তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রাধা’ উপন্যাস আলোচনা
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রাধা’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর অবক্ষয়িত সমাজ। এই অষ্টাদশ শতাব্দীর শাক্ত কবি রামপ্রসাদ সেন বলেছিলেন – ‘এমন মানব জমিন রইল পতিত / আবাদ করলে ফলত সোনা।’ হয়ত তার এই খেদোক্তি যুগের অবক্ষয়ের দিকে তাকেই ছিল। বলা বাহুল্য রামপ্রসাদ সেন ইঙ্গিতে যা বলেছিলেন তারাশঙ্কর তারই সামগ্রিক ছবি এঁকেছেন ‘রাধা’ উপন্যাসে।
‘রাধা’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু আলোচনার প্রসঙ্গে উপন্যাসটিকে দুটি পর্বে ভাগ করা চলে – ১) তারাশঙ্করের ইতিহাসচেতনা
২) তারাশঙ্করের ধর্মচেতনা
ঐতিহাসিকের যেমন কর্তব্য কোনো নির্দিষ্ট কালের নিরিখে তথ্য সংগ্রহ, নির্বাচন, পরিবেশন ও তার সম্যক ব্যাখ্যা, ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিকের ক্ষেত্রেও সেই দায়িত্ব এসে পড়ে। আর এই ভিত্তিতেই পাঠক ঔপন্যাসিকের মানসিকতাও বুঝতে পারে।
‘রাধা’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচন করেছেন অষ্টাদশ শতকের অবক্ষয়িত সমাজ – কালের বিচারে আঠারো শতকের তৃতীয় দশক প্রায় শেষ হয়ে আসছে। উপন্যাসটি শুরু হচ্ছে তখন ভারতবর্ষে মুঘল আমল সুবে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ, সুবে বাংলায় নবাবদের উজ্জ্বল জৌলুস, ১৭২৬/২৭ খ্রি: এর মাত্র তিরিশ বছর পর আসছে পলাশির যুদ্ধ।
আবার ‘রাধা’ উপন্যাসের শেষে পাই – পলাশির যুদ্ধের পর এখনও চার মাস হয়নি, সিরাজদ্দৌলাকে সরিয়ে দেবার পর মসনদের সিংহাসনকে কেন্দ্র করে মীরণ, দুর্লভরাম, মির্জা মেহেদি, আমানি খাঁ, রামনারায়ণ রায় নানাভাবে জট পাকিয়ে মসনদের দখলের চেষ্টা করেছেন। আর এর সূড়িপথে ইংরেজরা ক্লাইভের হুকুমে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারে তৎপর হয়েছে। আবার এর মধ্যেই ঘটে যাচ্ছে বর্গি আক্রমণ – বারবার – ৫ বার। বাংলাদেশ থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিরাট ক্ষেত্রে দীর্ঘ ষোল বছরের যুদ্ধ যেন কলির কুরুক্ষেত্র। অর্থাৎ সমস্ত ‘রাধা’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর সুযোগ মতো উপস্থাপন করেছেন অষ্টাদশ শতকের বিস্মৃত অধ্যায় এবং বিস্তৃতও, উপন্যাসের কাল পরিসর প্রায় তিরিশ বছর। এই বিস্তৃত পটভূমিকায় বিশিষ্ট আবহ আনতে আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর সযত্নলালিত রাঢ় বাংলায়, বীরভূম জেলার অজয় নদীর তীরের ইলমবাজারে।
এখন প্রশ্ন রাঢ়ের কথাকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রাঢ়ের কথা বলতে গিয়ে কেন বেছে নিলেন অষ্টাদশ শতকের এই বৃহৎ প্রেক্ষাপট ?
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের প্রতিনিধি, জমিদারির পতনে সামন্ততন্ত্রের উত্থান-পতনে জীবনের, সমাজের পরিবর্তন তাঁর মনে বিধৃত, তাঁর গল্প তিনি বারবার শুনিয়েছেন ছোটগল্প উপন্যাসের মধ্যে। আর এই উত্থান পতনের গল্পে স্থানিক পটভূমি রূপে ফিরে এসেছে তাঁর রাঢ় বাংলা। ‘রাধা’ উপন্যাসেও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সেই রাঢ় বাংলার উত্থান পতনের কথাই বলেছেন অন্য মাত্রায়। এখানে এসেথে বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মের অবক্ষয়। জয়দেব লালিত বীরভূমে বৈষ্ণব ধর্মের অবক্ষয় দেখাতে গিয়ে নির্বাচন করতে হয়েছে অষ্টাদশ শতকের কাল পরিসর। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, ক্রোচে সাহিত্যে ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনায় বলেছিলেন –
“সব ইতিহাসই সমসাময়িক ইতিহাস”। এর ব্যাখ্যায় বলা যায় যে ইতিহাস মূলত বর্তমানের চোখ দিয়ে ও তারই সমস্যার নিরিখে অতীতকে দেখা এবং তার মূল্যায়ন করা। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে একটি অবক্ষয়িত সমাজের প্রতিনিধি বলেই অন্যান্য অবক্ষয়িত সমাজ তার মানসচেতনায় বিধৃত এবং তিনি তার মূল্যায়নে তৎপর। তাই জয়দেবের বৈষ্ণবভাবনা বিধৌত বীরভূমে বৈষ্ণব ধর্মের অবক্ষয় তারাশঙ্কর মূল্যায়ন করেছেন রাধা উপন্যাসে। আর তার জন্যই বেছে নিয়েছেন অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ, এই বিস্তৃত সময় উপন্যাসে এসেছে কেবল পটভূমি হয়ে। ঔপন্যাসিকের মূল লক্ষ্য ইলমবাজারের ধর্মচেতনার অবক্ষয়।
শাক্ত ও বৈষ্ণবদের দেশ এই রাঢ়ভূমি, তারাশঙ্কর রাঢ়ের সন্তান, শাক্ত জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী, আবার বৈষ্ণবদের মঠ ও কুঞ্জবনকে কেন্দ্র করে ব্যভিচার তাঁর অজানা নয়। বাংলার বৈষ্ণব ও শাক্ত ধারা কখনও সংঘর্ষ কখনও সহাবস্থানের মধ্যে দিয়ে সমান্তরাল ভাবে প্রভাবিত। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ উপন্যাসে জানাচ্ছেন – শ্যামনগরে ভটচাজবাড়িতে শিলারূপী বিষ্ণুর সামনে রক্তপাত নিষেধ ছিল না। এদের সহাবস্থানের কারণ হিসাবে ঔপন্যাসিক দেখাচ্ছেন উভয় ধর্মই অবক্ষয়ের শেষ সীমায় উপস্থিত, অস্তিত্বটুকু বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে মিশ্রণ ঘটেছে। ‘কালীকৃষ্ণ’ এক – এই ধারণার জন্ম অষ্টাদশ শতক থেকেই হয়েছিল। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাঢ়কে সাহিত্যের পাতায় উজ্জ্বল স্থান দিতে গিয়ে এই অধ্যায় থেকে বিস্মৃত হননি। তবে তাঁর শাক্ত প্রবণার ফসল ধাত্রীদেবতা, কালিন্দী, কীর্তিহাটের কড়চা ইত্যাদি উপন্যাস আর বৈষ্ণব ধর্মের রূপ এঁকেছে রাইকমল , রসকলি, মালাচন্দন ইত্যাদিতে। আর আলোচ্য ‘রাধা’ উপন্যাসে এঁকেছে বৈষ্ণব ধর্মের অবক্ষয়ের রূপ। প্রেমদাস বাবাজীর স্নেহধন্যা কৃষ্ণদাসী সাধনসঙ্গিনীর পরিবর্তে পরিণত হয়েছে বিকৃতধর্মের সেবাদাসীতে। মাধবানন্দের বাবা মুসলমান নটীকে বৈষ্ণবী করে নিয়েছেন দৈহিক কামনা পরিতৃপ্তির জন্য। অর্থাৎ ধর্ম তখন মুক্তির উপায় নয় আর, কামনা প্রবৃত্তি পূরণের সহায়ক মাত্র।
‘আমার কালের কথা’ প্রবন্ধে তারাশঙ্কর জানাচ্ছেন –
“অসহায় মানুষরা মানত করছে, পূজো করছে…যা কিছু করছে দেবতার নাম নিয়ে, তান্ত্রিক মদ খেয়েছে কালীমার নাম করে…বৈষ্ণব গাঁজা খেয়েছে গোবিন্দর নাম করে। তাদের জন্য বেদনা অনুভব করি, ঘৃণা করতে পারি না।”
ধর্মের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধা হারিয়েছে, স্থান নিয়েছে ভয়। ধর্মের এই বিকৃতি কীভাবে অবক্ষয়িত সমাজকে আরোও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তার ছবি এঁকেছেন ‘রাধা’ উপন্যাসে। তবে এহো বাহ্য।
বৈষ্ণব ধর্মের স্বকীয়া – পরকীয়া দ্বন্দ্বকে উপস্থাপন করে ‘রাধা’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখালেন পরকীয়ার চরমরূপ। সাধনা ও দৈহিক বিকৃতির যুগপৎ সহাবস্থানে। কৃষ্ণসাধনা থেকে রাধাতত্ত্বকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে বৈষ্ণব দর্শনের এক নতুন অভিজ্ঞানকে সন্ধান করতে ব্রতী হয়েছিলেন মোহান্ত মাধবানন্দ। অপরদিকে প্রবল পৌরুষদীপ্ত মাধবানন্দের মধ্যে মা কৃষ্ণদাসীর প্ররোচনায় কৃষ্ণস্বরূপ উপলব্ধি করে কিশোরী মোহিনী তাকে আরাধনা করতে থাকে নিজেকে রাধাভাবে প্রণোদিত করে। কিন্তু মোহান্তের সাধনার একনিষ্ঠতায় মোহিনী মাধবানন্দকে কৃষ্ণরূপে পেতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রত্যাখ্যাতা মোহিনী কৃষ্ণসাধনার পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। এখানে মোহিনী পরকীয়া সাধনার পথে বিরহী রাধার প্রতিবিম্ব।আর তার মা কৃষ্ণদাসী আগেই জেনেছি পরকীয়া তত্ত্বের দৈহিক বিকৃতির স্বরূপ। অন্যদিকে, মোহিনীকে বাঁচাতে গিয়ে মাধবানন্দ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন বিভিন্ন সময় যার মধ্যে দিয়ে কংস নিধন রূপটিও উদ্ভাসিত। ‘রাধা’ উপন্যাসের শেষে গুরুতর আহত মাধবানন্দ মোহিনীর সেবায় সুস্থ হয়ে উপলব্ধি করে – “মোহিনীর মুখ এ তো নয়। এ মুখ রাধারাণীর স্নান জলে ধুয়ে ধুয়ে অন্য মুখ।” অর্থাৎ রাধাতত্ত্বে অবিশ্বাসী মাধবানন্দের প্রত্যাখ্যাতা মোহিনীর একাগ্র প্রেমের সুদীর্ঘ তপস্যার কাছে আত্মসমর্পণই ‘রাধা’ উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। যদিও এই অংশ তারাশঙ্কের কল্পনা প্রসূত এবং পরকীয়ার চরমরূপ হিসাবে বিকৃত মানসিকতাই সমকালের বাস্তব।
আসলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বৈষ্ণবদের অবক্ষয়ের বাস্তব চিত্রের সমান্তরালে পরকীয়ার প্রকৃত স্বরূপকে উপস্থাপিত করেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন অসহায় মানুষের এই বিকৃতি আসলে ক্রান্তিযুগের ফসল। তাই তিনি জানিয়েছেন – ‘তাদের জন্য বেদনা অনুভব করি, ঘৃণা করতে পারি না।’ অষ্টাদশ শতকের অবক্ষয়িত পটভূমিকার মধ্যেও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন বৈষ্ণবক্ষেত্রের অবক্ষয়িত চিত্রে। লক্ষ্যটি আরো ঘনীভূত হয়েছে বৈষ্ণবতত্ত্বের স্বকীয়া-পরকীয়া তত্ত্বের দ্বন্দ্বগত রূপটিকে আশ্রয় করে। চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্মের পরিশুদ্ধ রূপটি তখন বিকৃত, পরকীয়া সাধনতত্ত্ব কালপরিক্রমায় লৌকিক ভ্রান্ত ব্যাখ্যায় অনাচারে পরিণত। মাধবানন্দও সেই ব্যাখ্যায় আশঙ্কিত। অবশেষে উপন্যাসের শেষে তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরে এক অপরূপ অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। তারাশঙ্কর সমস্ত উপন্যাস জুড়ে এই পথটির খোঁজ দিতে গিয়ে বৃহৎ পটভূমিকার আয়োজন করেছে, অথচ রাজনৈতিক বাতাবরণে সেই অনুসন্ধান কোথাও ম্লান হয়ে যায়নি।
পরিশেষে, বৈষ্ণবীয় ভাবাদর্শে লেখা ‘মালাচন্দন’ ও ‘রাইকমল’ গল্প দুটি একত্র সন্নিবিষ্ট উপস্থাপন ‘রাধা’ উপন্যাস – এই মন্তব্য ভ্রান্ত হবে না।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস – ক্ষেত্র গুপ্ত