‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস আলোচনা
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কল্লোলের কালের লেখক, কিন্তু কল্লোল গোষ্ঠীর নয়। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘কল্লোলের উত্তর পুরুষ’ বলেছেন। সাহিত্যের চর্চায় যখন তিনি কলম ধরেছেন তখন মাথার ওপরে রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র বিদ্যমান। আশেপাশে কল্লোল-বিচিত্রা-প্রবাসী কেন্দ্রিক প্রথিতযশা শিল্পীদের পরিমন্ডল। অথচ পূর্বসুরীদের পথ ধরে এগোলেন না। আধুনিকতার অথচ মানিক পূর্বসুরীদের পথ ধরে এগোলেন না। আধুনিকতার ভাবনা নিয়েও কল্লোলীয়দের সঙ্গে নিজের মনোভঙ্গির পার্থক্য নিজেই নির্দেশ করেছেন – ‘লেখকের কথা’ গ্রন্থে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন –
“অসীম আগ্রহ নিয়ে আধুনিকদের লেখা পড়ি, ভাষার তীক্ষ্ণতা, ভঙ্গির নতুনত্ব, নতুন মানুষ ও পরিবেশের আমদানি, নরনারী রোমান্টিক সম্পর্ককে বাস্তব করে তোলার দুঃসাহসী চেষ্টা – আশা ও উল্লাস জাগায় – তারই পাশাপাশি হালকা নোংরা রোমান্টিক ন্যাকামি তীব্র বিতৃষ্ণা জাগায়।”
তাঁর মন্তব্যেই প্রতিভাত হয় পূর্বসুরীদের এমনকি সমকালীন দুই বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থানিক ঐতিহ্য থেকে সরে এসে ভিন্ন জীবনদৃষ্টিতে কলম ধরেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। পূর্বসুরী একমাত্র জগদীশ গুপ্ত। তাঁর নির্মোহ নিরাবেগ বৈজ্ঞানিকদৃষ্টির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীতে।
এখন প্রশ্ন ওই ড্যাবড্যাবে দুটো চোখ নিয়ে সমকালীন পরিবেশ সম্পর্কে কতটা নির্মোহ – নিরাবেগ এবং বৈজ্ঞানিক হতে পেরেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মাত্র ৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে ২৩ বছর উপন্যাস লেখায় নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৫৬ সালের এই কালসীমায় তিনি মোট ৩৬টি উপন্যাস লিখেছিলেন।
তবে শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলো তিনি তাঁর সাহিত্যজীবনের প্রথম পর্বেই উপহার দিয়েছেন –
১) দিবারাত্রির কাব্য
২) জননী
৩) পদ্মানদীর মাঝি
৪) পুতুল নাচের ইতিকথা
এর মধ্যে শেষ দুটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট পূর্ববঙ্গের নদীতীরের গ্রাম।
এবং এর পরবর্তী উপন্যাসগুলির বেশিরভাগেরই প্রেক্ষাপট কলকাতা।
আর সমকালীন ৪৫-৪৬ এর দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে কয়েকটি।উপন্যাস লিখলেও আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে নরনারীর প্রেমই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেশিরভাগ উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম দিককার উপন্যাসগুলির মধ্যে দুটি উপন্যাসের রচনাকালের মধ্যেকার সময়ের ব্যবধান সীমিত, দুটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট গ্রামবাংলা কিন্তু পরিবেশ, চরিত্র ও জীবনবাস্তবতা রূপায়ণের ক্ষেত্র স্বাতন্ত্র। ছেলেবেলা থেকেই নদীমাতৃক পূর্ব বাংলা ঘুরে বেড়াবার সময় মাঝি জেলেদের জীবনের সঙ্গে মানিকের অন্তরঙ্গ পরিচয় ঘটার সুবাদে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন –
“ভদ্র সমাজের বিকার ও কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত চাষী মজুর মাঝি মাল্লা হাড়ি বাগদিদের রুক্ষ কঠোর সংস্কারাচ্ছন্ন বিচিত্র জীবন কেন অবহেলিত হয়ে থাকে, কেন এই বিরাট মানবতা…সাহিত্যে স্থান পায় না ?”
– এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই সৃষ্টি করেছেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস।
‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের আগে বাংলা উপন্যাসে পদ্মা বিধৌত পূর্ব বাংলার কোনো অঞ্চল আত্মপ্রকাশ করেনি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাইরে বিরাট দরিদ্র শ্রমজীবী শ্রেণি দুঃখ কষ্টের মধ্যেও যে প্রাণবন্ত জীবন প্রবাহিত হয় – তার ঋজু বলিষ্ঠ বাস্তবতার নতুন মাত্রা যোজনার দিক থেকে কোনো নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ভূখন্ডকে উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা – আধুনিক উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ।
বলা বাহুল্য, বিশেষ ভৌগলিক পরিবেশের আবেষ্টনীর সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকে সেখানকার নরনারী জীবন। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসেও জেলে ও মাঝিদের গোষ্ঠী জীবনের বাস্তবনিষ্ঠ ছবি পাওয়া যায় পদ্মাপ্রকৃতির ভৌগলিক পরিবেশ আবরণের মধ্যে। বহু নায়কের সমাবেশ কিংবা একাধিক চরিত্রের উপস্থিতি মানিকের অন্যান্য উপন্যাসে থাকলেও গোষ্ঠীচেতনা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসেই প্রথম দেখা যায়। বস্তুত ময়নাদ্বীপ থেকে রাসুর পালিয়ে আসার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেতুপুরের মানুষের চাঞ্চল্য এবং পীতম মাঝি, নকুল, রাসু, কুবের – এদেরকে কেন্দ্র করে হোসেন মিঞার বিচারসভা গোষ্ঠীচেতনাকে নিপুণভাবে প্রকাশ করেছে।
তবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠককে এই গোষ্ঠীজীবন থেকে ধীরে ধীরে ব্যক্তিজীবনে এবং তারপর ব্যক্তিচৈতন্যের অন্তর্গূঢ় রহস্যের উন্মোচনে অভিনিবিষ্ট করান। উপন্যাসের শুরু থেকেই কুবেরের দৃষ্টিকোণে গোষ্ঠীজীবনের প্রতিনিধি হিসাবে মাছ ধরা ও বাজারে বঞ্চিত হওয়ার ছবি পাই। এরপর জেলে জীবনের বিস্তৃত চিত্রপট সংকুচিত হয়ে আসে কুবেরের পারিবারিক চিত্রে, পঙ্গু স্ত্রী মালা এবং তার ছেলেমেয়েদের বর্ণনায়। এরপর লেখক প্রবেশ করেন কুবেরের গূঢ় জীবন রহস্যের সন্ধানে তার প্রবল কামনা ও তজ্জনিত নৈতিক চেতনায় আক্রান্ত দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ সত্তার ভেতরে।
এখানে লক্ষণীয় উপন্যাসের শিরোনামও – নরনারীর চরিত্রের সঙ্গে প্রগাঢ় সংযোগ ভৌগলিক পরিবেশের প্রতিনিধি, আর মাঝি সংযোগে ভৌগলিক পরিবেশে লালিত লোকায়ত জীবন। কিন্তু সেই মাঝির জীবন সমগ্র মাঝি গোষ্ঠীর নাকি একক ব্যক্তিত্বের নাকি উভয়েরই ? তার উত্তর দিয়েছেন সমগ্র উপন্যাসের অগ্রগতির সঙ্গে।
পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের তৃতীয় পরিচ্ছেদে কুবেরের পারিবারিক জীবন বিস্তৃত পটে পাই, ছেলেদের ঘুমপাড়াতে মালা রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে – কুবেরও শুনছে মন দিয়ে সেই গল্প। এই স্নিগ্ধ শান্ত দৃশ্যপটে তৃতীয় পরিচ্ছেদের সমাপ্তি ঘটিয়ে চতুর্থ পরিচ্ছেদে কুবেরের সংসারে এবং জীবনে কপিলার আবির্ভাব ঘটেছে এবং শুরু হচ্ছে কুবেরের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র চেতনার।
বিচিত্র দাম্পত্য, অবৈধ প্রেম মানিকের উপন্যাসগুলির অন্যতম বিষয়। এর মধ্য দিয়েই তিনি প্রবেশ করেন মানুষের অবচেতনে, নিরাবরণ করেন জটিল মনস্তত্ব ও অন্তর্দ্বন্দ্বের স্বরূপকে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে শশী – কুসুমের অবৈধ প্রেমের ছবি আছে, কিন্তু শিক্ষিত চিকিৎসক শশীর জীবন যাপনে তার দ্বন্দ্ব আনলেও সংহত এবং পরিণাম টেনেছেন বিচ্ছেদে। তীব্র সংরাগ পরিণতি পায় পরিণত যুক্তিতে কিংবা নিয়তির দুর্নিরীক্ষ্য শক্তিতে।
অপরদিকে মননশীল, হিসেবি মানিক কপিলা কুবেরের অবৈধ প্রেমকে পরিণতির দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন। কারণ তিনি জানেন এই কাহিনিতে তাঁর নায়ক নিচুতলার মানুষ, আদিম প্রবৃত্তি সংযমের শৃঙ্খলায় আবদ্ধ নয়। কিন্তু ভীরু অবশ্যই। কুবের মাঝির জীবনে কপিলা পদ্মার মতোই চঞ্চল, মুক্তির আশ্রয়। মানিক জানাচ্ছেন –
‘নদীকে সে বড় ভালোবাসে, নদীর বুকে ভাসিয়া চলার মত সুখ আর নাই।’
এমনি আকর্ষণ সে পায় কপিলার মধ্যেই। কারণ অবশ্যই মানিক রেখেছেন, কেবল কপিলার স্বভাব নয়, মালার পঙ্গুতাও তার প্রধান কারণ। আশ্চর্য গতিশীলতায় যে কুবের চাঞ্চল্য অনুভব করে, পদ্মার বুকের প্রতি যে অমোঘ আকর্ষণ তা মালা দিতে পারে না, কৌতুকময়ী কপিলার প্রতিই তাই তার অমোঘ আকর্ষণ –
“দেহ যেন উথলিয়া উঠিয়াছে কপিলার, বর্ষার পদ্মার মতো।”
অধ্যাপক গোপিকানাথ রায়চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেছেন –
“বস্তুত কপিলার প্রতি তার যে মনোভাব তা ঠিক অবৈধ আসক্তি নয়, তা মুক্ত প্রমত্তা পদ্মার সঙ্গে কুবেরের গূঢ় সম্পর্কেরই এক মানবিক প্রতিফলন।”
আর মাছ ধরা জেলে থেকে নৌকার মাঝি এবং তারপর অন্তহীন সমুদ্রের আহ্বানের মধ্যে দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যেকার সংগ্রামী চেতনাকে প্রকাশ করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এই বিস্তৃত সংগ্রামী জীবন জটিল বটে, তবু সেখানেও আশা স্বপ্নরা দানা বাঁধে, ‘নতুন নির্মাণ’ হতে পারে তাও, তার প্রকাশ কপিলার উচ্চারণে –
‘আমারে নিবা মাঝি লগে ?’
‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের মুখ্য বিষয় কপিলা-কুবের সম্পর্ক হলেও হোসেন মিঞা ও ময়নাদ্বীপকে কেন্দ্র করে উপকাহিনিটিতে গোষ্ঠীজীবনের চিত্র পাই। ‘নীচু জল জঙ্গলপূর্ণ মানুষ্যবাসের অযোগ্য’ – এ হেন ময়নাদ্বীপে হোসেন মিঞার তত্ত্বাবধানে দরিদ্র নিরুপায় মানুষদের বসবাস করার প্রাণপণ চেষ্টা – আপাত দৃষ্টিতে এখানে হোসেন মিঞার প্রভুত্ব বিস্তার বা ময়নাদ্বীপকে তার উপনিবেশ করে তোলার প্রয়াস মনে হলেও মুখ্যত এখানে প্রতিফলিত হয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের অবিরাম লড়াইয়ের প্রচেষ্টা। আর ময়নাদ্বীপ সেখানে প্রকৃতি এবং হোসেন মিঞা মানুষের প্রতিনিধি। প্রসঙ্গত, নোবেল বিজয়ী আর্নেষ্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সী’ উপন্যাসটির কথা মনে আসে যেখানে সমুদ্রে জেলের সঙ্গে হাঙরের অর্থাৎ প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের কথাই উঠে এসেছে। আসলে এই ময়নাদ্বীপ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শোষণমুক্ত সমাজভাবনার প্রতিফলন। ময়নাদ্বীপের বাসিন্দাদের নিয়ে তাই হোসেন মিঞার চিন্তায় ধরা পড়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরই ভাবনা –
“প্রতিদানে হোসেন আর কিছুই তাদের কাছে চায় না, তারা শুধু এখানে বাস করুক, স্বপ্ন সফল হোক হোসেনের।…জঙ্গল কাটিয়া যত জমি তারা চাষের উপযোগী করিতে পারিবে সব তাদের সম্পত্তি, খাজনা বা চাষের ফসল কিছুই হোসেন দাবি করিবে না। নিজেদের জীবিকা তাহারা যতদিন নিজেরাই অর্জন করিতে পারিবে না, জীবিকা পর্যন্ত যোগাইবে হোসেন।”
সামগ্রিক আলোচনার নিরীখে বলা যায়, ময়নাদ্বীপই আসলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের স্পেশাল টাচ, অভিনব ভাবনা, স্বতন্ত্রতার বীজ। এই ময়নাদ্বীপের মধ্যে দিয়েই যেমন প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের অসম লড়াই, সংগ্রামী জীবন ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি ময়নাদ্বীপকে বসবাসের উপযোগী করে তোলার মধ্যে শোষণমুক্ত সমাজভাবনার আভাস দিয়েছেন। এমনকি উপন্যাসের নায়ককে দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চুরিও করিয়েছেন ময়নাদ্বীপ তথা সমুদ্রযাত্রার পথ প্রশস্ত করবেন বলে।
আবার বলা যায়, এই ময়নাদ্বীপ অঙ্কনেই থেকে গেছে পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের সীমাবদ্ধতা। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের স্বতন্ত্রতা বা অভিনবত্ব ময়নাদ্বীপকে কেন্দ্র করে নিহিত থাকলেও উপন্যাসের মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে কুবের-কপিলার প্রেম। এমনকি উপন্যাসের মুখ্য ঘটনাগুলি মালার পঙ্গুতা, ঝড়ে ঘর ভাঙা, গোপীর পা ভাঙা, চড়কডাঙায় বন্যা, হোসেনের সঙ্গে কুবেরের মেয়ের বিয়ে স্থির করা, কুবেরের হোসেনের নৌকায় মাঝি হওয়া সকল ঘটনাই কপিলা-কুবেরের সম্পর্ককে আরো মসৃণ করেছে। তাই সমালোচকের একাংশের মতে, প্রকৃতি ও মানুষের অবিরাম সংগ্রামের কাহিনি যা বাংলা সাহিত্যে প্রায় বিরল, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘গঙ্গা’, ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’ ইত্যাদি হাতে গোনা উপন্যাসে ময়নাদ্বীপকে কেন্দ্র করে প্রকাশের সমস্ত রকম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মানিক অভিনিবিষ্ট হয়েছেন নরনারীর সম্পর্কের অমোঘ আকর্ষণের প্রতি।
নদীকেন্দ্রিক আঞ্চলিক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে সেইসময় প্রায় ছিল না। পদ্মাবিধৌত পূর্ববঙ্গ উপন্যাসের পাতায় স্থান পেলেও কেন্দ্রিয় চরিত্র পদ্মা নয়, কুবের। এমনকি কুবেরের সমুদ্রযাত্রা প্রসঙ্গে সমুদ্র বাংলা উপন্যাসে স্থান পেলেও বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে পায়নি। উপন্যাসে হোসেন কুবেরের সমুদ্রযাত্রায় সমুদ্রের রূপ নয়, সিদ্ধি, বিদৌ, সন্দীপ, মানপুর ইত্যাদি কতকগুলি দ্বীপের নাম এসেছে। অর্থাৎ সমুদ্র বর্ণনার সুযোগ করেও তাকে প্রত্যাশামতো ব্যবহার করেননি, প্রয়োজনমতো কাজে লাগিয়েছেন। সমুদ্রের প্রসঙ্গ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে এসেছে হোসেন মিঞাকে বুঝতে, কুবেরকে চিনতে। কুবেরের দৃষ্টিকোণেই বর্ণিত হয়েছে সমুদ্রযাত্রা – হোসেনের নৌকাটি কেতুপুরের পদ্মায় অতি বৃহৎ মনে হলেও সমুদ্রে যেন মোচার খোলা মনে হয়েছে। নদী ছেড়ে সমুদ্রের দিকে যেতেই কুবেরের আর মন নেই, তার মনে হয়েছে এখানে ভালোবাসাসির সুর নেই। অপরদিকে, পদ্মা নদীর এত বড় ভূমিকা, থাকলেও ভাবব্যাকুলতাকে লেখক প্রশ্রয় দেননি, পদ্মা কেবল নাট্যমঞ্চের প্রচ্ছদপট হয়েই থেকে গেছে।
আসলে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর লেখক জীবনে প্রথম দিকে ফ্রয়েড দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। পরবর্তীকালে মার্কসীয় দর্শনে দীক্ষা নিচ্ছেন। আর এই উপন্যাস লিখছেন দুই ভাবনার সন্ধিস্থলে বলা যায়। মার্কসীয় দর্শনে তখনও পুরোপুরি দীক্ষিত হননি, ফ্রয়েডের মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চরিত্রের নির্মোহ অন্তর্গূঢ় রহস্যমোচনে ব্যাপৃত মন। তাই ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের সমাপ্তি কোনো নিয়তি তাড়িত নয়, এর চূড়ান্ত আবেদন অদৃষ্টের হাতে মানুষের অসহায়তায় পর্যবসিত নয়, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র ভাবনাকে অতিক্রম করে এই উপন্যাসের রাশ টেনেছেন ময়নাদ্বীপে এক কঠোর সংগ্রামে কপিলা কুবেরের নতুন জীবন শুরুর সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে। আর এখানেই মানিক তাঁর কলমের মুন্সিয়ানায় বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত নরনারীর প্রেমের ছবির মধ্যেই স্বতন্ত্রতার বীজ নিহিত রেখেছেন।
● কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
১) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : জীবনদৃষ্টি ও শিল্পরীতি – গোপিকানাথ রায়চৌধুরী
২) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাজজিজ্ঞাসা – ড. নিতাই বসু