।। গোয়েন্দা সাহিত্যের উৎস সন্ধানে গোয়েন্দাগিরি ।।

কলমে: মধুরিমা চ্যাটার্জী


             আয়তনে খুবই পাতলা। চোখ বোলালেই পড়া শেষ। একসাথে বেশ কয়েকটা সংখ্যা গোগ্রাসে  পড়ে ফেলা যায় অবলীলাক্রমে। মাত্র হাতে গোনা কয়েক পৃষ্ঠার এই বই ‘কাম'(‘cum’) পত্রিকা গুলো জুড়ে থাকত মজাদার চরিত্রগুলোর কান্ডকারখানা। কথা কম ছবি বেশি। এতক্ষণে বোঝাই যাচ্ছে যে আমি কমিকসের কথা বলছি। হ্যাঁ, অনেক শৈশব বুঁদ হয়ে থেকেছে এই কার্টুন সাহিত্য তথা শিশুকিশোর সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় শাখায়।

       অন্যদিকে আর একদল শৈশব তার অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে রাত জেগেছ রহস্যের সন্ধানে। কালচে রঙের দু-মলাটের মাঝে নিশুতি রাতগুলো কেটেছে গভীর উত্তেজনায়। সদ্য পড়তে শেখা কৈশোর গুলোর তাই অন্যতম পছন্দ অপরাধমূলক কাহিনি বা গোয়েন্দা সাহিত্য। এ এক অন্য অনুভূতি। পড়তে পড়তে হারিয়ে যাওয়া আলো-আঁধারি রহস্য-রোমাঞ্চের চোরা গলিতে। পুরুষালি চেহারা, বলিষ্ঠ কাঠামো, ক্ষুরধার বুদ্ধি, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, কখনো ‘মগজাস্ত্র’, কখনো বা আগ্নেয়াস্ত্র, সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা অ্যাসিস্টান্ট বা সহকারী- এমনই একটা চেনা ছক নিয়ে বিশ্ব তথা বাংলা সাহিত্য পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল একাধিক গোয়েন্দা চরিত্র। যাদের দাপুটে রাজত্ব আজও অমলিন। শুধু পুরুষ চরিত্রই নয় কালক্রমে রহস্যের সন্ধান করেছেন কখনো নারী কখনো আবার শিশু চরিত্র।

         না, না আমি কিন্তু কার্টুন সাহিত্যের সঙ্গে গোয়েন্দা সাহিত্যের কোনোরকম তুলনামূলক আলোচনা করছি না। তবে একটা কথা জানিয়ে রাখি ‘ক্রাইম’ কাহিনি বা অপরাধ কাহিনির সাথে ‘মিস্ট্রি’ গল্প বা রহস্য কাহিনির গঠনগত খুব একটা তফাৎ না থাকলেও মূল একটা ‘চোখ-এড়ানো’ পার্থক্য কিন্তু রয়েই যায়। ক্রাইম কাহিনিতে ‘অপরাধ’ মূল উপাদান অর্থাৎ অপরাধের কাঁধে ভর করেই গড়ে ওঠে কাহিনি। এ যেন অপরাধীর মুখোশ খুলে দেবার ছোট্ট একটা খেলা। মূলত অপরাধ সম্পন্ন হবার পরেই শেষ হয় গল্প। অপরাধীকে পাকড়াও করা অবধি অপেক্ষা করতে হয় না, কারণ শুরু থেকেই পাঠক জানেন অপরাধী কে।

       অন্যদিকে গোয়েন্দা গল্পে আমরা দেখি অপরাধ সংঘটিত হবার পর অপরাধের অনুসন্ধান করেন একজন গোয়েন্দা। উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রমের মাধ্যমে মুখোশ পরে থাকা ‘ছায়াময়’ অপরাধীকে রহস্যের আবরণ উন্মোচন করে এবং বাকি চরিত্রের মধ্যে থেকে চিহ্নিত করেন গোয়েন্দা। এই ধরণের গল্পে অনুসন্ধান(ইনভেস্টিগেশন), বিশ্লেষণ(ডিডাকশন) এবং শনাক্তকরণ(ডিটেকশন) প্রধান ভূমিকা পালন করে। সহজ কথায় গোয়েন্দাই হল মুখ্য চরিত্র।

       বিষয়ের উপস্থাপনা, রহস্যভেদের নতুনত্ব, গোয়েন্দার দক্ষতা আর তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি গুণগুলো নিয়ে গোয়েন্দা গল্প বরাবরই আমাদের আকৃষ্ট করে। এই গোয়েন্দা গল্প রচনার একটা সহজ ফরমুলা দিয়েছিলেন কিরীটী রায়ের স্রষ্টা নীহাররঞ্জন গুপ্ত। তাঁর কথায়, “…মনে মনে ডিসেকশন করে আগে নিজেকে দুভাগে কাটো। প্রথমভাগে নিজে ক্রিমিনাল হয়ে ক্রাইম-রহস্য-রোমঞ্চ হোয়াটেভার স্টোরি তৈরি করো। তারপর তোমারই দ্বিতীয় ভাগটা দিয়ে একজন ডিটেকটিভ চরিত্র হয়ে যাও। ভাবো একজন গোয়েন্দা হলে কী করত। পুরো ঘটনাকে আবার চিরে চিরে ডিসেকশন করতে থাকো। …ঘটনার একেবারে ভিতরে ঢুকে যাও। দেখবে তখন নিজে নিজেই বেরিয়ে আসবে সমাধান।”

         গোয়েন্দা গল্পের আর একটু কাটাছেঁড়া চালালে আমরা দেখি যে, গল্পে লেখকের সৃষ্ট গোয়েন্দার ভূমিকা অনুযায়ী এই গোয়েন্দা গল্পকে সাধারণত তিনভাগে ভাগ করতে পারি।
ক. কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘গোয়েন্দা’।
      অ. ইনি পেশাদার বা অপেশাদার গোয়েন্দা। অপরাধ হলে একে ডেকে আনা হয়। তারপর শাণিত বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে চলে রহস্য ভেদের প্রয়াস। যেমন- ব্যোমকেশ, ফেলুদা।
   আবার অনেক সময় এখানেই পুলিশকেও দেখা যায় গোয়েন্দা হিসাবে। যেমন- শবর।
     আ. এখানেও কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘গোয়েন্দা’। পার্থক্যটা হল যেকোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত বিচক্ষণ, বুদ্ধিসম্পন্ন ও অনুসন্ধানপ্রিয় এই গোয়েন্দা ঘটনার মধ্যে নিজেই নিজেকে জড়িয়ে নেন রহস্যভেদের উৎসাহে। যেমন- কাকাবাবু।

খ. কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘অপরাধ’।
      অপরাধ ও অপরাধীকে কেন্দ্র করে লেখা এই ধরণের গল্পে গোয়েন্দা থাকেন এবং অপরাধীকে ধরিয়েও দেন। গোয়েন্দা প্রতিনায়ক মাত্র। নায়ক হয়ে ওঠে অপরাধীই।

গ. এখানে অপরাধী এবং গোয়েন্দা দুই-ই ধাবমান। একে অপরের দিকে, আবার একে অন্যের থেকেও। এখানে তাই কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠে গল্পের গতি।

        এই ধরণের শ্রেণীবিভাজনের কথা সরিয়ে রাখলে আলোচনাক্রমে আর একটা যে বিষয় উঠে আসে তা হল, এই গোয়েন্দা কাহিনির মূল ধারা দুটি :-
    ১. ‘হুডানইট’ বা ‘Whodunit‘ অর্থাৎ অপরাধ কে করেছে? হু হ্যাস ডান ইট?/হু ডিড্ ইট?(Who has done it?/Who did it?) : এই ধারার লেখাগুলিতে যেমন রহস্য সমাধানের সূত্রগুলি গল্পের শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তেমন ভাবেই ছড়ানো থাকে ‘রেড হেরিং'(Red Herring) বা ভুল সূত্রগুলি। উদ্দেশ্য আসল সূত্র থেকে পাঠকের মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া। গল্প শেষ হবার পূর্বে সূত্র সাজিয়ে পাঠক দোষী ধরতে না পারলেই লেখক সফল।
        এই ‘হুডানইট’ ধারার আবার কয়েকটি উপধারাও আছে। যেমন-
       ক.আদালত নাটক /Courtroom drama: কোর্টে উকিলের ক্ষুরধার সওয়ালে অপরাধীর চিহ্নিতকরণ। এই ধরণের লেখা বাংলায় যদিও খুব কম।
      খ. পুলিশি তদন্ত: এখানে পুলিশের বিভিন্ন অনুসন্ধান পদ্ধতিকে তুলে ধরে রহস্যের কিনারা করা হয়।
      গ. মেডিকো লিগ্যাল বা ফরেন্সিক গোয়েন্দা কাহিনি: আধুনিক ফরেন্সিক বিজ্ঞানের নানান প্রয়োগে এই ধারাটি সম্প্রতি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এর কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায় রিচার্ড অস্টিন ফ্রিম্যানের লেখায়।

  ২. ‘হাউকেচেম’ বা ‘Howcatchem‘ বা কেমনে ধরি তারে : আনুমানিক বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে গোয়েন্দা গল্পের এই ধারাটির সূত্রপাত হয়। মূলত ইনভার্টেট ডিটেকটিভ স্টোরিস বা উল্টো গোয়েন্দা গল্প নামে পরিচিত এই ধরণের গল্পে খুন বা প্রধান অপরাধ প্রথমেই দেখিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি কে অপরাধী তাও বলে দেওয়া হয়। গোয়েন্দা কীভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে পাকড়াও করছে সেটাই গল্পের উপজীব্য। এই ধাঁচের গল্প খুব বেশি লেখা না হলেও সিনেমার পর্দায় এর প্রয়োগ প্রায়শই দেখা যায়।

          আমার কথা শুনে হয়তো অবাক হতে পারেন কিন্তু এ কথা না বললেই নয়, সারা বিশ্ব সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও  মেইন-স্ট্রিম সাহিত্য চিরকালই এই রহস্য-রোমাঞ্চ বা গোয়েন্দা গল্পকে একটি অনাভিজাত্যের তকমা লাগিয়ে দিয়েছে। ফলস্বরূপ এই গোয়েন্দা সাহিত্যকে সিরিয়াস সাহিত্য পাঠের আসরে স্থান দিতে আমাদের অনেকেরই প্রবল আপত্তি ও অনীহা। আমার এই বক্তব্যের সত্যতা বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেয় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘ব্যোমকেশের ডায়েরী’র ভূমিকায় (১৯৩৩) তাঁর মতামত।
শরদিন্দু বাবু লিখছেন-
ডিটেকটিভ গল্প সম্বন্ধে অনেকের মনে একটা অবজ্ঞার ভাব আছে– যেন উহা অন্ত্যজ শ্রেণির সাহিত্য– আমি তাহা মনে করি না। এডগার অ্যালান পো (Edger Allan Poe), কোনান ডয়েল (Conan Doyle),জি.কে.চেস্টারটন (G.K.Chesterton) যাহা লিখিতে পারেন, তাহা লিখিতে অন্তত আমার লজ্জা নাই।”
আর যা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্র কুমার রায়, সত্যজিৎ রায় লিখতে পারেন তা পড়তে অন্তত আমাদের লজ্জা থাকার কথা নয়। আর তাই বোধহয় বড় হবার সাথে সাথে গোয়েন্দা গল্পের প্রতি টানটা বেড়েছে প্রবলভাবে। এক্ষেত্রে নেশা-মুক্তি তো দূরের কথা।

         প্রবল প্রাচুর্য এবং বৈচিত্র্যে ভরা মহীরুহসম এই গোয়েন্দা গল্পের মূল শিকড়ের সন্ধান চালালে যে চিত্রটা উঠে আসে সেটা অনেকটা এইরকম, আনুমানিক ঊনবিংশ শতকের শেষ দিক। গোয়েন্দা গল্প প্রকাশিত হল সাহিত্যের এক পূর্ণাঙ্গ রূপ বা শাখা হিসাবে। কিন্তু তার বীজ অঙ্কুরিত অবস্থায় পাওয়া যায় অনেক আগে থেকেই। আধুনিক গোয়েন্দা গল্পের প্রাচীনতম রূপ দেখতে পাওয়া যায় ওল্ড টেস্টামেন্টের দানিয়েলের গল্পে। বিভিন্ন তথ্যের আভাসে জানা যায় গল্পটি প্রায় চারহাজার বছরের পুরানো। এটি একটি পায়ের ছাপের সাহায্যে অপরাধের সমস্যা সমাধানের গল্প। এইরকম গল্প আমাদের পরিচিত পঞ্চতন্ত্রের গল্পেও পাওয়া যায়, তবে তা বয়সে তুলনামূলক নতুন। অন্যদিকে সুপ্রাচীন বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে ঋগ্ বেদে ক্রাইম গল্পের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। বিদেশী প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশী গোয়েন্দা কাহিনার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় ‘আরব্য রজনী’র মধ্যে। গোয়েন্দা সাহিত্যকে যদি অনুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় ফেলে দেখি, দেখতে পাই সেখানে দুটো নীতি কথা আছে। শুভ বুদ্ধির জয় আর অপরাধ করলে ধরা পরতেই হবে। একটু ভালো করে দেখলে দেখা যাবে আমাদের পুরাণের নীতিকথার গল্পগুলোর মূলভাব টাই তাই। নীতিকথা কোনোভাবেই গোয়েন্দা সাহিত্য নয় একথা ঠিক কিন্তু গোয়েন্দা গল্পের মূল ধারাকে অবশ্যই অনুপ্রাণিত করেছে এই নীতিকথা, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের চির পরিচিত বেতাল ও বিক্রমাদিত্যের গল্প, পঞ্চতন্ত্রের গল্প, জাতকের গল্প, হিতোপদেশ প্রত্যেকটিতেই গোয়েন্দা গল্পের যে বীজ লুকানো আছে তা অস্বীকার করার জায়গা নেই।

       বাংলা সাহিত্য বারংবার অনুপ্রাণিত হয়েছে বিদেশি সাহিত্য দ্বারা। যার একটা কারণ যদি হয় বিদেশি উপনিবেশ, অপর কারণ হল সাহিত্য কখনোই ভাষার পাঁচিলে বাঁধ মানেনি। বারবার ভেঙেছে,নতুন ভাবে এগিয়েছে। গোয়েন্দা গল্পের বীজ পোঁতা হয়েছিল, সুগন্ধির দেশ ফ্রান্সে। যদিও তার প্রকৃত জন্ম আমেরিকায়। ‘এডগার অ্যালান পো‘র হাতে। আর লালন-পালনের দায়িত্ব যৌথভাবে নিয়েছিল আমেরিকা আর ইংল্যান্ড। ভলটেয়ার যে গোয়েন্দা সাহিত্যের খসড়া এঁকেছিলেন তার উপর কাঠামো তৈরি করেন ভিদিক। আর পো (Poe) তাতে প্রাণ সঞ্চার করেন। আধুনিক কালের প্রথম গোয়েন্দা সাহিত্য হিসাবে বিবেচিত পো-এর  ‘মার্ডার ইন দ্যা রু মর্গ’ এর কথা বাদ দিলে আর দুটি গল্প পাই,’দ্যা মিস্ট্রি অফ্ মেরি রজেট’ (১৮৪২-৪৩) এবং ‘দ্যা পারলয়েন্ড লেটার'(১৮৪৫), তিনটি গল্প একত্রে ‘টেলস্’ (‘Tales’) পরে নাম পরিবর্তন করে ‘টেলস্ অফ্ মিস্ট্রি অ্যান্ড সাসপেন্স’ (‘Tales of Mystery and Suspense’) নামে প্রকাশিত হল। বলাই বাহুল্য পো-এর গোয়েন্দা দ্যুপাঁ (Charles August Dupin) বর্তমান গোয়েন্দাদের রূপরেখাটি সৃষ্টি করল। পরে প্রায় সকলের লেখাতেই পো-এর প্রভাব পড়ল। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল দ্যুপাঁ ছিলেন শখের গোয়েন্দা, যে ধারণার সৃষ্টি তখনো পর্যন্ত হয়নি। আমেরিকায় যদি পো হন তাহলে ইংল্যান্ডে চার্লস ডিকেন্স। ১৮৫৩ সালে ‘ব্লিক হাউজ’ এর মাধ্যমেই গোয়েন্দা সাহিত্যের সূচনা ইংল্যান্ডে। ১৮৭০ সালে চার্লস ডিকেন্সের শেষ অসম্পূর্ণ উপন্যাস ‘দ্যা মিস্ট্রি অফ্ এডুউইন ড্রুড’ শেষ করতে পারলে একটি বিখ্যাত গোয়েন্দা উপন্যাস হতে পারত বলে মনে করেন গবেষকরা। চার্লস ডিকেন্সের পর উইলকি কলিন্সও গোয়েন্দা গল্প লিখে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ১৮৬০ সালে লেখেন ‘দ্যা উওম্যান ইন হোয়াইট’ এবং ১৮৬৮ তে ‘দ্যা মুনস্টোন’। টি.এস. এলিয়ট এবং ডরোথি সেয়ার্সের মতে ‘দ্যা মুনস্টোন’ শ্রেষ্ঠ ইংরাজী গোয়েন্দা উপন্যাস।
        আমেরিকার মাটিতে পা দিলে পাই মহিলা ঔপন্যাসিক অ্যানা ক্যাথরিন গ্রিন কে। তাঁর প্রথম লেখা ‘দ্যা লিভেনওয়ার্থ কেস’। সৃষ্টি করলেন গোয়েন্দা গ্রাইসকে। এই গ্রাইসকে নিয়েই এরপর বেশ কয়েকটি ডিটেকটিভ গল্প লিখে প্রথম ‘সিরিজ’ গোয়েন্দার সৃষ্টি করলেন। আর্থার কোনান ডয়েলের প্রথম ডিটেকটিভ কাহিনি ‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালে এবং তাঁরই সৃষ্ট সর্বজনবিদিত শার্লক হোমস বিখ্যাত হবার আগে গ্রাইস-ই ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র। এই প্রসঙ্গে আগাথা ক্রিস্টিকে যেমন ‘গোয়েন্দা গল্পের সম্রাজ্ঞী’ বলা হয়,তেমনই ক্যাথারিন গ্রিন-কে  ‘দ্যা মাদার অফ ডিটেকটিভ নভেল’ বলা হয়।
        মহিলা গোয়েন্দা রচয়িতার কথাতে মাথায় এলো আরো একজনের নাম – ক্যাথরিন ক্রো। ওঁর লেখা ‘দ্যা অ্যাডভেঞ্চারস অফ সুজান হপ্লি অর সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪১ সালে। প্রথম মহিলা গোয়েন্দা লেখক হলেন মেট্টা ভিক্টোরিয়া ফুলার ভিক্টর। ‘ডেড লেটার’ লেখাটি অবশ্য সিলি রেজেস্টার ছদ্মনাম ব্যবহার করে লিখেছিলেন তিনি।
          জি.কে.চেস্টারটন সৃষ্টি করেছিলেন এক অনন্য গোয়েন্দা চরিত্র। ফাদার ব্রাউন, এক ক্যাথলিক পাদ্রি। ইনি শার্লক হোমসের মতো অনুসন্ধান করেন না, বরং ধর্মীয় অনুশাসনের সূত্রের মাধ্যমে অপরাধীকে ধরেন। অন্যদিকে রিচার্ড অস্টিন ফ্রিম্যানের লেখায় দেখি শার্লক হোমসের প্রভাব। ফ্রিম্যান সৃষ্ট ড.জন থর্নডাইক শার্লক হোমসের মতোই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সমস্ত সমস্যার সমাধানের পথে হেঁটেছিলেন। তবে যে পার্থক্যটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তা হল, শার্লক হোমসের বিশ্লেষণ অনেকটাই মনের মধ্যে, মাথার ভিতরে, যা আমাদের চোখের দৃষ্টির বাইরে। কিন্তু ড.জন থর্নডাইকের বিশ্লেষণ পাঠকের সামনে,চোখের ওপর এবং তা সকলেই জানতে পারে।
          ‘ইট ইজ ইম্পসিবল নট টু বি থ্রিলড বাই ই.ডব্লু’  (‘It is impossible not to be thrilled by EW’ )– এই লেখা দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে আমি এডগার ওয়ালেসের কথা বলছি। খুব থ্রিলড যে কেউ হত তার প্রমাণ না থাকলেও একথা বলাই যায় যে ওয়ালেসের সহজ সরল বর্ণনা পাঠকদের অনায়াসেই আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর সবচেয়ে সফল গোয়েন্দা পুলিশে চাকরিরত জে.বি.রিডার।
            ওয়ালেসের পর চলে আসতে হয় ফিলিপস ওপেনহাইমের কথায়। তবে ওপেনহাইম বেশিদিন পাঠককে আকর্ষণ করে রাখতে পারেননি। কারণ তাঁর লেখায় মস্তিষ্কের খোরাক থাকত যৎসামান্যই। তার বদলে থাকত ঘটনার ঘনঘটা। মারামারি, হানাহানি আর আগ্নেয়াস্ত্রের গজরানি। অন্যদিকে আর্ল স্ট্যানলি গার্ডনার তৈরি করলেন ব্যারিষ্টার পেরি মেসনকে। এটা ছিল একটা নতুন ধারা, প্রথাগত গোয়েন্দার বাইরে।
         যাঁরা ক্রাইম কাহিনির স্বর্ণযুগের সঙ্গে ওতপ্রতো ভাবে জড়িত তাঁরা হলেন আগাথা ক্রিস্টি আর ডরোথি সেয়ার্স। আগাথা ক্রিস্টির নাম এলেই চলে আসে হারক্যুল(এরক্যুল) পোয়ারোর নাম। পোয়ারো বেলজিয়ামের প্রাক্তন গোয়েন্দা পুলিশ। গোঁফের প্রতি অত্যধিক শৌখিন,ভুল ইংরেজী,পোশাকের প্রতি খুঁতখুঁতে,চকোলেট এবং মিষ্টি সিরাপের প্রতি আসক্তি সব মিলিয়ে তাকে এক কমিক চরিত্রের মত লাগলেও, তাক লাগিয়ে দেন যখন অপরাধীর মনস্তাত্বিক অভিসন্ধির খোঁজ করে অপরাধীকে ধরে ফেলেন। পোয়ারোর অভিনব গোয়েন্দা গিরির সঙ্গে মিশে আছে আশাতীত জীবনবীক্ষার স্বাদ। পোয়ারোর প্রথম গল্প ‘দ্যা মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস’ আর শেষ ‘কার্টেন’।
           অন্যদিকে ডরোথি সেয়ার্সের লেখা গোয়েন্দা গল্প গুলি হল ‘অ্যাকাডেমিক’ গল্প। তাঁর গোয়েন্দা লর্ড পিটার উইমসির চরিত্রে অক্সফোর্ডের শিক্ষা এবং আভিজাত্যের চিহ্ন স্পষ্ট।
         
            বিদেশে গোয়েন্দা গল্প লিখে জনপ্রিয় হয়েছেন এমন লেখক-লেখিকা এবং তাঁদের সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রের অভাব নেই। এখানে মূলত তাদেরকেই বেছে নেওয়া হয়েছে যাদের প্রভাব সরাসরি বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে পড়েছিল বা আজও আছে।
   
                ফিরে আসি বঙ্গভূমিতে।
       
       আঠারো শতকের গোড়ার দিকে পাদ্রি উইলিয়াম কেরির ‘ইতিহাসনামা‘ বইটিতে সমস্যার সমাধান করেছিলেন এক বিচারক। এই বিচারক স্বয়ং গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আধুনিক গোয়েন্দা গল্পের মজা অনুপস্থিত থাকলেও এই সমস্ত গল্পের মধ্যেই লুকানো ছিল গোয়েন্দা গল্পের বীজ।
          স্বর্ণকুমারী দেবী তখন ‘ভারতী’ মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদিকা, তাঁরই উৎসাহে ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হল নগেন্দ্রনাথ গুপ্তর ‘চুরি না বাহাদুরি’। যদিও এই গল্পের মাধ্যমেই বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের সূচনা বলে ধরা হয় কিন্তু সে অর্থে ডিটেকটিভ গল্প না বলে একে রহস্যমূলক গল্প বলা যেতে পারে। এরই সমসাময়িক সময়পর্বে প্রকাশিত হল ‘উদাসিনী রাজকন্যার গুপ্তকথা’। ছদ্মনামধারী লেখক হলেন ‘দেড়ে বাবাজি’।
    
          আনুমানিক ১৮৯০ সাল প্রকাশিত হল দামোদর মুখোপাধ্যায়ের ‘শুক্লবসনা সুন্দরী’। এটি মূলত উইলকি কলিন্সের লেখা ‘দ্যা উওম্যান ইন হোয়াইট’ এর অনুবাদ। অন্যদিকে ‘গোয়েন্দা গল্প’ নামে পত্রিকা চালাতেন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক অম্বিকাচরণ গুপ্ত। সেখানেই প্রকাশিত হয় ‘নথীর নকল’, ‘স্বর্ণবাঈ’ ইত্যাদি।

            সময়টা আনুমানিক ১৮৯২ সাল। সরকারি ডিটেকটিভ বিভাগে কর্মরত প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের গল্পের সিরিজ প্রথম বের হতে থাকে ‘দারোগার দপ্তর’ নামে। প্রথম বই ‘বনমালী দাসের হত্যা’। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘রাণী সুধামুখী’ সে যুগের আর একটা গোয়েন্দা উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৮৯৪ এ।

        ‘কলকাতার একাল ও সেকাল’ লিখে পরিচিত ঐতিহাসিক হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ‘আশ্চর্য হত্যাকান্ড’কে গবেষকরা মনে করেন কিশোরদের জন্য লেখা প্রথম ক্রাইম থ্রিলার। ১৮৯৪ সালে ‘সখা ও সাথী’ মাসিক পত্রিকাতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর লেখা অন্যান্য গল্পগুলি হল- ‘কঙ্কণ চোর’, ‘লাল চিঠি’, ‘পান্নার প্রতিশোধ’ ইত্যাদি।

          এরপর ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কেলেঙ্কারি ও অপরাধমূলক ঘটনা নিয়ে লেখেন ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ এবং এই একই সময় পর্বে অর্থাৎ ১৮৯৬ এ কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ করলেন ‘বাঁকাউল্লার দপ্তর’। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের প্রথম মৌলিক রচনা ‘উদোর ঘিরে বুদোর বোঝা’ । ‘নন্দনকানন’ পত্রিকায় অন্য নামে তিনি লিখতেন। তাঁর বিখ্যাত গল্পগুলি হল- ‘আয়েষা’, ‘চীনের ড্রাগন’ ইত্যাদি। এছাড়া তিনি ‘রহস্য লহরী’ নামে গোয়েন্দা গল্পের সিরিজ প্রকাশ করেছিলেন।
    


           বাংলা গোয়েন্দা গল্পের বাঁক বদল করলেন পাঁচকড়ি দে। ইনিই প্রথম বাংলা গল্পের দুটি ডিটেকটিভ চরিত্র সৃষ্টি করলেন- দেবেন্দ্রবিজয় ও তার সহকারী অরিন্দম। উল্লেখযোগ্য রচনা ‘নীলবাসনা’, ‘মায়াবিনী’, ‘রহস্য বিপ্লব’ ইত্যাদি।

         ত্রিশের দশকে প্রণব রায় আনলেন গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ীকে। সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য লিখলেন ‘দুই দারোগা’ , ‘নকল নারী’, ‘ধরিবাজ চোর’ ইত্যাদি।

       ১৯২৮ সালে ‘রামধনু’ পত্রিকায় লেখক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য তাঁর ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে আবির্ভাব ঘটালেন জাপানি গোয়েন্দা হুকোকাশির। তাঁর সম্পাদিত ‘রহস্য চক্র’ নামে গোয়েন্দা সিরিজ প্রকাশিত হয়। রোমাঞ্চ পত্রিকায় লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র পরাশর বর্মাকে পাঠকের কাছে হাজির করলেন প্রথম লেখা ‘গোয়েন্দা কবি পরাশর’-এর মধ্য দিয়ে।

          বাংলা গোয়েন্দা কাহিনিতে নতুনত্ব নিয়ে আসেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। তিনিই প্রথম ডিটেকটিভ ভাবনায় বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর ‘জয়ন্তের কীর্তি’, ‘শনি মঙ্গলের রহস্য’, ‘সাজাহানের ময়ূর’ ইত্যাদি বহু পরিচিত।

          গোয়েন্দা গল্পের শক্তিশালী লেখকদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে যার নাম তিনি হলেন নীহাররঞ্জন গুপ্ত। গোয়েন্দা কিরীটী রায় এবং সহকারী সুব্রত তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি। তাঁর শ্রেষ্ঠ অপরাধী চরিত্র ‘কালো ভ্রমর’কে ভোলা যায় না। অন্যদিকে সুকুমার সেন বাংলা গোয়েন্দা কাহিনির শ্রেষ্ঠ লেখকের মর্যাদা দিয়েছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী এবং সহকারী অজিত প্রায় সকলেরই ভীষণ পরিচিত এবং প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র। বিখ্যাত কয়েকটি রচনা- ‘চিড়িয়াখানা’, ‘মাকড়সার রস’, ‘চোরাবালি’ ইত্যাদি। ১৩৩৯  বঙ্গাব্দে ‘বসুমতী পত্রিকায় ‘পথের কাঁটা’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে ব্যোমকেশের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৫  তে সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে শুরু হল ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি। ফেলুদা ওরফে প্রদোষ মিত্র, তপসে এবং লালমোহন গাঙ্গুলী চরিত্রগুলো বাঙালি হৃদয়ে আজও অমলিন। গোয়েন্দা গল্পে যুক্তি ও বুদ্ধির দাপট দেখিয়েছেন সৈয়দ মুস্তাফা  সিরাজ। নারায়ণ সান্যালের ‘কাঁটা সিরিজ’ বেশ উল্লেখযোগ্য। তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রগুলি হলো- পি.কে.বসু, শার্লক হেবো।

         শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা চরিত্র বরদাচরণ মূলত কিশোর পাঠ্য মজার চরিত্র। এছাড়া তাঁরই সৃষ্ট শবর দাশগুপ্ত পাঠক মহলে খুবই জনপ্রিয়। সমরেশ বসু লিখেছেন ছোটদের জন্য গোয়েন্দা কাহিনি। তাঁর গোয়েন্দা গল্পের নায়ক গোগল প্রাপ্ত বয়স্ক গোয়েন্দা নয়,তার ছিল অনুসন্ধিৎসু মন এবং অপার কৌতূহল।

          সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বানালেন একটু অন্য ধরণের অ্যাডভেঞ্চার চরিত্র রাজা রায়চৌধুরী অর্থাৎ কাকাবাবুকে। ‘রহস্য রোমাঞ্চ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিমল কর ও কবি অরুণ ভট্টাচার্য। বিমল করের সৃষ্ট চরিত্র কিকিরা ওরফে কিঙ্কর কিশোর রায়। ‘রহস্য’ পত্রিকার সম্পাদক গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান গোয়েন্দা দিলীপ সান্যাল ও তার সহকারী ত্রিদিব চৌধুরী। কবি আনন্দ বাগচীর গোয়েন্দা সত্যপ্রিয়। হীরেন চট্টোপাধ্যায় গোয়েন্দা সাহিত্যে আনলেন যে দুজন গোয়েন্দাকে তারা হলেন সুধাময় ও ম্যাক। হাসির গল্পকার হিমনীশ গোস্বামী হাস্যরস সহযোগে গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন। হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় সৃষ্টি করলেন গোয়েন্দা পারিজাত বক্সীকে। এই পারিজাত বক্সী কল্পিত হয়েছে ব্যোমকেশ বক্সীর ভাইপো হিসাবে। অন্যদিকে পূর্ণেন্দু পত্রী তাঁর গল্পে গোয়েন্দা চরিত্র হিসাবে আনলেন ব্যোমকেশের পুত্র জুনিয়র ব্যোমকেশকে। শেখর বসু অল্প বয়সী গোয়েন্দা চিন্ময়কে সৃষ্টি করলেন। অন্যদিকে ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকায় দিলীপকুমার চট্টোপাধ্যায় নিয়ে এলেন ব্ল্যাক ‘ডায়মন্ড’ সিরিজ। পাশাপাশি কিশোরদের জন্যই ডিটেকটিভ গল্পের সিরিজ এনেছেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। এই প্রসঙ্গে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভাদুড়ী মশাইকে বাদ দেওয়া যায় না। হাল আমলের লেখক সুজন দাশগুপ্তর ‘একেন বাবু’ বহু সমাদৃত।

          যদি বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা কাহিনির প্রথম মহিলা লেখিকার সন্ধান করি তাহলে যে নামটা উঠে আসে তা হল সরলাবালা দাসী। তাছাড়া বাংলা সাহিত্যে মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র প্রথম কল্পনা করেছিলেন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী। তাঁর প্রথম উপন্যাস গুপ্ত ঘাতক(১৯৫২)। আবার ষাটের দশকে উপেন্দ্র কিশোর রায়ের নাতনী নলিনী দাস বাংলা সাহিত্যে আনলেন মেয়ে গোয়েন্দার দল ‘গন্ডালু’। আধুনিক সময় পর্বে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের হাত ধরে এলেন মিতিন মাসি। হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের নামকরা গোয়েন্দা। এরপর অদ্রীশ বর্ধনের ‘নারায়ণী’, প্রদীপ্ত রায়ের ‘জগাপিসি’, মলয় রায়চৌধুরীর ‘রিমা খান’ এবং হাল আমলে দেবারতি মুখোপাধ্যায় আনলেন ‘রুদ্রাণী’কে। সময় পর্বের ছকটা ভেঙ্গেই মহিলা লেখিকা ও মহিলা গোয়েন্দাদের আলোচনাটা স্বল্প পরিসরে সারলাম।

          সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে সুদূর ফ্রান্স-আমেরিকা-ইংল্যান্ড হয়ে ভারত তথা বঙ্গভূমিতে বহুকাল পূর্বে আছড়ে পড়েছিল যে গোয়েন্দা সাহিত্যের ঢেউ তা আজও সিক্ত করে রেখেছে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপ্তপ্রসারী উপকূল অঞ্চলকে। টানটান উত্তেজনায় ভরা এই রহস্য রোমাঞ্চের গোয়েন্দা গল্পের সাথে অন্যান্য গল্পের মূল পার্থক্যের জায়গাটা হল বুদ্ধির খেলা। গোয়েন্দা তার বিশ্লেষণ ক্ষমতা, যুক্তিবোধ, তীক্ষ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা,ক্ষুরধার বুদ্ধি এসবের উপর ভিত্তি করে অপরাধীর সাথে বুদ্ধির প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেন। সহজ কথায় গোয়েন্দা গল্প হল একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার, তার সাফল্য লাভের গল্প। বহু শতাব্দী পূর্বে পথচলা শুরু করে আজও একইরকম জনপ্রিয়তার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে গোয়েন্দা সাহিত্য। সত্যিকারের উৎস সন্ধানে প্রয়াসী হয়ে কতটা সফল হলাম জানি না, তবে এই গোয়েন্দা সাহিত্যের অমলিন,সজীব,দীর্ঘ পথ চলার প্রতি রইলাম আশাবাদী। আশা করছি টুকরো টুকরো সময় পর্ব দিয়ে শব্দ-বাক্যের কাঠামোয় যে কোলাজ নির্মাণ করলাম তা কিছুটা হলেও গোয়েন্দা সাহিত্যের উৎসের ইতিহাসটা বলবে।

       ——————————-