মিছিলের মুখ
কবিতার বিষয়বস্ত
বাংলা কাব্য জগতে চল্লিশের দশকের কবি হলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। মাত্র ২১ বছর বয়সেই রোমান্টিক প্রেমচেতনা থেকে মুখ ফিরিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির অসহায়ত্ব আর অর্থনৈতিক দুর্দশার বিপরীতে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়ে লিখলেন প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’। কবিদের ব্যক্তিচেতনাকে নস্যাৎ করে সমষ্টি চেতনা প্রকাশ করলেন, ‘পদাতিক’ তাই গণমানুষের কবিতা।
শুধু ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থে নয়, তৎকালীন ফ্যাসিজম কমিউনিজম দ্বন্দ্ব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ভারতবর্ষে বিপ্লবীদের বৈপ্লবিক কর্মকান্ড, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ – সমস্ত কিছু প্রভাব ফেলেছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম দিককার তিনটি কাব্যগ্রন্থে – পদাতিক, অগ্নিকোণ ও চিরকূট।
'পদাতিক' কাব্যগ্রন্থ অপেক্ষা পরবর্তী চিরকূট ও অগ্নিকোণ আরও বেশি পরিণত। সিঙ্গাপুরের যে তিনজন শহিদ ব্রিটিশের ফাঁসির কাঠে আন্তর্জাতিক গান গাইতে গাইতে প্রাণ দিয়েছেন তাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৪৮ খ্রি: সুভাষ মুখোপাধ্যায় রচনা করলেন 'অগ্নিকোণ' কাব্যটি। প্রকাশকালে এই কাব্যের কবিতার সংখ্যা পাঁচটি - অগ্নিকোণ, ঝড় আসছে, একটি কবিতার জন্য, মিছিলের মুখ ও রামরাম।
‘অগ্নিকোণ’ – এর আক্ষরিক অর্থ – দক্ষিণপূর্ব দিক, এর মধ্যে নিহিত আছে সমকালের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিত। সেইসময় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে সাম্রাজ্যবাদের থাবা বসেছিল, ব্রিটিশ, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদ লাল ফৌজের আঘাতে প্রত্যাঘাতে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, ভারতেও ১৯৪৮ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির উগ্রবাম নীতিতে ডাক দেয় সশস্ত্র গণ অভ্যুত্থানের। সেইসময় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয় পশ্চিমবাংলায়, কমিউনিস্ট নেতাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়, গ্রেপ্তার হন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সেই পরিমন্ডলেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘অগ্নিকোণ’ কাব্যগ্রন্থটি। আর এই প্রেক্ষাপটেই ‘অগ্নিকোণ’ কাব্যগ্রন্থের ‘মিছিলের মুখ’ কবিতার বিষয়বস্তু বিচার্য।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনে পার্টি ছিল অনেকখানি, পার্টির সভা সমিতি মিছিল শ্লোগান ইত্যাদির সঙ্গে ছিল কবির আত্মিক যোগ, সেই সম্পর্কের নিরিখে এই কবিতায় ‘মিছিল’কে মানবিক সত্তায় উন্নীত করেছেন কবি –
“মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ
মুষ্টিবদ্ধ একটি শাণিত হাত
আকাশের দিকে বিক্ষিপ্ত;
বিস্রস্ত কয়েকটি কেশাগ্র
আগুনের শিখার মত হাওয়ায় কম্পমান।”
কবিকে এই মিছিল উজ্জীবিত করে, স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যেন সেই প্রতিবাদের ঝড় ফিকে হয়ে যায়। কবির মতে, প্রতিবাদী মানুষের মিছিল শ্লোগান থেকে সরে আসার ফল – ধনতন্ত্র ও ভোগবাদের পূজারী হয়ে ওঠা। কবিকে হতাশ করে হারিয়ে যাওয়া সেই মিছিল –
“…কিন্তু হাত তাদের নামানো মাটির দিকে
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে জ্বলে ওঠে না তাদের দৃপ্ত মুখ
ফসফরাসের মতো।”
যাদের কবি মিছিলে পা মেলতে বলেছিলেন আজ তাদের –
“কারো বাঁশীর মতো নাক ভালো লাগে
কারো হরিণের মতো চাহনি নেশা ধরায়।”
অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবেই তারা আত্মকেন্দ্রিক ও নিম্নগতিসম্পন্ন মানুষ। মিছিলের সেই মানুষগুলি আজ হারিয়ে গেছে, মানুষের এই সামাজিক অচল অবস্থা অবসান করাই কবির লক্ষ্য। কবি রাজনৈতিক সংকটের এই কালকে কবিতার শিল্পরূপ দিয়েছেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি ভারতীয় কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমোর তাঁতি ইত্যাদি মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও সংগ্রামী ভূমিকা গ্রহণ করলে কংগ্রেস সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে ১৯৪৮ সালের ২৭শে মার্চ। তবে পার্টি নিষিদ্ধ হলেও কাজ বন্ধ ছিল না, গোপনে কাজ চলত। বামপন্থী রাজনৈতিক সমাজ মানসিকতা এই কবিতায় অভিব্যক্ত। আর তার সঙ্গে যুক্ত করেন মানবিক বিশ্ব রচনার উদার প্রত্যয় ও দৃঢ় বিশ্বাস –
“অন্ধকারে হাতে হাতে তাই গুঁজে দিই আমি
নিষিদ্ধ এক ইস্তেহার,
জরাজীর্ণ ইমারতের ভিত ধসিয়ে দিতে
ডাক দিই –
যাতে উদ্বেলিত মিছিলে একটি মুখ দেহ পায়
আর সমস্ত পৃথিবীর শৃঙ্খলমুক্ত ভালোবাসা।”
সম্পূর্ণ কবিতার মধ্য দিয়ে মিছিল একটা অবয়ব পায়। মিছিলে মিলিত মানুষ সমস্ত শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে এক পৃথিবী রচনা করবে যার মধ্যে শোষণ, বঞ্চনা, পীড়নমুক্ত এক প্রজাতন্ত্র তৈরি হবে।
জীবনই জীবনকে চায় ভালোবাসতে, সে জীবন যদি হয় বহু জীবনের সমাহার, তাহলে যে একাকী যে বিমুক্ত যে প্রবাহিত জীবনের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, প্রকৃত মৃত্যু ঘটে তারই। তাই ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লেখেন –
“আমাকে উজ্জীবিত করে সমুদ্রের সেই স্বপ্ন
মিছিলের সেই মুখ।”
নবযুগ আনার আশ্বাস ধ্বনিত হয়েছে বিষ্ণু দে ও সমর সেনের কবিতাতে। বিষ্ণু দে জ্ঞানতান্ত্রিক কবি, বুদ্ধি দিয়ে সাম্যবাদকে গ্রহণ করেছেন আর সমর সেন নৈরাশ্যের কবি - নিরুপায় হয়ে নতুন সমাজ ব্যবস্থাকে স্বাগত জানাচ্ছেন, কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায় এ থেকে অনেকটাই প্রাগ্রসর, তাঁর কবিতাও যেন চলমান ছবির মিছিল। তিনি জানতেন সাধারণ জনসাধারণকে প্রভাবিত বা উদ্বুদ্ধ করতে কবিতার ভাষা দুর্বোধ্য হলে চলবে না। তাই প্রচার ধর্মী ভাষার আঙ্গিকে সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন চিত্রকল্প।