কৃষ্ণকুমারী নাটক – ঐতিহাসিক নাটক কি
বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যায় মূলত ১৮৫২ সাল থেকে মৌলিক নাটক রচনার সূত্রপাত ঘটেছে। তবে ভদ্রার্জুন কিংবা কীর্তিবিলাস নাটকগুলি অপটু হাতের নিদর্শন। প্রথম বাংলা ঐতিহাসিক নাটক রচনার কৃতিত্ব তাই মাইকেল মধুসূদন দত্তের। মধুসূদন তাঁর ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকটিকে নিজেই ‘হিরোইক ট্রাজেডি’ বলে অভিহিত করেছেন।
মধুসূদন ‘কৃষ্ণকুমারী নাটকে’র ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহ করতে সাহায্য নিয়েছিলেন জেমস টডের ‘Annals and Antiquities of Rajasthan’ থেকে। রাণা ভীমসিংহের কন্যা কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ জগৎসিংহ ও মানসিংহ উভয়েই। অবশেষে উভয় রাজাদের প্রতিযোগিতায় নিজের দেশ রাজ্য বাবা মাকে বাঁচাতে কৃষ্ণকুমারী স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ইতিহাসের সত্য হচ্ছে বিশেষ সত্য, আর সাহিত্যে প্রকাশ পায় নিত্য সত্য। ঐতিহাসিক নাটকে অতীত ইতিহাস থেকে উপাদান নেওয়া হবে ঠিকই তবে তা ইতিহাসের সত্যকে ছাপিয়ে নিত্য সত্যকে প্রকাশ করবে। এই মন্তব্যের আলোকে ঐতিহাসিক নাটক হিসাবে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক বিচার্য। টডের রাজস্থানে বিবৃত কাহিনি থেকে মাইকেল কিছু কিছু পরিবর্তন করেছিলেন। রাজার রাজার যুদ্ধে রাজকুমারীর মৃত্যু – এই ঐতিহাসিক সত্যটাই কেবল নাটকের কাহিনিতে ব্যবহৃত হয়েছে এবং তা এসেছে মধুসূদনের কল্পিত প্রেক্ষাপটে। আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন –
“টডের রাজস্থানকে যদি ইতিহাস বলতে পারা যায় তবেই কৃষ্ণকুমারীকে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায়।”
কেননা টডের রাজস্থানে বর্ণিত কৃষ্ণকুমারীর প্রসঙ্গের আর অন্য কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তাই সুকুমার সেন ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’কে ঐতিহাসিক নাটক বলতে চাননি। সমালোচক আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন ঘটনার দিক দিয়ে ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক অত্যন্ত দীন। মধুসূদন এর জন্য কৈফিয়ৎ দিয়েছেন যে, মূল ঐতিহাসিক কাহিনিই বৈচিত্র্যহীন। এখন প্রশ্ন হল বৈচিত্র্যহীন জেনেও মধুসূদন কেন এই কাহিনিই বেছে নিলেন তাঁর সাহিত্য জীবনের শেষ নাটক লেখার জন্য ?
এর উত্তরে বলা যায়, মধুসূদন আসলে ঐতিহাসিক কাহিনির মোড়কে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। নাট্যসমালোচকদের একাংশের দাবি, টড তাঁর রাজস্থান গ্রন্থে ভারতবর্ষের পূর্বপুরুষের গৌরব বর্ণিত করেছিলেন কেননা, জমি থেকে শিল্পের দিকে ভারতবাসী মনোনিবেশ করতে না পারে। এই বিদ্রুপাত্মক দিকটা মধুসূদন উপলব্ধি করতে পেরে এই কাহিনিকে বেছেছিলেন নাটক রচনার জন্য। কূল ও মান রক্ষার জন্য, দেশ ও জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিষ্পাপ তরুণী কৃষ্ণকুমারীর আত্মবিসর্জন দেশাত্মবোধের পরিচয়কে সুস্পষ্ট করে। নাটকের বিভিন্ন সংলাপেও ছড়িয়ে আছে প্রচ্ছন্ন দেশাত্মবোধ –
১) “মহারাজ, স্বদেশের হিতসাধনে যদি আমার প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়, তাতেও আমি প্রস্তুত আছি।” ~ বলেন্দ্রনাথের উক্তি
২) “এ ভারতভূমির কি আর শ্রী আছে। এ দেশের পূর্বকালীন বৃত্তান্ত সকল স্মরণ আমরা যে মনুষ্য, কোনোমতেই বিশ্বাস হয় না।”
~ ভীমসিংহের উক্তি
এর পাশাপাশি প্রকাশ পেয়েছে সমকালীনতা, তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষে এক শ্রেণির নাগরিক ছিল যারা আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্রিটিশ শাসকদের পদলেহন করত, সেই পরান্নভোজী নাগরিকদের প্রতিভূ ‘কৃষ্ণকুমারী নাটকে’র ধনদাস চরিত্রটি। ধনদাস চরিত্রের চতুরতা, ষড়যন্ত্র এবং বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে সমকালীন ভারতের শঠ রাজনীতির খেলা স্পষ্ট হয়েছে।
তবে নাটকে কাহিনির বুনন ও দৃশ্যগত অসংলগ্নতা কৃষ্ণকুমারী নাটকের সীমাবদ্ধতাকে সূচিত করে। তা সত্ত্বেও ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’ মধুসূদনের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক।