তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোয় রহস্য-রোমাঞ্চ-ভূতের হাতছানি ও কিশোর মন
কলমে :- ধৃতি সিংহ
যদি বলি ভূত আছে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে প্রমাণ কী ? প্রশ্নকর্তা আমাদের যুক্তিবাদী মন। মনের আবার নানা স্তর – চেতন , অচেতন , অবচেতন । এই তিন স্তরের কারসাজি ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের আলোচ্য বিষয় হতে পারে। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন ভূত-রহস্য-রোমাঞ্চ তাও আবার কিশোর মনের প্রেক্ষিতে, তখন সাহিত্যকে সঙ্গী করে খুঁজতে হবে মনস্তত্ত্বের অলিগলি । শুধুই মনোরঞ্জন নাকি আরো কোন প্রভাব কাজ করে এই আপাত নিরীহ ভৌতিক-রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পের ! রূপকথা হোক বা পঞ্চতন্ত্র , শার্লকহোমস বা ফেলুদা , হ্যারিপর্টার হোক বা সবুজ মানুষ , ভূত হোক বা পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার – তথ্য আর সত্যের মধ্যে ভারসাম্য মেনে লেখা বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধের আবেদন তাই মনের কাছে , বুদ্ধির কাছে ।
শিশুমনস্তত্ত্বের উপর সাহিত্যের প্রভাব উল্লেখ করে জ্যাকলিন স্যান্ডার্স ‘Psychological Significance of Children’s Literature’ প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন –
“To gurantee that the child psychologically experiences literature as a useful tool, the first books that he reads are of crucial importance.”১ শিশুর প্রথম পাঠের গুরুত্ব যেমন তিনি স্বীকার করেছেন তেমনি কিশোর মনে বিভিন্ন ধরনের কাহিনীর প্রভাব সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন –
”The extent to which a particular piece of writing evokes anxiety has to be related not only to its psychological implications but also the craft of the writer. For the well-being of the child, the danger lies in depicting a situation with either much more or much less anxiety related to it than is actually reasonable।“২ জীবনের যাত্রাপথ আগাগোড়া মসৃণ নয়। জীবনের চড়াই উৎড়াই বা বিপদসংকুল পরিস্থিতির সাহিত্যিক রূপায়ণে কিশোরমন ভালো-মন্দের ধারনার সাথে সাথে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করার প্রাথমিক আভাসটুকু পেয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক সৃষ্টির মন্তব্য যথোপযুক্ত বলে মনে হয় –
“The learning of a child from children literature can be the best and the most lasting imprint in a child’s mind and has to power to develop a sustainable and productive thought process which helps the child to develop a easily adaptable learning process in the later stages of life”. ৩
শিশুসাহিত্যের রহস্য-রোমাঞ্চের কক্ষপথে চলা শুরু করলে প্রথমেই দেখা মেলে জন বুনিয়ানের দ্য পিল্গ্রিমস প্রোগ্রেস (The Pilgrim’s Progress), ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুশো (Robinson Crusoe) এবং জোনাথন সুইফটের গালিভার্স ট্র্যাভেলস (Gulliver’s Travel’),–
আশা বন্দোপাধ্যায়ের মতে –
“যাহাদের সঙ্গে শিশু-সাহিত্যের বস্তুত কোন সম্পর্কই ছিলনা –– কিন্তু তা সত্ত্বেও শিশুমন এগুলিকে পরম কৌতুহলে আকর্ষণ করিয়া লইল।“৪
বাংলা সাহিত্যেও শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত মৌলিক বা অনূদিত অ্যাডভেঞ্চারধর্মী বা রহস্য-রোমাঞ্চধর্মী গল্প উপন্যাসেও প্রধান ভুমিকায় দেখাগেছে প্রাপ্তবয়স্ক চরিত্রদের। তা সাম্প্রতিক কালের মিতিনমাসি হন বা কাকাবাবু , কর্নেল কিংবা শবর আবার কয়েক দশক পিছিয়ে যদি দেখি ফেলুদা বা ব্যোমকেশ বক্সীকে ,তারা শিশু বা কিশোর নন তবু কিশোরমনে তাদের ছাপ সুদূর প্রসারী, এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকও তাঁদের সঙ্গে কখনো ঘুরছেন ‘মছলিবাবা’র ঘাটে, কখনো মুকুলের সাথে চলেছেন সোনার কেল্লার রহস্য উদ্ধারে, কখনোবা ব্যোমকেশের সঙ্গী হয়ে খুলে দিচ্ছেন অপরাধীর মুখোশ। আপাত বিশ্বাসযোগ্য এই ধরনের গল্পে থাকে উত্তেজনা, অজানাকে জানার কৌতূহল, রোমাঞ্চ। কখনো দীর্ঘ মরুপথে, কখনো দুর্গম গিরিপথে, ভীষণ সমুদ্রের হাতছানি, গভীর বনভূমির অচেনা পথে কিশোরমনও ঘুরে বেড়িয়েছে তার পছন্দের চরিত্রের সাথে।
বিশ শতকের প্রথম দিকে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের যকেরধন দিয়ে বাংলা ভাষায় অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর যাত্রা শুরু হয়ে পরে সুনির্মল বসু (মরণ ফাঁদ,আদিম দ্বীপে), বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ( চাঁদের পাহাড়,মরণের ডঙ্কা বাজে), পরবর্তী দশকে প্রেমেন্দ্র মিত্র, লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণা দেবী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার রোমাঞ্চকর গল্প পড়েননি এমন বাঙালী বোধহয় এখনও হাতে গোনা ! অ্যাডভেঞ্চারের সাথে সাথে বিজ্ঞান-ইতিহাস-ভূগোলের পরিক্রমা না করে ঘনাদার কবল থেকে রেহাই পাওয়া কষ্টকর ! তবে পুরো লাভটাই যে পাঠকের, এ ব্যাপারে দ্বিমতের সুযোগ নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সন্তু-কাকাবাবু সিরিজের সবুজ দ্বীপের রাজা, মিশর রহস্য, কাকাবাবু ও ব্জ্রলামায় রহস্যের সাথে সাথে জানা অজানা ভূগোল- ইতিহাসের পাঠও মেলে তবে গল্পের ছলে। সন্তুর সাহসে সাহসী হয়ে ওঠে কৈশোর। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হীরের আংটি, পাগলা সাহেবের কবর, হেতমগড়ের গুপ্তধন কিশোরমনে দাগ কেটেছে বর্ণনাভঙ্গির সাবলীলতার কারণে। আবার বুদ্ধদেব গুহর ঋজুদার জঙ্গলকেন্দ্রিক অ্যাডভেঞ্চার ও শিকারের গল্প কচিকাচাদের মধ্যে যে সাড়া ফেলেছে তার একটা কারণ নিশ্চয় রুদ্র, তিতির, ভটকাইয়ের মত চরিত্রগুলো। বাংলা শিশুসাহিত্যে তাদের মত কৌতূহলী, নির্ভীক শিশু সহযোগী চরিত্রের জুড়ি মেলা ভার। রোমাঞ্চের সাথে অলৌকিক অতিপ্রাকৃতের মিশেল ঘটেছে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অলৌকিক চাকতি রহস্য, সবুজ পাঁচিল, হাট্টিম রহস্য এ ।
রোমাঞ্চকর অভিযানকাহিনীর মত গোয়েন্দা কাহিনীর জনপ্রিয়তাও নিরবচ্ছিন্নভাবে বেড়ে চলেছে। আর্থার কোনান ডয়েলের অমর সৃষ্টি ডিটেকটিভ শার্লকহোমস ও তার সহযোগী ডক্টর ওয়াটসনের অনুপ্রেরণায় বাংলা ভাষায় গোয়েন্দা গল্প নতুন রূপ পেয়েছে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গোয়েন্দা জয়ন্তের পথে ক্রমে এগিয়ে চলেছে নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা কিরীটী রায় ও তার সহকারী সুব্রত, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা ও তোপসে, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের জাপানি গোয়েন্দা হুকা-কাশি ও সহযোগী রনজিৎ এবং আরো অনেকে। রহস্য উন্মোচনের দিকে লক্ষ্য রেখে গোয়েন্দা গল্পের প্লট তৈরি হয়ে থাকে। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি চরিত্রের পরস্পরের প্রতি সন্দেহের মনোভাব লক্ষ্য করার মত, প্রতিটি ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ, অপরাধের সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড়ে সচতন গোয়েন্দার তৎপরতা, প্রয়োজনে রিভলভার চালানোয় দক্ষতা, কখনো দুঁদে ডিটেক্টিভের নিজের মগজাস্ত্রে ঘা দেওয়া, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধীর মুখোশ খুলে নেওয়া—সব মিলিয়ে টানটান উত্তেজনায় পাঠকমন ভরে থাকে।
কিশোর পাঠক ‘জয়ন্তের কীর্তি’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’, ‘যত কান্ড কাঠমাণ্ডূতে’, ‘বাদশাহী আংটি’ র কথা মনে রেখেছে। গোয়েন্দা হুকা-কাশির আদলে শিবরাম চক্রবর্তী গড়ে তুলেছেন কল্কেকাশি নামের গোয়েন্দা চরিত্র (‘কল্কেকাশির গোয়েন্দাগিরি’) যে কেবল বুদ্ধির জোরে হারিয়ে দিয়েছে ধূর্ত প্রতিপক্ষকে, বন্দুক-পিস্তলের সাহায্য তার দরকার পড়েনি। অন্যান্য গোয়েন্দা চরিত্রের মধ্যে উল্লেখ করা যায় পরাশর গোয়েন্দা (প্রেমেন্দ্র মিত্র), কর্ণেল (সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ), গোয়েন্দা তাতার (শ্রীকান্ত গালুই), শবর (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়),গোয়েন্দা গার্গী (তপন বন্দোপাধ্যায়), মিতিনমাসি (সুচিত্রা ভট্টাচার্য) প্রভৃতি। কিশোর গোয়েন্দা হিসাবে সমরেশ বসুর গোগল ও ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পান্ডব গোয়েন্দা’র বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু -এই পাঁচ কিশোরের গোয়েন্দাগিরি ছোটদের মনে দাগ কেটেছে অন্য কারণে। গোয়েন্দা জয়ন্ত, ব্যোমকেশ, ফেলুদা, পরাশর, মিতিনমাসি, গার্গীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গোগল, বাবলু, বাচ্চুরা কৈশোরের ক্ষমতাকে চিনিয়ে দিচ্ছে, নিজেদের প্রতিনিধি পেয়ে তাই খুশি বাংলার ছোট ছোট পাঠকেরাও। কিশোর গোয়েন্দা গল্প বা অভিযানধর্মী কাহিনীর যথাযথ উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে শিশু-কিশোর মনের বিশ্লেষণী ক্ষমতা বাড়ে, বিভন্ন ঘটনার মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যুক্তির পথে তারা এগিয়ে থাকে। তবে ‘অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা ও উন্মাদনার আতিশয্য’এ রচনাগুলো ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। প্রসঙ্গত আশা গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে-
“…আধুনিক বাংলা শিশু-সাহিত্যের দিকে চাহিয়া একটি বিশেষ প্রবণতা যে-কোনো সাধারণ পাঠককেও কিছু পরিমানে বিচলিত করিয়া তুলিবে মনে হয়। শিশুদের পাঠযোগ্যতার দিক হইতে গোয়েন্দা-কাহিনী ও রোমাঞ্চকর গল্পের সার্থকতা লইয়া বিতর্কের অবকাশ আছে। এইগুলিকে শোভন ও পরিমিতভাবে পরিবেশন করিলে হয়তো অভিযোগের তেমন কারণ ঘটেনা, কিন্তু এই জাতীয় সাহিত্যের অতি-বিস্তার এবং রচনার মানের ক্রমাবনতি আজ আশঙ্কার কারণ হইয়া উঠিয়াছে। এই পর্য্যায়ের নিকৃষ্ট রচনা শিশু মনের যে কী অপরিসীম ক্ষতি সাধন করে এবং তাহাদের মূল্যবোধ ও কল্পনাশক্তিকে কিভাবে নষ্ট করিয়া দেয় – তাহার বিবরণ অনাবশ্যক।“৫
গোয়েন্দার হাত ছেড়ে এবার আলো ফেলা যাক ভূতেদের ডেরায় ! ভূতের বয়স , ভয় দেখানোর ক্ষমতা, জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে দেশি বনাম বিদেশি ভূতের তুলনা না টেনে বরং দেখা যাক তাদের বৈচিত্র্য। হোরেস ওয়ালপোলের লেখা কাসেল অব ওরান্টো (১৭৬৪) বিদেশে প্রথম ভৌতিক গল্পের মর্যাদা পেয়েছে। গবলিন, জিন, রোলাং, নোম, ভ্যাম্পায়ার – নানা ধরনের ভূত ঠাঁই পেয়েছে গল্পের পাতায়, সিনেমার পর্দায়। ফিরে আসি বাংলায় — লোকজীবনের নির্যাস দিয়ে গড়ে ওঠা রূপকথায় শিশুর প্রথম পরিচয় হয় ‘রাক্ষস-খোক্কস-দৈত্য-দানো’র সাথে। ঠাকুরমার ঝুলি র ‘জিভ লকলক’ রাক্ষসী রাণীর বর্ণনায় শিশুমনে ভয়ের অনুভূতি জেগে ওঠে। রূপকথার রাজ্যে যেমন রাক্ষস-রাক্ষসী-শাকচুন্নীরা তেমনি একালের গল্প-উপন্যাসে বহালতবিয়তে বিরাজ করছে ভূতেরা। ভূতেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরী সিনেমাও। রাক্ষস বনাম ভূত বিতর্কে না গিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যের বিভিন্ন দশকের ভূতেদের খোঁজ নিয়ে তাদের জনপ্রিয়তার কারণ আন্দাজ করা যেতে পারে।
উনিশ শতক থেকে ভূতের গল্পের পথ চলা শুরু হলেও তা ছিল রূপকথার মত। ভূত নিয়ে কৌতুক করাই ছিল মূল লক্ষ্য। বিশ শতক থেকে বাংলা গল্পে শুধু নয় পাঠকমনেও ভুতেরা দাগ কেটেছে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভূত-পেত্নী’ (১৯০২) বইটি সাড়া ফেলেছিল। এই ধারায় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের লুল্লু ও চীনে ভূত উল্লেখযোগ্য নাম। তাঁর গল্পে অন্ধকার জমে ভূত তৈরির ঘটনা আজও আমরা মনে করি। ভৌতিক গল্প রচনায় উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়,হেমেন্দ্রকুমার রায়, খগেন্দ্রনাথ মিত্রের নাম উল্লেখযোগ্য। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের ভূতের গল্প প্রসঙ্গে লীলা মজুমদারের উল্লেখ না করলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাঁর ‘অহিদিদির বন্ধুরা’, ‘তেপান্তরের পাড়ের বাড়ি’, ‘উলুবেড়ের ভূতের বাড়ি’, ‘পিলখানা’ ইত্যাদি গল্পে শিশু-কিশোর ভূতেরা সমাজের অব্যাবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কোথাও ফিরে এসেছে দুশো বছর আগে পৌষপার্বণে পিঠে খেতে চাওয়া শিশুর দল, দুরন্তপনায় অতিষ্ঠ হয়ে জমিদার যাদের জিভ কেটে দিয়েছে (‘অহিদিদির বন্ধুরা’), কোথাওবা দেখা মেলে দুর্ভিক্ষে উজার হয়ে যাওয়া বাচ্চাভূতের দলের (‘তেপান্তরের পাড়ের বাড়ি’), আবার পিলখানা গল্পে দয়ালু ভূতের সঙ্গে পরিচয় হয় পাঠকের।
ভৌতিক গল্পের এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন শ্রী সত্যজিৎ রায়, তাঁর ‘অনাথবাবুর ভয়’, ‘নীল আতঙ্ক’, ‘টেলিফোন’ প্রভৃতি গল্প পাঠকমহলে সুপরিচিত। পরবর্তী দশকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় , সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, কার্তিক ঘোষ প্রমুখ কিশোর মনোপযোগী ভৌতিক গল্প লিখেছেন। সময়ের পরিবর্তনে গল্পের প্লটের পরিবর্তন হয়েছে। ভূতের রাজ্যে বৈচিত্র্যের অভাব নেই “সত্যিভূত, মিথ্যে ভূত, লম্বা ভূত, গেছো ভূত, বাচ্চা ভূত, ভুলো ভূত, মেছো ভূত, ভীতু ভূত” — এমনকি গল্পে ‘ভূতের রাজার’ বর পেয়ে বদলে গেছে গুপী-বাঘার জীবন , ভুশন্ডির মাঠে কারিয়া পিরেত-যক্ষের মধ্যে ডাকিনীকে নিয়ে চলেছে ঝগড়া, কখনো ভূত লড়ছে লখনৌয়ের ডুয়েল, কোথাও ইঁদারায় ভূতেদের গন্ডগোলে নাজেহাল গ্রামবাসী ! এ তো হল ভালো মন্দ ভূতের নিজেদের কথা কিন্তু সমালোচকমহল ভূতেদের পরীক্ষা নিয়েছে বার বার। কখনো অপাঙক্তেয় হয়েই থেকে গেছে কখনোবা ছাড়পত্র পেয়েছে মজাদার ভূতেরা ! বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে লেখালেখিও কম হয়নি। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যয়ের নির্দেশ ছিল –
“ যদি ভূতের গল্প একান্তই কেউ দিতে চান, গল্প ও ছবি এমন দিবেন, যাহা দ্বারা ভূতগুলো হাসিয়া উড়াইয়া দিবার মত কিছু হয়।… …ভূতকে হাস্যকর অকিঞ্চিৎকর কিছু করিয়া গল্প লিখিতেও বলিনা। কিন্তু সেরকম ভূতের গল্প তবুও চলিতে পারে। আর সব রকম ভূতের গল্প ছেলেমেয়েদের বহি ও মাসিক পত্র হইতে বিদূরিত হওয়া উচিত।“৬
যদিও সবটাই শিশু – কিশোর মনের কথা ভেবেই ! এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে কবি নরেন দেবের প্রশ্ন (লীলা মজুমদারএর প্রতি) – “কেন এই মিথ্যে ভয়ের গল্প লেখ ? পড়লে ছোটরা ভীতু হয়ে যায় ।“ আবার এর পাশাপাশি গড়ে উঠেছে অন্য ধারনাও। কোন কোন সমালোচকের মতে –
“ Not only are ghost stories entertaining, they can also help children experience courage, learn about different cultures and expand their sense of community. Sharing ghost stories can help children grow braver as they fears in a safe setting reading a book or listening to a ghost story. Scary stories can show children that it is okay to be afraid and that they can use their brains to solve problems, even when they are frightened or use their natural survival instincts to safely escape from dangerous situations.” ৭
নানা মুনির নানা মত তবু একথা বলতে দ্বিধা থাকেনা যে, দেশ হোক বা বিদেশ, উনিশ শতক হোক বা বিশ শতক , ভৌতিক গল্প আজও তার জনপ্রিয়তা হারায়নি।
মনোসামাজিক বিকাশ তত্ত্বের ( Theory of Psycho-social Development) প্রবক্তা এরিক এরিকসন শিশুর জীবন বিকাশকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন- প্রারম্ভিক পর্যায় , মধ্যবর্তী বা প্রাকবয়ঃসন্ধিক্ষণ পর্যায় , বয়:সন্ধিক্ষণ বা কৈশোর পর্যায় এবং পরবর্তী পর্যায়। কৈশোর পর্যায়ে বিভন্ন দ্বন্দমূলক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, শারীরিক-বৌদ্ধিক এমন স্তর পরম্পরার মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয় , যার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা তারা পায়না। মনোস্তত্ত্ববিদ জা পিয়াঁজে (Jean Piaget) কৈশোরের পর্যায়টিকে (অর্থাৎ ১১-১৮ বছর সময়কাল) যৌক্তিক সক্রিয়তার স্তর হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তাই দেখা যায় কিশোরমন তার চারপাশের জগতকে যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে চায়। তাই একেবারে আজগুবি ঘটনা তাদের মনে জায়গা পায়না। কবিগুরুর ভাষায়-
“দুধের বদলে পিটুলি-গোলা যদি ব্যবসার খাতিরে চালাতেই হয় তবে সে ফাঁকি বরঞ্চ চালানো যেতে পারে বয়স্কদের পাত্রে, তাতে তাঁদের বুদ্ধির পরীক্ষা হবে; কিন্তু ছেলেদের ভোগে নৈব নৈব চ।“ ৮
বাস্তব ঘেঁষা রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পপাঠে তাদের আনন্দ। ভৌতিক গল্প এমন হওয়া প্রয়োজন যাতে শিশু-কিশোর পাঠকের মনে কোন ভিত্তিহীন ধারনা গড়ে তুলবেনা। আমরা শুধু বই পড়িনা , বই শুনিও ! কথা হচ্ছে অডিওবুকের । গল্পপাঠের সময় ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিকও ভয়ের পরিবেশ তৈরিতে বড় ভূমিকা নিচ্ছে। এর প্রভাব এড়ানো শক্ত। আবার এমন কিছু ভৌতিক গল্প লেখা হচ্ছে যা কালোজাদু, ডাইনী সন্দেহ, মারণ- উচাটনের মত বিষয়গুলোকে অকারণ প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। শিশুমন এগুলো খুব সহজে বিশ্বাস করে। নড়বড়ে ভিতের ওপর মজবুত সৃষ্টি গড়ে তোলা যায়না।তাই শিশু-কিশোর মনস্তত্ত্ব নিয়ে এত আলোচনা, এত তত্ত্বের অবতারণা। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার ব্যবস্থা আজ সবখানে। রুশো, ফ্রয়েবেল, ম্যাডাম মন্টেসরির শিক্ষাচিন্তার মধ্যেই শিশুশিক্ষার মূল কথা রয়েছে। শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। যেখানে শিশু তার চারপাশের জগৎকে আবিষ্কার করবে। পাঠ্যবইয়ের সীমায় আটকে না রেখে তার সামনে খুলে দিতে হবে এমন সাহিত্য জগতের দরজা যা তার জিজ্ঞাসু মনের খোরাক জোগাবে ,অজানাকে জানার পথ মসৃণ করবে, তার মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাবে ,স্বাধীন চিন্তার বিকাশে সাহায্য করবে। বিভিন্ন সাহিত্যিক-সমালোচক-মনস্তাত্ত্বিকের আলোচনায় কিশোরমনের বিভিন্ন স্তরের যে পরিচয় পাই তার নিরিখে একথা স্পষ্ট ভাবে বলা যায় যে তাদের সর্বাঙ্গীন বিকাশে সাহিত্য পাঠের বিকল্প নেই। পাঠের মধ্যে দিয়ে যেহেতু বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় ঘটে , তাই তাদের উপযুক্ত গল্প-কাহিনী নির্বাচনের দিকেও অভিভাবকের সতর্ক দৃষ্টি থাকা প্রয়োজন। জন মিল্টনের ভাষায় –
“Children show the man, as morningshows the day.”– এই প্রবাদ বাক্যকে মনে রেখে শিশু-কিশোর মনস্তত্ত্বের নীতিকে পাথেয় করে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শনের এগিয়ে যাওয়া মানব সভ্যতার সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠনের লক্ষ্য পূরণের দিকে।
১ http://www.jstor.org/stable/4305730
২ ঐ
৩ https://ijcrt.org/papers/IJCRT2002213.pdf
৪https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.301856/mode/2up
৫ https://shodhganga.inflibnet.ac.in/handle/10603/169371
৬ https://shodhganga.inflibnet.ac.in/handle/10603/169371
৭ https://www.augusthouse.com/single-post/why-scary-stories-are-so-important
৮ হীরেন চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণগোপাল রায়, সাহিত্য-প্রবন্ধ প্রবন্ধ-সাহিত্য, ( কলকাতা; বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ,১৪১১)
/ —— /