রবি ঠাকুরকে লেখা আশাপূর্ণার চিঠি
প্রথম প্রতিশ্রুতি, নিভৃত অন্তঃপুরকারীদের কাছে খোলা আকাশ, সরব হবার প্রথম সোপান। অথচ যিনি সেদিনের সেই অবলা মেয়েদের মুখে ভাষা জুগিয়েছিলেন তিনিও ছিলেন প্রথাগত শিক্ষার গন্ডীর বাইরে। সত্যবতী বা সুবর্ণলতার মতো তাঁরও জন্ম অতিরক্ষণশীল পরিবারে। অর্থাৎ সেখানে মেয়েদের স্কুলে যাবার বালাই নেই, নেই ইতিহাস ভূগোল মুখস্থ করার কিংবা অঙ্ক কষার চোখ রাঙানি। অর্থাৎ মেয়েদের জন্য চার দেওয়ালের গন্ডীর ভেতর অফুরন্ত ছুটি। কিন্তু সেই ছুটিতে পাঠ্য পুস্তকের শাসানি না থাকলেও অপাঠ্য পুস্তকের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য ছিল অখন্ড অবকাশ। আর ছিল আশাপূর্ণা দেবীর মায়ের প্রভাব ও প্রশ্রয়।
আশাপূর্ণা দেবীর মায়ের জীবনের একটি মাত্রই পরমার্থ ছিল, সাহিত্য। সেই চাহিদা মেটাতো জ্ঞানবিকাশ লাইব্রেরি, চৈতন্য লাইব্রেরি আর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ লাইব্রেরি। আর তাঁর বাবা আঁকতেন ছবি, সেসব ছবি পত্রিকায় ছাপাও হত। সেই সুবাদে ঘরে আসত নানা পত্র পত্রিকা – প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মানসী ও মর্মবাণী, নারায়ণ, সবুজপত্র, সাধনা, ভারতী, মাসিক বসুমতী, সন্দেশ আরও কত কী। কজেই বইয়ের সঙ্গে অখন্ড সখ্যতা গড়ে উঠেছিল জ্ঞানোন্মেষের আগে থেকেই।
সেসময় গল্পপড়া, কবিতা মুখস্থ করাই ছিল খেলা। এতে আবার প্রতিযোগিতাও ছিল। দিদি রত্নমালা, আশাপূর্ণা আর ছোটবোন সম্পূর্ণা – কে আগে , কে পরে কিংবা কে পারেনি। নাটক নভেল কাব্য কবিতার খেলা খেলতে শিশু আশাপূর্ণা কীভাবে যেন জেনে গিয়েছিলেন রবি ঠাকুর মস্ত কবি। তারপর মার পদ্য মুখস্থ করার ধরিয়ে দেওয়া নেশায় বাড়ি তখন সর্বদা উচ্চকিত ‘গান্ধারীর আবেদন’, কিংবা ‘বিদায় অভিশাপ’ এর ছত্রে। এই সময়েই বাড়ির কাউকে না জানিয়ে আশাপূর্ণা এক কান্ড করে বসলেন।
আশাপূর্ণার কথায় সে এক অসম সাহসিক কান্ড। আশাপূর্ণা ও তাঁর বোন সম্পূর্ণা দুয়ে মিলে। বাড়ির কাউকে না জানিয়ে ‘শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ – এর নামে একটি চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন। দুই বোনের যুগল স্বাক্ষরে। আর তাতে ছিল একটাই আবেদন, কিংবা আব্দারও বলা যেতে পারে। ‘নিজের হাতে আমাদের নাম লিখে একটা উত্তর দেবেন’। ব্যস এটুকুই। বহু কষ্টে বাড়ির সকলকে এড়িয়ে খাম , চিঠির কাগজ আর ঠিকানা জোগাড়, আবার সেই চিঠি পাঠানো।
তারপর তিন চারদিন ভয়, বুক ধড়ফড়। যদি বাড়ির কেউ জেনে যায়, যদি কেউ বকে। যদি হঠাৎ কেউ এসে বলে, কোন সাহসে রবি ঠাকুরকে চিঠি লিখেছ ? তারপর ঘটল আরেক আশ্চর্য ঘটনা। রবিঠাকুর রাখলেন তাঁদের আব্দার। আশাপূর্ণা দেবী জানাচ্ছেন – “সাদা শক্ত কাগজের একখানি বড় মাপের খামে চিঠি এল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে লিখেছেন – আমাদের মতো অধম দুটো মেয়ের নাম।”
সে কি উত্তেজনা। দু’বোনে ছুটলেন মায়ের কাছে। ভেবেছিলেন মাও বুঝি তাঁদের মতো উত্তেজিত হবেন। তিনি হাতের লেখাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলেছিলেন, “তোরা পারলি? আমি শুধু স্বপ্নই দেখেছি।”
তথ্যসূত্র : আর এক আশাপূর্ণা – আশাপূর্ণা দেবী