দুরাশা : সিপাহি বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে ব‍্যর্থ প্রেমের গল্প

         রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘দুরাশা’ গল্পটি শুরু করেছেন দার্জিলিঙের ক‍্যালকাটা রোডে, মেঘ বৃষ্টিতে দশ দিক আচ্ছন্ন, এক প্রাত:কালে বদ্রাওনের নবাবপুত্রীর সঙ্গে গল্প শ্রোতার সাক্ষাতে। বদ্রাওনের নবাব পুত্রী গল্পের ছলে নিজের জীবন কাহিনি শুনিয়েছেন কথককে। এ দুটি তথ‍্য‌ই আভাস পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের দার্জিলিঙের পথে বেড়িয়ে কুচবিহারের মহারাণীকে বলা গল্পের সঙ্গে।
‘দুরাশা’ গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র দুজন – কেশরীলাল ও বদ্রাওনের নবাবপুত্রী। গল্পের কাহিনিতে বর্ণিত হয়েছে কেশরীলালের ও বদ্রাওনের নবাবপুত্রীর অপরিণত ব‍্যর্থ প্রেম। যে নবাবপুত্রী কেশরীলালের প্রতি আকর্ষণে যুদ্ধের পরিবেশে ভাইয়ের পোশাকে ছদ্মবেশে রাজপ্রসাদ ত‍্যাগ করে, যুদ্ধে মৃত‍্যুমুখে পতিত কেশরীলালের প্রাণ বাঁচালে কেশরীলাল তার পরিচয় জিঞ্জাসা করে। প্রেমাস্পদকে ছদ্মবেশী নবাবপুত্রী নিজের সত‍্য পরিচয় প্রকাশ করলে ব্রাহ্মণ কেশরীলাল তাকে মৃত‍্যুমুখে যবনের হাতে জল খেয়ে ধর্ম নষ্ট হয়েছে বলে কপোলদেশে আঘাত করে প্রত‍্যাখ‍্যান করে। আর প্রত‍্যাখ‍্যাত নবাবপুত্রী তখন হিন্দুধর্মের পায়ে অগ্রসর হয়। অবশেষে যুদ্ধ শেষে দীর্ঘ সময় কেলরীলারের খোঁজে বেরিয়ে তার দেখা পায় ভুটিয়া স্ত্রী ও ছেলে মেয়ের সঙ্গে ভুট্টা শস‍্যের দানা সংগ্রহ করতে। নবাব ব্রাহ্মণ বীর কেশরলালের ভুটিয়া স্ত্রী এই দৃশ‍্য‌ই নবাবপুত্রী হিন্দু ধর্মের পথে চলা এতদিনের সাধনাকে হতাশাব‍্যঞ্জক করে তোলে। তবে এই কি দুরাশা ? রবীন্দ্রনাথ কি কেবল ব‍্যর্থ প্রেমের অতলান্ত বেদনাকে প্রকাশ করলেন ‘দুরাশা’ গল্পে ?

        ১৮৯৮ খ্রি: প্রকাশিত ‘দুরাশা’ গল্পের জন‍্য রবীন্দ্রনাথ প্রেক্ষাপট হিসাবে গ্রহণ করেছেন ১৮৫৭-৫৮খ্রি: অর্থাৎ সিপাহি বিদ্রোহকালীন যুদ্ধ পরিবেশ। একটা ব‍্যর্থ প্রেমের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কেন সিপাহী বিদ্রোহের যুদ্ধবিক্ষুব্ধ পরিবেশকে গ্রহণ করতে হল ?
লক্ষ‍্য করো, ১৮৯৮খ্রি: প্রকাশ পাচ্ছে ‘দুরাশা’ গল্প কিন্তু সেই গল্পের বীজ রবীন্দ্রভাবনায় জন্ম নিচ্ছে আরো দুই বছর আগে – ১৮৯৬খ্রি:, এই সময়েই কবি প্রকাশ করছেন ‘চিত্রা’ আর ‘মালিনী’। কী ছিল সেই কাব‍্যগ্রন্থের দুটো বিষয় ?
         ‘চিত্রা’য় জীবনদেবতার উদ্দেশ‍্যে প্রেমিকের পরানুরুক্তির মধ‍্যেই রবীন্দ্রনাথ নিজের অন্তরঙ্গ স্বধর্মকে উপলব্ধি করেছেন। আর ‘মালিনী’ কাব‍্যনাট‍্যে সুপ্রিয় আচার ধর্মকে প্রত‍্যাখ‍্যান করে মালিনীকে ভালোবেসেই তার প্রেমধর্মকে খুঁজে পেয়েছে। এই নবলব্ধ ধর্মচেতনা সম্পর্কে ২৩৬ সংখ‍্যক ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানান – “আমরা বাইরের শাস্ত্র থেকে যে ধর্ম পাই সে কখনো আমার ধর্ম হয়ে ওঠে না, তার সঙ্গে কেবল এটা অভ‍্যাসের যোগ দৃঢ় হয়ে আসে – যে ধর্ম আমার জীবনের ভেতরে সংসারের দুঃসহতাপে ক্রিস্টলাইজড হয়ে ওঠে সেই আমার যথার্থ।”

১৩২৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন-কার্তিক সবুজ পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত এই চিঠির পরিবর্তিত পাঠ, যেখানে’ধর্মকে নিজের মধ‍্যে উদ্ভূত করে তোলাই মানুষের চিরজীবনের সাধনা।”আমার ধর্ম্ম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –

‘ধর্মকে নিজের মধ‍্যে উদ্ভূত করে তোলাই মানুষের চিরজীবনের সাধনা।’

এই ধর্মভাবনাকেই প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ সেইসময়ের লেখা ‘দুরাশা’ গল্পে, আর তারজন‍্য‌ই আনতে হয়েছে সিপাহি বিদ্রোহকালীন বিক্ষুব্ধ পরিবেশ। আমরা জানি সিপাহি বিদ্রোহের প্রত‍্যক্ষ কারণ ছিল কার্তুজে গোরুর চর্বির সঙ্গে শূকর চর্বি মিশ্রিত থাকার জনশ্রুতি, যার কারণে হিন্দু মুসলিম সেপাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ও অসন্তোষে সম্মিলিত হয়েছিল।

        ‘দুরাশা’ গল্পে যখন ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধল, মুসলমান নবাব যুদ্ধে বিরত থাকলেও হিন্দু বীর কেশরলাল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে কেশরলালের বীরত্বকে মাহাত্ম‍্যজ্ঞাপক করে পরিবেশন করেননি। কারণ রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন সিপাহি বিদ্রোহে হিন্দু মুসলমানের একত্র হ‌ওয়া বীর ধর্ম নয়, জাতীয়তাবোধ নয়, তা আসলে সংকীর্ণ আচার সর্বস্বতা ; ধর্মীয় আচার ধর্মের আঘাতের কারণে তারা সিপাহি বিদ্রোহে উত্তেজিত হয়েছিল। তাই ‘দুরাশা’ গল্পে কেশরলাল যে আচার ধর্মের নিষ্ঠায় ব্রাহ্মণ থেকে ক্ষাত্রধর্মে বীরত্ব প্রকাশ করেছিল সেই আচার ধর্ম স্খলিত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণ কেশরলাল কৃষিজীবী বৈশ‍্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তার আচারধর্ম স্খালন হল কোথায় ?

         বদ্রাওনের রণক্ষেত্রে নবাবপুত্রীই যে মৃত‍্যু পথযাত্রী কেশরলালের মুখে জল দিয়ে ধর্ম নষ্ট করেছিলেন। এ থেকে এটা মনে করাই যেতে পারে, যে কেশরলাল যুদ্ধে এবং নানা জায়গায় প্রাণভয়ে ঘুরে বেড়িয়ে বিজাতির সংস্রবে নিজের ধর্ম খোয়াচ্ছিলেন তার সূত্রপাত নবাবপুত্রীর হাতে ভেবে নিজের ধর্ম খোয়াচ্ছিলেন তার সূত্রপাত নবাব পুত্রীর হাতে ভেবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করেছিলেন নিজের কাছে। তাই পরবর্তীতে ভুটিয়া স্ত্রীকে গ্রহণ করতে কেশরলালের কোনো বাধা ছিলনা। গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন কেশরলালের ধর্মবিশ্বাস আসলে প্রচারসর্বস্বতা।

        অপরদিকে, নবাবপুত্রীর কাছে প্রাধান‍্য পেয়েছিল প্রেমধর্ম, তার মতে হিন্দুশাস্ত্রে যেমন জ্ঞান ও তপস‍্যা দ্বারা শূদ্র ব্রাহ্মণ হতে পারে, তেমনি সে সময় যদি মুসলমান‌ও থাকত তাদের কথাও শূদ্রদের সঙ্গে লেখা থাকত। তাই তিনি যোগিণী সেজে কাশীর শিবানন্দ স্বামীকে পিতৃ সম্বোধন করে সংস্কৃত শাস্ত্র অধ‍্যয়ন করতে লাগলেন এবং ব্রাহ্মণ হয়ে উঠলেন দীর্ঘ তিরিশ বছরের সাধনায়। এরপর আরো আট বছর পর তিপ্পান্ন বছর বয়সে নবাবপুত্রী যার জন‍্য এত সাধনা করলেন তাকে পেলেন ভুটিয়া স্ত্রীর পাশে কৃষিকাজে।

        তাই ‘দুরাশা’ গল্পের শেষে নবাবপুত্রী বলছেন যে, ব্রাহ্মণ‍্য আমার কিশোর হৃদয় হরণ করিয়া ল‌ইয়াছিল, আমি কি জানিতাম তাহা অভ‍্যাস তাহা সংস্কারমাত্র। আমি জানিতাম তাহা আদি অনন্ত। অর্থাৎ কেশরলালের ধর্মের নামে আচারসর্বস্বতা তার জীবনকে অনুজ্জ্বল পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে, অপরদিকে সেই ভয়ানক ভ্রান্ত নবাবপুত্রীকেও ঠেলে দিয়েছে বেদনার্ত জীবনে। এবং শেষে শ্রোতাকে নবাবপুত্রী বলেছেন “নমস্কার বাবুজী।” পরেই নিজের ভুল সংশোধন করে বলেছেন – “সেলাম বাবুসাহেব” – এ আসলে প্রেমের নৈবেদ‍্য রূপে সুদীর্ঘ সাধনায় হিন্দুধর্মকে আয়ত্ত করার ফল এবং অবশেষে প্রচন্ড আঘাতের পর দীর্ঘলালিত মোহাবেশ থেকে জেগে ওঠে অবলম্বন করতে চাইছেন নিজের আত্মপরিচয়ে, মুসলমান পরিচয়ে।
অর্থাৎ সামগ্রিক আলোচনার নিরীখে বলা যায়, ‘দুরাশা’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথাজীর্ণ রীতির স্বরূপকে প্রকাশ করেছেন।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার –
রবীন্দ্র ছোটগল্পের শিল্পরূপ – তপব্রত ঘোষ