আরোগ্য নিকেতন : জীবন মৃত্যুর দ্বন্দ
‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসটি লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৩৫৯ সালের চৈত্র মাসে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘সঞ্জীবন ফার্মেসী’ নামে একটি উপন্যাস। পরবর্তী দ্বিতীয় সংস্করণে অনেক পরিবর্তন পরিমার্জনা করে নাম দেন ‘আরোগ্য নিকেতন’।
ঐতিহ্য ও প্রগতির দ্বন্দ্ব তারাশঙ্করের প্রিয় বিষয়। প্রাচীন ও নবীনের এই দ্বন্দ্বকে নানাভাবে নানা মাত্রায় তারাশঙ্কর তাঁর ছোটগল্প বা উপন্যাসে প্রকাশ করেছেন। এই প্রাচীন ও নবীনের দ্বন্দ্ব আলোচিত ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে এসেছে চিকিৎসা ও চিকিৎসাবৃত্তি প্রসঙ্গে, ব্যধি ও ব্যধি নিরাময়ের নানা উপায়ে। তারাশঙ্করের চিকিৎসাতত্ত্ব সম্পর্কে নানা আগ্রহ ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে ‘দেবতার ব্যধি’, ‘নাগিনী কন্যা’, ‘বোবা কান্না’ ইত্যাদি গল্পে।
‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসেও তারাশঙ্কর এক চিকিৎসকের গল্প লিখতে বসেছেন, মানুষের রোগ আরোগ্য মৃত্যুর কাহিনি লিখেছেন। দেবীগ্রাম নবগ্রাম এমন কয়েকটি সন্নিহিত গ্রামকে ভিত্তি করে গল্প লিখেছেন। পুরানো দিনে গ্রামাঞ্চলে সন্ন্যাসীদের টোটকা, বৃদ্ধদের লোক চিকিৎসা এবং বিশুদ্ধ কবিরাজি চিকিৎসা প্রচলিত ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মানুষের মনে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার প্রতি ঝোঁক বাড়তে থাকল। এই পরিবর্তনে শামিল হতে চেয়েছিলেন জীবন মশায়। কবিরাজের ছেলে, কবিরাজিতে অঞ্চলের সেরা তা সত্ত্বেও রঙ্গলাল ডাক্তারের কাছে পড়ে অ্যালোপাথিও রপ্ত করেছিল। নিপুণতা যথেষ্ট দেখালেও জীবন মশায় ডিগ্রিধারী ডাক্তারের কাছে নিতান্ত হাতুড়ে। তাই গ্রামে যখন হেলথ সেন্টার, সরকারি হাসপাতাল তৈরি হল, ডিগ্রিধারী ডাক্তাররাও আসতে থাকল সেখানে জীবন মশায়ের পসার নিষ্প্রভ হতে থাকল।
কিন্তু ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে জীবন দত্ত অনেক বাস্তববাদী। যুগের সঙ্গে নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি, নতুন ওষুধের গুরুত্ব মেনে নিয়েছেন। যেসব ক্ষেত্রে কবিরাজির তুলনায় অ্যালোপাথি সহজে কার্যকর তখন তা প্রয়োগ করেছেন। জীবন মহাশয় দক্ষ কবিরাজ, একজন পাশ না করা ভালো ডাক্তার। তারচেয়ে বড় কথা জীবনমৃত্যুর যে খেলা চলে রোগ আরোগ্যের হারজিতের দাবায়, সেখানে জীবনমশায় এক প্রতিভা যেন কোনো অলৌকিক ক্ষমতায় অতিমানবিক। বিপিনের মৃত্যুতে মশায়ের অনুচ্চারিত নিদান সত্য হয়েছে, আর কলকাতার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মতির মায়ের নাড়িতে মৃত্যুর পদধ্বনি শুনেছিল জীবন মশায়, ছয় মাস সময় দিয়েছিল তাকে। রামহরি মৃত্যুকে স্বীকার করে জ্ঞানগঙ্গায় যেতে চায় কিন্তু জীবনমশায় বলে মৃত্যু এখনও বেশ দূরে। আবার জীবন মশায়ের ছেলে বনবিহারী অবিরাম অত্যাচারে মৃত্যুকে ডেকে আনছে। জীবন মশায় বুঝতে পারে নাড়ি টেপার আগেই। কিন্তু মৃত্যুর নিয়তিকে রোধ করতে পারে না। জীবন মশায়ের নাড়ি দেখা শুধু রোগীর মৃত্যু ঘোষণার জন্য নয়, মৃত্যু রোধ করার জন্য। তাই জীবনমশায়ের বিশ্বাস মৃত্যু অনিবার্য যখন সে কালব্যাধি মানুষ রোধ করতে পারে না। আবার বহু কঠিন ব্যাধি যদি কালব্যাধি না হয় তবে তা রোধ করা সম্ভব। এই প্রত্যয় নিয়েই জীবন মশায় সেখানে দেখছে রূপহীন মৃত্যুর এগোনো পেছোনোর খেলা।
বহুবিচিত্র মৃত্যু, তারাশঙ্কর মৃত্যুর বিচিত্র ছবি এঁকেছেন উপন্যাস জুড়ে। ফলে ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাস কেবল প্রাচীন ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বন্দ্ব এ সীমাবদ্ধ থাকল না সেখান থেকে এগিয়ে এল জীবন মৃত্যুর দ্বন্দ্বে।প্রসঙ্গত মনে পড়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসটি। যামিনী কবিরাজ, যাদব পন্ডিত ও শশীর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন খুব সূক্ষভাবে। সেইসূত্রেই উপন্যাসে এসে পড়েছিল জীবন মৃত্যুর দ্বন্দ্ব, যাদব পন্ডিতের ইচ্ছামৃত্যু, যেন জীবনকে পরিহাস, আবার সেনদিদিকে বাঁচাতে শশীকে মৃত্যুর সঙ্গে জীবনের লড়াইয়ে নামতে হয়েছে, আধুনিক চিকিৎসায় কবিরাজি প্রথা ব্যর্থ হচ্ছে। ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসের জীবন মৃত্যুর দ্বন্দ্ব আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে জীবন মশায়ের অনুভবে –
“এতকাল জীবন মশায় নাড়িতে মৃত্যুর আগমন অনুভব করেছে, তার নির্ভুল দিনক্ষণ তার বিদ্যার করতলগত ছিল। আজ তার সিদ্ধি, নিজের মৃত্যু তার মৃত্যু দর্শন।”
তারাশঙ্করের জীবনজিজ্ঞাসার প্রধান বিষয়ই ছিল মৃত্যুভাবনা। ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর মৃত্যুর প্রশান্তরূপটাই এঁকেছেন। জীবন মশায়ের দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে অভিজ্ঞতার সূত্রে পাঠক মৃত্যুর রহস্যময় জগতে পরিক্রমা করেন। তবু ড. আশিষ কুমার দে জানিয়েছেন –
“মৃত্যুরহস্য বিশ্লেষণের চেষ্টা তত্ত্বসর্বস্ব হয়নি, পাঠকের অনুভবের স্তরে তীক্ষ্ণতা জাগিয়েছে।”
তাহলে কি মৃত্যুভাবনাতেই তারাশঙ্কর উপন্যাসটিকে শেষ করলেন ? এ বিষয়ে অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন,
‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসের বিষয় সাময়িক নয়, চিরন্তন। ভারতবাসীর মনে যে মৃত্যু জিজ্ঞাসা আছে – মৃত্যুর দর্শন সম্বন্ধে যে চিরন্তন জিজ্ঞাসা আছে মৃত্যুর রহস্যময়তা সম্বন্ধে শ্রদ্ধা – বিস্ময় মিশ্রিত অনুভূতি আছে তাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাস।”
কিন্তু ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে মৃত্যু প্রাসঙ্গিক নয়, আধিকারিক, জীবন থেকে শুরু করে মৃত্যুতে পৌঁছানো নয়, মৃত্যু থেকে জীবনে যাওয়ার গল্প, এ গল্প জীবনের গল্প – মৃত্যুর পাত্রে ধরা সে জীবন। মৃত্যুর আলোকেই জীবনের সত্যের উদ্ভাস হয়। ভারতীয় দর্শনে জীবন মৃত্যুকে একটি অখন্ড প্রবাহ বলে মেনে নেওয়া হয়েছে, মৃত্যু ধ্বংসনয়, চিরাবসান নয়। মৃত্যুর পরিণামে পুনরায় জন্মগ্রহণ – এভাবেই জন্ম জন্মান্তর মৃত্যুর সূত্রে গাঁথা পড়ে।