নীলদর্পণ নাটক আলোচনা
দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক বাংলা নাট্য জগতে একসময় দারুণ সাড়া ফেলেছিল। এর কারণ হিসাবে বলা যায় –
● নীলের চাষকে কেন্দ্র করে ইংরেজরা নীল চাষীদের প্রতি যে অত্যাচার করতেন তার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে চাষীরা বিদ্রোহ করেছিল। বলা যায় এটাই প্রথম জাতীয় জাগরণ।
● সেই নীলচাষীদের প্রতি হওয়া অন্যায় অত্যাচার নিয়ে দীনবন্ধু মিত্র লিখেছিলেন ‘নীলদর্পণ’ নাটক। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই পদক্ষেপ অভিনব।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হল – সেদিনের নীলচাষ ও তার সমস্যাকে কতটা সাহিত্যের পাতায় তুলে আনতে পেরেছিল দীনবন্ধু মিত্র ?
কিংবা, ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনার পরেও ‘নবান্ন’ র মতো বাঁক বদলের নাটকের প্রয়োজন হল কেন ?
নীলচাষের ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যায়, নীলচাষ অনেক আগে থেকেই ভারতবর্ষে ছিল। এমনকি বাংলার নীলের চাহিদা সারা পৃথিবীতে ছিল। এই নীলচাষ প্রথমে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ছিল। কিন্তু ১৭৭৯ খ্রি: থেকে কোম্পানি এই চাষের ভার তুলে দেয় ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের হাতে, তারাই পরিচিত হল নীলকর সাহেব হিসাবে। এই চতুর ব্যবসায়ী নীলকরেরা জোর করে দাদন নিয়ে রায়ত বা চাষিদের নীল চাষের চুক্তি করত। রায়তরা নীলচাষে যেহেতু লাভ পেত না এবং অন্নসংস্থান হত না, তাই তারা চাষ করতে চাইত না। কিন্তু তারা দাদন নিতে বাধ্য হত, চাষের শেষে তা ফেরত দিতে পারত না। তখন শুরু হত তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার। পেটে ও মারা পিঠেও মারা – এমনি দুর্দশা ছিল সেদিনের নীলচাষীদের। নীলকর সাহেবদের দ্বারা রায়তদের দুর্দশা – এই পর্ব আমাদের জানা, এর পাশাপাশি ছিল ইংরেজদের চাষীদের প্রতি সমবেদনা, যে পর্বটা অনেকসময়েই অজ্ঞাত থেকে যায়।
বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাসলি ইডেন ও কৃষ্ণনগরের ম্যাজিস্ট্রেট হার্সেল – এরা নিরীহ কৃষকদের পক্ষ থেকে অবলম্বন করেছিলেন। সেসময় ছোটোলাট পিটার গ্রান্ট পরোয়ানা জারি করেন যে নীল চাষ সম্পূর্ণ চাষীদের ইচ্ছাধীন। এই স্বাধীনতা পাওয়া মাত্র নীল চাষীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং এতদিনে তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিদ্রোহ হয়ে ফেটে পড়ার সুযোগ পায়। এরপর নীলের হাঙ্গামা সম্পর্কে তদন্ত করতে ১৮৬০ খ্রি কমিশন বসে হার্সেল, গ্রান্ট, ইডেন, স্টিনকার প্রমুখ ৫জন সমস্যা নিয়ে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার নীল চাষীদের কিছু স্বাধীনতা দিয়ে অত্যাচার প্রশমনের ব্যবস্থা নিলে দূর্দান্ত চতুর নীলকররা আন্দোলন শুরু করে এই কমিশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে। সেইসময় আমাদের বাংলার যে দুই প্রাণপুরুষ নীলচাষীদের মধ্যে ক্ষোভ উত্তেজনার সঞ্চার করেছিলেন তাঁরা হলেন – হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং দীনবন্ধু মিত্র। হরিশ্চন্দ্র বেছে নিলেন হিন্দু পেট্রিয়েটের পাতা আর শ্রী মিত্র লিখলেন ‘নীলদর্পণ’ নাটক।
‘নীলদর্পণ’ নাটকের ভূমিকাতে দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন –
“নীলকর নিকর করে নীলদর্পণ অর্পণ করিলাম। এক্ষণে তাঁহারা নিজ মুখ সন্দর্শনপূর্ব্বক তাঁহাদিগের ললাটে বিরজমান স্বার্থপরতাকলঙ্ক তিলক বিমোচন করিয়া তৎপরিবর্ত্তে পরোপকার – শ্বেতচন্দ ধারণ করুন, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য , নিরাশ্রয় প্রজাব্রজের মঙ্গল এবং বিলাতের মুখরক্ষা।”
– ভূমিকার এই অংশ থেকে সহজেই বোঝা যায় এই নাটক রচনার মূলে নিরাশ্রয় ও উৎপীড়িত প্রজাব্রজের জন্য গভীর সহানুভূতি ও বেদনাবোধ ছিল। এবং একথাও উল্লেখ্য যে নাট্যকারের ‘নীলদর্পণ’ রচনার উদ্দেশ্য কথনোই ইংরেজবিদ্বেষ ছিল না, মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ইংরেজ জাতির ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যনিষ্ঠাকে যে তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন তার উল্লেখ নাটকের বিভিন্ন স্থানে পাই। সাবিত্রী একদা বলেছেন –
“সাহেবরা সব কত্তে পারে, তবে যে বলে সাহেবরা বড় সুবিচার করে,…তা এরা কি সাহেব না, না এরা সাহেবের চন্ডাল।”
– এখানেই স্পষ্ট রবীন্দ্রভাবনার ছোট ইংরেজ বড় ইংরেজ বিভাজন দীনবন্ধু মিত্রের ভাবনাতেও বিদ্যমান ছিল। অর্থাৎ ‘নীলদর্পণ’ নাটকের উপজীব্য ইংরেজ বিদ্বেষ নয়, নীলকরদের বিরোধিতা। সিপাহি বিদ্রোহের আগুন নিভতে না নিভতেই নীলকরদের অত্যাচারকে কেন্দ্র করে সারাদেশে যে গণ অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল সেই অসন্তোষের সূত্রই আছে ‘নীলদর্পণ’ নাটকে।
‘নীলদর্পণ’ নাটকের কাহিনির কেন্দ্রে স্বরপুর গ্রামের একটি বাঙালি পরিবার গোলক বসুর পরিবার, এর সঙ্গে উপকাহিনি হিসাবে যুক্ত হয়েছে সাধুচরণের পরিবার – এই দুই পরিবার নীলকলদের দ্বারা নানানভাবে অত্যাচারে সর্বস্বান্ত হয়। নাট্যকার তৎকালীন নীলকরদের অত্যাচারের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করতে গিয়ে নাটকে এনেছেন নানা উত্তেজনামূলক ঘটনা যেমন গোলক বসুর কারাবাস, সন্তান সম্ভবা ক্ষেত্রমণির রোগ সাহেবের দ্বারা অত্যাচার, গোলক বসুর আত্মহত্যা, নাটকের শেষে সাবিত্রী সৈরিন্ধ্রীর করুণ পরিণতি ইত্যাদি। এছাড়া গোপীনাথ ও পদী ময়রাণীর মতো যেমন চরিত্র আছে যারা নীলকরদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তেমনি তোরাপ, আদুরীর মতো প্রতিবাদী চরিত্রও পাই। ‘নীলদর্পণ’ নাটক সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন –
” হঠাৎ যে বঙ্গসমাজ ক্ষেত্রে উল্কাপাত হইল ; এ নাটক কোথা হইতে কে প্রকাশ করিল কিছুই জানা গেল না। ঘটনাসকল সত্য কিনা অনুসন্ধান করিবার সময় পাওয়া গেল না, নীলদর্পণ আমাদিগকে ব্যাপ্ত করিয়া ফেলিল।”
অর্থাৎ নীলদর্পণ তৎকালীন নীলের সমস্যা নিয়ে রায়তদের মর্মবেদনার প্রতিবিম্ব আবার এই নাটকেই সর্বপ্রথম গণজীবনের চিত্র উদঘাটিত হয়েছে।
এবার আসি পরবর্তী প্রশ্নে, যে ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনার পরেও ‘নবান্ন’র মতো নাটক প্রয়োজন হল কেন ?
আগেই বলা হয়েছে, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের বিষয়বস্তু ছিল নীলচাষকে কেন্দ্র করে নানা সমস্যা। সেই সমস্যা থেকে মুক্তির কোনো উপায় তিনি বলতে পারেননি, এমনি মুক্তি সম্ভব কিনা তার আশাও দিয়ে যেতে পারেননি।
তোরাপ একজন প্রতিবাদী কৃষক কিন্তু সে জনপ্রতিনাধি হয়ে উঠতে পারেনি, প্রতিবাদের একক মুখ হয়ে থেকে গেছে। বিচ্ছিন্ন থেকে এককভাবে কোনো সংগ্রাম সম্ভব নয়।
১৮৬০এ দীনবন্ধু লিখছেন ‘নীলদর্পণ’ নাটক, প্রায় সমসাময়িক কালে ঘটে যাচ্ছে দেশ জুড়ে নীল বিদ্রোহের মতো গণঅভ্যুত্থান, অথচ তার কোনোরকম ইঙ্গিত ‘নীলদর্পণ’ নাটকে পাওয়া যাচ্ছে না। শাসকের হৃদয় পরিবর্তনকে উদ্দেশ্য করে লেখা ‘নীলদর্পণ’ উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারলেও আবেদন নিবেদনের রাজনীতি সম্বল করে মুক্তির পথ দেখাতে পারেনি, এমনকি সমস্যা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর আশার আলো দেখাতে পারেনি। সেই সময় রচিত ‘জমিদার দর্পণ’, ‘চা-কর দর্পণ’ সকল নাটকই ‘নীলদর্পণ’ লেজ ধরে হেঁটেছে মাত্র।
তাই ‘নীলদর্পণ’ এর মতো সাড়া জাগানো নাটক রচনার পরেও ৮৪ বছর অপেক্ষা করতে হয় এর থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখতে, সংগ্রাম করতে, বিজন ভট্টাচার্যের নবান্নের জন্য।
তবু ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনবত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা আছে –
কালের বিচারে ‘নীলদর্পণ’ সমাজের সমস্যার প্রতিবিম্ব স্বরূপ হয়ে প্রথম পদক্ষেপ।
এমনকি কাহিনির সঠিক বয়নের জন্য কাব্যিক ভাষা ছেড়ে বিন্দুমাধব থেকে তোরাপ – চরিত্রানুযায়ী ভাষার প্রয়োগ দীনবন্ধুর বিষয় সচেতনতার পরিচয় দেয়।
সর্বোপরি, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের প্রকাশ ইতিহাসই প্রমাণ করে নাটকটির সফলতা।
তাই কাহিনি বিন্যাসে সীমাবদ্ধতা থাকলেও সমস্যা থেকে সমাধানের পথে উত্তরণ না ঘটলেও ‘নীলদর্পণ’ সেইসময়ের মাইলস্টোন। দ্বিজেন্দ্রলাল নাথের কথায় –
“দীনবন্ধুর শিল্পসৃষ্টির উৎকর্ষ প্রশ্নাধীন হতছ পারে, কিন্তু এ দরদী স্রষ্টাকে শুধুমাত্র নাট্যকার আখ্যা না দিয়ে সমসাময়িক বাংলাদেশের নবজাগ্রত জীবনবোধের চারণ কবি বলাই বোধ হয় সমীচীন।”
Please send me your password