ডাইনী গল্প –
মানুষ হবার আর্তির শিল্পরূপ
উনিশ শতকের শিল্পসাহিত্য মানবমহিমার যে মূল্যবোধকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল বিশ শতকের নানা রাজনৈতিক ঘটনা, মূল্যবোধের পরিবর্তন, ফ্রয়েড ইয়ং এর মনোবিশ্লেষণ, সমাজবাস্তবতা, সাম্যবাদী চেতনা প্রভৃতির প্রতিঘাতে তিরিশ শতকের বাংলা কথাসাহিত্যের পালাবদল ঘটল। দেশ-কাল ও তত্ত্বের এই প্রেক্ষিতে জীবন রসের শিল্পীরূপে বাংলা কথা সাহিত্যের আসরে তারাশঙ্করের (১৮৯৯-১৯৭১) আবির্ভাব। তিনি অনেকাংশে কল্লোল কেন্দ্রিক চেতনাকে অস্বীকার করে, পাশ্চাত্যমুখীনতাকে অঙ্গীকার না করে নিজস্ব দৈনিক সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক পরিপার্শ্বিককে ও তার রূপান্তরের কাহিনিকে উপন্যাসে ও ছোটগল্পে রূপায়িত করেছেন।
তারাশঙ্কর তাঁর লেখনী সম্পর্কে বলেছেন –
“আমার বই বলুন আর যাই বলুন সেটা হচ্ছে আমার এই রাঢ় দেশ।”(আমার সাহিত্যজীবন) তাই রাঢ় বাংলা তার সমস্ত আদিমতা, লোকবিশ্বাস, কিংবদন্তী, রুক্ষতা নিয়ে উপস্থিত তাঁর গল্পগুলিতে।
আলোচ্য 'ডাইনী' গল্পটি একাধারে রাঢ়বাংলার প্রকৃতি আর সমাজ পীড়িত মানুষের এক আশ্চর্য জীবন্ত কাহিনি। 'ডাইনী' গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'প্রবাসী' পত্রিকায় ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে আষাঢ় সংখ্যায়।
গল্পটি লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাপ্রসূত।
‘ডাইনী’ গল্প সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন –
“…মর্মান্তিক বেদনা ছিল তার। নিজেরও তার বিশ্বাস ছিল সে ডাইনী। কাউকে স্নেহ করে সে মনে মনে শিউরে উঠত, কাউকে দেখে চোখে ভালো লাগলে সে সভয়ে চোখ বন্ধ করত।”
আলোচ্য গল্পে ডাইনির জীবনের যে ইতিহাস অতীত ও বর্তমানের টানাপোড়েনে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন তার মর্মান্তিক দ্বন্দ্ব আছে। ছাতিফাটা মাঠের ধারে যে বৃদ্ধা ডাইনি নানা লৌকিক জনশ্রুতির কেন্দ্র হয়ে বসে বসে আয়নায় নিজের মুখ দেখে তার স্মৃতি রোমন্থনে গল্পটি শুরু হয়েছে। দশ-এগারো বছর বয়সে প্রথম একটি ছেলেকে নজর দিয়েছে বলে পেটের যন্ত্রণায় সে ছটফট করছে – এই অজুহাতে বামুন বাড়ির হারু চৌধুরি পুকুরঘাটে তাকে চুলের মুঠি ধরে আছড়ে মারে। কেন এমন হয়েছে বোঝেনি সে, অপমানবোধে ভগবানকে ডেকেছে –
“ঠাকুর ভালো করে দাও”
তারপর থেকে তাকে কেন্দ্র করে ঘটতে যাওয়া ঘটনাগুলোয় তার সামাজিক সত্তা যন্ত্রণা পেয়েছে। তাঁর দৃষ্টির সর্বনাশী তীক্ষ্ণতার পাশাপাশি এক মর্মান্তিক আক্ষেপ তাকে স্মরণীয় মানবিক চরিত্র করে তুলেছে। অন্যদিকে তার নিজের ডাইনিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস এত বেড়ে গেছে যে নিজের প্রতি চরম ঘৃণা তো এসেছেই, তার ওপর প্রকৃতি ও মানুষ এ দুয়ের প্রতি তার শক্তিকে সচেতনভাবে ফলানোর কথা ভেবেছে। দূর থেকে ছাতিফাটা মাঠ ধরে শিশুকোলে মেয়েটিকে আসতে দেখে সে ভেবেছে –
“ফুঁ দিয়া, ধূলা উড়াইয়া দিয়া মানুষটাকে উড়াইয়া দেয়?”
তারপরই ভেবেছে “না – না – না”। মেয়েটি জল চাইলে তাকে স্নেহবশে জল আর পাটালি দিয়েছে, পরক্ষণেই চেঁচিয়ে বলে উঠেছে –
“ছেলেটাকে খেয়ে ফেললাম রে, পালা পালা তুই ছেলে নিয়ে পালা বলছি।”
এই ডাইনি আর মানবী সত্ত্বার দ্বন্দ্বে সে মানত করে –
“মা আমাকে ডাইনী হইতে মানুষ করিয়া দাও, আমি তোমাকে বুক চিরিয়া রক্ত দিব।”
এই মানবিক বোধেই যখন তার ঘরের দাওয়ার কাছে নির্জন মাঠে একটি ছেলে ও মেয়ে প্রণয়ের অভিমান-আবেদন পর্বে ব্যস্ত তখন বৃদ্ধা সরা তার জীবনের প্রেমানুভূতি ও বিবাহিত জীবনের কথা ভেবেছে, পূর্বস্মৃতির তাড়নায় ছেলেটিকে দায়পরবশ হয়ে সাহায্য করতে গেছে কিন্তু ছেলেটি ভয়ে পালাতেই তার মনে হয়েছে তার মধ্যে বিধ্বংসী শক্তি জেগে উঠেছে। আর তার জেরেই ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে।
সারদাপুর আতঙ্কে বন্ধ ঘরে থেকে সন্ধ্যার মুখে ছোট একটা পুঁটলি নিয়ে ঘর থেকে পালাতে শুরু করেছে, ছাতিফাটার মাঠে দূর্দান্ত ঘূর্ণিঝড়ে অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে একটি মাত্র বাক্য তার মুখে বসিয়েছেন –
“অকস্মাৎ আজ বহুকাল পরে তাহার নিজেরই শোষণে মৃত স্বামীর জন্য বুক ফাটাইয়া সে কাঁদিয়া উঠিল – “ওগো তুমি ফিরে এসো গো।”
– এই একটিমাত্র বাক্য ডাইনির ভিতরকার চাপা অথচ দুর্বার শক্তি সম্পর্কে ভয় নিজের অবস্থার অসহায় নিঃসঙ্গতা এবং আগেই মরে যাওয়া সেই শক্তিমান পুরুষটির কাছে সাহায্যের ব্যর্থ প্রার্থনা তাকে এক করুণ মানবী করে তুলেছে। ডাইনির ছদ্মবেশে এ গল্প এক মূর্ত তৃষ্ণার্ত অসহায় করুণ মানবীর গল্প।
‘ডাইনী’ গল্পে প্রকৃতিকে অপরিচয়ের রহস্যে আবৃত করে মানবজীবনের একটি গভীরতর অর্থের সন্ধান করেছেন লেখক। তাঁর মানস বিবর্তন এগিয়েছে প্রকৃতি থেকে মানুষে, মানুষ থেকে অতিপ্রাকৃতে। গল্পে অতিপ্রাকৃত রস সৃষ্টি হয়েছে গল্পকারের আসক্তিবিহীন জীবন প্রতিন্যাসে লৌকিক বিশ্বাস আর কুসংস্কারের অন্ধ তামসিকতায় নিষ্পষ্ট মানবীয় মূল্যবোধের আলোকহীন গ্লানিজর্জরতা ডাইনির অভিশপ্ত জীবনের অন্তিম বিশ্বাসে। তার নরুণ দিয়ে চেরা ছুরির মতো চোখে বিড়ালির মতো দৃষ্টিতে যাকে ভালো লেগে যায় তার থেকে রক্ষা থাকে না। জরা কুঞ্চিত দন্তহীন মুখে তার সর্বনাশী লোলুপ শক্তিটা সাপের মতো লকলকে জিভ বের করে ফণা তুলে নেচে ওঠে। তার এই লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাদ যায়নি পথভ্রান্ত তরুণীর নরম সরস শিশুটি কিংবা বাউরীদের স্বামী পরিত্যক্তা তরুণীর প্রণয়মুগ্ধ তরুণ যুবকটি। আর এর সঙ্গে জনহীন ছায়াশূন্য দিগন্তবিস্তৃত ছাতিফাটার মাঠ একটি অতিপ্রাকৃত আবহ রচনা করেছে।
গল্পের শুরুতে প্রকৃতির রুদ্ররূপের নিষ্ঠুরতায় ছাতিফাটা অভিশপ্ত, লেখক বর্ণনা দিয়েছেন –
১) “…ওপারের গ্রাম চিহ্নের গাছপালাগুলিকে কালো প্রলেপের মতন মনে হয়।”
২) “…ছাতিফাটার মাঠ নামগৌরব মহামারীর সমকক্ষতা লাভ করিবার জন্য লালায়িত হয়ে ওঠে।”
ছাতিফাটা মাঠের অদ্ভূত ভয়ঙ্কর রূপ, তার জলশূন্যতা, রুক্ষতা, সর্বগ্রাসীতার ওপর আরোপিত হয়েছে মানবীয় আর্তি।
“কোন বড় গাছ নাই – বড় গাছ এখানে জন্মায় না, কোথাও জল নাই – গোটাকয়েক শুষ্ক গর্ত জলাশয় আছে, কিন্তু জল তাহাতে থাকে না”
– এতগুলো নঞর্থক শব্দও পরিবেশের নির্মমতাকে প্রকট করেছে। আর এই ছাতিফাটার মাঠের মতো সেই মাঠের মাঝে একা বসবাসকারী সুরধূনী ডাইনির অন্তরটাও হয়েছে তৃষ্ণার্ত –
“মানুষ দেখিলেই যেন অনিষ্টস্পৃহা জাগিয়া ওঠে।”
জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ৫৪বছরের প্রৌঢ় ‘সরা’, অনাথ, অনাদৃত, নিঃসঙ্গ, বঞ্চিত এক নারী; জন্মের সঙ্গে সঙ্গে খিদেও তার বেড়ে উঠেছে, ক্ষুধা তার নিত্য দিনের সঙ্গী, অনাহারে অভাবের কবলে পড়ে তার শারীরিক চেহারাটাও হয়েছে সর্বগ্রাসী। ছাতিফাটার মানবীয় রূপ হয়ে উঠেছে সে, নিসর্গ বৈশিষ্ঠ্যগুলো তার মানুষ্যধর্মের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। ছাতিফাটা, প্রকৃতির রুদ্ররূপের নিষ্ঠুরতায় অভিশপ্ত আর সরা, মানুষের নিষ্ঠুরতায়, সংস্কারান্ধে অভিশপ্ত।
মানুষের অন্ধ কুসংস্কার, আদিম অন্ধত্ব, সামাজিক অবজ্ঞার স্বীকার হয়েছে ‘সরা’। প্রতিনিয়ত তাকে কেন্দ্র করে ঘটতে যাওয়া অমঙ্গল ঘটনা, সমাজের প্রত্যাখ্যান তাকেও ভাবতে শিখিয়েছে সে ডাইনি, ভয় – একাকীত্ব থেকে সঞ্চারিত হয়েছে তার মধ্যে ক্রূরতা। বারংবার প্রত্যাখ্যান, সামাজিক সচলতা মানুষকে তা সম্পর্কে বিশ্বাস করতে দেখায়। গল্পটিতে উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গ, প্রভূত্ব-অধীনতার মানদন্ড আরোপিত। যেখানে চৌধুরী, সরকার – বামুনবাড়ির প্রতিনিধি ক্ষমতার আসনে আসীন আর তাদের সামাজিক অবজ্ঞার স্বীকার হয়েছে নিম্নবর্গীয় অনাথ সোরধনি। অনাথ অভূক্ত সরার সামান্য আম খাবার, গরম মাছ ভাজা খাবার ইচ্ছা বদলে গেছে সর্বনাশী লোলুপতায়, সর্বগ্রাসীতায়, অনিষ্টস্পৃহায়। ঊদ্ধর্তনের অধস্তনের প্রতি সামাজিক অবজ্ঞা অলৌকিক বিশ্বাস এবং কুসংস্কার মানুষের জীবনে কত ভয়াবহ রূপে আত্মপ্রকাশ করে ‘ডাইনী’ গল্পের সোরধনির জীবনের শোচনীয় পরিণাম তার এক চরমতম রূপ।
'ডাইনী' গল্পে নিঃসঙ্গ স্মৃতি সর্বস্ব ডাইনির আশৈশব মানসিক লড়াইএর ইতিহাসটুকু ফোটাতে গিয়ে লেখককে সময়ের বিভিন্ন স্তরে বারবারই যাতায়াত করতে হয়েছে। যদিও ডাইনির জীবনের শেষ তিনদিনের দুটি ঘটনার ওপর দাঁড়িয়ে আছে গল্পটি তবুও ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতিতে অতীতে অনেকগুলো ঘটনার স্মৃতি নানা সময়ে ডাইনির মনে ছায়া ফেলে তার অমানুষিক ক্রোধ ও আক্ষেপকে একইসঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাছাড়া 'ডাইনী' গল্পের সূচনায় পরিবেশ ও ডাইনির সঙ্গে মেলবন্ধন এবং ডাইনির পরিবেশ ও লৌকিক বিশ্বাসকে দক্ষতার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাবের আগে মানুষের সুপ্ত জান্তববৃত্তি বা যৌনকামনা বাসনার গল্প লেখা শুরু হয়েছিল জগদীশ গুপ্ত, যুবনাশ্ব, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত প্রমুখের হাতে। কিন্তু জান্তব বৃত্তির সঙ্গে মানুষের আত্মিক ক্ষুধা, হিংস্রতার সঙ্গে সারল্য বা শিল্পসৃষ্টির প্রতিভা এই জাতীয় বৈপরীত্যের অবস্থান তারাশঙ্করের গল্পগুলিতে লক্ষ্য করা যায়। গল্প লেখার প্রথম থেকেই বিপরীত স্বভাবের অস্তিত্ব সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সচেতন হয়ে ওঠেনি, জৈবিক তাড়না ও মানবিক বোধ এই দুয়ের দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে যে জনসমাজকে তিনি লক্ষ করেছিলেন সেই লক্ষ্যে স্থির রেখেই তিনি লিখেছিলেন –
তারিণী মাঝি, ডাইনী, নারী ও নাগিনী, বোবাকান্না ইমারত প্রভৃতি গল্পগুলি।