ভিডিও দেখুন
সবুজ পত্র পত্রিকা
কোনো সাময়িক পত্রকে ঘিরে যেমন গড়ে ওঠে সাহিত্য ও সাহিত্য গোষ্ঠী – কল্লোল গোষ্ঠী, তেমনি কোনো সাময়িক পত্রের তাগিদে নতুন সাহিত্য রীতির জন্ম হচ্ছে, এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে আসে – সবুজ পত্র পত্রিকা।
সবুজ পত্র পত্রিকার সম্পাদক বীরবল অর্থাৎ প্রমথ চৌধুরী। বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ অবদান সবুজ পত্র পত্রিকা, আর সবুজ পত্র পত্রিকার স্বতন্ত্রতা মৌখিক ভাষায় সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে।
‘চিঠিপত্র’ পঞ্চম খন্ড থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ প্রথমে পত্রিকাটির নাম ‘কনিষ্ঠ’ ভেবেছিলেন, তবে নামটি গৃহীত হয়নি এবং পরে পত্রিকার নাম রাখা হয় সবুজ পত্র।
■ পত্রিকা প্রকাশ ■
● ২৫শে বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪, ৮ই মে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে ‘সবুজ পত্র’ প্রথম প্রকাশিত হয়।
● সবুজ পত্র পত্রিকার সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী, সহ সম্পাদক সুরেশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী।
● পত্রিকার প্রচ্ছদ ছিল – সবুজ মলাটের মাঝখানে সবৃন্ত তালপাতার ছবি।
● পত্রিকাটির প্রচ্ছদ অঙ্কন করেছিলেন – নন্দলাল বসু।
● পত্রিকাটির প্রথম থেকে বার্ষিক মূল্য ছিল ২টাকা ৬ আনা, মাসিক মূল্য ৪ আনা।
● পত্রিকাটি প্রকাশিত হত – সবুজ পত্র কার্য্যালয়, ৩নং হেস্টিংস হাউস থেকে।
■ প্রথম সংখ্যা ■
● সবুজ পত্র পত্রিকার প্রথম সংখ্যার আখ্যান পত্র ছিল –
প্রথম সংখ্যা / ২৫শে বৈশাখ / প্রথম বর্ষ
সবুজ পত্র
শ্রী প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত
প্রকাশক শ্রী কালাচাঁদ দালাল
মুদ্রক শ্রী হরিচরণ মান্না
কান্তিক প্রেস, ২০ কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট, কলকাতা
● সবুজ পত্র পত্রিকার প্রথম প্রকাশে পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল – ৬৮,
মোট লেখা – ৬টি।
● প্রথম সংখ্যার সূচিপত্র –
মুখপত্র(প্রবন্ধ) : সম্পাদক
সবুজপত্র (প্রবন্ধ) : বীরবল
সবুজের অভিযান(কবিতা) : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিবেচনা ও অবিবেচনা(প্রবন্ধ) : ঐ
হালদার গোষ্ঠী(ছোটগল্প) : ঐ
সবুজ পাতার গান(কবিতা) : সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
● প্রমথ চৌধুরী মুখপত্রের সূচনা করেছিলেন – “ওঁ প্রানায় স্বাহা” – এই লিখে
■ সবুজ পত্রের স্বতন্ত্রতা ■
● সবুজ পত্র পত্রিকার প্রচলিত রীতিকে অগ্রাহ্য করেছিল। কোনো বিজ্ঞাপন, ছবি বা ফিচার শ্রেণির নয়নরঞ্জন কোনো কিছুই পত্রিকার পাতায় থাকত না। প্রমথ চৌধুরীর এ বিষয়ে বক্তব্য –
“কলম চালানো আমার শখ, কাগজ চালানো আমার ব্যবসা নয়।”
● সবুজ পত্রের সবচেয়ে বড় স্বতন্ত্রতা ভাষা ব্যবহারে, বলা যায় ভাষার আন্দোলনে। সাধু ভাষা ও চলিত ভাষার মধ্যেকার দীর্ঘ বিরোধের মীমাংসা সবুজপত্রের মাধ্যমেই হয়েছিল। শুধু তাই নয়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানীর আঞ্চলিক ভাষাটি সর্বজনবোধগম্য যে সাহিত্যিক আভিজাত্য লাভ করেছিল, সবুজ পত্রের আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় তা শ্রীসমৃদ্ধ সাহিত্যিক ভাষায় পরিণত হল।
● সবুজ পত্র পত্রিকার স্বতন্ত্রতার মধ্যে একটি দোষ হল ছাপার ভুল। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বিরক্তি প্রকাশ করলেও প্রমথ চৌধুরীর মতে, “ছাপার ভুলকে আমি দোষ বলে মনে করিনে, কেননা পাঠক মন্ডলী ও ভুল নিজগুণেই অনায়াসে সংশোধন করে নিতে পারেন।”
■ রবীন্দ্রনাথ ও সবুজপত্র ■
● ৫৩ বছরের তরুণ রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্রকে মনে প্রাণে স্বীকার করেছিলেন। এই সময়কার নতুন ভাবনা নিয়ে রচিত গল্প কবিতা সবুজ পত্রকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল।
● রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুরঙ্গ ও ঘরে বাইরে – ২টি উপন্যাস, হালদার গোষ্ঠী, হৈমন্তী, বোষ্টমী, স্ত্রীর পত্র, ভাই ফোঁটা, শেষের রাত্রি, অপরিচিতা, তপস্বিনী, পাত্র ও পাত্রী, পয়লা নম্বর, তোতাকাহিনী, পট, সিদ্ধি – ১৩টি ছোটগল্প, স্বর্গ মর্ত্য, ফাল্গুনী ইত্যাদি নাটক, বেশ কিছু কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল সবুজ পত্র পত্রিকায়।
● বিজিত কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘সেরা সবুজ পত্র’ সংগ্রহের মুখবন্ধে অন্নদাশঙ্কর রায় জানিয়েছেন –
“সবুজ পত্র রবীন্দ্রনাথের মুখপত্র। এটা তারই আইডিয়া। সম্পাদক হিসাবে প্রমথ চৌধুরী তাঁরই মনোনীত।”
● সবুজ পত্র পত্রিকা প্রসঙ্গে সাহিত্য পত্র পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু বলেছেন –
“প্রমথ চৌধুরী এবং রবীন্দ্রনাথ, এ দুজনের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল সবুজ পত্রের, প্রথম জনের আত্ম প্রকাশের জন্য, দ্বিতীয় জনের নতুন হবার জন্য।”
■ আয়ুষ্কাল ■
● ১৩২১এর বৈশাখ থেকে ১৩৩৪ এর চৈত্র পর্যন্ত সবুজ পত্র একটানা প্রায় ১২-১৩বছর প্রকাশিত হয়েছে।
যদিও এর মধ্যেই দুটো পর্যায় লক্ষ্য করা যায় –
১) ১৯১৪ – ১৯২২
২) ১৯২৬ – ১৯২৮
● শোনা যায়, পাঁচ বছর যেতে না যেতেই প্রমথ চৌধুরী পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তা হতে দেননি। সেসময় সম্ভবত পত্রিকার হাল ধরেছিলেন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী।
● সবুজ পত্র বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে নতুন পথের সন্ধান দিলেও লেখক বেশি টানতে পারেননি।পত্রিকায় নিয়মিত লেখকের সংখ্যা খুব কম ছিল।
● এমনকি ১৩২১এর চৈত্র সংখ্যায় ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকা কেবল রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসকে কেন্দ্র করেই প্রকাশিত হয়েছিল।
● ১৩২৮ এর বৈশাখ থেকে আষাঢ় – তিনমাস পত্রিকা বেরোয়নি। পরে ১৩৩৪ এর ভাদ্র সংখ্যা পর্যন্ত পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
● সবুজ পত্র ছিল যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর যুগের সন্তান। এসময় রুশ বিপ্লব, ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড, নাইট উপাধি ত্যাগ এসবের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী ও বিশ্বভ্রমণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সবুজ পত্রের জন্য লেখা কমে আসে।
● সর্বোপরি, প্রমথ চৌধুরির ব্রাইট স্ট্রীটের বাসভবন অর্থাভাবে বিক্রি করতে হয় যা ছিল সবুজ পত্র গোষ্ঠীর আড্ডার ক্ষেত্র। অপরদিকে পত্রিকাটি যেহেতু বিজ্ঞাপন নিত না তাই অর্থকারীও ছিল না। অর্থাৎ মূলত অর্থাভাবের কারণে সবুজপত্র পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন –
“ফর্ম্মা গণনা করে সবুজপত্রের আয়ু নির্ণয় কোরো না। সবুজপত্র বাংলাভাষার মোড় ফিরিয়ে দিয়ে গেল। এ জন্যে যে সাহস যে কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে তার সম্পূর্ণ গৌরব একা প্রমথনাথের।”