একরাত্রি : ব‍্যর্থতার গল্প

‘একরাত্রি’ ব‍্যক্তির নিভৃত অনুভূতির গল্প, ব‍্যক্তির একান্ত অভিজ্ঞতা উপলব্ধির প্রকাশের জন‍্য কবিতার পরিসর‌ই কার্যকর, মূলত গীতিকবিতার। সেখানে তত্ত্ব দর্শন উপেক্ষা করে মানুষের গূঢ় ক্রন্দন, উচ্ছ্বাস দীর্ঘশ্বাসকে রূপ দিয়েছেন ‘একরাত্রি’ গল্পে। কিন্তু প্রশ্ন হল –
● ‘একরাত্রি’ গল্প যাকে কেন্দ্র করে রচিত রবীন্দ্রনাথ সেই নায়কের‌ই কোনো নাম দিলেন না কেন ?
● ‘একরাত্রি’ যদি কোনো রোমান্টিক দীর্ঘশ্বাসের গল্প হয় তাহলে গল্পের নায়ককে কলকাতার জটিল প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত করলেন কেন ?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন ‘একরাত্রি’র গল্প। নোয়াখালি বিভাগের কোনো এক ছোট শহরে অবস্থিত এক এন্ট্রান্স স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের নিভৃত জীবনের দীর্ঘশ্বাস উত্তম পুরুষে বর্ণিত হয়েছে ‘একরাত্রি’ গল্পে। গল্পের নায়ক বাল‍্যসঙ্গিনী সুরবালাকে কাছে পেয়েও বোঝেনি, তার প্রেমকে উপেক্ষা করেছে বিশালের হাতছানিতে, তাকে মনে করেছে ‘বিশেষ অবহেলার পাত্র’ হিসাবে। প‍রে রামলোচনের ঘরণী হিসাবে সুরবালাকে তার বেদনার্ত স্বগতোক্তি –
“যাহাকে ইচ্ছা করিলেই পাইতে পারিতে এখন মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও একবার চক্ষে দেখিবার অধিকারটুকু পাইবে না।”
গল্প শেষ হচ্ছে এক বিশেষ ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ রাত্রে, জলমগ্ন শহরের একটা পাঁচ ছয় হাত দ্বীপের ওপর তারা দুজন, নিভৃত অথচ নীরব। প্রসঙ্গত মনে করা যেতে পারে, শেক্সপীয়রের ‘কিং লিয়ার’ নাটকের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাত্রির প্রসঙ্গ; যেখানে মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকৃতিতে প্রকাশ পেয়ে ট্রাজেডিকে আরো ঘনিয়ে তুলেছে। কিন্তু রবীন্দ্রচেতনায় প্রেম অম্লান, অনন্ত। তাই ‘একরাত্রি’র নায়ক বিচ্ছেদের বেদনা, ফিরে পাবার অন্তর্দ্বন্দ্বকে সরিয়ে চিরমিলনের প্রান্তরেখায় এসে অমলিন মাধুর্য নিয়ে ভাবতে পেরেছে –
ঢেউ না আসুক। স্বামী পুত্র গৃহধনজন ল‌ইয়া সুরবালা চিরদিন সুখে থাকুক।”
দেহগত প্রেম বাসনা থেকে বিরহের স্বর্গলোকে অনন্ত সৌন্দর্যের মধ‍্যে প্রিয়ার সঙ্গে ভাবসম্মিলন‌ই রবীন্দ্রনাথের কাছে অধিক কাম‍্য। মিলনে যা বাধা পড়ে, বিচ্ছেদে তাই বিশ্বময় ব‍্যাপ্ত হয়। প্রায় সমসাময়িককালে রচিত ‘মানসসুন্দরী’ কবিতায় কবি লিখছেন –

“……বিষণ্ন বিচ্ছেদরাশি
চরাচরে আর সব ফেলিয়াছে গ্রাসি;
শুধু এক প্রান্তে তার প্রলয়মগন
বাকি আছে একখানি শঙ্কিত মিলন,
দুটি হাত, ত্রস্ত কপোতের মতো দুটি
বক্ষ দুরুদুরু, দুই প্রাণে আছে ফুটি
শুধু একখানি ভয়, একখানি আশা,
একখানি অশ্রুভরে নম্র ভালোবাসা।।”

মিলন বিচ্ছেদের এই ভাবনায় সেসময় রবীন্দ্রনাথ ভাবিত ছিল, তাই ই প্রকাশ পেয়েছে ওই সময়ের লেখা কবিতা ও গল্পগুলিতে। ব্রাউনিং এর “Last Ride Together” কবিতাতেও অনুরণিত হয়েছে সেই সুর –

“with life for ever old yet new,
Changed not in kind but in degree
The instant made eternity –
And Heaven just prove that I and She
Ride,  ride together, for ever ride ?”

তবে, ব্রাউনিং এর কবিতায় চরম মুহূর্তে প্রেমিক প্রেমিকা “who knows but the world may end to night!” – এই কথা মনে করলেও রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পে তা চিরন্তন, শাশ্বত। তাই গল্পের নাম‌ও শেষ রাত্রি নয়, একরাত্রি। অধ‍্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ‍্যায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন –
একরাত্রি ছাড়া, এ গল্পের নামান্তর কল্পনাই করা চরে না – Only one night – but the eternal night”.
সব রাত্রি নয়, শেষ রাত্রি তো নয়‌ই, বিশেষ এক রাত্রির বিশেষ অনুভবেই নিহিত আছে বিশ্বজনীন আবেদন, আর তার সঙ্গে নিহিত আথে ভাবাত্মক নামকরণের সার্থকতাও।

কিন্তু এখন প্রশ্ন ‘একরাত্রি’র মতো মিলন বিচ্ছেদের ভাবনা ভরপুর রোমান্টিক কাহিনি বয়ন করতে নায়ককে কেন কলকাতার জটিল ঘূর্ণাবর্তের মধ‍্যে ফেললেন ?

‘একরাত্রি’ গল্পের ঘটনাবিন‍্যাস অনুযায়ী গল্পের নায়ক বাল‍্যসঙ্গিনী সুরবালার প্রেমকে উপেক্ষা করেছে কারণ তার সামনে তখন দেশ-সমাজ-রাজনীতিতে অংশ নেবার আগ্রহ, ‘মাটসীনি গারিবালডি’ হ‌ওয়ার স্বপ্ন, বিশালের হাতছানি। এবং তার জীবনের লক্ষ‍্য ছিল – কালেক্টরের নজির রাখতে না পারলেও জজ আদালতের হেডক্লার্ক অবশ‍্য‌ই হবেন। এই লক্ষ‍্য নিয়ে কলকাতায় এসে তার নব উপলব্ধি হল – দেশের জন‍্য প্রাণ বিসর্জন করা আশু আবশ‍্যক এবং সে ব‍্যাপারে তার নিষ্ঠাও অত‍্যন্ত দৃ‌ঢ় ছিল।

প্রসঙ্গত স্মর্তব‍্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘একরাত্রি’ গল্প লিখছেন ১৮৯২খ্রি অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষার্ধে। সেইসময় ইউরোপ সমুদ্র অভিযানের মাধ‍্যমে এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকায় নিজেদের আধিপত‍্য যেমন বিস্তার করেছিল তেমনি অর্থ-জ্ঞান-সম্পদ-প্রভূত্বের জোরে নিজেদের প্রতি শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা অনুষঙ্গে সৃষ্টি করেছিল যুগ্ম বৈপরীত‍্য। এবং এর কারণেই ঔপনিবেশিক দেশগুলো ইউরোপকে গভীরভাবে অনুকরণ করতে শুরু করে রাজনৈতিক – সামাজিক – সাংস্কৃতিক এমনকিই মনোজাগতিক ক্ষেত্রেও। যুগ্ম বৈপরীত‍্যের মধ‍্য দিয়ে এই সত‍্য প্রতিষ্ঠিত হল – ইউরোপ হচ্ছে উন্নত ও সভ‍্য, অবশিষ্ট বিশ্ব হচ্ছে অনুন্নত, অসভ‍্য; ইউরোপ হল কেন্দ্র, অবশিষ্ট প্রান্ত। উপনিবেশিত এই সমাজের উৎপাদিত ফসল হল বিচ্ছিন্ন ভাবনা, প্রবঞ্চনা। ঔপনিবেশিক শক্তির এই প্ররোচনা ‘একরাত্রি’ গল্পে প্রথম থেকেই লক্ষ‍্য করা যায়। ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়ক কৈশোরক কৌতূহলে আবিষ্কার করেছিল ইংরেজদের প্রতি মোহ আর মুগ্ধতা –
সর্বদাই দেখিতাম, আমার বাপ উক্ত আদালত জীবীদের অত‍্যন্ত সম্মান করিতেন…এইজন‍্যে আদালতে ছোটো কর্মচারী এমনকি পেয়াদাগুলোকে পর্যন্ত হৃদয়ের মধ‍্যে খুব একটা সম্ভ্রমের আসন দিয়াছিলাম।”
আর এই ভাবনা থেকেই ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্রলোক মধ‍্যবিত্ত সাধারণ মানুষকে অবহেলার পাত্র বিবেচনা করত, ঠিক যেমন ভাবনা পোষণ করেছিল ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়ক তার বাল‍্য সঙ্গিনী সুরবালার প্রতি। আর মোহ মুগ্ধতা থেকে এসেছিল উচ্চাভিলাষ –
“নাজির সেরেস্তাদার হ‌ইতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু মাটসীনি গারিবালডি হ‌ইবার আয়োজন করিতে লাগিলাম।”
কিন্তু, কলকাতায় গিয়ে মাটসিনী গারিবাল্ডি, জজ আদালতের হেডক্লার্ক থেকে গল্পের নায়ককে যেতে হয় নোয়াখালির কোনো এক ভাঙা স্কুলে – এই বিবর্তনেই প্রকাশ পাচ্ছে উপনিবেশী ষড়যন্ত্র, আর এই ঔপনিবেশিক শোষণের ফল উচ্চাভিলাষ আচ্ছন্নে নিঃসঙ্গ আশ্রয়। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে তাই পোস্টমাস্টারের অন্তিম দার্শনিকতা –
“ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।”
এই প্রবঞ্চনাও আসলে ঔপনিবেশিকতার‌ই ফল। তাই ‘একরাত্রি’ গল্পে নায়ক ও দার্শনিকতার মোহন প্রলেপ জড়িয়েছে –
ভাবিলাম, আমি নাজির‌ও হ‌ই নাই, সেরেস্তাদার‌ও হ‌ই নাই, গারিবালডিও হ‌ই নাই, আমি এক ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার, আমার সমস্ত ইহজীবনে কেবল ক্ষণকালের জন‍্য একটি অনন্তরাত্রির উদয় হ‌ইয়াছিল – আমার পরমায়ুর সমস্ত দিন-রাত্রির মধ‍্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।”
আসলে এই ছিল উনিশ শতকের নব‍্য শিক্ষিত কলকাতার জীবনের গতিবেগ, ঔপনিবেশিকতার ফল স্বরূপ এই উচ্চাভিলাষ, প্রবঞ্চনার বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ ছিল ব‍্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবোধ। নব‍্য শিক্ষায় শিক্ষিত যৌবনের উন্মাদনায় নাগরিক জীবনের গতি ও চাঞ্চল‍্যে গ্রামবিমুখতা, নিজ সংস্কৃতির প্রতি উদাসীনতাও প্রকট হয়ে উঠেছিল। আর সর্বাত্মক বিষাদময় পরিণতি হল ব‍্যর্থতা, আত্মবঞ্চনা, বিচ্ছিন্নতার অপেক্ষা সেকেন্ড মাস্টারের জীবন‌ও সেই ব‍্যর্থতার চিত্র‌ই প্রকট ভাবে প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘একরাত্রি’ গল্পে। শিক্ষিত উচ্চাভিলাষী তরুণ স্বপ্ন পূরণের ব‍্যর্থতা মাইকেল মধুসূদনকে মনে করায়। শুধু মধুসূদন নয় সেসময়ের কলকাতার মূল বৈশিষ্ঠ‍্য ছিল এই ব‍্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যতা – আত্মপ্রবঞ্চনা – বিচ্ছিন্নতা এবং ব‍্যর্থতা। পুঁজিবাদের প্রসারে মধ‍্যবিত্ত জীবন বহুকৌণিক জটিলতায় আক্রান্ত ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসলে এই মানব নিয়তির একান্ত চিত্র অঙ্কন করেছেন ‘একরাত্রি’ গল্পে রোমান্টিক কবির মতো।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
একরাত্রি : মানবনিয়তির চিরায়ত আখ‍্যান – রফিকুল্লাহ খান

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে উপনিবেশিত বাংলা – বিশ্বজিৎ ঘোষ