পুতুল নাচের ইতিকথা : শশী চরিত্র
বাংলা সাহিত্যে নিঃসঙ্গ নায়কের দৃষ্টান্ত প্রচুর। উনবিংশ শতকের প্রাকমুহূর্তে পাশ্চাত্যশিক্ষা ও জীবনবিন্যাস দ্বারা প্রভাবিত বাংলা জীবন ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছিল। ক্রমশ এই পাশ্চাত্য দর্শন, পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব একটা বিচ্ছিন্নতাবোধ সৃষ্টি করেছে সাধারণ মানুষের মনে। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকেই নিঃসঙ্গতা এসেছে, বিভিন্ন সাহিত্যিকের মানসপ্রসূত হয়ে বিভিন্ন রূপে ধরা দিয়েছে বাঙালি পাঠকের সামনে। রবীন্দ্রনাথের শচীশ, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, বিভূতিভূষণের অপু কিংবা সমরেশ বসুর বিবরের নামহীন নায়ক – এরা সকলেই নিঃসঙ্গ অথচ এদের একই শ্রেণিতে দাঁড় করানো চলে না। ঠিক তেমনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শশী, তার নিঃসঙ্গতা কোন কল্পনাভূমি থেকে জাত? তার নিঃসঙ্গতা তাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে সেটাই বিচার্য।
অন্তর্মুখী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ (১৯৩৬) উপন্যাসের নায়ক চরিত্র শশী। উপন্যাসে শশী ডাক্তার। গ্রাম্যতা, সংস্কার, গ্রামীণ কায়দাকানুন শশীর প্রথম জীবনের সঞ্চয়। তারপর শহরে গিয়ে ইংরাজি শিক্ষা, বিজ্ঞানবোধ, ডাক্তারি পাস, নাগরিক মনোভাব সর্বোপরি বিচিত্র কুমুদের সান্নিধ্য শশীর পরবর্তী জীবনে অর্জিত। গ্রাম এবং শহরের ভিন্ন পটভূমিতে শশী চরিত্রটি তিনটি পর্যায়ে আলোচনার দাবি রাখে –
১) দ্বৈত অস্তিত্ব
২) ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী
৩) নিঃসঙ্গ নায়ক
■ দ্বৈত অস্তিত্বের স্বাক্ষর শশী –
৹ গ্রাম ও শহরের ভিন্ন পটভূমি শশীর চরিত্রটিকে আপাতভাবেই দুই ভিন্ন অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একদিকে বাবার পাটোয়ারি বুদ্ধি, আচরণের দুষ্টতা, বদনামকে সে ঘৃণা করে অপরদিকে পিতার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ‘ছোটবাবু’ নামকরণে সে সন্তুষ্ট, ওই নামেই গ্রামে সে শ্রদ্ধার পাত্রও।
৹ শশীর ডাক্তারি বিদ্যা ও বিজ্ঞানবোধ গ্রামের মাটিতে প্রায়শই ঠোক্কর খেয়েছে। ডাক্তার শশী গ্রামে এসে প্রথমেই সংগ্রাম করতে চেয়েছে গ্রামীন চেতনার বিরুদ্ধে, শুরু করেছে নিজের বাড়ির মধ্যে থেকেই – “দুপুরবেলা শশী ঘরে ঘরে বলিয়া যায় , ওঠ, উঠে পড় সবাই, ঘুমোতে হবে না। অথচ নিদ্রিত গাওদিয়ার চেতনা নিয়ে তারাইশশীর বিরুদ্ধে বলে উঠেছে – “শশী যেন পাগল, স্বাস্থ্য দিয়ে আমাদের কি হবে!” এমনকি দরজা জানলা খুলে রাখার ব্যাপারেও সচেতন করাতে পারেনি শশী তাদের। মতিকে টিকে নিয়েছে কিনা শশী জিজ্ঞাসা করলে মতি জানায় ‘মা শেতলার দয়া হলে হবেই’ তাই বাড়ির লোকের স্বাস্থ্য ভালো করার চেষ্টা শশী ত্যাগ করেছে। অতঃপর শশীর সিদ্ধান্ত :
“রোগে ভুগিয়া অকারণে মরিয়া ওরা বড় আনন্দে থাকে।…সতেজ, উত্তপ্ত জীবন ওদের সহিবে না”
৹ শশী কলকাতা থেকে বিজ্ঞান সন্ধিৎসু মন নিয়ে গ্রামে এসেছে। কিন্তু গ্রামে সূর্যবিজ্ঞানে বিশ্বাসী যাদবের মতো মানুষ এখনও আছে যার কাছে একালের ডাক্তার, কবিরাজ দৃষ্টিহীন অন্ধ সব। যাদব পন্ডিত পাগলদিদি শশীকে স্নেহ করে, শশীও সে বুড়োবুড়ির নীড়ে এসে শান্তি পায়। সূর্যবিজ্ঞানের মহিমাকে প্রবল করার উদ্দেশ্যে, ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণের সম্মানের লুব্ধতায় যখন যাদব – পাগলদিদি অতিরিক্ত আফিমসেবনে আত্মহননের পথ বেছে নেয়, এর নেপথ্যে আত্মহত্যার রহস্য উন্মোচন কেবল শশীই টের পায়। অতঃপর লেখকের স্পষ্টোক্তি :
“বিশ্বাস হয় না তবু শশীর মনের আড়ালে লুকানো গ্রাম্য সংস্কার নাড়া খাইয়াছে।”
৹ একদিকে ভাবাবেগ, রসবোধ সহ নাগরিক রোমান্টিকতা অন্যদিকে সাংসারিক বুদ্ধি ও ধনসম্পত্তির প্রতি মোহ শশীর চরিত্রকে দুইভাগে ভাগ করেছে। শহর থেকে সদ্য আসা চিকিৎসক শশীর চিন্তায় ধরা পড়েছে – “একদিন কেয়ারি করা ফুল বাগানের মাঝখানে বসানো লাল টাইলসে ছায়া বাংলোয় শশী খাঁচার মধ্যে কেনারি পাখির নাচ দেখিবে, দামি ব্লাউজে ঢাকা বুকখানা শশীর বুকের কাছে স্পন্দিত হইবে…” শশীর নিজস্ব এই কল্পনার জগত, কল্পিত মানবীর মোহ প্রথমদিকে গ্রামীণ কুসুমকে অস্বীকার করেছে। মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতা, সমাজে ডাক্তার হিসাবে প্রতিষ্ঠা সর্বোপরি বিদেশ বাসের ইচ্ছা কুসুমের অবৈধ প্রেমের অনৈতিকতাকেই শশীর মনে স্বীকার করিয়েছে। বিদেশে প্রতিষ্ঠা, লাল টাইলে ছাওয়া বাংলো, দামী ব্লাউজে ঢাকা রমণীর বুক শশীকে আন্দোলিত করেছে। কিন্তু ক্রমশ শশীর যতই মনে হয়েছে সে চিরকালের জন্য মার্কামারা ডাক্তার হয়ে গেছে – “এই গ্রাম ছাড়িয়া কোথাও যাইবার শক্তি নাই” তখনই কুসুমের সান্নিধ্য তার কাছে আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠেছে। রোমান্টিক ভাবনা এখানে মানসিক সংকটের আবর্তে পড়ে নিজের অস্তিত্বকে প্রবলভাবে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় পর্যবসিত হয়েছে।
বিদেশে প্রতিষ্ঠার মোহ ভাঙলে মধ্যবিত্ত শশীর পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়ভাবনা প্রকাশ পায়। ডাক্তার হিসাবে শশীর মূল্য, নিজের ভিজিট, ওষুধের টাকা আদায়ের ব্যাপারে বাসুদেব বাড়ুজ্জ্যের সঙ্গে তার আচরণ শশীর বিষয়সর্বস্বতাকেই প্রকাশ করে।
যাদব পন্ডিতের দানে গড়া হাসপাতালের কর্ণাধার হয়ে শশী অনুভব করে – “এতদিনে সে ছিল ডাক্তার এবার যেন আপন হইতে ছোটোখাটো একটি নেতা হইয়া উঠিতেছে”
– গ্রামজীবনে এই সম্মানপ্রাপ্তিই বিদেশে যেতে না পারার ব্যর্থতাকে পূরণ করে প্রতিষ্ঠালাভের আকাঙ্ক্ষাকে উসকে দিয়েছে।
■ ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী শশী –
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় একজন চিকিৎসকের দৃষ্টিতে মানব অস্তিত্বের বিচার করতে বসেছেন। সেই চিকিৎসক, উপন্যাসের নায়ক – শশী। মানিক উপন্যাস শুরু করছেন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, মৃত্যুর বিপরীতে ডাক্তার ; মৃত্যুকে দেখছে নিরূপায়ভাবে, হার মেনেছে মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবীতার কাছে। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও এই মৃত্যুর বিরুদ্ধে ডাক্তাররা অবিরত সংগ্রাম চালায়। এবং তাই চিকিৎসকরা তাদের জীবিকার্থে ঈশ্বরের নিয়মকে প্রতিহত করে, অনিবার্যকে অস্বীকার করার প্রয়াস করে, আর এখানেই ডাক্তার হয়ে যায় ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় শশীকে গড়ে তুলেছেন ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে, এখন মৃত্যু শশীকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে সেটাই বিচার্য।
উপন্যাসের শুরুতেই দেখি বজ্রাঘাতে মৃত হারু ঘোষকে – “আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে কটাক্ষ করিলেন”। এবং নায়ক, চিকিৎসক শশীর প্রবেশ শববাহক হিসাবে। জীবনের দূত হয়ে যে গ্রামে এসেছে তার প্রথম পদক্ষেপ মানিক ঘটালেন মৃত্যুর দৌত্য নিয়ে। উপন্যাসের প্রথম পাতাতেই ঈশ্বর তথা নিয়তির হাতে মানুষের অসহায়তা, সীমাবদ্ধতা প্রকট হয়ে ওঠে।
এরপর মানিক শশীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ক্ষয় ও মৃত্যুকে ব্যাপকভাবে প্রকাশ করেছেন। গাওদিয়ায় এসেই নাগরিক রোমান্টিক ভাবালুতা সম্পন্ন চিকিৎসক শশীর প্রধান সংগ্রাম ছিল চেতনাহীনতার বিরুদ্ধে। অসময়ে নিদ্রাগত গাওদিয়াকে জাগাতে শশীর প্রথম পদক্ষেপ নিজের বাড়িতেই – “দুপুরবেলা শশী ঘরে ঘরে বলিয়া যায় ওঠ, উঠে পড় সবাই” কিন্তু অসচেতন গাওদিয়া বিদ্রোহ করে তারই বিরুদ্ধে –
“শশী যেন পাগল, স্বাস্থ্য দিয়ে আমাদের কি হবে!” ব্যঙ্গ বিদ্রুপকে কানে না তুলে শশীর পরবর্তী পদক্ষেপ : “দম আটকে মরবে যে সবাই। সব জানলা বন্ধ, বাতাস আসবে কোথা দিয়ে ?” কিন্তু অপরপক্ষ নির্বিকার। অতঃপর “বাড়ির লোকের স্বাস্থ্য ভাল করার চেষ্টা শশী ত্যাগ করিয়াছে”
পরবর্তী অভিজ্ঞতায় শশী আরও অসহায়। শশীর আপ্রাণ চেষ্টা, পরিজনদের আকুল প্রার্থনা সমস্ত ব্যর্থ করে বাসুদেব বাড়ুয্যের দশ বছরের ছেলেটা মারা যায়। নিয়তিকে ঠেকানো কোনো মানুষ, কোনো মা, কোনো ডাক্তারের সাধ্যের বাইরে – এটাই বুঝিয়েছেন মানিক এই চিত্রকল্পের মাধ্যমে।
আধ্যাত্মিক মৃত্যুর অসহায় ভূমিকাই যেন শশীর একমাত্র নিয়তি, তা আবারো স্পষ্ট হয়ে যায় – যাদব পন্ডিত ও পাগলদিদির যুগ্ম আত্মহত্যায় শশীর নীরব নির্বিকার সাক্ষী থাকার মধ্য দিয়ে। আশেপাশের গ্রামসহ সমস্ত গাওদিয়ায় যখন যাদব পন্ডিতের ইচ্ছামৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় তখন চিকিৎসক শশীর চোখে ধরা পড়ে যায় উভয়ের মুখে আফিমের বিষক্রিয়ার। শুধু তাই নয়, একমাত্র শশীই জানে সূর্যসিদ্ধান্তের বিশ্বাসকে তার কাছে অটল রাখতেই বৃদ্ধ দম্পতির এই পদক্ষেপ ; শশী আবারো একবার পুতুল বনে যায় – ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী চিকিৎসক শশী নিয়তির হাতে ক্রীড়নকে পর্যবসিত হয়ে যায়।
তাছাড়া শশী প্রাণপাত করে সেনদিদির প্রাণ বাঁচালেও লাবণ্যময়ী সেনদিদিকে ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে সেনদিদি প্রাণ বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞ না থেকে রূপহীন দৃষ্টিহীন করার অভিশাপই দিল শশীকে।
চিকিৎসক শশীর প্রচেষ্টা, নিয়তি তাড়িত ব্যর্থতা সমস্তই মনে করিয়ে দেয় সাগর পারের রিউকে, কাম্যুর ‘প্লেগ’ উপন্যাসের নায়ক, সেও ডাক্তার, তারও সংগ্রাম ওরানের অধিবাসীদের চেতনার বিরুদ্ধে কেননা, “প্লেগ এখানে বাইরের কোনো বিমূর্ত প্রতীক নয়, ওরানের অধিবাসীদের মনের মূল্যবোধের অন্তঃস্থল পর্যন্ত প্রসারিত”
‘প্লেগ’ উপন্যাসে রিউয়ের সামনে দিয়ে মহামারির মৃত্যুলীলা বয়ে চলে, অপরদিকে শশীর চোখের সামনে দিয়ে ঘটতে থাকে আধ্যাত্মিক এবং জৈবিক মৃত্যুর ভয়ঙ্কর অন্তহীন খেলা। এ প্রসঙ্গে নবনীতা দেবসেন জানাচ্ছেন –
“পুতুল নাচের ইতিকথা’তে মৃত্যুগুলির চেহারা বড় ভয়ানক। দশ বছরের প্রতীক্ষার পরে কুসুমের প্রেম মরে যায়”। প্রাণচঞ্চল কুসুম, যে কিনা গাওদিয়ার সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে গাওদিয়াতেই থেকে যেতে চেয়েছিল, পরানের বৌ হিসাবে নয়, কুসুমের পরিচয়ে, সেই কুসুমও শশীর দীর্ঘদিনের অন্যমনস্কতায়, দ্বিধায় শুকিয়ে গেছে।
শশী ভাবে : “কুসুম মরিয়া গিয়াছে, তারই চোখের সামনে তারই অন্যমনস্ক মনের প্রান্তে। কি ছেলেখেলায় সে মাতিয়াছিল যে এমন ব্যাপার ঘটতে দিল ?”
শুধু কুসুম নয়, বিন্দুর ক্ষেত্রেও শশী ব্যর্থ। যে বোনকে উপপত্নী জীবনের গ্লানি থেকে বাঁচাতে স্বামীর ঘর থেকে নিয়ে এল, সে মদের তীব্র নেশা উত্তেজনাপূর্ণ জীবন ছেড়ে বাঁচতে পারে না। মাঝরাতে তাই ওষুধের গ্লাসে করে তাকে মদ পরিবেশন করতে হয়। এবং শেষ অবধি চরম হার মেনে নিয়ে পৌঁছে দিতে হয় স্বামী নন্দলালের কাছে।
জৈবিক বা অধ্যাত্মিক মৃত্যুতে অসহায় ভূমিকাই শশীর একমাত্র নিয়তি। অবশেষে শশী হাল ছেড়ে দেয়। উপন্যাসের শেষে শশীকে দেখি পরাজিত, অসহায়, একাকী – “মাটির টিলার উপর উঠিয়া সূর্যাস্ত দেখিবার শখ এ জীবনে আর একবারও আসিবে না।” এখানেই রিউর সঙ্গে শশীর পার্থক্য লক্ষ করা যায়। শশী হাল ছাড়লেও রিউ হাল ছাড়ে না। নবনীতা দেবসেন এর বিশ্লেষণ করে বলছেন –
“রিউয়ের মনে সাফল্য বিষয়ে মোহ নেই, তাই অসাফল্য নিয়েও সে তার মাথা ঘামায় না। যেহেতু তার মনে আশ্বাস নেই, তাই সে হতাশ্বাস হয় না। কেবল কাজ করার জন্যই কাজ করে যায়। এখানেই রিউ শক্তিমান – শশী দূর্বল।”
আসলে রিউর রক্ষাকবচ – আত্মজ্ঞান, শশী তা থেকে বঞ্চিত, তাই সে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েও হয়ে উঠতে পারেনা, নিয়তি তাড়িত হয়ে পরিণত হয় পুতুলে।
■ নিঃসঙ্গ নায়ক শশী –
উপন্যাসে নায়কের নিঃসঙ্গতাবোধ উপন্যাস সৃজনের মুহূর্ত থেকেই বিদ্যমান থাকে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। শববাহক হিসাবে কলকাতা থেকে ডাক্তারি পড়ে আসা চিকিৎসক শশীর গাওদিয়ায় প্রবেশ তারই ইঙ্গিত দেয়। শুধু তাই নয়, মরার ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারে শশীর সচেতনতা শশীর দ্বিধাভক্ত মনকে প্রকাশ করে ফেলে। একদিকে সঞ্চিত গ্রামীণ সংস্কার আর একদিকে অর্জিত নাগরিক মনোভাব এই দুয়ের মিল করতে পারে না কখনোই শশী। তাই কখনো বাবার কাজকে মেনে নিতে পারেনি, কখনো বন্ধু কুমুদের প্রতি ঈর্ষা অনুভব করে মতিকে বিয়ে করতে চেয়েছে, কখনো কুসুমকে দূরে ঠেলেছে গভীর অন্যমনস্কতায়, কখনো আবার কাছে টানতে চেয়েছে, কখনো গাওদিয়ার মানুষের জন্য প্রাণপাত করেছে কখনো আবার মিথ্যে টাকার অঙ্ক নিয়ে বচসায় জড়িয়েছে। আসলে পরান, কুসুম, বিন্দু, সেনদিদি, মতি, কুমুদ এদের কাউকে যখনই শশী আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে তখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শশীর নিজেরই দ্বিধান্বিত মন, অন্তর্মুখী মানসিকতা। না হতে পারে বাবা গোপালের মতো, না পারে বন্ধু কুমুদের মতো – আর এই টানাপোড়েনেই শশী হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব। এবং মানিক পাঠককে জানিয়েই দিচ্ছেন – “এ বিষণ্ণতা ঘুচিবার নয়”
শশী ভবঘুরে নয়, শখের পরবাসী বা আত্মমগ্ন শিল্পী নয়। সে যুক্তিবাদী। স্বেচ্ছায় বারবার সমাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়, ব্যর্থ হয়। এবং এই বারংবারের ব্যর্থতাই শশীকে বিধ্বস্ত করে তোলে। শশীর এই নিঃসঙ্গতার কারণ আসলে নিহিত হয়ে আছে সমকালীন বাংলা সাহিত্যে –
১) বাংলা সাহিত্যে শশীর যথার্থ পূর্বসূরী কেউ নেই। সম্পূর্ণ অপরিচিত মনোভঙ্গীর পথিকৃৎ শশী। অরোমান্টিক নির্বাসিত নায়কের প্রথম অগ্রদূত হিসাবে তার আবির্ভাব।
২) শশীর স্রষ্টা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন একাধারে নিঃসঙ্গ। সমকালীন বাংলা সাহিত্যে একমাত্র জগদীশ গুপ্তকেই তার শ্রেণীতে দাঁড় করানো যায়। সর্বোপরি, পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাস রচনার সময় মানিক ছিলেন বন্ধুবর্জিত, ভিন্ন ভাষা গোষ্ঠির লেখকমন্ডলী পরিবৃত। ফলে শশীও বন্ধুহীন।
এবং নির্বান্ধব নিঃসঙ্গ নায়ক শশী যথার্থই একক এবং অদ্বিতীয়।