আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি – শঙ্খ ঘোষ
■ মূল কবিতা –
আমাদের ডান পাশে ধ্বস
আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ
আমাদের মাথায় বোমারু
পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ
আমাদের পথ নেই কোনো
আমাদের ঘর গেছে উড়ে
আমাদের শিশুদের শব
ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে!
আমরাও তবে এইভাবে
এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি ?
আমাদের পথ নেই আর
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।
আমাদের ইতিহাস নেই
অথবা এমনই ইতিহাস
আমাদের চোখমুখ ঢাকা
আমরা ভিখারি বারোমাস
পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে
পৃথিবী হয়তো গেছে মরে
আমাদের কথা কে-বা জানে
আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয় আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।
■ উৎস : জলই পাষাণ হয়ে গেছে (২০০৪)
■ বিষয়বস্তু :
আধুনিক যুগের একজন সমাজমনস্ক যুগসচেতন কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি সেই সমাজমনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। কবিভাবনা দেশকালের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর বুকে সাম্রাজ্যবাদীশক্তির আগ্রাসনে যুদ্ধবিধ্বস্ত, সর্বহারা, আতঙ্কগ্রস্ত অসহায় সাধারণ মানুষদের উদ্দেশ্যে কবি এই আহ্বান জানিয়েছেন।
মানুষই বেঁচে থাকার জন্য দলবদ্ধ হয়েছিল, সমাজ গড়ে সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিল। কিন্তু সেই মানুষই ক্ষমতা, লোভ আধিপত্য বিস্তারে এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে মানুষের প্রতি দেশের আঘাত হানতে সংকোচ বোধ করে না – এর ফল গোষ্ঠী সংঘর্ষ, সন্ত্রাস, যুদ্ধ, হানাহানি। সাধারণ মানুষ থেকে শিশু কারোর রেহাই নেই, বাঁচার পথ অবরুদ্ধ। তাই কবি বলেছেন –
“আমাদের পথ নেই কোনো”
শিশুরা দেশের সম্পদ, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ভবিষ্যত দেশের কান্ডারী তারা। অথচ বর্তমান নৈরাজ্যকতায় ভবিষ্যত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সে মানুষদের এই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আগলে রাখার কথা তারাই বিনষ্ট করেছে। কিছু সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতালোভী মানুষেরা তাদের কায়েমিস্বার্থ চরিতার্থ করতে শিশুদের ওপরও নখর থাবা বসাতে পিছপা হচ্ছে না, ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে। তা দেখে ব্যথিত শঙ্কিত কবিচিত্ত তুলে ধরেছেন সেই নির্মম ছবি –
“আমাদের শিশুদের শব
ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে
আমরাও তবে এইভাবে
এ মুহূর্তে মরে যাব না কি ?”
‘ইতিহাস’ বলতে যেমন অতীত কাহিনি, পুরাবৃত্ত বোঝায়। তেমনই ইতিহাস হল মানবসভ্যতা তথা কোনো জাতির সভ্যতা বিকাশের ক্রমোন্নতির পর্যায়। সেই ইতিহাসেই নিহিত থাকে ঐতিহ্য। কিন্তু ইতিহাসের নিয়ন্ত্রাশক্তি যদি হয়ে ওঠে কোনো ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী, সে ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো সম্প্রদায়, তখন ঘটে ইতিহাসের বিকৃতি। ঐতিহ্যের এই অগৌরবের আবর্তে ভবিষ্যৎ ও কলঙ্কের সাক্ষ্য বহন করে বয়ে চলে। কবি যখন আলোচ্য কবিতায় লিখছেন – “আমাদের ইতিহাস নেই”। তখনই প্রকাশ পাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অপর এক নগ্ন রূপ – ঐতিহ্যের বিকৃতির কথা, ইতিহাসের মিথ্যাচারের কথা।
আমরা সাধারণ মানুষ যারা প্রবাহমান জীবনধারায় সবচেয়ে চলমান ঐতিহ্যের রূপ তারাই ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে উপেক্ষিত, বঞ্চিত ও বিকৃতির শিকার। তাই কবি ইতিহাসে স্থান না পাবার কথা বলার পাশাপাশি বলেন –
“অথবা এমনি ইতিহাস
আমাদের চোখমুখ ঢাকা।”
এ আসলে তথ্য বিকৃতি, স্বার্থান্ধ ব্যক্তিদের বানানো একমাত্রিক ইতিহাস, সুখের ইতিহাস।
সেই ইতিহাসে আমাদের চোখ ঢাকা, আমরা প্রকৃত সত্যের নাগাল পাইনা, সাধারণ মানুষের যারা সভ্যতার চালিকাশক্তি তাদের কথা জানতে পারি না। তারা সমাজের বঞ্চিত, শোষিত, পর্যুদস্ত, অবাঞ্ছিত মানুষ। তাই তাদের ইতিহাসটাও হয়ে আছে উপেক্ষার বা বঞ্চনার। শুধু একটি দেশে নয়, যুগের ইতিহাস দেখলে নানা দেশের মানুষের একই চিত্র ধরা পড়বে। আর এই বিকৃত ইতিহাসই আপামর সাধারণ মানুষও মেনে নিয়ে চলেছে।
সাধারণ মানুষ চিরকাল আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে পরানুকরণে ব্যাপৃত থেকেছে। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতাও তাদের নেই। এমনকি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে যে সচেতন মনোভাব থাকা দরকার তাও নেই। কবি বলেছেন – সাধারণ মানুষের এই নিষ্ক্রিয় মনোভাব ভিখারি দশার সামিল। এ থেকে মুক্তির উপায় করতে না পারাকেই কবি ‘ভিখারি বারোমাস’ বলেছেন।
সাধারণ মানুষ স্বভাবতই শান্তিপ্রিয়, সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কিন্তু দেখা যাবে তারাই চিরকাল ক্ষমতাহীন থেকে প্রকৃতির কাছে বিপর্যস্ত। তাই কবি সাধারণ মানুষকে অসহায় অবস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে না থেকে একত্র সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে ঐক্য মৈত্রী সহযোগিতার ভিত্তিতে আগুয়ান হওয়ার কথা বলেছেন, বাঁচার পথ দেখিয়েছেন –
“আমাদের পথ নেই আর
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।”
বৃহত্তর কর্মযজ্ঞে একক চলায় সার্থকতা নেই, প্রয়োজন সংঘবদ্ধতার, ঐক্যর। ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ না করে ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করার অঙ্গীকারের কথা বলেছেন। সেই অঙ্গীকারের বাণী সংহতি, পারস্পরিক সহচর্য – হাতে হাত রেখে চলা। কবি চান মানুষের সংগ্রাম, মানুষের প্রতিবাদ। তার জন্য দরকার একত্র সহাবস্থান। সংঘবদ্ধতাই সমস্ত বিপর্যয় দূর করার চরম অস্ত্র বলে কবি ইঙ্গিত দিয়েছেন।