আম্ফানের দূর্যোগপূর্ণ দিনের অভিজ্ঞতা
◆ ভূমিকা ~ ঋতুরঙ্গময়ী আমাদের বঙ্গভূমি, তার ওপর গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ুর দেশ। ফলে প্রতিটা মানুষেরই গ্রীষ্মকালীন কালবৈশাখি ঝড় এবং বর্ষণমুখর সন্ধ্যাকে নিয়ে নানা অভিজ্ঞতা আছে। রবি ঠাকুরের ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে / পাগল আমার মনে জেগে ওঠে’ গানটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেইসব দিনের অনুভূতিগুলিও চঞ্চল হয়ে ওঠে। এমনি একদিন ছিল, ২০মে, ২০২০. অন্যান্য ঝড়ের মত বিধ্বংসী আমফানের জন্যও কড়া সতর্কতা জারি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে। আর আমি ঝড়ের আগাম খবর পেয়ে অপেক্ষা করছিলাম আবার এক আনন্দমুখর অভিজ্ঞতার। কিন্তু ২০মে আমার জীবনে থেকে গেল ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিয়ে।
◆ ঝড়ের পূর্বাভাস ~ এই ২০২০ সালটা প্রথম থেকেই বিশেষ সাল। বছরের শুরুতেই দেওয়া উপহার করোনা ভাইরাসের দাপটে সমস্ত বিশ্ব অসহায়, তারওপর গ্রীষ্মকালীন কালবৈশাখি ঝড় আম্ফান। ১৬ই মে ভারত মহাসাগরের উত্তর ভাগে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়ে তা ক্রমশ বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এলাকাগুলির দিক ধেয়ে আসে। প্রথমে সাইক্লোন হলেও পরে নিম্নচাপ আরও গভীর হয়ে সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয় এবং প্রচুর শক্তিশালী হয়ে স্থলভাগের দিয়ে ধেয়ে আসে। আবহাওয়াবিদরা এর পূর্বাভাস আগে থেকে পেয়ে প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই সতর্কতা জারি করেছিল পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে। এবং এর জেরে মেদিনীপুর, ২৪ পরগণা ছাড়াও হাওড়া হুগলি কলকাতাতেও এই আম্ফানের প্রভাব পড়বে বলে জানানো হয়েছে।
‘আম্ফান’ বা ‘উম্ফুন’ কোন নাম সঠিক তা নিয়ে সংবাদ মহলে যথেষ্ট বিতর্ক আছে, তবে এটি একটি থাই শব্দ যার অর্থ আকাশ। আর নাম নিয়ে দ্বিমত থাকলেও নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে ঠিকই উপস্থিত হয়েছিল এই ঘূর্ণিঝড়।
◆ বর্ষণমুখর সকালবেলা ~
বুদ্ধদেব বসুর পঙক্তি মিলিয়ে সেদিন – “সকাল থেকেই বৃষ্টির পালা শুরু / আকাশ হারানো আঁধার জড়ানো দিন / আজকে যেন শ্রাবণ করেছে পণ / শোধ করে দেবে বৈশাখি সব ঋণ”। কোভিড ১৯ এর কারণে বিশ্ব জুড়ে লকডাউন চলছে, ফলে বাড়ির সবাই গৃহবন্দি। তারওপর ঝড়ের আগমনী সতর্কবার্তা চলছে কখনো আকাশে পরিবেশে কখনো বা টিভিতে খবরের চ্যানেলগুলিতে। কখনো গুমোট গরম, কখনো বা হালকা মাঝারি বৃষ্টি মনের মধ্যে পুরানো নানা ঘটনা, নানা গান কবিতার পঙক্তি নিয়ে উঁকি দিচ্ছে। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ কিংবা ‘নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জ ছায়ায় ইত্যাদি গানের ওপারে যে জিনিসটা মনের মধ্যে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করেছে তা হল এই আম্ফানে নাকি কলকাতাতেও প্রভাব পড়বে। এতদিন বাবার মুখে যা ঝড়ের অভিজ্ঞতা শুনেছি সব দেশের বাড়িতে – আম কুড়ানো, কাদা জলে মাছ ধরা আরও কত কী। এবার কলকাতার সঙ্গে আমিও সাক্ষী হতে চলেছি এক নতুন অভিজ্ঞতার তাই উৎসুক হয়ে আছি সন্ধ্যার জন্য।
◆ বর্ষণমুখর সন্ধ্যা ~ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দুপুর থেকেই উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে আম্ফান তার সমস্ত আক্রোশ নিয়ে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় ঝড়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব উপলব্ধি করা যাবে সন্ধ্যের পর থেকে – এই সতর্কবার্তা অনুযায়ী বিকেল থেকেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। মুষলধারে বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি তীব্র বেগে এলোপাথাড়ি ঝড় শুরু হয়েছে। সকাল থেকে ভেবে থাকা কবিতার বই , ডায়েরী, চায়ের চুমুক, ক্যামেরা, বারান্দা সব এলোমেলো হয়ে গেছে ঝড়ের তোড়ে, এখন শুধুই দেখে যাওয়া। বাড়ির সামনের পাঁচিলের দিকে সুপুরি গাছগুলো যেন প্রায় মাটিতে নেমে চুমু দিচ্ছে। নারকেল গাছ তখন ঠিক পেন্ডুলাম। আর রাস্তার উল্টো দিকের বাগানের শিরীষ মেহগনি গাছগুলো যে কোনদিকে বাঁকছে বোঝা যাচ্ছে না। সন্ধ্যা থেকে যত রাত্রি হচ্ছে ঝড়ের বেগ ততই বেড়ে চলেছে, আর তার সঙ্গে তার শব্দও।
আমাদের পাকাবাড়িতেও বারান্দা আর জানলার ফাঁক দিয়ে যে পরিমাণ জল ঢুকেছে।তা প্রায় বন্যার সমতুল্য যেন। কারেন্ট তো চলে গিয়েছিল বিকেল থেকেই। আবছা আলো অন্ধকারের পরিবেশে পরিবারের সবাই গল্প ভুলে ঘর থেকে জল ফেলতে ব্যস্ত। রাত্রি ৯ টার পর ঝড়ের গতি কিছুটা কম হল, কমল শোঁ শোঁ আওয়াজও, বৃষ্টিও বুঝি কিছুটা ক্লান্ত হল।
◆ ক্ষয়ক্ষতি ~
বৃষ্টির রাতে ঠান্ডা পরিবেশে ঘুম ভালো হলেও ভোরবেলাতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বাইরে বেরোতেই দেখতে পেলাম আম্ফানের ফেলে যাওয়া পদচিহ্ন চারিদিকে। সুপুরি গাছগুলো সব এদিক ওদিক হেলে গেছে, কিন্তু ভাঙেনি। নারকেল গাছ দুটোও ঠিকই আছে, তবে পাতা ভেঙেছে। কিন্তু সামনের বাগানটা লন্ডভন্ড, সমস্ত গাছ ভেঙে গিয়েছে। রাস্তায় বেরোতেই চোখে পড়ল মানুষের জমায়েত, দু’মাসের গৃহবন্দিত্বের পর করোনার সমস্ত গাছ ভেঙে গিয়েছে। রাস্তায় বেরোতেই চোখে পড়ল মানুষের জমায়েত, দুমাসের গৃহবন্দিত্বের পর করোনার সমস্ত চোখরাঙানি ভুলে মাস্ক সোস্যাল ডিসট্যান্সকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে জমায়েত হয়েছে। রাস্তা গাছের ভাঙা ডালে বন্ধ, তার সঙ্গে পড়েছে নাড়ি ভুড়ি জড়ানো ইলেকট্রিক পোস্টগুলো। রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানটার টিনের দরজা উড়ে গেছে। পাশের বাড়ির কাচ ভেঙেছে গাছের ডালে, মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দু একটা অটোর মাথায় গাছ পড়ে অটোগুলো দুমড়ে ভেঙে গেছে। ফোনে খবর চালিয়ে শুনলাম আমার পড়ার এ চিত্র কলকাতার সর্বত্র, কোথাও বা আরো বেশি ব্যাপক। তবে ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়েছে উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে। গ্রামগুলি সব জলমগ্ন হয়ে কোথাও মুখ তুলে উঁকি মারছে কোথাও বা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, চাষের জমি, গবাদি পশুর সঙ্গে এবারে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছ। প্রায় লক্ষাধিক গাছ ভেঙেছে গতকালের আম্ফানের তান্ডবে। বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার খবর অনুযায়ী উপকূলীয় এলাকায় ঘন্টায় প্রায় ২০০ কিমি এবং কলকাতায় ঘন্টায় ১২০ কিমি বেগে ঝড় প্রবাহিত হয়েছে। আর তার জেরে ব্যাহত হয়েছে বিদ্যুৎ পরিষেবাও। তাই কল্লোলিনী তিলোত্তমা, আলোময় কলকাতা এখন নিমজ্জিত অন্ধকার কুহকে।
◆ উপসংহার ~
কালবৈশাখি ঝড়, কখনো ঝিমঝিম কখনো বা মুষলধারে বৃষ্টি গিয়ে গান, কবিতা ছবি সমস্ত কিছুকে এক চুটকিতে সরিয়ে আম্ফান যেন এক দুঃস্বপ্ন। কলকাতার কাছে বহু বছর পর আর কলকাতাবাসীর কাছে প্রথম এই অভিজ্ঞতা। আধুনিক সভ্যতা আদিম প্রকৃতির হাতে শিশুমাত্র – তারই মযেন শর্ট ফিল্ম এই আম্ফান। দুই ২৪ পরগণা জলের তলায়, দক্ষিণবঙ্গ ডুবে অন্ধকারে, করোনা পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোই এখন চ্যালেঞ্জ। আর এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিয়ে আসবে রোমান্টিকতা।