ভিডিও দেখুন
প্রবাসী পত্রিকা
প্রবাসী বাঙালির মুখপত্র ছিল প্রবাসী পত্রিকা। আর এর জন্মদাতা হলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। অধ্যাপনা জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনভাবে পত্রিকা সম্পাদনার কাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন রামানন্দ। ধর্মযুদ্ধ, দাসী, কায়স্থ সমাচার, প্রদীপ প্রভৃতি নানা বাংলা ইংরাজী পত্রিকার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান নিয়ে সম্পাদনা করলেন – প্রবাসী পত্রিকা।
◆ পত্রিকা প্রকাশ ◆
● এলাহবাদ থেকে বৈশাখ, ১৩০৮ বঙ্গাব্দে (এপ্রিল,১৯০১) প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় সচিত্র পত্রিকা প্রবাসী।
● রামানন্দ সম্পূর্ণ এককভাবে পত্রিকাটি সম্পাদনা করলেও তাঁকে অপরিসীম সাহায্য করেছিলেন – ইন্ডিয়ান প্রেসের স্বত্বাধিকারী চিন্তামণি ঘোষ।
● পত্রিকার নাম ‘প্রবাসী’ এই মর্মে রাখা হয়েছিল –
“আমরা যে স্বাধীনতা হারিয়ে নিজের ঘরে পরাশ্রিতদের মতো বাস করে প্রবাসী হয়ে আছি, এই অর্থটাই প্রধান হল।”
● পত্রিকার প্রথমে মুখবাণী ছিল টেনিসনের পঙক্তি –
“Beauty, Good and Knowledge
are three sisters
to look on the noble forms
makes noble thro the sensors organism
that which is higher.”
● ১৩১৪ বঙ্গাব্দে আষাঢ় মাসে এর সঙ্গে যোগ হয় – সংস্কৃত দুটি বাক্য –
“সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম”
“ন্যায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ” (মুন্ডকোপনিষদ)
● ১৩২২ বঙ্গাব্দে মুখবাণীতে প্রকাশ পেল পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ জাতির মর্মবেদনা –
“নিজ বাসভূমে, পরবাসী হলে
পর দাস খতে সমুদায় দিলে।
পরহাতে দিয়ে, ধনরত্ন সুখে
বহ লৌহবিনির্মিত হার বুকে
পর ভাষণ, আসন, আনন রে
পর দীপশিখা নগরে নগরে
তুমি যে তিমিরে তুমি সে তিমিরে।”
– গোবিন্দ চন্দ্র রায়
● প্রবাসী পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ ছিল – স্বদেশের সংস্কৃতি ও ধর্মের সমন্বয়ে এক চিত্র।
◆ প্রথম সংখ্যা ◆
১৩০৮ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ প্রকাশিত হয়-
১) সূচনা
২) আবাহন(কবিতা) – শ্রী দেবেন্দ্রনাথ সেন
৩) প্রয়োগধামে কমলাকান্ত – শ্রী কমলাকান্ত শর্মা
৪) আদর্শ কবি (ক্রমশ:) – ঐ
৫) অজন্তা গুহাচিত্রাবলী (সচিত্র) – সম্পাদক
৬) প্রবাসী (কবিতা) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৭) জীববিদ্যা – শ্রী যোগেশচন্দ্র রায়
৮) ক্ষীরাৎকুম্ভ (সচিত্র) – শ্রী জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস
৯) শর্করা বিজ্ঞান (ক্রমশ:) – শ্রী নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়
১০) বিবিধ প্রসঙ্গ – সম্পাদক
১১) ভিতরে পূর্ণ পৃষ্ঠা ছবি – জয়পুরের মহারাজা ও দেওয়ান কান্তিচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
● সূচনায় সম্পাদক লিখেছিলেন –
“সর্ব্বসিদ্ধিদাতা পরমেশ্বরের নাম লইয়া আমরা ‘প্রবাসী’ প্রকাশ করিতেছি।…প্রারম্ভের আড়ম্বর অপেক্ষা ফল দ্বারাই কার্য্যের বিচার হওয়া ভাল। এইজন্য আমরা আপাতত আমাদের আশা ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নীরব রহিলাম।”
◆ প্রকাশ্য বিষয় ◆
প্রবাসীর সূচিপত্র ছয় মাস অন্তর প্রকাশিত হত। বৈশাখ সংখ্যায় বৈশাখ থেকে আশ্বিন এবং কার্তিক সংখ্যায় কার্তিক থেকে চৈত্র পর্যন্ত প্রকাশিত হত।
● চিত্রপরিচয় – ১৩০৯ বঙ্গাব্দ থেকে এই বিভাগ শুরু হয়। দেশি বিদেশি চিত্রকরদের আঁকা বিখ্যাত তিনটি করে ছবি থাকত। আর সেই চিত্রের বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা থাকত।
চিত্রসূচী পত্রিকায় পৃথকভাবে প্রকাশ পেত।
● বিবিধ প্রসঙ্গ – প্রথম সংখ্যা থেকেই সাময়িক রাজনীতি, সমাজনীতি, সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ নামে সম্পাদকীয় বক্তব্য প্রকাশ পেত। তার কোনো শিরোনাম ছিল না তখন পরবর্তীকালে নাম হয় ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’।
● পঞ্চশস্য – আর একটি জনপ্রিয় তথ্যসমৃদ্ধ বিভাগ হল পঞ্চশস্য। জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা খবর এখানে প্রকাশ পেত। ১৩২০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস থেকে শুরু হয় এই বিভাগটি। এই বিভাগের সংবাদগ্রাহকদের মধ্যে ছিলেন চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমলচন্দ্র হোম। ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের পরে এই বিভাগটি বন্ধ হয়ে যায়।
● কষ্টিপাথর – সমকালীন পত্র পত্রিকা থেকে বিভিন্ন রচনার সংক্ষিপ্তসার অথবা পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হত কষ্টিপাথর বিভাগ। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ভারত মহিলা, বঙ্গদর্শন, ভারতী, সবুজপত্র, নারায়ণী, সন্দেশ, প্রাচী, মাসিক বসুমতী, সৌরভ, আয়ুবিজ্ঞান, নমঃশূদ্র হিতৈষী প্রভৃতি পত্রিকা থেকে বিষয়বস্তু নির্বাচিত হত। ১৩১৬ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল বিভাগটি।
● দেশে বিদেশের কথা – দেশে বিদেশের কথা (সচিত্র) বিভাগটি শুরু হয়েছিল ১৩২৮ বঙ্গাব্দ থেকে। এর আগে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে ‘দেশের কথা’ নামে বিভাগটি চালু হয়েছিল। পরে বিদেশের খবর অন্তর্ভূক্ত করে এর নাম হয় ‘দেশে বিদেশের কথা’। পঞ্চশস্য বিভাগের সদস্যরাই খবর সংগ্রহ করতেন এই বিভাগের জন্য।
● মহিলা মজলিশ – ১৩২৮ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল এই বিভাগটা। বিভিন্ন মহিলাদের সংবাদ ও তাদের সমস্যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারীদের নানা কৃতিত্ব নিয়ে এই বিভাগে খবর প্রকাশিত হয়। আবার শোকসংবাদও থাকত।
● ছোটদের পাততাড়ি – এই বিভাগে ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য দেশ বিদেশের গল্প, রূপকথা, বিজ্ঞান, জীবজন্তুদের কথা, শরীর ও স্বাস্থ্য এবং নানা আকর্ষণীয় ও কৌতূহলোদ্দীপক রচনা থাকত। তবে, এই বিভাগটি পতরিকার প্রতি সংখ্যায় প্রকাশ পেত না।
● আলোচনা – রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রদীপ’ পত্রিকার মতই ‘প্রবাসী’তে আলোচনা বিভাগ ছিল। এখানে যেকোনো রচনা সম্বন্ধে পাঠকের মতামত ছাপানো হত। অনেক সময় মূল লেখকের উত্তরও সঙ্গে দেওয়া থাকত।
● বেতালের বৈঠক – বেতালের বৈঠক বিভাগটি শুরু হয়েছিল ১৩৩০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা থেকে। এই বিভাগে পাঠকদের বিভিন্ন বিষয়ের জিজ্ঞাসা ও পরবর্তী সংখ্যায় সেইসব জিজ্ঞাসার উত্তর প্রকাশ পেত। এর উত্তর পাঠকও দিতে পারতেন। উত্তরের পাশে উত্তরদাতার নামও লেখা থাকত।
● হারামণি – ‘হারামণি’ প্রবাসীর একটি নতুন সংযোজিত বিভাগ। ১৩২২ বঙ্গাব্দ থেকে এই বিভাগের শুরু হয়। বহু পুরানো ও হারিয়ে যাওয়া গান যেমন বাইল, দরবেশ, ফকির, তর্জ্জাওয়ালা প্রভৃতি গায়কের এই বিভাগে প্রকাশ পেত।
● সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ সমালোচনা – প্রবাসী র একটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা হল সমসাময়িক পত্রিকা ও গ্রন্থের সমালোচনা প্রকাশ। ১৩০৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ইংরাজি গ্রন্থের প্রশংসাসূচক সমালোচনা – হিন্দু রসায়নের ইতিহাস’ নামে বেরিয়েছে। ১৩১৩ আশ্বিন সংখ্যায় ‘সমালোচনা’ শিরোনামে কিছু গ্রন্থের সমালোচনা প্রকাশ পেয়েছে। তবে এই সমালোচনা তখনও নিয়মিত হয়নি। ১৩১৮ বঙ্গাব্দ থেকে ‘পুস্তক পরিচয়’ নামে নিয়মিত বিভাগের শুরু হয়।
এছাড়া গল্প, উপন্যাস, নাটক প্রকাশ পেয়েছে এবং এর পাশাপাশি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, ভৌগলিক বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে নানা সময়।
◆ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রবাসী পত্রিকা ◆
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রবাসী পত্রিকার প্রাণপুরুষ। তাঁর অসংখ্য কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস প্রবাসী পত্রিকার পাতাকে সমৃদ্ধ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
গোরা (ভাদ্র, ১৩১৪ – ফাল্গুন, ১৩৩৬)
শেষের কবিতা ( ভাদ্র, ১৩৩৫)
মুক্তধারা ( বৈশাখ, ১৩৩৯)
অচলায়তন ( ভাদ্র, ১৩১৯)
রক্তকরবী ( আশ্বিন, ১৩৩০)
এছাড়া তোতাকাহিনী, প্রথম চিঠি, অতিথি, পণরক্ষা, কর্ত্তার ভূত ইত্যাদি ছোটগল্পও প্রকাশিত হয়েছে প্রবাসীর পাতায়। তবে, পরবর্তীকালে সবুজ পত্র পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত হওয়ায় প্রবাসীর থেকে দূরত্ব তৈরি হয়।
রবীন্দ্রনাথের লেখা যেমন বেরিয়েছে প্রবাসীর পাতায় তেমনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও নানা লেখা বেরিয়েছে, যেমন –
১) রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা – অজিতকুমার চক্রবর্ত্তী (আশ্বিন, ১৩১৯)
২) রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (মাঘ, ১৩৩৬)
৩) রবীন্দ্রনাথ – নলিনীকান্ত গুপ্ত ( জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৮)
৪) রবীন্দ্রনাথ ও মৃত্যু – শান্তা দেবী (অগ্রহায়ণ, ১৩৪৮)
৫) রবীন্দ্রচিত্রের ভূমিকা – বিমলচন্দ্র চক্রবর্ত্তী (মাঘ, ১৩৫৪) ইত্যাদি।
দীর্ঘ ৪২ বছর রামানন্দ ‘প্রবাসী’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর অগ্রহায়ণ, ১৩৫০ বঙ্গাব্দ থেকে পত্রিকার হাল ধরেন পুত্র কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়।