েকটি গ্রামকে একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
- বন্যা মানুষদেরকে করে দেয় গৃহহীন এবং খাদ্যহীন ও বাসস্থানহীন।
- বন্যা কিছু মানুষকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার প্রবাহিত পথে এবং তাদেরকে চির মুক্ত করে দেয় এই পৃথিবী থেকে।
- বন্যা আবার কিছু গবাদি পশুকেও ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায় জীবনের অন্তিম লগ্নে।
- বন্যার প্রকোপে মাঠের শস্য গুলিও নষ্ট হয়ে
যায়, যার ফলে কৃষকদের মাথায় হাত পড়ে। বন্যার সুফল:- বন্যার এত কুফল থাকা সত্ত্বেও বন্যার বেশ কিছু সুফল রয়েছে। মানুষজনেরা বন্যার এই সুফল গুলি বাহ্যিকভাবে বুঝতে না পারলেও, অভ্যন্তরীণভাবে সেগুলি ক্রিয়াশীল এবং জনকল্যাণে বিশাল উপকারী। বন্যার এই সমস্ত সুফল গুলি হল নিম্নরূপ- - আমরা আমাদের চারপাশে নোংরা ও আবর্জনা কে স্তূপ আকৃতিতে প্রত্যাহার করি। বন্যা সেই সমস্ত নোংরা আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থ গুলিকে নিশ্চিহ্ন করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে তোলে।
- আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্যের ফলে আস্তে আস্তে আমাদের মাটির তলার যে ভৌম জলের স্তর ভান্ডার রয়েছে তা ধীরে ধীরে শেষ হতে থাকে থাকে। বন্যা এসে সেই সমস্ত ভৌম জলের অর্ধ স্তর গুলিকে পূর্ণ করে দিয়ে যায়।
■ প্রতিকার:-
সভ্যতার সেই উষালগ্ন থেকেই মানুষ তাদের জীবনের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, যাতনার থেকে মুক্তির উপায় খুঁজেই চলেছে। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলি থেকেও মুক্তির উপায় খুঁজতে খুঁজতে মানুষ একসময় আশ্রয় নিয়েছিল যাগ-যজ্ঞ-বলি প্রভৃতি বিষয়বস্তুর। এইভাবেই এগোতে এগোতে মানুষ জনেরা একসময় আশ্রয় নিয়েছিল কুসংস্কারের। বর্তমানে মানুষ তথ্য নির্ভর হয়েছে, ফলস্বরূপ এইসমস্ত কুসংস্কারের অদ্ভূত রাস্তাগুলি প্রায় মুক্ত হতে চলেছে বর্তমান সমাজ থেকে। আজ বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে পুরাতন ওই কুসংস্কারের কথা মুখে আনলে সভ্য সমাজের বুকে নিজের পরিচয় হয় ব্যাকডেটেড। যাই হোক বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে বন্যার প্রতিকারের কিছু উপায় নিস্কাসিত হয়েছে সেগুলি হল নিম্নরূপ-
প্রথমত:- নদীর তীরগুলি পূর্বের তুলনায় উচ্চতম করা। এর ফলে নদীর স্রোতপ্রবাহে কোনো বাধা সৃষ্টি না হয়ে, নদী নিজের সঠিক রাস্তাতেই প্রবাহিত হতে পারে। ফলস্বরূপ বন্যার প্রকোপ অনেকাংশেই কমে যায়।
দ্বিতীয়ত:- নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে অতিরিক্ত বৃক্ষরোপন করার প্রয়োজন রয়েছে। এর ফলে নদীর পাড়ের ভূমিধ্বস অনেকাংশেই কমানো যাবে। যার ফলস্বরূপ বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেকাংশেই কমানো যাবে।
তৃতীয়ত:- নদীতে নোংরা আবর্জনা প্লাস্টিক প্রদাহ প্রভৃতি জিনিসগুলির নিস্কাসন ব্যাবস্হা বন্ধ করতে হবে, এতে নদীর গভীরতা হ্রাস পায়, ফলস্বরূপ বন্যার প্রকোপে পড়তে পারে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল। তাই এইসমস্ত মানসিকতার পরিবর্তন আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন।
চতুর্থত:- সমস্ত সাবধানবার্তাগুলি নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে প্রচার করা। নদীর পাশের গ্রাম্য অঞ্চলে অনেক অশিক্ষিত মানুষের সমাহার লক্ষ্য করা যায়। তাই তারা স্বাভাবিকভাবেই এইসমস্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত নয়। তাদেরকে এইসমস্ত বিষয়গুলোর প্রতি আলোকপাত করানোর মাধ্যমে আমরা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অনেকাংশেই খর্ব করতে পারবো।
■ উপসংহার:-
পরিশেষে বলা যায় বন্যা হলো একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানেই তা হবে প্রকৃতির খেয়ালখুশি মতো তার ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। তবুও সর্বোপরি আমরা বিভিন্ন সতর্কতার মাধ্যমে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে বিজ্ঞানের প্রযুক্তির সাথে হাত মিলিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে যতটুকু পারি বন্যাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করাটাই সবার থেকে ভালো। সর্বশেষ প্রকৃতির কথা চিন্তা করে আমাদের ভবিষ্যতের রঙিন দিনের কথা চিন্তা করে ওপরে আলোচিত বন্যা প্রতিকারের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলি যাতে প্রতিটি মানুষ মেনে চলে তার সুব্যবস্থা করাই আমাদের একান্ত কাম্য বলে মনে করি।