কমলকুমার মজুমদারের ছোটগল্প
কমলকুমার মজুমদারের ছোটগল্প
কমলকুমার মজুমদার পাঠক বন্দিত লেখক নন। অধিকাংশ পাঠক তাঁর লেখা পাঠ করে চুপ করে থাকেন, মর্মোদ্ধার করতে পারেন না। গল্পের বিষয়বস্তু অনেকসময় আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। সমগ্র কাহিনিকে একই বৃত্তের মধ্যে ফেলতে পারেননা। ফলে কমলকুমার মজুমদার বাংলা পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য থেকে ক্রমে ব্রাত্য হয়ে পড়েন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানাচ্ছেন কমলকুমার মজুদারের প্রথম গল্প ‘লাল জুতো’, যা প্রকাশিত হয় ১৯৩৮খ্রি:, এর প্রায় ২৩বছর পর প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। চৌষট্টি বছরের জীবনে মাঝামাঝি থেকে লেখালেখি শুরু, প্রায় পঁচিশ বছর তাঁর লেখালেখি জীবনের বিস্তৃতি হলেও শেষ সতেরো বছরে লিখে ফেলছেন ৭টি উপন্যাস।
কমলকুমার মজুমদারের প্রাপ্ত ছোটগল্পের সংখ্যা ২৯টি, এছাড়া আরও গল্প থাকতে পারে বিভিন্ন বেনামী লিটল ম্যাগাজিনের হারিয়ে যাওয়া পাতায়। ‘দেশ’ পত্রিকার কথা বাদ দিলে কমলকুমার লিটল ম্যাগাজিনেরই লেখক। কৃত্তিবাস, এক্ষণ, উষ্ণীষ, সাহিত্যপত্র, চতুরঙ্গ, বক্তব্য এবং পরিচয় ইত্যাদি পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে তাঁর লেখকসত্তা। সত্যজিৎ রায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শ্রীপান্থ কমলকুমারের আড্ডার সঙ্গী। অর্থাৎ এ থেকে সহজেই বোঝা যায় কমলকুমারের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের কালপর্বটি। রোমান্টিসিজম, রিয়ালিজম পেরিয়ে বাংলা সাহিত্য তখন পা ফেলেছে ম্যাজিক রিয়ালিজমের সিঁড়িতে। চল্লিশের দশকের সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সঙ্গে ষাটের দশকের জাদু বাস্তবতার অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন কমলকুমার মজুমদার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী উত্তাল বিক্ষুব্ধ সময়, কালোবাজারি, দাঙ্গা, তেভাগা আন্দোলন, দেশভাগ, রক্তাক্ত স্বাধীনতা – উত্তাল সময়ের বিপন্ন বাস্তবের মধ্যে কমলকুমার কলম ধরেছিলেন। বিক্ষুব্ধ এই পরিবেশের মধ্যে মানুষের মূল্যবোধের মাত্রার বদল ঘটেছে। স্বপ্নে যেমন প্রবৃত্তি থেকে অবাস্তব জগৎ তৈরি হয়, জাগ্রত অবস্থাতেও সেই ইচ্ছা থেকে বাস্তব জগৎ উৎপন্ন হয়। এই পটভূমিতে মানুষের মধ্যে তারই প্রকাশ ঘটছিল। সচেতন, অবচেতন, এবং মগ্নচেতনের ব্যাখ্যাগুলো ক্রমশ পরিস্কার হয়ে উঠছিল আত্মিক সংকটের প্রেক্ষাপটে। এই সময় দাঁড়িয়ে কমলকুমারের ভাষা ও বিষয়বস্তুর নির্বাচনে সমকালকে প্রায় অগ্রাহ্য করেছেন। সাধারণত কোনো বড় শিল্পী বা সাহিত্যিক সমকালের সমাজব্যবস্থা দ্বারা খুশি হতে পারে না, তারা কেউ আশ্রয় নেয় প্রকৃতিতে, কেউ অতীতে। কমলকুমার আশ্রয় খুঁজেছিলেন হিন্দু ঐতিহ্যের মধ্যে আর ভাষাকেও করেছিলেন তার উপযোগী করে।
এই বৈশিষ্ঠ্যের নিরীখে কমলকুমারের দুটি গল্পের আলোচনা থাকল –
১) নিম অন্নপূর্ণা
২) মতিলাল পাদরী
★ ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্পের বিষয়বস্তু আলোচনা–
কমলকুমার যখন তার আখ্যান বিশ্বটি গড়ে তোলেন তখন জীবনের নানা স্তরে অস্থিরতা ও ভাঙন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে দেশভাগ এবং রক্তাক্ত স্বাধীনতা – এই প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্তের ভন্ডামি, মিথ্যাচার কীভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল তাইই তুলে ধরেছেন ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্পে।
‘নিম অন্নপূর্ণা’ আসলে ক্ষুধার গল্প। ক্ষুধাই যে জীবনের চরম সত্য যেখানে নিম্নমধ্যবিত্তের সমস্ত মুখোশ খসে পড়ে। গল্পের প্রথমেই দেখি খিদের জ্বালায় যুথী প্রতিবেশী পাখির খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে ভিজে ছোলা খেতে গিয়ে পাখির ধারালো ঠোঁটে ঢুকে রক্তাক্ত হয়। কেউ তার খাবারের ভাগ দিতে রাজি নয়, পাখিও না। এরপর কমলকুমার আনছেন জাদু বাস্তবতার আবেশ ঐতিহ্যের, প্রাচীনতার এবং লোকসংস্কৃতির কুহকে। খেতুর মা যখন প্রীতিলতাকে যুথীর নির্লজ্জতার কথা বলছে তখন খেতুর মায়ের সেই কথার টোন প্রীতিলতার কাছে বাস্তবতার বিপরীত সুর লক্ষীর পাঁচালি পড়ার ছাঁদের মিল হয়ে ধরা দিচ্ছে। কমলকুমার লিখছেন, বিশেষত যেখানে আছে, ‘বন অধিষ্ঠাত্রী তুমি বনে বনে…গৃহলক্ষী রূপে তুমি সকলের ঘরে। দীনজনে রাজ্য পায় তব কৃপা বলে।’
চরম বাস্তবতার মুখে ফ্যানটাসির জগৎ তৈরি করছেন, জাদু বাস্তবতার বৈশিষ্ঠ্য মিলিয়ে কিন্তু সেই ফ্যানটাসি উপাদান আহরণ করছেন কমলকুমার ভারতীয় লোকসংস্কৃতি থেকে। আর ঠিক সেই সময়েই মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক জঙ্গি বিমান, লক্ষ্মীশ্রী পরিবেশের পলেস্তারা খসিয়ে বাস্তবের মাটিতে আছড়ে ফেলছে। মুহূর্তে প্রীতিলতাও হয়ে উঠেছে অন্নপূর্ণা থেকে নিম অন্নপূর্ণা – কমলকুমার মজুমদারের ভাষায়,
“একদা মায়াবিনী প্রীতিলতার কন্ঠস্বরে ক্রমাগত বালি ঝরার ভয়াবহতা।”
ক্ষুধার দাপটে মধ্যবিত্তের মিথ্যাচার থেকে রেহাই নেই শিশুদেরও। ভাদের বদলে চোকরসেদ্ধ পেয়ে ছোট্ট মেয়ে লতি মায়ের মনোরঞ্জন করতে বলে –
“ভাতের থেকে আমার চোকর খুব ভালো লাগে।”
যুথী আরও একটু এগিয়ে বলে –
“ভাতের থেকে চোকর একশগুণে ভালো, হাইক্লাস।”
মধ্যবিত্তের ভন্ডামি, মিথ্যাচার, ফ্যানটাসি রূঢ় বাস্তবকে নগ্ন করে একশ্রেণিতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন কমলকুমার। আবার মেয়েদুটোর খাওয়া খাওয়া খেলা দেখে মেয়ে দুটোকে প্রচন্ড মারের পর নিজের কপালে করাঘাত করে প্রীতিলতা বলে –
“আমার ইচ্ছা করে গলায় দড়ি দিতে, না লেখা না পড়া খালি খাই খাই…কোথাকার দুর্ভিক্ষ হা ভাতের ঘর যে এসেছে ভগবান জানেন।”
‘নিম অন্নপূর্ণা’র এই প্রীতিলতা যেন ‘পথের পাঁচালী’র সর্বজায়ার এক অত্যুগ্র সংস্করণ। কমলকুমার দেখাচ্ছেন – যে অন্নপূর্ণার দায় নিরন্নকে অন্ন যোগানো, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই অন্নপূর্ণা এখন নিম অন্নপূর্ণা – খাবারের সংস্থানে মরিয়া প্রীতিলতা বাইরের বারান্দায় আশ্রয় নেওয়া যক্ষারোগাক্রান্ত বৃদ্ধ ভিখারির জমানো চালের বস্তা চকিতে তুলে আনতে তাকে ঠেলে ফেলে বারান্দার নীচে। অনিচ্ছাকৃত হত্যায় অনুশোচনা নেই প্রীতিলতার। ভাত ফোটার গন্ধ তাকে আশ্বস্ত করে। স্বামী সন্তানের খাওয়া দেখতে সোহাগ খোরাকী গলায় বলে,
“বুড়োর জন্য মন খারাপ করছে…খেতে ইচ্ছে করছে না।”
সুকান্ত ভট্টাচার্যের ক্ষুধা রাজ্যের পূর্ণিমা চাঁদ যে ঝলসানো রুটি তারই গল্প বলেছেন কমলকুমার ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্পে ১৯৬০খ্রি: আর ১৯৭৭ এ সেই গল্পকেই আরো নগ্ন করে প্রকাশ করছেন সুনীল গাঙ্গুলী ‘গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প’।
● ‘মতিলাল পাদরী’ গল্পের বিষয়বস্তু আলোচনা –
ষাটের দশকের বিক্ষুব্ধ পরিবেশ কমলকুমারের লেখায় আনছে সুতীব্র যন্ত্রণার আর্তি। আত্মিক সংকটের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রিয় বিষয়বস্তু হয়ে উঠছে বাঙালি জীবনের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, ঐতিহ্য ও অবক্ষয়। সমাজ ও ইতিহাস একইসঙ্গে দ্যোতিত হচ্ছে কাহিনি বয়নে। ‘মতিলাল পাদরি’ সেই শ্রেণির গল্প।
গ্রামের হাড়ি, কৃষক, ডোম এবং বেশ কিছু খ্রিস্টান পরিবারের মাঝে বাঙালি পাদরী মতিলাল ও তার গির্জার অবস্থান। এই মতিলালের চাইবার কিছু ছিল না, শান্তিও নয়, “শুধুমাত্র একটি আশা পূর্ণাঙ্গ ক্রিশ্চান”।
আষাঢ়ের ঝড় জল বৃষ্টির প্রেক্ষাপটে কমলকুমার এক অভিনব কল্পচিত্র রচনা করলেন। ভারী বৃষ্টির মধ্যে মতিলাল গির্জার দরজা পড়ার শব্দের পাশাপাশি শুনতে পেলেন ‘অস্থির গোঙানির আওয়াজ’। কমলকুমার জানাচ্ছেন, “এ মৃত্যুর গোঙানি নয়। পুরুষ এই বেদনার কাছে নাবালক। তবু হলকর্ষণের শব্দে যেমন আনন্দ থাকে এখানে সেটুকু ছিল। সাঁওতাল রমণীর প্রসব যন্ত্রণার স্থান গির্জা এবং কাল বর্ষণাক্লান্ত আষাঢ়ের রাত্রির মধ্য দিয়ে রমণীর মানবপুত্র যিশুর দ্যোতনা নিয়ে পাদরির কাছে আশ্রয় পেল। বীণা পাদরীকে বলেছিল –
“লাও গো পাদরী, ঘরকে দেবতা আনলাম।”
মতিলাল নিশ্চিত যিশুর আবির্ভাব ঘটেছে। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে খ্রিস্টধর্মের সংস্কার যে কতটা তীব্র তার প্রমাণ মতিলাল। খ্রিস্টধর্মের যা কিছু গলঃধকরণ করতে পারলেই সভ্যতার আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় – এ ছিল ভারতবাসীর বদ্ধমূল ধারণা। কমলকুমার তাই লিখেছেন –
“সকালে এখানে বসে যখন মানুষের জিব দেখেন, চোখ দেখেন, নাড়ি ধরে অনেকক্ষণ কাটে, তখন আর্ত্তরা আর এক ঐশ্বর্যের স্বাদ পায়, সভ্যতার দিকে এগিয়ে আসে।”
কিন্তু ভামরের মিথ্যা কথা, বস্ত্রচ্যুত বিড়ির টুকরো, উদগ্র আলিঙ্গনলিপ্সা – মতিলালের ঐশ্বরিক প্রত্যয়কে বিনষ্ট করতে থাকে। আর তার সঙ্গে ম্লান হতে থাকে শিশুপুত্রের পবিত্রতা। তাই গল্পের শেষে ঘন জঙ্গলের ফাঁকে শিশুটিকে নামিয়ে দূরে যেতে চাইলে শিশুপুত্রের ক্রন্দন মতিলালের পাদরী নির্মোক খসিয়ে দেয়, রয়ে যায় শুধু মতিলাল, ‘বাববা মতিলাল।’ মতির উদয় ঘটে স্বাভাবিক মানবিকতার স্ফূরণে। মানুষের অন্তর্নিহিত ধর্ম উন্মোচনের গল্প এই ‘মতিলাল পাদরী’।
কমলকুমারের ভাষার গঠন ও প্রকাশের দূরূহতা কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। তাঁর রচনা অনেকের কাছে হেঁয়ালিপূর্ণ ও উদ্ভট মনে হয়েছে। এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, লেখকের পাঠক তৈরি করার একটা দায়িত্ব থাকে। তবে এটা ভাবা ঠিক নয় যে পাঠক মাত্রই বুদ্ধিহীন হবে, তারা কিছুই বুঝতে পারবে না। অর্থাৎ কমলকুমার পরোক্ষভাবে এটা বুঝিয়ে দিলেন বাঙালি পাঠককে যে, তাঁর লেখা পড়তে হলে বুদ্ধিকে ঘুম পাড়িয়ে গা এলিয়ে পড়তে বসলে হবে না।
বাংলা ভাষার প্রয়োগ ঐতিহ্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। ভাষার সংস্কারের চেয়ে খানিক পিছু হটে শুদ্ধ ভাষার প্রয়োগে ব্রতী হয়েছিলেন। কমলকুমারের রচনায় ক্রিয়ার ব্যবহার, শব্দ প্রয়োগ, অন্বয় বিন্যাস রামমোহন , মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের কিংবা ক্রিশ্চান পাদরিদের ব্যবহৃত অপরিণত বাংলাকে মনে করায়। জটিল অন্বয়, অপ্রচলিত নাম ধাতুর প্রয়োগ, ইংরাজি বাক্য গঠনের অন্বয় কখনো নিয়ে আসে গদ্যে অনূদিত রামায়ণ মহাভারতের স্মৃতি, কখনো লক্ষ্য করা যায় বাংলা বাইবেলের প্রাচীন সংস্করণের সুস্পষ্ট প্রভাব। আর এ কারণেই তাঁর ভাষা গদ্যকে যে দুরূহ বলা হয় সেই অভিযোগ সত্যি নয়। সূচনাপর্বের গল্পগুলিতে কিংবা যখন 'অন্তর্জলী যাত্রা' বা 'নিম অন্নপূর্ণা' লিখছেন তখন কমলকুমার নিজস্ব বাক্যবিধি অনুসরণ করলেও জটিলতা তেমন দেখা যায় নি। তবে 'সুহাসিনীর পমেটম', 'পিঞ্জরে বসিয়া শুক' ইত্যাদি নিয়ে দূর্বোধ্যতার প্রবল অভিযোগ ওঠে। এই প্রসঙ্গে 'মতিলাল পাদরি' গল্পটি বিচার্য।
‘মতিলাল পাদরি’ গল্পে ‘কষা হাঁদা জমি’, ‘ঢ্যাঙা ইউক্যালিপটাস’, ‘দেহটা যেন কুঁদে তোলা’, ‘ভয়ানক তড়কা ব্যাপার’ ইত্যাদি শব্দপ্রয়োগ লোকায়ত ভাষাকে মনে করায়। এর পাশাপাশি প্রাচীন বাংলা শব্দ ‘ভুকভুকিয়া’ যার অর্থ টর্চ, পেঁকা, আলো ধিমিয়ে আছে, ঠেকা যার অর্ধ ধামা, কিরে অর্থাৎ দিব্যি ইত্যাদির যথেচ্ছ শব্দ প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। আর এইসব শব্দের প্রয়োগই চেনা ভাষাকে অচেনা করে তোলে। আসলে কমলকুমার ভাষার সংস্কারে অর্থাৎ শুদ্ধ ভাষার প্রয়োগ করতে গিয়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন আঠারো শতকের সংমিশ্রিত ধরণ। যেখানে সাধুরীতির সঙ্গে লোকায়ত গদ্য মিশেছে তার রচনায়। কমলকুমার তাঁর ‘ভাব প্রকাশ বিষয়’ প্রবন্ধে বলেছেন –
“আমার ভাষা লইয়া অনেকে অনেক কিছু রটিয়াছে,…তাহারা অপপ্রচার করে, আমি গঙ্গাজলে দাঁড়াইয়া বলতে পারি আমার মত সরল খুব নাই, সত্যিকারের বাঙালিরাই আমার মতো সরল। যদি কিছু জটিল হয়, তাহা যে হেতু আমরা বাঙালিত্ব হইতে বহুদূর সরিয়া আসিয়াছি। আমরা ইদানীং শুধু জানি – শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বিছুলী ঘাটের ইলিশ উঠে, শীতে নলেন গুড় এবং শরতে দূর্গাপূজা হয়। বাঙালিত্ব আমরা ভুলিয়াছি। পৃথিবীর মধ্যে এত বড় জাতি আর নাই।”
একইভাবে প্রতীকের প্রয়োগেও কমলকুমারের বিশিষ্টতা লক্ষণীয়। কমলকুমার ভাষার মধ্যে প্রতীকবাদের মতো কুহক সৃষ্টি করলেও ঐ কুহকময় ভাষাতে তিনি হিন্দু ঐতিহ্য তাঁর ধ্যান ধারণা ও বিশ্বাসকে তুলে আনার কাজেই ব্যবহার করেছিলেন। ‘মতিলাল পাদরী’ গল্পে লিখেছেন ‘একটি ঘন্টা লাটঠা – যার গা বেয়ে পাক দিয়ে ওঠা সবুজতা’ – প্রাণ প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করেছেন কমলকুমার। কিংবা পাদরীর বর্ণনায় বলেছেন “তাঁর লতার অগ্রভাগের মত দেহটা কি যেন জড়িয়ে ধরতে চায়…”, প্রসূতি যন্ত্রণার দৃশ্য রচনাতেও কমলকুমার বেছে নেন দেশজ জান্তব প্রতীক – ‘বিদ্যুৎপীড়িতা রমণী’, হলকর্ষণের শব্দ, কালো দরজা খুলে যাওয়া, পবিত্রতার ছবি, এক ধামা দেবশিশু ইত্যাদি। ‘বিরাট স্ত্রীলোক’ যেখানে ধরিত্রী জননীর ইঙ্গিতবাহী, এই ধরিত্রী বিশ্বজনীন। কিংবা শিশুর জন্ম বুঝিয়েছেন শুধুমাত্র ‘একটি গোলাপি স্পন্দন’ শব্দবন্ধে। প্রসব যন্ত্রণার প্রতীক হয়ে এসেছে মেঘগর্জন। অর্থাৎ কমলকুমারের উপমা ও প্রতীকের ব্যবহার ভাষার মতো জনজীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ছিল। আবার এর পাশাপাশি কমলকুমারের গদ্যে ক্রিয়ার ব্যবহার বা বাক্যের বিন্যাস যা ইংরেজি ভাষার অনুসরণে। এ বিষয়ে কমলকুমারের মত ছিল যদি বিদেশি রীতি আনতেই হয় তবে ফরাসি বাকভঙ্গি অনেক কাম্য। তিনি ফরাসি রীতি বাংলা গদ্যে ব্যবহার করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ফরাসি ও ইংরাজি গদ্যের কাঠামো মোটামুটি এক। পদবন্ধ, বাক্যবন্ধ, গদ্যশৈলী নিয়ে একটি অহংঋদ্ধ মন কাজ করেছিল সারাজীবন কমলকুমারের। তিনি বলতেন, “আমার ভারতীয়দের জন্য এই ভাষাটা দরকার।”
আসলে কমলকুমার মজুমদারের ভাষাই তাঁর রচনার সৌন্দর্য। তাঁর নিজের ব্যাখ্যায় কাঁটা ঝোপঝাড় গভীর অরণ্য পেরিয়ে তবেই চন্দনের বনে যাওয়া যায়। একবার পৌঁছতে পারলেই সুগন্ধ। কমলকুমারের লেখনীও তাই। পাঠককে বুদ্ধিবৃত্তি সজাগ রেখে ধীরে ধীরে পা ফেলে এগোতে হবে, তবেই যথার্থ রসাস্বাদন সম্ভব। কবি আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত চিঠিতে জানিয়েছিলেন,
“আপনার সৃষ্টিশক্তির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছি।”
তাঁর রচনায় বিমুগ্ধ কথাসাহিত্যিকেরা শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টির কাছে। দেবেশ রায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবিমল মিশ্র – ছক ভাঙতে চাওয়া গদ্যশিল্পীরা যে কমলকুমারকে ‘লেখকের লেখক’ বলে স্বীকার করে নেবেন এ অনিবার্য ছিল।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
অন্যমন – কমলকুমার মজুমদার সংখ্যা , অক্টোবর, ২০১৭