আফ্রিকা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
■ মূল কবিতা –
উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগ
স্রষ্টা যখন নিজের সৃষ্টির প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে
রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা-
বাঁধল তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়
কৃপণ আলোর অন্ত:পুরে।
সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি
সংগ্রহ করেছিলে দুর্গমের রহস্য,
চিনেছিলে জলস্থল-আকাশের দুর্বোধ সংকেত
প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু
মন্ত্র জাগাচ্ছিল, তোমার চেতনাতীত মনে।
বিদ্রূপ করেছিল ভীষণকে
বিরূপের ছদ্মবেশে,
শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে
আপনাকে উগ্র করে বিভীষিকার প্রচন্ড মহিমায়
তান্ডবের দুন্দুভিনিনাদে।।
হায় ছায়াবৃতা,
কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানব রূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হলো ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,
দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিন্ড
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।
সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়
মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘন্টা
সকালে সন্ধ্যায় দয়াময় দেবতার নামে;
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;
কবির সংগীতে বেজে উঠেছিল
সুন্দরের আরাধনা।।
আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে
প্রদোষকালে ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,
যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল-
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,
এসো যুগান্তের কবি,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;
বলো ‘ক্ষমা করো’ –
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।।
■ উৎস – পত্রপূট কাব্যগ্রন্থ
■ আফ্রিকা – রূপক কবিতা ■
প্রতীক বা সংকেতের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে স্রষ্টা তার মনের ভাব প্রকাশ করেন, আর ভোক্তা সেই সংকেতের আড়ালে স্রষ্টার অভিপ্রেত অর্থ বুঝে সৃষ্টির যথার্থ রস আস্বাদনে সচেষ্ট হন। এই নিরীখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি রূপক কবিতা কিনা বিচার্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতায় প্রথমার্ধের প্রকাশ করেছেন আফ্রিকার জন্মরহস্য প্রকাশ করে আফ্রিকার সার্বিক পরিচয় দিয়েছেন। কবি কল্পনায় আফ্রিকা এক মমতাময়, লাঞ্ছিতা, কৃষ্ণা নারী যে ধরিত্রীমায়ের বুক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অবগুন্ঠিতা ছিল –
“বনস্পতির নিবিড় পাহারায়
কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।”
কিন্তু অপরিচিতা মানবী যে কালো ঘোমটার নিচে ছায়াবৃত ছিল তাকে নগ্ন করল নির্ল্লজ্জ অমানুষতা, সভ্যের বর্বর লোভ। ‘চিরচিহ্ন দিয়ে গেল’ তার ‘অপমানিত ইতিহাসে’। এখন কবি আহ্বান জানাচ্ছেন যুগান্তের কবিকে। বর্বর পশুদের অশুভ ধ্বনিতে ঘোষিত অন্তিমকালে সে যেন দাঁড়ায় ওই আফ্রিকা নাম্নী মানহারা অপমানিতা মানবীর দ্বারে আর ক্ষমা চায়। ক্ষমা মন্ত্রের দ্বারা ভালোবাসার বিকাশ চেয়েছেন কবি।
তবে কবি কি আলোচ্য কবিতায় কেবল অপমানিতা নারীর ছবি প্রকাশ করেছেন ? তবে আফ্রিকাই কেন হয়েছে সেই নারীর নাম ?
এর উত্তরে বলা যায়, আসলে কবি আফ্রিকা নাম্নী নারীর রূপকে আফ্রিকার প্রতি ১৮৮৫ – ১৯০৮ সালের অত্যাচারের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। শুস্ক মরুভূমি এবং সিক্ত অরণ্যকে পাশাপাশি নিয়ে আফ্রিকা ছিল রহস্যে মোড়া, দুর্গম আফ্রিকা ছিল আসলে সম্পদে সমৃদ্ধ। আর সেই সম্পদের লোভে অনুপ্রবেশ ঘটল সম্রাজ্যবাদী শক্তির। কেবল আফ্রিকার প্রাচুর্য তথা বনজ ও খনিজ সম্পদই তারা লুন্ঠন করল না, তার পাশাপাশি চলতে থাকল শ্বেতাঙ্গদের কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অকথ্য নির্যাতন। সেই লুন্ঠনের প্রতীকি ইতিহাসইকবি তুলে ধরেছেন কবিতায় –
“এল মানুষ ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা”
ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৮৫ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত কঙ্গো রাজ্য ছিল দ্বিতীয় লিয়োপোলড্ এর ব্যক্তিগত মালিকানার মধ্যে। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকার মানুষদের ওপর চরম অত্যাচার চালিয়ে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থকে ঊর্ধ্বে তোলাই ছিল তার কাজ। এই অপমানিত ইতিহাসই কবি বিধৃত করেছেন 'আফ্রিকা' কবিতায়।
আসলে ‘এহো বাহ্য’। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমিয় চক্রবর্ত্তীর অনুরোধে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি লিখেছেন ১৯৩৭ সালে ফ্যাসিস্ট ইতালি কর্তৃক আবিসিনিয়ার আগ্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধে। ফ্যাসিবাদের উদ্দেশ্যই ছিল দূর্বল রাজ্যগুলিতে বর্বরোচিত আক্রমণ করে তাদের করায়ত্ত করা। মুসোলিনীর এই কূটনৈতিক চক্রান্ত তথা ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনে বিশ্বজুড়ে মানুষ সন্ত্রস্ত হয়েছিল। ফ্যাসিবাদের এই কার্যকলাপে বিচলিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথও। তাদের নৃশংস কার্যকলাপের জবাবে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন –
“নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস”
১৩৪০ বঙ্গাব্দের ২০শে জুন রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লিখেছিলেন –
ডারউইন বলেছেন বানরের অভিব্যক্তি মানুষে, কিন্তু মানুষের অভিব্যক্তি এ কোন জানোয়ারে
সমকালীন রাষ্ট্রনীতির আন্তর্জাতিক স্বরূপই প্রকাশ করেছেন ‘আফ্রিকা’ কবিতায় আফ্রিকা নাম্নী নারীর রূপকে আফ্রিকার ইতিহাস তুলে ধরে। এখানে রূপক সাংকেতিক কবিতা হিসাবে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি সার্থক।
Nice Note