★করোনা ভাইরাস : আশীর্বাদ না অভিশাপ★
◆ ভূমিকা ~
বিশ্বজুড়ে এই ২০২০র সর্বাপেক্ষা আলোচিত এবং আলোড়নকারী বিষয় হল করোনা ভাইরাস। কোভিড – ১৯ এর করাল গ্রাসে আচ্ছাদিত উৎসস্থল চিনসহ বিশ্বের ২২০টি দেশ। আর এই করোনা ভাইরাসের প্রভাব যেমন পড়েছে মানুষের জীবনযাত্রায়, তেমনি বিশ্বের অর্থনীতিও এর ধাক্কায় আন্দোলিত। শুধু মানুষ নয় এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আনুবীক্ষণিক জীবটি নাড়িয়ে দিয়েছেবৈশ্বিক পরিবেশকেও। অর্থাৎ পরিবেশের মূল দুটি উপাদান প্রকৃতি ও মানুষ – উভয়ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলেছে এই করোনা ভাইরাস। এখন দেখার এই খুদে ভাইরাসের দাপট বিশাল উদার পরিবেশের প্রকৃতি ও মানুষের জন্য কতটা আশীর্বাদের নাকি এই কোভিড ১৯ কেবল অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
◆ করোনা ভাইরাস কী ?
করোনা ভাইরাস ভাইরাসের একটি শ্রেণি, আর এই করোনা ভাইরাস গোষ্ঠীর একটি বিশেষ প্রজাতি হল কোভিড ১৯। করোনা ভাইরাস সাধারণত ভাম, গরু, শূকর, মুরগি ইত্যাদি প্রাণীদেহে অবস্থান করে এবং প্রাণীদেহ থেকে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। গবেষকদের একাংশের দাবি, চিনের উহান শহরের ‘হর্সগু’ নামক একপ্রকার বাদুড়ের দেহ থেকে এই কোভিড ১৯ মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়েছে।
◆ করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ও প্রতিরোধের উপায় ~
করোনা ভাইরাসের একটি বিশেষ প্রজাতি অর্থাৎ কোভিড ১৯ এর বাহক হল মানবদেহ। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শে ভাইরাসটি মূলত নাক মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে ফুসফুসকে আক্রমণ করে। এই ভাইরাসের সংক্রমণে এত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO একে মহামারী বলে ঘোষণা করেছে। এই বিপুল জনসংখ্যার পৃথিবীতে এই প্রতিষেধক বিহীন মারণ ভাইরাস থেকে প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হল মানুষের থেকে মানুষের দূরত্ব বজায় রাখা। এর ফলে বিশ্ব জুড়ে প্রশাসনিকভাবে নানা সময় লকডাউনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সাধারণ মানুষকে সোস্যাল ডিসট্যান্স বা দূরত্ব বিধি বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে এবং সংক্রমিত ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে বা গৃহবন্দি করে চিকিৎসা চলছে।
◆ করোনা : অভিশাপ ~
এবারের ২০২০ সালের শুরু থেকেই অর্থাৎ নববর্ষের সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের আগমন ঘটেছে। মাত্র ছয় মাসে এই মহামারীর কারণে ২২০টির ও বেশি দেশ করোনায় আক্রান্ত, প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ বলি হয়েছে করোনার খড়্গে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে করোনা পা রেখেছে ভারতবর্ষে, এরপর থেকে পাঁচ মাসের মধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা ১২ লক্ষ ছাড়িয়েছে। তার সঙ্গে চলছে মৃত্যু মিছিল। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা নভেম্বর ডিসেম্বর মাস থেকে এই মৃত্যুর হার কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
যদিও করোনা সংক্রমণের প্রবণতা এবং তার জেরে মৃত্যুর হার বয়স্কদের ও ডায়াবেটিস , উচ্চরক্তচাপসম্পন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি, তবুও তরুণ কিশোর কিংবা শিশুদের মৃত্যু সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। এমনকি করোনায় মৃত্যু হলে সংক্রমণ এড়াতে মৃতদেহকে পরিবারের হাতে না দিয়ে অন্যত্র সৎকার করা হয় – সেইসব প্রিয়জনের কাছে এর থেকে হৃদয়বিদারক আর কি হতে পারে।
আবার চিকিৎসা ক্ষেত্রে করোনা পরিষেবার জেরে অন্যান্য রোগের পরিষেবা বন্ধ আছে। কিংবা জরুরিকালীন চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
তাছাড়া করোনা সংক্রমণের প্রতিরোধে প্রশাসনিকভাবে লকডাউনের কারণে স্কুল কলেজ, অফিস, সিনেমা হল, যানবাহন পরিষেবা সমস্ত বন্ধ আছে অনির্দিষ্ট কাল ধরে। ফলে অর্থনীতি ব্যবস্থা যেমন বড়সড় ধাক্কার মুখে তেমনি ব্যাহত হয়েছে সাধারণ জনজীবনও। পরীক্ষার স্থগিতকরণ, স্কুল কলেজের অনির্দিষ্টকাল ধরে বন্ধের নির্দেশের ফলে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়েও সমস্যা তৈরি হয়েছে। এই করোনার জেরে জনঘনত্ব বা মানুষের ভিড় এড়াতে বড় বড় শপিং মল, রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল গুলি সম্পূর্ণ বন্ধ। এইসব পরিষেবাকে কেন্দ্র করে কর্মচারীরা বেকারের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হয়েছে। তাছাড়া এই লকডাউনের জেরে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে, তার জেরে আত্মহত্যা কিংবা অনাহারে অপুষ্টিতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাটাও কম নয়। তেমনি ব্যাহত হয়েছে আন্তর্জাতিক লেনদেনও।
সর্বোপরি করোনার কারণে এতদিন ধরে চলে আসা সিস্টেম টা ভেঙে পড়েছে। প্রতিষেধক বিহীন এই মারণ ভাইরাসের হাত থেকে রেহাই কোনোমতেই সম্ভব নয়, তাই আমাদের অন্যভাবে পরিকাঠামো গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে।
◆ করোনা : আশীর্বাদ ~
কথায় আছে সবকিছুরই একটা ভালোদিক থাকে। তাই এই মারণ ভাইরাসের কবলে স্তব্ধ বিশ্বে মৃত্যু মিছিলের হৃদয় বিদারক ঘটনা যেমন আছে তেমনি তার ওপিঠে কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। করোনার কারণে দীর্ঘকালীন লকডাউনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে যান চলাচল বন্ধ থাকলে এবং মানুষের গৃহবন্দিত্বের কারণে ধূলি ধূসর প্রকৃতি আবার সবুজ হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে।
করোনার আবহে উন্নত শিল্পশহর গুলোতে দূষণের মাত্রা অনেকটাই কমে গেছে। কমেছে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং কার্বন মনো অক্সাইডের মতো মারাত্মক গ্যাসগুলির মাত্রা। মানুষের বিচরণ কমে যাওয়ায় হাফ ছেড়ে বেঁচেছে অন্যান্য পশুপাখিরা। তাদের স্বস্তির বিচরণের ছবি ধরা পড়েছে নানা মানুষের ক্যামেরায়। নদনদীতেও দূষণের মাত্রা বেশ কম, এবারের বর্ষাতেও অনেক নদীই দুকূল ছাপিয়েছে, কেউ বা তাদের মরা বুকে গজিয়ে ওঠা চরা বুজিয়েছে। আবার বিজ্ঞানীদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী এতদিনে ক্রমবর্ধিত ওজোন গহ্বরও পূর্ণ হয়েছে অনেকটাই। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারে গরমের প্রভাব যেমন কম ছিল, বর্ষাও রাজ্যে ঢুকেছে সঠিক সময়ে। অর্থাৎ বলা যায়, করোনা ভাইরাস মানুষের জন্য অভিশাপ হলেও অন্যান্য জীবজন্তু এবং প্রকৃতির জন্য আশীর্বাদের, যদিওয়এই প্রভাব প্রত্যক্ষ নয়, করোনার জেরে যে লকডাউনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার ফলশ্রুতি এটা।
◆ উপসংহার ~
করোনা ভাইরাস মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর কিংবা অভিশাপ, আবার করোনার কারণে হওয়া দীর্ঘকালীন লকডাউন প্রকৃতির এবং জীবজন্তুর জন্য মঙ্গলদায়ক।
আবার যদি এই লকডাউন তুলে নেওয়া হয় তাহলে যে আশীর্বাদের কথা ভাবা হচ্ছিল তা সাময়িক হয়ে যায়, মৃত্যু মিছিল তথা অমঙ্গলটাই একমাত্র ফলাফল হয়ে দাঁড়ায়।
কিংবা বিপুল জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীতে প্রকৃতির যে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছিল, সেই দিক থেকে করোনার কারণে এত মানুষের মৃত্যু ভারসাম্য ঠিক রাখতে সহায়ক হবে। তবে এখনও পর্যন্ত করোনার কারণে মৃত্যু অপেক্ষা প্রতিদিনের জন্মহার অনেক বেশি।
সর্বোপরি, এইসব হিসাবের থেকেও বড় কথা হল করোনা ভাইরাস এখন থেকে আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। ডেঙ্গু ম্যালেরিয়ার মতোই কোভিড১৯ এর হাত ধরে আমাদের জীবন অতিবাহিত করতে হবে। তাই করোনা আশীর্বাদ না অভিশাপ, করোনার ফল ভালো না মন্দ তা ঠিক করবে আমাদের প্রাত্যহিক সচেতনতা, নতুন অভ্যাস, কাজকর্মের নতুন পরিকাঠামো সহ নতুন জীবনযাত্রা। আর তা না হলে পক্ষীরাজন কিংবা থ্যানোসের মতো করোনাকে কেন্দ্র করেও তার্কিকরা দুটো দলে বিভক্ত হয়ে যাবে।