ছোটগল্পকার মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

        ছোটগল্পের কোনো দেশী বিদেশী সংজ্ঞায় তাঁর আস্থা নেই, কুড়িটি গল্পসংগ্রহে সংকলিত ২২২টি গল্প এবং এ যাবৎ অগ্রন্থিত প্রায় ৫০টি গল্পের মধ‍্যে নেই কোনো কালানুক্রমিক বিবর্তনের ইতিহাস। তিনি এক‌ইকালে লিখতে পারেন ‘অতসীমামী’র মতো শরৎচন্দ্র প্রভাবিত আটপৌরে গল্প এবং ‘আত্মহত‍্যার অধিকারের মতো ভিত কাঁপানো গল্প। এমনকি এই পরস্পর বিরোধী গল্পগুলিকে এক‌ই মলাটের অন্তর্ভূক্ত করতেও দ্বিধান্বিত হননি। এমনভাবেই অবস্থান লক্ষ করা যায় ‘সরীসৃপ’, ‘নদীর বিদ্রোহ’, ‘দুঃশাসনীয়’ প্রভৃতির পাশে ‘নেড়ী’, ‘হারানের নাতজামাই’ প্রভৃতির সঙ্গে ‘ভালোবাসা’, ‘হ‍্যাংলা’ ইত‍্যাদি গল্পগুলি।তিনিই মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। এবং এর পরেও ড. নিতাই বসুর সংযোজন – “উপন‍্যাসের চেয়ে ছোটগল্পে মানিক অনেক বেশি বেপরোয়া, উদ্ধত এবং স্পষ্ট”।

        মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের উপন‍্যাসগুলি নানা কাহিনি সমবায়ে গ্রথিত, যেমন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন‍্যাস থেকে পাই কুমুদ-মতির আখ‍্যান, বিন্দুর গল্প, যাদ পন্ডিতের আখ‍্যান ইত‍্যাদি একাধিক কাহিনি। শেষ পর্যায়ের উপন‍্যাসে এই প্রবণতা আরো স্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় নিজেই বলেছেন – 

“প্রত‍্যেক উপন‍্যাসেই একাধিক গল্পের উপাদান এবং সংকেত কম বেশি থাকে।” 

অর্থাৎ উপন‍্যাসের বৃহৎ প্রেক্ষাপট থেকেই মানিক তাঁর অনেক ছোটগল্পের উপাদান সংগ্রহ করেছেন। ‘সার্বজনীন’, ‘আরোগ‍্য’, ‘পাশাপাশি’, ‘হলুদ নদী সবুজ বন’ ইত‍্যাদি এই প্রসঙ্গের সাক্ষ‍্য বহন করেছে। 

          শুধু তাই নয়, এর বিপরীত পদ্ধতিও লক্ষ‍্য করা গেছে। অর্থাৎ কোনো একটি গল্প লেখার পর তার মধ‍্যে উপন‍্যাসের সম্ভাবনা পেয়ে বনস্পতির আকার নিয়েছে। আবার অসংখ‍্য এমন গল্প আছে যা কোনো অর্থেই গল্প নয়। সেগুলো তাত্ত্বিক প্রবন্ধমূলক নতুবা আত্মজৈবনিক টুকরো কাহিনি। কিংবা সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের দলিলের ছেঁড়াপাতা। প্রথম থেকেই ছোটগল্পের সুনির্দিষ্ট রীতি তাঁর কাছে গ্রহণীয় হয়নি। পরবর্তীকালে আরো বেপরোয়া, ছোটগল্পগুলির নাম হয়ে যায় – ‘গলায় দড়ি কেন’, ‘মরব না সস্তায়, ছিনিয়ে খায়নি কেন, ‘আর না কান্না’ ইত‍্যাদি। অর্থাৎ সহজেই স্পষ্ট এ গল্প হৃদয় ভোলানো নয়, মস্তিষ্কে আগুন জ্বালায় এ গল্প। মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা জুড়ে ছিল নিম্নশ্রেণীর শ্রমিক কৃষক থেকে মধ‍্যবিত্ত মানুষ তাদের স্খলন পতন বা সাহসিকতা শৌর্য এবং সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে। এদের কথাই সম্পূর্ণ মৌলিকভাবে রূপায়িত করেছেন মানিক। তাই ছোটগল্প রচনায় তাঁর কোনো পূর্বসুরী নেই, যথার্থ উত্তরসূরীও আছে কিনা তা বিচার্যের বিষয়। 

        এতক্ষণ আলোচনা করলাম মূলত মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের ছোটগল্পের আঙ্গিক বিষয়ে। এবার আসি বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে – 

মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের মনোভূমিতে আমৃত‍্যু বিচরণ করেছেন দু’জন – ফ্রয়েড ও মার্কস। কখনো এককভাবে কখনো বা সম্মিলিতভাবে দুজনে। তাই মানিকের জীবনদৃষ্টি ও অন্তর্লোকের বিবর্তনের সঙ্গে ছোটগল্পের ধারণাটিকে সমান্তরালভাবে রেখে দুটি মাত্রা নির্ণয় করা যায় – 

১. মধ‍্যবিত্ত নরনারীর জটিল মনস্তত্ত্ব – ব‍্যক্তিকেন্দ্রিক ধারা

২. আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নরনারীর জীবন সংগ্রাম – সমাজকেন্দ্রিক ধারা

 মধ‍্যবিত্ত নরনারীর জটিল মনস্তত্ত্ব 

যুদ্ধোত্তর বাংলা কথাসাহিত‍্যের প্রধান উপজীব‍্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় অর্থনৈতিক ভাঙনের প্রেক্ষাপটে চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক পর্যালোচনা। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ও জগদীশ গুপ্তের গল্পে এবং কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের কথাসাহিত‍্যে এই ভাঙনের ছবি বিচিত্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এরপর মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় সেই বিচিত্র ছবিতে যোগ করলেন জটিল ও কৌণিক মাত্রা এবং তা মূলত নির্মোহ মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের বিজ্ঞান মনস্কতাকে কেন্দ্র করে প্রতিভাত হয়েছে। মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের লেখনীতে যে বিজ্ঞান মনস্কতা প্রকাশ পেয়েছে তা মূলত ফ্রয়েডীয় দৃষ্টিভঙ্গীর ফসল। বস্তুত মধ‍্যবিত্ত জীবনযাত্রাকে আশ্রয় করেই মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানে অনুপ্রাণিত হয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে চরিত্রগুলির বিশ্লেষণ করেছেন। ‘অতসীমামী’, ‘সরীসৃপ’, ‘বিপত্মীক’, ‘সিঁড়ি’, ‘টিকটিকি’, ‘প্রাগৈতিহাসিক’, কিংবা বৌ পর্যায়ের গল্পগুলি এই পর্বের অন্তর্ভূক্ত। এর মধ‍্যে ‘সরীসৃপ’, ‘প্রাগৈতিহাসিক’, এবং ‘কুষ্ঠরোগীর বৌ’ – এই তিনটি গল্পের বিশ্লেষণের মধ‍্য দিয়ে এই পর্বটা আলোচনা করা যাক। 

            আধুনিক সভ‍্যতার আড়ালে মধ‍্যবিত্ত চরিত্রের যে বিকৃতি ঘটেছে তাকেই বিশ্লেষণ করেছেন ‘সরীসৃপ’ গল্পে। চারু-বনমালী-পরী – এই তিনটি মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা বা স্বার্থপরতার স্বরূপ উন্মোচনের কাহিনি মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের এই ‘সরীসৃপ’ গল্প। চারুর বিকৃত মস্তিস্ক স্বামী ও মনোরোগী পুত্র ভুবনের মাঝখানে তার সৌন্দর্য ও যৌবন নিতান্ত‌ই মূল‍্যহীন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বনমালী সে বুভুক্ষু যৌবনের পাহারাদারমাত্র। বনমালীর হৃদয়ে যখন প্রেম বিকশিত হতে চেয়েছে চারু তাকে আশা দিয়েছে মাত্র, পূরণ করেনি। বনমালী উপলব্ধি করেছে এই ব‍্যবধান অর্থবৈষম‍্য। কিন্তু অবস্থা ও সময়ের পরিবর্তনে মধ‍্যবয়সী বিধবা চারুর আশ্রয়দাতার গৌরব অর্জন করেছে পাটের দালাল বনমালী। 

“চারুর মাথার চুলের কালিমা ফ‍্যাকাসে হ‌ইয়া আসিয়াছে কেবল এইটুকু লক্ষ‍্য করিয়া আবার সে আহারে মন দিল” – লেখকের এই বর্ণনা স্পষ্ট করে চারুর প্রৌঢ়ত্ব এবং বনমালী ও চারুর সম্পর্কের দূরত্ব। এই সূত্র ধরে চারুর ছোট বোন পরী বৈধব‍্যের পর অবিবাহিত বনমালী এক ক্লেদকুটিল খেলায় মত্ত হয়েছে। পরী যৌবনচ্ছ্বসিত শরীরের বিনিময়ে বনমালীকে কুক্ষিগত করতে চায়, নিশ্চিত ও নিরাপদ করতে চায় নিজের‌ও সন্তানের ভবিষ‍্যৎ। ফলে চারুর প্রতি দেখা দিল বনমালীর বিমুখতা ও ঔদাসীন‍্য। নিজের এবং তার মানসিক বিকৃতগ্রস্ত সন্তানের ভবিষ‍্যতের অনিশ্চয়তা চারুকে বোন পরীর সঙ্গে ঘৃণ‍্য প্রতিযোগিতায় নামাল। অর্থনীতি হয়ে উঠল সম্পর্কের নিয়ামক, মানুষের চিন্তা চেতনার মূল‍্যবোধের নিয়ামক। কলেরা রোগীর ভেদবমির পাত্রে পরীকে তার কোহলের নির্মাল‍্য দিল যাতে কলেরায় পরীর মৃত‍্যু হয়। কিন্তু ভাগ‍্যের পরিহাস চারু নিজেই এই রোগের কবলে পড়ে মারা গেল। তখন বনমালীর স্নেহ মানসিক রোগী ভুবনের প্রতি পড়ে, আর এক‌ইভাবে বনমালীর ঔদাসীন‍্য হয় পরীর প্রতি। কেননা 

“অবস্থাকে অতিক্রম করে যাওয়া বনমালীর চিরদিনের স্বভাব।”

 কিন্তু পরী সহ‍্য করতে না পেরে ভুবনকে গাড়ীতে তুলে পাঠিয়ে দেয় অজানা ভবিষ‍্যতের দিকে। নিরুদ্দেশ হবার কথা জেনে বনমালীর স্পষ্টোক্তি – “আপদ গেছে যাক”।

আর নির্বিকার চিত্তে পরীকে নামিয়ে দেয় নীচে ঝি চাকরের চেয়েও অধম অনুগৃহীতাদের মধ‍্যে। স্বার্থপর, আত্মসর্বস্ব মতলববাজ বনমালীকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগী দুই বোনের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষিত হয়েছে। 

চারু-বনমালী-পরী সকলের মধ‍্যেই ধরা পড়েছে সরীসৃপের নিঃশব্দ হিংস্র কুটিল ধর্ম। এই ধর্মের বহি:প্রকাশ যতটা না যৌন প্রবৃত্তি, তার থেকেও বেশি অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা লাভের আকাঙ্ক্ষা। মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় এই গল্পের অনুষঙ্গে আমাদের দেখিয়েছেন এই আধুনিক সমাজ সভ‍্যতার আড়ালে কত বিষাক্ত কুটিল সরীসৃপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষের চাহিদা মৌলিক, সরীসৃপ তথা পশুদের চাহিদ মূলত জৈবিক। মানুষের মানসিক চাহিদা থাকে যা সভ‍্যতাকে সংস্কৃত করে, পশুর তা থাকে না। কিন্তু পশুর জগৎ স্বতঃস্ফূর্ত, সে আক্রমণ করে খাদ‍্যের জন‍্য সরাসরি, মানুষের জগৎ কৃত্রিম। এখানেও গল্পের চরিত্রগুলি যৌন বিকৃতগ্রস্ত, তাদের চাহিদা পূরণের পথে তারা নির্মম, কঠোর হয়ে উঠেছে। আবার, এরা কেউই কাউকে সরাসরি আক্রমণ করেনি, চারু পরীকে কলেরায় মারতে চেয়েছে, ভুবনকে পরী পাঠিয়েছে অজানা ভবিষ‍্যতের দিকে, আর বনমালী পরীকে নামিয়েছে অনুগৃহীতাদের দলে এবং নিরুদ্দেশ ভুবন সম্পর্কে নিস্পৃহ থেকেছে। সাপ তথা সরীসৃপ যেমন বিষ থাকুক না থাকুক আক্রমণ করতে উদ‍্যত হয়, গল্পের চরিত্রগুলিও তাই, ব‍্যক্তিত্বহীন, সহানুভূতিহীন, অমানবিক সর্পিল স্বভাব সম্পন্ন। কেবল চারু-পরী-বনমালী নয়, রামতারণের ছোট উপস্থাপনে লেখক তাকে এদের সমগোত্রীয় করে প্রকাশ করেছেন। কেবলমাত্র ব‍্যতিক্রম ভুবন, যার মানবিক বিকাশ ঘটেনি, শরিক হতে পারেনি আধুনিক সভ‍্যতার। তাই তার মধ‍্যেও প্রকাশ পায়নি এই সরীসৃপবৃত্তি।

         ‘সরীসৃপ’ গল্পে প্রকাশিত এই জৈবকামনা কেবল মধ‍্যবিত্ত জীবনে প্রতিফলিত হয়নি, ‘সভ‍্যতার পালিশ করা জীবন ও জগতের বাইরে একেবারে নিচুতলার মানুষের জীবনেও প্রবাহিত। তবে সেখানে মধ‍্যবিত্তের ভন্ডামি নেই, সেখানে সকল জৈব বৃত্তিই বলিষ্ঠ ঋজুতায় দৃশ‍্যমান, প্রত‍্যক্ষ। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে জীবন বাস্তবতা দ্বিস্তরীয় – একদিকে ভিক্ষাজীবী শ্রেণির নরনারীর সমাজ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ফুটেছে আশ্চর্য সজীবতায়, অন‍্যদিকে উদঘাটিত হয়েছে মানুষের অন্তর্নিহিত আদিম সত্তার চিরন্তন ভয়ংকর সত‍্যরূপ। উদরের ক্ষুধা ও যৌন ক্ষুধা যেখানে মানুষকে প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে অন‍্য কোনো মহত্তর মূল‍্যবোধের প্রয়োজন কতটুকু – অস্তিত্বের এই নিদারুণ কঠিন প্রশ্নটাই মানিক রেখেছেন এই গল্পে। আর সেই সঙ্গে ব‍্যক্ত হয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার জন‍্য মরীয়া মানুষের প্রবলতম জীবন পিপাসা – “মরিবে না সে কিছুতেই মরিবে না। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না, সেই অবস্থায় মানুষ যে বাঁচবেই।”

অধ‍্যাপক গোপিকানাথ রায়চৌধুরীর মতে, 

“লেখকের (মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়) অসংশায়িত শিল্প সাফল‍্য এখানে যে তিনি ভিক্ষুক সমস‍্যার মতো একটি পরিচিত সামাজিক সমস‍্যার সঙ্গে সমাজ বহির্ভূত আদিম জৈবকামনার ‘প্রাগৈতিহাসিক’ এক প্রবণতাকে এক‌ই কাহিনী ও চরিত্র সূত্রে গ্রথিত করতে পেরেছেন।”

        মধ‍্যবিত্ত এবং নিম্নমধ‍্যবিত্ত জীবনের ভন্ডামি এবং আত্মপ্রবঞ্চনার পাশাপাশি মধ‍্যবিত্তের করুণ প্রেমচেতনাও প্রকাশ পেয়েছে অতসীমামী, ‘বিপত্মীক’ কিংবা বৌ পর্যায়ের গল্পগুলিতে। তবে এর প্রধান অবলম্বন মানসিক বিকার ও অর্থনৈতিক সংকটের সমান্তরাল প্রবাহ। এই উভয়ের টানা পোড়েনে প্রেম চেতনা লুপ্ত, দম্পতিরা ক্লান্ত, বিষণ্ণ অসুস্থ। ‘কুষ্ঠরোগীর বৌ’ গল্পে মহাশ্বেতা ও যতীনের বিবাহিত জীবনের চারটি বসন্ত ভরে ছিল ফুলে ফুলে। বসন্ত অতিক্রম করে তারা আজ এসে দাঁড়িয়েছে বৈশাখের তপ্ত দিনে। যতীনের স্বামীত্বের দাবী কাছে পরাজয় স্বীকার করে মহাশ্বেতা ‘কল বনিয়া যাওয়া’ মানুষে পরিণত হয়েছে। কেবলমাত্র যতীনের পরিবর্তনশীল ইচ্ছাকে সে অক্লান্ত তৎপরতার সহিত তৃপ্ত করিয়া চলে।” তাদের জীবনের যে সমবেত গতি ছিল তা রুদ্ধ হয়ে গেছে, স্বামীর সহচর্য তার হৃদয়ে হিল্লোল জাগায় না, বৈশাখী রোদের ঝাঁঝে তার ঘর্মাক্ত দেহ জ্বালা করলেও সে উঠে যায় না –

“জ‍্যোতির্ময়ী পবিত্রতার মত স্বামীর কাছে বসিয়া ঝিমায়।” 

এই নবতর সম্পর্কে মহাশ্বেতা স্ত্রী থেকে পৌঁছেছে সেবিকার ভূমিকায়। আর ‘সংকীর্ণ কারাগারে নিজের বিষাক্ত চিন্তার সঙ্গে দিবারাত্রি আবদ্ধ’ থেকে যতীনের মনুষ‍্যত্ব হয়ে উঠেছে ভঙ্গুর। অন্তর – বাহিরের কদর্যতা ‘মুহ‍্যমান মহাশ্বেতার’ মনকে সুদূরে নিক্ষেপ করেছে। মহাশ্বেতার নির্বাক ও নির্বিকার আত্মসমর্পণ যতীনের কাছে প্রতিভাত হয়েছে ঘৃণার অস্বাভাবিক প্রকাশরূপে। আর অনাগত সন্তানের ভয়ঙ্কর ভবিষ‍্যৎ কল্পনা করে মহাশ্বেতা নিজের হাতে সেই অঙ্কুরকে বিনষ্ট করলে – এই ঘটনা সন্দিহান যতীনের মনে ধনাত্মক অনুঘটকের কাজ করেছে। ক্ষিপ্ত যতীন তার রোগ মহাশ্বেতার মধ‍্যে সংক্রমিত করতে চেয়েছে, যতীনের এই নীচতা মহাশ্বেতার মধ‍্যে আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি জাগিয়ে তুলেছে। রোগাক্লান্ত কদর্য যতীনের যন্ত্রণাদগ্ধ অন্তরের গূঢ়চারী প্রবৃত্তিটাকেও লেখক সহানুভূতিতে সিঞ্চিত করেছেন। আসলে, বিশশতকের প্রথমার্ধের বাঙালি জীবন লেখক এখানে তুলেছেন। সেখানে যতীন মহাশ্বেতার দাম্পত‍্যে অনুভূতির গভীরতা ততটা ছিল না, তারা ছিল রূপজ মোহে আবিষ্ট। তাদের সম্পর্কের দ্বিতীয় ছিদ্র রূপে কাজ করেছে দাম্পত‍্য যোজক তথা সন্তানের অনুপস্থিতি। অনাগ সন্তানের ভয়ঙ্কর ভবিষ‍্যৎ ভেবে মহাশ্বেতা তার অঙ্কুরের বিনষ্টি করে দিলে তাদের সম্পর্কের দূরত্ব আর‌ও বেড়ে যায়। আর এইসব ঘটনায় অনুঘটক হয়েছে বিশ শতকের অসুস্থ বাঙালি জীবনের প্রতিভূ যতীনের শারীরিক ও মানসিক বিকার। কুষ্ঠ আক্রান্ত যতীনের নীচতা, ক্রুরতা, সন্দেহপ্রবণ মানসিকতা মহাশ্বেতার মধ‍্যে আত্মরক্ষা এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রবৃত্তি জাগিয়ে তুলেছে। তাই মহাশ্বেতা একদিন যে পথের কুষ্ঠরোগীদের ঘৃণা করত আজ তাদের ভালোবাসে। একদিন সে যে সুস্থ সুদর্শন যতীনকে ভালোবেসেছিল সেই বোধ থেকেই আজ সে কুষ্ঠরোগীদের সেবা করে। ফ্রয়েডের কথায় – মানুষের মুক্তি মহত্তর জগতের সন্ধানে, ইদ থেকে অহংএর পথে, তাই সে আর্ত মানুষের সেবার মধ‍্যে নিজেকে নিয়োজিত করে বাঁচার রসদ খুঁজেছে। আর যতীনের রূপজ মানসিক বিকৃতি যতীনের প্রতি তার ভালোবাসার বিনষ্টি ঘটিয়েছে। এর কারণ হিসাবে মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় বলছেন – 

“মহাশ্বেতা দেবী তো নয় ? সে শুধু কুষ্ঠরোগীর বৌ।”

হিন্দু নারীর পাতিব্রত‍্যের বিজ্ঞাপন খসিয়ে মানিক ‘বৃহত্তর ও মহত্তর’ গল্পের মমতাকে দিয়ে নির্দ্বিধায় বলিয়েছেন – 

“স্বামী আমার কাছে ছোট নয় – তুচ্ছ নয় – কিন্তু পর। সব স্বামীই পর – নিজের চেয়ে মানুষের আপনার কেউ নয়, প্রেমে নয়, স্নেহে নয়। প্রেম দুটি আত্মাকে কাছে আনে, কিন্তু আত্মগত আত্মার চেয়ে কাছে আসা আত্মার দূরত্ব বেশি।” 

দাম্পত‍্য সম্পর্ক কিংবা নরনারীর প্রেমের সম্পর্কে মাধুর্যের পরিবর্তে অন্তর্নিহিত অন্ত:সারশূন‍্যতার তির্যক বিশ্লেষণেই মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের বিশিষ্টতা। এক্ষেত্রে তিনি কখন‌ও ফ্রয়েডকে আশ্রয় করেছেন কখনো বা মার্কসকে। এবং এ সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত খুব স্পষ্ট – 

“এ জগতে সব‌ই যখন ভঙ্গুর, মনুষ‍্যত্বের ভঙ্গুরতায় বিস্মিত হ‌ওয়ার কিছু নাই। মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বভাব‌ও ভাঙে গড়ে।” (কুষ্ঠরোগীর বৌ)

আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নরনারীর জীবন সংগ্রাম  

         জীবনের একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত মানিক গভীরভাবে ফ্রয়েডে আচ্ছন্ন থাকলেও তাঁর বৈজ্ঞানিক মন, সমাজসচেতন ও ইতিহাস চেতনা তাঁকে মার্কসের সন্ধান দেয়। তিনি উপলব্ধি করলেন মানুষ তাঁর প্রত‍্যয়-সংশয়, আনন্দ বেদনা নিয়ে কালের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ ও সংগ্রামের ঘাতপ্রতিঘাতের সঙ্গে একত্রে গ্রথিত। এই ভাবনা থেকেই দ্বিতীয় পর্বের গল্পগুলিতে এসেছে সমাজ সচেতনতা, অর্থনৈতিক শোষণ ও সংগ্রামের চেতনা। ‘আত্মহত‍্যার অধিকার’, ‘টিচার’, ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’, ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’, ‘হারানের নাতজামাই’, ‘দুঃশাসনীয়’ ইত‍্যাদি গল্পগুলি এই চেতনার‌ই ফসল। 

          মার্কসবাদে দীক্ষিত হ‌ওয়ার পর তাই তিনি কলম ধরেছিলেন শোষিত বিপর্যস্ত অবহেলিত নিম্নমধ‍্যবিত্ত মানুষের কাহিনি রচনায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তর-কালোবাজারির সমন্বয়ে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক জীবনে যে চূড়ান্ত অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল তার‌ই পটভূমিকায় মানিক রচনা করেছেন ‘দুঃশাসনীয়’ গল্পটি। যুদ্ধের সময়কালে সাম্রাজ‍্যবাদী শাসক শ্রেণি যুদ্ধের জন‍্য অকাতরে অর্থ ব‍্যয় করলেও মন্বন্তর পীড়িত গ্রাম বাংলার দিকে ফিরেও তাকায়নি। ফলে সর্বত্র দেখা যায় ব‍্যাপক দূর্নীতি, শোষণ আর কালোবাজারি। রেশনিং ব‍্যবস্থা চালু হলেও পয়সাওয়ালা ধান্দাবাজ লোকেরা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে অশুভ আঁতাত করে খাদ‍্যদ্রব‍্য , বস্ত্র সবকিছুই গুদামজাত করে ফেলে। প্রথমে শুরু হয় খাদ‍্যসংকট তারপর বস্ত্র সংকট। 

বিদেশী সরকারের শোষণে নয়, স্বদেশের সরকারী শাসনে গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষ অবর্ণনীয় খাদ‍্য ও বস্ত্র সংকটের মধ‍্যে দিননিপাত করছে। একদিকে ‘ঘোষবাবুর বাড়ির মেয়েরা এবেলা ওবেলা রঙিন শাড়ি বদলে নিয়ে পড়ে’, ‘আজিজ সাহেবের বাড়ির মেয়েরা চুমকি বসানো হালকা শাড়ীর তলায় মোটা আবরণ পায়,’ আর অন‍্যদিকে পাঁচী, মানদা রাবেয়া আমিনাকে নিয়ে হাতিপুর পরিণত হয়েছে উলঙ্গ হাতিপুরে। গ্রামের সমস্ত নারীরাই প্রায় বিবস্ত্রা, নারীর কায়া যেন ছায়ায় পরিণত হয়েছে – 

“কোনো ছায়ার গায়ে লটকানো থাকে একফালি ন‍্যাকড়া…কোনো ছায়াকে ঘিরে থাকে শুধু সীমাহীন রাত্রির আঁধার, কুরুসভায় দ্রৌপদীর অন্তহীন অবর্ণনীয় রূপক বস্ত্রের মতো।”

বিশ শতকের মধ‍্যভাগে বসে বস্ত্রসংকটের মর্মন্তূদ চিত্রটিকে উপস্থাপিত করেছেন মহাভারতের কুরুর রাজসভায়। কুরুসভায় দুঃশাসন কর্তৃক দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা মনের গভীর থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে surface এ আধুনিক জীবনসত‍্যে সমান্তরালতা পেয়েছে। মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেছিল দুঃশাসন আর একালে আধুনিক ভারতে মুনাফা লোভীদের দুঃশাসনের ফলে একক দ্রৌপদীর লাঞ্ছিত সত্তা অনুভূত হয়েছে হাতিপুর গ্রামের সমস্ত নারীর মধ‍্যে। সে যুগে দ্রৌপদীকে অবমাননা থেকে রক্ষা করেছিল কৃষ্ণ, ঘনশ‍্যাম। এ যুগে কৃষ্ণ নেই, নারী তাই তার অবমাননা রুখতে পারে না, সে আশ্রয় নেয় অন্ধকারের কোলে। মানিক এখানে ঘনশ‍্যাম তথা কালো অন্ধকারের রূপক হিসাবে কৃষ্ণকে উপস্থাপিত করেন। দ্রৌপদীর পক্ষে অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব হয়েছিল – শত্রুর বুকের রক্তপান করেছিল স্বামী। কিন্তু একালের স্বামীদের পক্ষে স্ত্রীদের চূড়ান্ত অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব নয়, তাই একালে রাবেয়ার মতো দ্রৌপদীদের আশ্রয় নিতে হয় পুকুরের জলে নীচে, আত্মহত‍্যা ছাড়া তাদের গত‍্যান্তর নেই। তখন রাবেয়ার মৃত‍্যু কেবল ব‍্যক্তি ট্রাজেডির সীমায় আবদ্ধ থাকে না, সাম‍্যের ট্রাজেডি, দেশগত ট্রাজেডিতে পর্যবসিত হয়। কেননা ত‍ৎকালীন মেয়েদের লজ্জা নিবারণের জন‍্য রাবেয়ারই পথ অনুসরণ করতে হয়। তাই রাবেয়ার মৃত‍্যু কোনো ব‍্যক্তিবিশেষের মৃত‍্যু নয়, এ যেন সমাজের ভয়ংকর পরিণামকে নির্দেশ করে। এ প্রসঙ্গে অধ‍্যাপক বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্য বলেছেন –

“অভিমানী রাবেয়ার আত্মহত‍্যা কেবল আনোয়ারের ব‍্যর্থ পৌরুষের প্রতি ধিক্কার‌ই নয়, তার আত্মহত‍্যা এই হৃদয়হীন সমাজের প্রতি তীব্র অভিযোগের অঙ্গুলি তুলে ধরেছে।”

ভারতচন্দ্র দেখিয়েছেন যে সমাজ মানুষের খাবার দিতে পারে না, লজ্জা নিবারণের কাপড় দিতে পারে না, সেই সমাজ‌ই তার অসহায়তাকে ব‍্যঙ্গ করে। মানিক‌ও সেই পটভূমিই উপস্থাপিত করেছেন আলোচ‍্য গল্পে। ‘রাঘব মালাকার’ গল্পে উপক্রমণিকায় পৌরাণিক প্রসঙ্গ অবতারণা করে মানিক বলেছেন – 

“পুরাণে বলে একদা নবরূপী ভগবান স্নানরতা গোপিনীদের অপহরণ করে তাদের অন্তর পরীক্ষা করেছিলেন – বহুকাল পরে আবার তিনি এবার অদৃশ‍্য থেকে তাঁর প্রতিনিধিদের নিয়ে সমগ্র বাংলাদেশের নরনারীদের বস্ত্র অপহরণ করে নিয়ে কি পরীক্ষা করে দেখছেন তিনিই জানেন।”

‘দুঃশাসনীয়’ গল্পে গ্রামবাংলার ভয়াবহ বস্ত্র সংকট ঘনীভূত হয়েছে একটি মাত্র শব্দে, ‘ছায়া’ শব্দের পুনঃপুনঃ প্রয়োগে নিদারুণ বস্ত্রসংকটের সঙ্গে রহস‍্যময় বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে। এই দারিদ্রলাঞ্ছিত দুর্ভিক্ষ পীড়িত গ্রাম বাংলার করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘১৯৪৬-৪৭’ শীর্ষক কবিতায় – 

“বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল।/

সূর্য অস্তে চলে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার

খোঁপা বেঁধে নিতে আসে – কিন্তু কার হাতে ?”

দেশের শাসক ও দেশীয় শোষক – উভয়ের সম্মিলিত অত‍্যাচারে জর্জরিত দেশবাসীর বিপন্ন মানসিকতা এবং সেই সংকট থেকে মুক্তির খোঁজে মানুষের সংগ্রামী মনোভাব – মানিকের ছোটগল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে ধরা পড়ে। এই প্রসঙ্গে লেখা গল্পগুলির মধ‍্যে উল্লেখযোগ‍্য হল ‘ছোটবকুলপুরের যাত্রী’।

‘ছোটবকুলপুরের যাত্রী’ গল্পটি মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ১৯৪৮-৪৯ সালের বাংলার তেভাগা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লিখেছেন। তেভাগা আন্দোলন বা কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় গ্রামে গঞ্জে অবর্ণনীয় পুলিশি সন্ত্রাস। এই পরিস্থিতির মধ‍্যে পড়ে লক্ষ লক্ষ দেশবাসীকে কীভাবে অকথ‍্য নির্যাতন সহ‍্য করতে হয় তার‌ই ছবি তুলে ধরেছেন দিবাকর ও আন্না দুটি চরিত্রের মধ‍্য দিয়ে। শুধু তাই নয় দিবাকর ও আন্নার মতো সাধারণ মানুষের ছোট বকুলপুরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা সাসপেন্স তৈরি করে কাহিনিকে নিপুণ কুশলতার সঙ্গে অন‍্য মাত্রা দান করেছেন মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। ড. সরোজমোহন মিত্রর মতে এই ধরণের কৃষকদের দমন পীড়ন মূলক ঘটনা মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার ফসল। তিনি এও জানান যে ছোটবকুলপুরের ঘটনা আসলে মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের কমলাপুরের অভিজ্ঞতা, তবে মানিকের প্রত‍্যক্ষ অভিজ্ঞতা কমলাপুরের কি অন‍্য স্থানের তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে সমগ্র পরিস্থিতির বর্ণনায় মানিক শৈল্পিক পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে গোপিকানাথ রায়চৌধুরী বলেছেন, 

“সন্ত্রাসের শিহরণ জাগানো থমথমে আবহাওয়া, বিক্ষুব্ধ প্রেক্ষাপট, অস্থির সময় সব মিলিয়ে এক আসন্ন দিন বদলের অশনি সংকেতের গূঢ় ইঙ্গিত দিয়েছেন। সমগ্র গল্পটিতে আপাততুচ্ছ বর্ণবিরল ব‍্যঙ্গাশ্রয়ী এক কাহিনীয় আবরণের অন্তরালে নিহিত বজ্রগর্ভ মেঘের ইঙ্গিতময়তা গল্পটিতে এক অনন‍্য শিল্প গৌরব এনে দিয়েছে।”

গণজাগরণের ঐক‍্যবদ্ধ শক্তিতে উৎপীড়িত মানুষের প্রতিবাদ প্রবল হয়ে উঠে। যদিও এই সংগ্রাম সফল হয়না, দূর্বলের ঐক‍্যকে নতিস্বীকার করতে হয় সবলের দম্ভের কাছে তবুও তার মূল‍্য থেকে যায় সংঘবদ্ধ মানব সমাজের অভ‍্যুদয় হিসাবে। সাধারণ মানুষের বর্তমানের সংগ্রাম ও আগামীর স্বপ্ন সফলের ছোট পদক্ষেপ হিসাবে। এই ভাবনায় মানিকের অপর একটি উল্লেখযোগ‍্য হল মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের ‘হারানের নাতজামাই’ গল্পটি। গ্রামীণ কৃষিজীবী পরিবারের সাধারণ গৃহবধূর উজ্জীবিত চেতনার ছবি একেঁছেন গল্পের মধ‍্য দিয়ে মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। কৃষক আন্দোলনের অন‍্যতম নেতা ভুবন মন্ডলকে খুঁজতে এসে পুলিশকে বোকা হতে হয় সাধারণ কৃষক হারানের পুত্রবধূর কাছে। কৃষক আন্দোলনের নেতা ভুবন মন্ডলকে নববিবাহিতা জামাই সাজিয়ে পুলিশের চোখে ধুলো দেবার মধ‍্য দিয়ে মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় একদিকে যেমন গল্পের সিচ‍্যুয়েশনে নতুনত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি ময়নার মা’র মতো সাধারণ কৃষকবধূর প্রথাবদ্ধ নৈতিক সংস্কারকে ভেঙে এগিয়ে আসা, সংসারের সংকীর্ণ ক্ষেত্র ত‍্যাগ করে বৃহৎ আন্দোলনের পটভূমিতে নিজেকে দাঁড় করানোর মধ‍্য দিয়ে স্বতন্ত্র‍্যতার পরিচয় দিয়েছেন। এই পটভূমিতে ময়নার মা সমগোত্র হয়ে ম‍্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’ পেলেগনা নিলোভনার সঙ্গে এক শ্রেণিতে দাঁড়ানোর দাবি রাখে। সাময়িকভাবে হলেও সবলকেও নতিস্বীকার করতে হয় দূর্বলের কাছে, গ্রাম বাংলার স্তিমিত জীবনেও পৌঁছে গেছে গণচেতনার ঢেউ – এই ভাবনাই ‘হারানের নাতজামাই’ গল্পের নাটকীয় মুহূর্তের বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে বিচ্ছুরিত করেছেন মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। এর সঙ্গে এটাও উল্লেখ‍্য  যে, ‘হারানের নাতজামাই’ গল্পের শেষে জগমোহন ও ময়নার সম্পর্কের নতুন মাত্রা উন্মোচনের মধ‍্য দিয়ে মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় কৃষক জীবনের সংগ্রামী চেতনার প্রেক্ষাপটে নরনারীর দাম্পত‍্য সম্পর্কের এক বিশেষ মূল‍্যবোধ ব‍্যক্ত করেছেন। মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের গল্পের এই সামাজিক সমীক্ষার ওপর গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব‍্যাখ‍্যা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু বলছেন –

“মধ‍্য বিশ শতকের বাংলা দেশের সামাজিক বিশৃঙ্খলার ঘনিষ্ঠ রূপকার তিনি ; যে সময়ে তথাকথিত ভদ্রলোক শ্রেণির একটা অংশ নিচে নেমে এলো এবং তথাকথিত দীন শ্রেণির একটা অংশ প্রবল হয়ে উঠল, সেই অধ‍্যায়ের বিবিধ লক্ষণ ভাবীকালের জন‍্য মূর্ত্ত হয়ে র‌ইল তাঁর রচনায়।” (কবিতা পত্রিকা, পৌষ,১৩৬৩)

অর্থনৈতিক সংকট আরো ভয়াবহ হয়ে যায় নৈতিক মূল‍্যবোধের অবক্ষয়ে; সেখানে যখন নিম্নমধ‍্যবিত্ত মানুষ স্তিমিত অন্ধকারের জীবনে গণ আন্দোলনের গোপন প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন মধ‍্যবিত্ত মানুষ প্রতিবাদের সাহস হারিয়ে আত্মসমর্পণ করে দূর্নীতির কাছে, কিংবা ছদ্ম আবরণ বজায় রেখে আত্মবঞ্চনার স্বীকার হয় এবং অবশেষে বাধ‍্য হয় জীবন সংগ্রামের কঠোর ভূমিতে নামতে, মধ‍্যবিত্তের ভদ্র খোলস ত‍্যাগ করে শ্রমিকের দলে ভিড় করতে। ‘লাজুকলতা’ গল্পে মধ‍্যবিত্ত লাজুক বধূর গোত্রান্তরে – “পাড়ার লোক তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে দ‍্যাখে বিখ‍্যাত লাজুক বৌ তমাললতা মাথার কাপড় কোমড়ে বেঁধে ছেলেমেয়ের সঙ্গে নিজেই বাসন-কোসন বিছানা-পত্র বয়ে নিয়ে বস্তিতে উঠে যাচ্ছে মাথা উঁচু করে।”

মধ‍্যবিত্ত জীবনের গোত্রান্তরের অন‍্য এক ছবি এঁকেছেন ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে!’ গল্পে। গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র মৃত‍্যুঞ্জয়, ভালো মাইনের চাকুরীজীবী মধ‍্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। অফিস যাবার পথে অনাহারে মৃত‍্যু দেখে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাবশত প্রথমে মাইনের টাকা তুলে দেয় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন‍্য। এতেও বিন্দুমাত্র সুরাহা না হলে ভাবপ্রবণ মৃত‍্যুঞ্জয় গভীর হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং অবশেষে জীবনের বোধে সর্বহারাদের মাঝে আশ্রয় নেয় সহকর্মী বন্ধু নিখিলের সতর্কবাণীকে উপেক্ষা করে, নিজের সংসার স্ত্রী কন‍্যা ভবিষ‍্যৎ বিস্মৃত হয়ে। মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পটি শুরু করেছেন মৃত‍্যুর প্রসঙ্গ দিয়ে – ‘অনাহারে মৃত‍্যু’।

মৃত‍্যুঞ্জয়ের মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে অনাহারী, অন্নপ্রার্থীর ভিড় লক্ষ করে অভিজ্ঞতালব্ধ সিদ্ধান্ত – 

“কারো বুকে নালিশ নেই, কারো মনে প্রতিবাদ নেই! কোথা থেকে কীভাবে কেমন করে সব ওলট পালট হয়ে গেল তারা জানেনি, বোঝেনি, কিন্তু মেনে নিয়েছে।” 

অবশেষে মৃত‍্যুঞ্জয়কেও পাওয়া যায় সেই অনাহারীদের দলে, বলে –

 “গা থেকে এইচি। খেতে পাইনে বাবা, আমায় খেতে দাও।”

গল্পের প্রথমদিকে মৃত‍্যুঞ্জয়ের অনুসন্ধানের মধ‍্য দিয়ে খোঁজ চলছে যে বাঁচায় তার, আর গল্পের শেষে ‘কে বাঁচে’র দলে মগ হাতে পাওয়া যায় তাকে। অর্থাৎ গল্পের দুটি বিষয় – 

১) কে বাঁচায় ? কীভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করে – 

২) যে বাঁচানোর চেষ্টা করে সেও একসময় তাদের দলে মৃতের মতো মিশে যায়। 

আর তারপর মানিক ব‍্যবহার করেছেন শ্লেষ মিশ্রিত বিস্ময়বোধক চিহ্ন, যা গল্পটির ব‍্যঞ্জনাকে আরোগভীর অর্থবোধক করে তুলেছে। গল্পের প্রধান চরিত্র দুটোর নাম‌ও মিশে আছে গল্পের বক্তব‍্যের সঙ্গে। মৃত‍্যুঞ্জয় – সে মৃত‍্যুকে জয় করেছে, আর নিখিল – পৃথিবী। আলোচ‍্য ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পে মানিক জানাচ্ছেন – 

“শক্তির একটা উৎস আছে তার মধ‍্যে, অব‍্যয়কে শব্দরূপ দেবার চেষ্টায় যে শক্তি বহু ক্ষয় হয়ে গেছে মানুষের জগত তার‌ই একটা অংশ। নিখিল পর্যন্ত তাই কাবু হয়ে যায় মৃত‍্যুঞ্জয়ের কাছে।”

এই দুর্ভিক্ষপীড়িত অনাহারী মানুষগুলোও তাই , তারা প্রতিবাদ জানেনা, সবকিছু মেনে নেবার মধ‍্য দিয়ে এক শক্তি পেয়েছে, দূর্মর সে শক্তি, সেই শক্তিতেই তারা মৃত‍্যুঞ্জয়, সেই বুভুক্ষু নরনারীর কাছে হার মেনেছে মৃত‍্যু – ‘ক্ষুধার যন্ত্রণা বেশি নাকি মৃত‍্যুযন্ত্রণা ?’ মৃত‍্যুকে জয় করার পর তাদের কাছে হার মেনেছে পৃথিবীও, দুনিয়াও, বিশ্বচরাচর‌ও। মৃত‍্যুঞ্জয়কে সর্বহারাদের মাঝে এনে দাঁড় করিয়েছে তাকে সর্বংসহা করে তুলে জীবনের অস্তিত্বের মূল ধরে টান মেরেছেন মানিক। আর পরিশেষে বিস্ময়বোধক চিহ্নের মধ‍্য দিয়ে শ্লেষমিশ্রিত প্রশ্ন রেখেছেন সমাজের উদ্দেশ‍্যে।

        মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের ছোটগল্পগুলিকে দুটি মাত্রায় আলোচনার নিরীখে বলা যায় – 

মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ফ্রয়েড ও মার্কসের নিহিত সংগতি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে ফ্রয়েড এবং মার্কস আসলে এক‌ই ধরণের মানসিক তথা সামাজিক ব‍্যধির কথা বলেছেন ভিন্ন পথ অবলম্বন করে, ফ্রয়েড খুঁজেছেন চেতন-অবচেতন প্রবণতার বিশ্লেষণে, মার্কস খুঁজেছেন ইতিহাস ও সমাজের দ্বন্দ্বের মধ‍্যে। মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের শেষ পর্বের গল্পগুলি এই সমন্বয় ভাবনার ফসল। একদিকে মনোবিজ্ঞান, অপরদিকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ – সাহিত‍্যের দুটি পদ্ধতিকে মিলিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানমনস্ক মানিক, আপন কলমের মুন্সিয়ানায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পকার মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে একক, অনন‍্য, স্বতন্ত্র‍্য।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – 

 মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের সমাজ জিজ্ঞাসা – নিতাই বসু

 মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় : জীবনদৃষ্টি ও শিল্পরীতি – গোপিকানাথ রায়চৌধুরী

 মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প – বেঙ্গল পাবলিশার্স, ১৯৯৭