দেশভাগ, মন্বন্তর ও বিজন ভট্টাচার্যের নাটক
বিজন ভট্টাচার্য কলম ধরেছিলেন দেশভাগ ও মন্বন্তরের পটভূমিকায়, বাঁক বদল ঘটিয়েছিলেন বাংলা নাট্য সাহিত্যের। তাই বিজন ভট্টাচার্যের নাটক আলোচনার আগে জেনে নিই তাঁর নাটক রচনার কাল পরিসর।
১৯৩৯ – ১৯৪৭ সাল, একদিকে বিশ্বযুদ্ধের সর্বগ্রাসী প্রভাব অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রবিপ্লব – এই দুয়ে মিলে বাঙালির সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত করেছিল। এসব কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর্ব শেষে এল মহাপ্রস্থানের পথে অর্থাৎ দেশভাগ। অসহায় অগণিত ছিন্নমূল মানুষ পুরানো শিকড় ছেড়ে পাড়ি দিল আরো অন্ধকার অনিশ্চয়তার পথে। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা সমবায়ে দেশভাগ বাঙালির জীবন করাল বিপর্যয়, কুৎসিত বিভীষিকার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। ভৌগলিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে সামাজিক পারিবারিক পরিবর্তনকেও ত্বরান্বিত করল। বাঙালি পরিবারের আদর্শের বদল ঘটল, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেল, শ্রম ও বিত্তের ভিত্তিতে সমাজ গড়ে উঠল, মেয়েদের গৃহপালিত লজ্জা খসে গেল, সর্বোপরি বেদনা ও বঞ্চনা তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়াল। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়ল সংস্কৃতি জগতেও। ছায়াসুনিবিড় গ্রামের পটভূমি বদলে গেল শ্রী হীন কোলাহলময় শহরতলিতে, নাট্যকারও অভিনিবেশ করলেন জীবনের রূঢ় সত্য প্রতিষ্ঠায়। এবং এর সঙ্গে নাট্যকার বিষয়ের গুরুত্বকে অতিক্রম করে আঙ্গিকের অভিনবত্বের ব্যাপারে ঝুঁকলেন। পরিচিত রূঢ় বাস্তব ভরা কাহিনি নয়, তার উপযুক্ত সাধারণের জন্য বাহুল্য বর্জিত বাস্তব মঞ্চই দর্শককে আকর্ষণ করবে – এই ভাবনা থেকেই নাটকগুলিতে দর্শকের সঙ্গে সমন্বয় করার প্রয়াস দেখা দিল। এবং এই ভাবনা থেকেই নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে গণনাট্যের জন্ম দিল। অর্থাৎ গণনাট্যের উদ্ভব ঘটল সমাজমানসের এক রাজনৈতিক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকারণে। বাংলাদেশ থেকে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’র পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, বিষ্ণু দে, বিনয় ঘোষ, শম্ভু মিত্র এবং বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখ। এদের প্রচেষ্টায় এখান থেকেই সর্বভারতীয় সংগঠন হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে “Indian People’s Theater Association” বা ভারতীয় গণনাট্য সংঘ।
বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ নাটকের মধ্য দিয়ে এই ভারতীয় গণনাট্য সংঘের পথচলা শুরু হয়েছিল। চল্লিশের দশকে এসে গণনাট্য এবং বিজন ভট্টাচার্য প্রায় সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৪৩ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের নাট্যজীবনে ২৬টি নাটক রচনা করেছেন। এই পটভূমিকায় বিজন ভট্টাচার্যের ‘দেবীগর্জন’ ও ‘গোত্রান্তর’ নাটক নিয়ে আলোচনা থাকল।
নির্যাতিত নিপীড়িত সাঁওতাল আদিবাসী কৃষকদের জোতদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চিত্র প্রকাশ পেয়েছে এই ‘দেবীগর্জন’ নাটকের মধ্যে দিয়ে। জমিদার প্রথার বিলোপ হলেও মধ্যস্বত্ত্বভোগী প্রভঞ্জন সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পঞ্চায়েতি প্রথাকে পিছনে রেখে কৃষকদের জমি নিজের দখলে করে নেন। এদিকে কৃষি ঋণ ও সুদ জোগাতে দরিদ্র আদিবাসী কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়। অবশেষে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তারা, নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়।
‘নবান্ন’ নাটকে বিজন ভট্টাচার্য অসহায় কৃষকদের এবং অত্যাচারী হারু দত্তকে দেখালেও কৃষকদের অসহায়তার মূল কারণ হিসাবে দেখিয়েছিলে প্রতিকূল প্রাকৃতিক শক্তি কে। তবে সেখানেও ‘নবান্ন’ উৎসবের মধ্য দিয়ে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সফল লড়াই চিত্রিত হয়েছে। আর ‘দেবীগর্জন’ নাটকেও লড়াই শোষকের বিরুদ্ধে তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে। তিন অঙ্কের এগারোটি গর্ভাঙ্কে ‘দেবীগর্জন’ হয়ে উঠেছে সার্থক গণনাট্য। এখানে ‘আমি রাজা আমারই নীতি ইটাই রাজনীতি’ প্রভঞ্জনের এই কথায় যেমন সমকালীন জোতদারের মুখোশ খুলে যায়, ধর্মগোলার মজুত ধানের বিতরণের দাবিতে চাষিদের সঙ্গে জোতদারের বিরোধ বাঁধে তখন মংলার চেতনায় প্রশ্ন জাগে – ‘কে রাজা, কার রাজ্য ?’ এটাই গণনাট্যের মূল। নাটকের শেষে সঞ্চরিয়া ও মংলার নেতৃত্বে জোটবদ্ধ ভুঁইচাষির দল পঞ্চায়েতি শাসন চালুর দাবি জানায়। সেই দাবির গর্জনই আসলে ‘দেবীগর্জন’ – এই দেবী ধরিত্রী। অবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে চাষিদের সংঘবদ্ধ বিরোধ এবং তাতে জয়লাভ ও অবস্থার পরিবর্তন এই আলেখ্যে ‘দেবীগর্জন’ সার্থক গণনাট্য এমনি ‘নবান্ন’ অপেক্ষা অনেক পরিণত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, ‘দেবীগর্জন’ নাটকটি বিজন ভট্টাচার্যের ‘কলঙ্ক’ নাটকের কাহিনি সূত্র ধরেই লেখা, মোড়ল বা সর্দার, তার স্ত্রী গিরি, পুত্র মংলা, পুত্রবধূ রত্না – এরা ‘কলঙ্ক’ নাটকের মতো ‘দেবীগর্জন’ নাটকেও আছে। তবে পটভূমির পরিবর্তন হয়েছে – বাঁকুড়া গ্রাম থেকে নাট্যকার তাদের নিয়ে গেছেন বীরভূমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, আর গোরা সৈন্যদের বদলে তাদের বিদ্রোহ দেশীয় জোতদারদের বিরুদ্ধে।
অর্থাৎ ‘দেবীগর্জন’ কৃষক নাটক, উৎসর্গ করা হয়েছে কৃষক আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশ্যে, উনিশ – বিশ শতক জুড়ে নীল – তেভাগা সহ সমস্ত কৃষক যারা আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। এছাড়া ‘দেবীগর্জন’ নাটকে দুটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে হয় –
১) বিজন ভট্টাচার্য জানান যে আদিবাসী সাঁওতালরা তাদের আরাধ্য হিসাবে কালীকে আরাধনা করেন, সেই মাতৃশক্তির আবির্ভাবের কথা খেয়াল রেখেই নাটকে ‘দেবীগর্জন’ নাম এবং প্রসঙ্গ এসেছে। এর ফলে নাটকটি লোকনাট্যের কাছাকাছি যেতে পেরেছে।
২) কৃষক আন্দোলন নাটকে প্রেক্ষাপট হলেও দুটি প্রসঙ্গ নাটকে প্রধান – ধর্মগোলা ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা – এর মধ্য দিয়েই বিজন ভট্টাচার্য সমস্যার সমাধানের সূত্র খুঁজেছেন।
এবার আসি ‘গোত্রান্তর’ নাটক প্রসঙ্গে। পরিবর্তিত অবস্থা, মুক্তি, সংগ্রাম এসবের কথা বলে গণনাট্য, গণনাট্যের সার্থক প্রকাশ ‘দেবীগর্জন’ নাটক। কিন্তু ‘গোত্রান্তর’ নাটকে অন্য কথা বলেছেন বিজন ভট্টাচার্য। আলোচনার শুরুতেই জেনেছিলাম দেশভাড, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা – এই তিনের প্রভাব যেমন পড়েছিল রাজনৈতিক ও ভৌগলিক ক্ষেত্রে তেমনি সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়েছিল। বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মানুষ যখন অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মুখর তখন তার সমান্তরালে ফল্গুধারার মতো নিঃশব্দে ঘটে যাচ্ছিল সামাজিক পরিবর্তন, তারই ছবি তুলে ধরেছেন বিজন ভট্টাচার্য ‘গোত্রান্তর’ নাটকে।
‘গোত্রান্তর’ নাটকটি ১৯৫৭ সালে শারদীয় বসুমতীতে প্রথম প্রকাশিত হয়, প্রথম অভিনীত হয় ১৯৫৯ সালের ১৬ই আগষ্ট নিউ এম্পায়ার মঞ্চে, ক্যালকাটা থিয়েটারের প্রযোজনায়। নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন নাট্যকার স্বয়ং এবং হরেন চরিত্রটি তিনি অভিনয় করেন। ‘গোত্রান্তর’ নাটকটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে। দেশভাগের কবলে পড়ে একজন উদ্বাস্তু স্কুল শিক্ষক ও তার পরিবারের কীভাবে সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত জীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে বস্তিবাসী শ্রমিকের অসম্মানের জীবনে উপনীত হন তারই কাহিনি এই নাটকের বিষয়বস্তু। ‘গোত্রান্তর’ নাটকের ভূমিকায় নাট্যকার লিখেছেন – “নীতিবাদের প্রশ্ন নয় – জীবনের ক্ষেত্রেই গোত্রান্তর আজ যুগসত্য।”
‘গোত্রান্তর’ নাটকের কেন্দ্রিয় চরিত্র হরেনবাবু, পেশায় শিক্ষক, দেশভাগের ফলে ছিন্নমূল হরেনবাবুর বস্তিতে বসবাস এবং তার কন্যা গৌরীর সঙ্গে বস্তিবাসী কানাইএর প্রেমজ বিবাহ – এর মধ্যেই মধ্যবিত্ত জীবনের গোত্রান্তরের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ তার ভদ্রতার, শিক্ষার, আভিজাত্যের গোত্রবন্ধন ত্যাগ করে কায়িক পরিশ্রমজীবী শ্রমিক সমাজের গোত্রভূক্ত হয়েছে। তবে, নাটকে মধ্যবিত্ত সমাজের গোত্রান্তর নিতান্তই আংশিক ও আকস্মিক বলে মনে করেছেন সমালোচক ড. অজিত ঘোষ। সম্ভ্রান্ত শিক্ষক হরেন্দ্রবাবুর শিক্ষক জীবনের কোনো স্বপ্ন আদর্শ পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে তার সংঘাত এবং তার ফলে কোনো পরিণতি বা তা থেকে মুক্তির উপায় নাটকে সেভাবে দেখা যায়নি। নাটকের শেষে গৌরী ও কানাইয়ের যে অসমগোত্রীয় বিবাহের ওপর সম্পূর্ণ 'গোত্রান্তর' নাটকের যে ভাববস্তু দাঁড়িয়ে আছে তার আভাসও পাওয়া যায় নাটকের তৃতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে এসে। শিক্ষক জীবন থেকে দুঃখজনক পরিণতি - এই পটভূমির প্রেক্ষিতে গোত্রান্তর নাটকের সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায় সলিল সেনের 'নতুন ইহুদী' নাটকটির। মধ্যবিত্ত শিক্ষক পরিবার এবং তার স্নেহ সম্পর্কিত নমঃশূদ্র পরিবার দেশভাগের স্বাধীনতায় ছিন্নমূল হয়ে বঞ্চনার কুটিল জগতে এসে কীভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তার ছবি ফুটে উঠেছে 'নতুন ইহুদী' নাটকে। পন্ডিত মরল, তার আপনভোলা ছেলে মরল, মেয়ে ভুল পথে গৃহত্যাগিনী হল - পরিবারের এই ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নবলব্ধ স্বাধীনতার পরিণতি দেখিয়েছেন নিষ্করুণ সমাজব্যবস্থাকে তুলে ধরেছেন সলিল সেন। অপরদিকে, 'গোত্রান্তর' নাটকের শেষে ভাঙা বস্তিকে হরেন্দ্রবাবুর নতুন করে নির্মাণের আহ্বান -
“হেই বিশ্বকর্মার পূতের দল, চুপ কইর্যা দাঁড়াইয়া আছস – হাত লাডাইতে পারস না তরা – হাত লাগাও, কাম কর – উঠাও বস্তি।”
এর মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের সম্ভাবনার আভাস পাওয়া যায়। এই নতুন জীবনে আদর্শ নেই, পরিবর্তিত জীবনকে মেনে নিয়েই তার মধ্যে নতুন করে বাঁচার ইঙ্গিত আছে মাত্র। এখানেই ‘গোত্রান্তর’ নাটকটির অভিনবত্ব। সমকালীন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় মধ্যবিত্তের কেবল জীবনযাত্রায় নয়, মানসিকতার পরিবর্তনই গোত্রান্তর।