রাঢ়ের অন্ত‍্যজ জীবন ও তারাশঙ্করের ছোটগল্প


তারাশঙ্কর বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় বাংলা কথাসাহিত‍্যে বড় ঐতিহ‍্যকে মেনে নিয়েছেন, তাকে ছাপিয়ে নিশ্চিতরূপে নতুনের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছেন। বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরতের সেকেলেপনা, অলীক কল্পনার প্রাধান‍্য, আদর্শবাদ ও নৈতিকতার মোকাবিলা করে নব বাস্তবতার আমদানি করতে রাজি হননি। বরং দেশীয় ঐতিহ‍্যকে অনুসরণ করে ঘুরে বেড়িয়েছেন সাপুড়ে, মেছো, বাউল, মাঝি, ডাইনি কাহার, বাউরী প্রভৃতি অন্ত‍্যজদের গলিতে গলিতে। বাংলা কথাসাহিত‍্যে পল্লীর বাস্তবতা শরৎচন্দ্র প্রথম আনলেও তাতে ছিল আবেগ উচ্ছ্বাসের বাহুল‍্য, এদিক থেকে শৈলজানন্দ ছিলেন তারাশঙ্করের পথপ্রদর্শক। শৈলজানন্দ যার আভাসমাত্র দিলেন তারাশঙ্কর তাকেই সমগ্রতায়, গভীরতায়, জীবন রহস‍্যের নিগূঢ় অর্থদ‍্যোতনায় একটি বিশালতা দিলেন। তাঁর লেখনীতে অতলস্পর্শী অন্ধকার গহ্বরের মধ‍্য থেকে মানবমহিমার তুঙ্গতম শৃঙ্গ মাথা তুলেছে, যেখানে মানবাত্মার চরম অবমাননা সেখানেই তার সর্বাপেক্ষা জ‍্যোতির্ময় প্রকাশ। নীচুতলার জীবন‌ই হয়ে উঠেছে তাঁর ছোটগল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র।

তারাশঙ্কর বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের অন্ত‍্যজ সম্প্রদায় নিয়ে রচিত গল্পগুলি হল –

১. বেদে - নারী ও নাগিনী, বেদেনী, বেদের মেয়ে, সাপুড়ের গল্প
২. ডোম - ডাইনি, চোরের মা, বোবাকান্না, চোর
৩. বাজিকর - যাদুকরী, যাদুকরের মৃত‍্যু
৪. পটুয়া - রাঙাদিদি, কামধেনু
৫. সদগোপ - কালাপাহাড়, পৌষলক্ষ্মী
৬. বাউড়ী - সুরডহাল রিপোর্ট
৭. সাঁওতাল - কমল মাঝির গল্প
৮. হাঁড়ি - কবি
গল্পগুলি সমাজের অন্ত‍্যজ মানুষগুলি কখন‌ও তাদের নিজস্ব লোকসংস্কৃতি, নিজস্ব জীবনযাত্রায় স্বতন্ত্র এবং উজ্জ্বল কখন‌ও বা সমাজের অবদমনের স্বীকার।

‘নারী ও নাগিনী’ গল্পে সাপুড়ে খোঁড়া শেখের মধ‍্য দিয়ে বেদে সমাজের বিচ্ছুরণ পাই, তেমনি ‘ডাইনী’ গল্পে সমাজের উচ্চবর্গের মানুষের অবদমনের চিত্র সোরধনির মধ‍্যে। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ বা অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে গ্রামীণ সমাজের দীন দরিদ্র অবহেলিত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন স্বপ্নভঙ্গের যে চিত্র পাই তারাশঙ্কর বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের ছোটগল্পে তা দেখা যায়নি। তারাশঙ্কর এই অন্ত‍্যজ মানুষের আদিম ও অমার্জিত জীবনযাত্রাকে চিত্রিত করেছেন, স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের আদিম প্রবৃত্তিকে। মানুষের অন্তর্লীন প্রবৃত্তিকে চরম নিয়তি বলে মনে করতেন তিনি, ‘অগ্রদানী’ গল্পে পূর্ণ চক্রবর্তীর মধ‍্যে সেই চিত্র পাই। ‘তারিণী মাঝি’ গল্পে সুখী ও তারিণীর সুখের দাম্পত‍্য জীবনে ধাতু প্রকৃতির স্বরূপ উন্মোচনে বিপরীত প্রবণতার যুগল বন্ধন অত‍্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে তারিণী নিজের জীবন বিপন্ন করে অপরকে বাঁচায়, ময়ূরাক্ষীর বিশেষ আক্রোশের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সুখীর গলা টিপে ধরে নিজে বাঁচতে চায়। বলা বাহুল‍্য, জীবন মৃত‍্যুর এক ভয়ঙ্কর সন্ধিক্ষণে লেখক প্রেম ও আত্মরক্ষার পরস্পর বিরোধের একান্ত নিষ্ঠুর চিত্র অঙ্কন করেছেন। এখানে ময়ূরাক্ষী ও সুখী হয়ে উঠেছে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী এক‌ইভাবে নাগিনী ও জোবেদার মধ‍্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়। এইভাবে নিজ আদিম সংস্কৃতির মধ‍্যে আবদ্ধ থেকে এরা স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে।

ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গে বাস্তুহারা উদ্বাস্তু আর খেতমজুর শ্রমিকদের প্রাবল‍্য বাড়তে থাকে। মহাশ্বেতা দেবী গেলেন সেইসব লাঞ্ছিত মানবাত্মার সন্ধানে ; লিখলেন বাঁয়েন গল্প, যেখানে ভগীরথ জানতে পেরেছিল ১৯৫৫র অচ্ছুৎ আইনের পর ওরা কেউ আর অচ্ছুৎ নয়, জেনেছিল ভারতীয় সংবিধান বলে একটা জিনিস আছে, সেখানে নাকি তারা সবাই সমান। বস্তুতপক্ষে ভগীরথের এই জানাই অন্ত‍্যজ শ্রেণির জীবনযাত্রার প্রেক্ষিত বদলে দিয়েছিল, শুরু হয়েছিল নিম্নবর্গীয়দের নিয়ে চর্চা, ওদের জীবন ভাবনা নাড়িয়ে দিয়েছিল অভ‍্যস্ত ধ‍্যানধারণাকে।

সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে, ক‍্যাপ্টেনের অধস্তন অফিসারদের 'সাবলটার্ন' বলা হয়, তবে শব্দটির সাধারণ অর্থ হল অধস্তন বা নিম্নস্থিত। ইতালির কমিউনিস্ট নেতা আন্তেনিও দ্রামশি তাঁর 'কারাগারের নোটব‌ই' তে 'সাবলটার্ন' শব্দটি ব‍্যবহার করেছেন দুটি অর্থে -
একটি অর্থ, প্রলেতারিয়েত এর প্রতিশব্দ; পুঁজিবাদী সমাজব‍্যবস্থার এক বিশেষ ধরণের শ্রেণিবিন‍্যাসে একমেরুতে থাকে 'পুঁজিমালিক', বিপরীত মেরুতে থাকে শোষিত শ্রমিক শ্রেণি বা প্রলেতারিয়েত। অপর এক অর্থে দেখিয়েছেন যেখানে পুঁজিবাদী সমাজব‍্যবস্থা নয়, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে 'প্রভূত্ব - অধীনস্থ' সম্পর্ক, অধীনস্থরা হল 'সাবলটার্ন শ্রেণি'।
আবার, মোগল যুগ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত ভারতে যে কৃষি অর্থনীতি চলছে উৎপাদন সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে তাও উচ্চবর্গ বনাম নিম্নবর্গে আবর্তিত হয়েছে। এই নিম্নবর্গদের নিয়ে প্রথম চর্চা শুরু করেছিলেন রণজিৎ গুহ, যার ফলে বিগত ৩৫ বছরের সমস্ত পৃথিবী জুড়ে শিল্প সাহিত‍্য চর্চার দৃষ্টিভঙ্গী বদলে গেল, সম্পর্কগুলির মূল‍্যায়ণে নতুন মাত্রা যোগ হল।

মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, মহাশ্বেতা দেবীর রচনাগুলিতে এই সব নিম্নবর্গদের পাই, তার কখন‌ও অত‍্যাচারিত হয়েছে, কখন‌ও আবার তাদের অধীনতার সীমা জেনে কথা বলেছে (দিবাকর : আমাদের কি খেতে মানা ? / ছোট বকুলপুরের যাত্রী), কথার আড়ালে নিজেদের অবস্থার সম্পর্কে সচেতন হয়ে প্রতিবাদ করেছে। এই প্রভূত্ব অধীনস্থ বর্গের প্রেক্ষিতে তারাশঙ্করের ছোটগল্পগুলি আলোচ‍্য –

‘নারী ও নাগিনী’ গল্পে খোঁড়া শেখ ও জোবেদা – এদের সামাজিক অবস্থান তার নিজস্ব বর্গের বাইরে নয়। এরা নিম্নবর্গীয় মুসলিম ঘরের বেদে সমাজের প্রতিনিধি। কিন্তু তারাশঙ্কর নাগিনী উদয়নাগ এর মধ‍্যে মানবীসত্তা আরোপ করেছেন এবং গল্পবিন‍্যাসে নাগিনী ও জোবেদা সতীন সম্পর্কে আবর্তিত। এবং এর পাশাপাশি ক্ষমতায়নের প্রেক্ষিতে নাগিনী জোবেদা ক্রমে প্রভূস্থ -অধিনস্থ সম্পর্কে আবদ্ধ। তাই গল্পে জোবেদা নাগিনীকে তাড়িয়ে দিলে নাগিনীর আপন ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশে অধীনস্থ জোবেদা বেঁচে থাকতে পারল না। এবং গল্পের শেষে তারাশঙ্কর জানাচ্ছেন – জোবেদার মৃত‍্যুর পর তাদের ভিটেতে উদয়নাগ সংসার পেতেছে –
“রাঙা রঙের সাপ ফণা দুলাইয়া খেলা করিতেছে।”
ক্ষমতায়নের প্রশ্নে জোবেদা নাগিনীর কাছে পরাজিত।

‘ডাইনী’ গল্পে সামাজিক বিন‍্যাসের মধ‍্যে উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের অবস্থান চিত্রায়িত হয়েছছ। অন্ত‍্যজ ডোমকন‍্যা সোরধনি সামাজিক সচলতায় উচ্চবর্গের প্রত‍্যাখ‍্যানে নির্যাতিত ডাইনীতে রূপান্তরিত। আর এই সমাজসৃষ্ট ভয়, প্রত‍্যাখ‍্যান, কুসংস্কার প্রচলিত থাকতে থাকতে তা সোরধনিনিজেই নিজের মধ‍্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছে, আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছে –
“হে ঠাকুর, আমার দৃষ্টিকে ভালো করে দাও, না হয় আমাকে কানা করে দাও।”
গল্পে চৌধুরি, সরকার পদবির মধ‍্যেই আছে ক্ষমতায়নের চিহ্ন। আবার অর্থনৈতিক প্রতিবেশী অনুযায়ী নিম্নবর্গের মানুষ যদি নিম্নবর্গকে নির্যাতন করে সেক্ষেত্রে নিম্নবর্গের মধ‍্যেও প্রভূত্ব অধীনস্থের সম্পর্ক তৈরি হয়। ‘ডাইনি’ গল্পে সাবিত্রীর পরিবার সোরধনির স্বজাতি হয়েও তাকে প্রত‍্যাখ‍্যান ও নির্যাতন করেছে।

নিম্নবর্গের, অন্ত‍্যজ জীবনের কথা বলতে গেলেও তারাশঙ্কর বন্দ‍্যোপাধ্যায়ের গল্পগুলি নিম্নবর্গচর্চার নিরীখে ক্ষমতা-অধীনতার সম্পর্কে নতুনভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে।