বাংলা সাহিত্য ও ‘বাংলাটা ঠিক আসেনা’ বাঙালি – একালের নিরিখে

কলমে : ধৃতি সিনহা  


       প্রবন্ধের শিরোনামে একটু ব্যঙ্গের আভাস পেলেন কী? অস্বীকার করার উপায় নেই! কিন্তু  আজ কেন হঠাৎ ‘বাঙালি’(তাও আবার ‘বাংলাটা ঠিক আসেনা’ গোষ্ঠী!) ও বাংলা সাহিত্যকে  আলোচনার বিষয় হিসাবে বেছে নিলাম! কারণ আছে। খুলে বলি? আসলে যে বন্ধুর সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে এম. এ করলাম ,কাল জানলাম সে তার ছোট্ট মেয়েকে  তৃতীয় ভাষা হিসাবেও বাংলা পড়াতে চায়না! একটু অবাক হলাম বৈকি তবে “এন্তাই তো হোন্দাই রহতা : এমনটা তো হয়েই থাকে!”১ তবু – তবু মনে হয় সত্যি কি এতটাই অবমাননা, লাঞ্ছনা মেনে নেবে আমাদের বাংলা ভাষা – সাহিত্য? শুধু বাংলা কেন কোনো ভাষাই কি মেনে নেয়? বর্তমান বাংলা সাহিত্য কী সত্যিই এত দীন যে পাঠকের দরবারে তার কদর আর আগের মতো নেই – সমালোচনা নয়, ব্যঙ্গ নয় বরং নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের আলোয় চিনে নেওয়া যাক বক্তব্যবিষয়ের স্বরূপকে।

          উনিশ শতকে নবজাগরণের হাত ধরে এগিয়ে চলা বাংলা সাহিত্য বিশ্বের দরবারে সমাদৃত হয়েছে কবিগুরুর প্রতিভায়। গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রানুসারী ও রবীন্দ্রবিরোধী কবিসমাজ। দুই বিশ্বযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, উদ্বাস্তু সমস্যা, কালোবাজার, দুর্ভিক্ষ, মূল্যবোধে ভাঙ্গন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,নকশাল আন্দোলন,জরুরি অবস্থা – ব্যাপকভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে  বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যকেও। আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি। কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে – বিশশতক বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ! এবার পালা ‘একবিংশের’! কিন্তু বিশশতক কি ফুরিয়ে গেল? না।তাকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে চলছে একুশ শতক।সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ, প্রযুক্তির অপব্যবহার, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ – একুশের অবস্থাও সঙ্গীন ! সময়ের পরিবর্তনের ছাপ বাংলা সাহিত্যেও পড়েছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই। এখন দেখে নেওয়ার বিষয় হল পরিবর্তিত সময়ের বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমরা অযথাই দুশ্চিন্তায় ভুগছি না তো ?

          শিশুসাহিত্য দিয়ে শুরুটা করা যাক । ঠাকুরমার ঝুলি থেকে শুরু করে আজকের দিনের সায়েন্স ফিকশন – বাংলা শিশুসাহিত্যে অভাব কিসের ? যদি পড়তে চাই ডিটেকটিভ গল্প – ফেলুদা আগেই পড়া আছে? তাহলে মিতিন মাসি, ঋজুদা, কর্নেল, কাকাবাবু, গার্গী, শার্লক হেবো – কত বলব ! অদ্রীশ বর্ধন, নারায়ণ সান্যাল, হুমায়ুন আহমেদ – এঁদের  সায়েন্স ফিকশন পড়ে দেখেছ? আরো আগের কথা যদি বলি – লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের গল্প ছাড়াও পড়ে দেখেছ পদিপিসির বর্মিবাক্স, টংলিং, হলদে পাখির পালকের মতো সৃষ্টিগুলো! ছড়ার তো শুনেছি বয়স বাড়েনা – পড়া আছে ছড়াগুলো ? কুমড়ো পটাশ, ট্যাশগরু নাম শুনেছ ? হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন, টেনিদা, ঘনাদা, শুঁড়অলা বাবা – চেনো এদের? মহাশ্বেতাদেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা পড়েছ? কী বলছ ? ও বাংলা বলতে পার কিন্তু লিখতে বা পড়তে খুব একটা পারনা। মুশকিল ! সমস্যা আরো আছে। ইউটিউবে দেখা বাংলা গল্পের অ্যানিমেশন কেমন যেন নিবু নিবু ! অনেক শব্দের মানে জানো না! বাংলা গল্পের বইয়ের ছবিগুলোও যেন কেমন ! সত্যি এ ব্যাপারে ওদের দোষ দেওয়া যায় না। অভিযোগ করতে গেলে অনেক কথা উঠবে। শুধু মনে করিয়ে দিতে চাইব সেই সত্যি যা কয়েক শতক আগেও ছিল ,আজ আরো ভীষণ হয়ে দেখা দিয়েছে –
“কিন্তু এখনো আমাদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাঁহারা বাঙালি ছাত্রদিগকে অধিকতর পরিমাণে বাংলা শিখাইবার আবশ্যকতা অনুভব করেন না, এমন-কি সে প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেন…তাঁহারা বলেন, ইচ্ছা করিলেই বাঙালির ছেলেমাত্রেই বাংলা শিখিতে ও লিখিতে পারে।“২  

          এ তো গেল যা ছিল-আছে-থাকবের সমস্যা। এর সাথে জুড়ে দেওয়া যেতেই পারে ভার্চুয়াল জগতের হাতছানির ব্যাপারকে। মোবাইল গেমের নেশায় বুঁদ কৈশোর ( শৈশবও বটে ) একদিকে যেমন হারিয়ে ফেলছে গল্পপাঠের আনন্দ (শুধু বাংলা নয়, যে কোনো ভাষায়), তেমনি বিভিন্ন কুরুচিকর উপস্থাপনা- অশ্লীল শব্দের সাবলীল ব্যবহার নষ্ট করছে শিষ্টভাষা ব্যবহারের স্বাভাবিক বোধ।

           এবার আসি বড়দের কথায় (যদিও ছোটদের জন্য লেখা কালজয়ী সাহিত্যের স্বাদ আমরা অনায়াসেই নিতে পারি)। অমিতাভ ঘোষ, দেভদত পট্টনায়ক, ঝুম্পা লাহিড়ী, কিরণ দেশাই, অরুন্ধতি রায়, বিক্রম শেঠ –  বিশ শতকের প্রায় শেষ থেকে শুরু করে একুশ শতকে যারা ইংরাজি সাহিত্য সমৃদ্ধ করে চলেছেন (ভারতীয় লেখক হিসাবে) –  এঁদের লেখা তো পড়েন নিশয়ই। এছাড়াও অসংখ্য অগণিত নাম উল্লেখ করা যায় যারা বিশ্বসাহিত্যের দরবারে বরেণ্য। এখন প্রশ্ন – বিশ্বসাহিত্যের মানদন্ডই কি সাহিত্য বিচারের একমাত্র উপায়? আঞ্চলিক ভাষায় (অন্যান্য ভাষাতেও) লেখা সাহিত্যের সাফল্য বা ব্যর্থতা কি নোবেল,পুলিৎজার বা বুকার ঠিক করে দেবে ? নাকি ‘বেস্ট সেলর’ এর তকমা আঁটা বইগুলোই শুধু বেঁচে থাকবে? অস্বীকার করার উপায় নেই যে এরকম হয়ে আসছে।

          প্রবন্ধের এই সীমায়িত পরিসরে বাংলা সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা আলোচনার স্পর্ধিত চেষ্টার পথ যারা সুগম করে তুললেন, তাঁদের মধ্যে – নারায়ণ সান্যাল, সমরেশ বসু, মহাশ্বেতা দেবী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, মতি নন্দী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, অনিতা অগ্নিহোত্রী, নলিনী বেরা, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, তিলোত্তমা মজুমদার সহ বরেণ্য অন্যান্য সাহিত্যিকের কলমে বাংলা কথাসাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। কাব্য – নাটক – প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও নামের তালিকা লেখা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্যের সচেতন পাঠক অনেক বেশি ওয়াকিবহাল এ ব্যাপারে। বিষয়বৈচিত্র্যেও তো বাংলা সাহিত্য দীন নয়! পৌরাণিক কাহিনির ডিকন্সট্রাকশন থেকে শুরু করে জাদু বাস্তবতা, ‘যৌনতা ও সংস্কৃতির’ পাশাপাশি কুইয়্যার আইডেন্টিটি, পদ্মাপার থেকে মরিচঝাঁপি – অসংখ্য স্বর – আমাদের জাগিয়ে দিয়ে যায়। প্রতীচ্যের প্রভাব স্বীকার করেও স্বকীয়তা আমাদের অন্যতম সম্পদ। বাংলার প্রকৃতি – ভাষা – সংস্কৃতি – সমাজ ও মানুষের কথাইতো সাহিত্যে উঠে এসেছে বার বার।

       অত্যন্ত একপেশে মনে হচ্ছে ? মনে হচ্ছে তবে কেন  রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের কবিতার মতো নয়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে  শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে শঙ্খ ঘোষ – আর কে রইলেন!  উপেন্দ্রকিশোর-লীলা মজুমদার- সুকুমার রায় গেলেন কোথায় ? সন্দেশের মতো পত্রিকা কোথায় হারিয়ে গেল ? পথের পাঁচালির মতো উপন্যাস আর লেখা হয়না কেন? দ্রৌপদীর মতো নারী চরিত্র সাহিত্যে আর হবে? সত্যবতীর মতো চরিত্রইবা কোথায় ? তারাশঙ্কর – মানিক – বিভূতিভূষণ – বন্দোপাধ্যায়ত্রয়ীর (এবং আরো অনেকে ) সমকক্ষ হবেন কারা!  –  এককথায় বিশশতকের বাংলা সাহিত্যের একটা অনতিক্রমনীয় প্রভাবের কথা অস্বীকার করা যায়না। ( কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ক্ষেত্রে শতকের উল্লেখ ‘এহো বাহ্য’)। তেমনি অস্বীকার করা যাবেনা সময়ের দাবীকে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলা চাহিদা ও যোগানের সমীকরণকে। বিভিন্ন পত্র -পত্রিকার ‘অর্ডার’ মেটাতে গুণগতমানের সাথে আপোস করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। তবে এই আত্মসমালোচনা যা নেই বা যা হারিয়েছি তার কথা বলে কিন্তু প্রশ্ন যা আছে তাকে স্বীকৃতি দিতে আমরা ভুলে যাচ্ছি না তো !

         এবার তাকানো যাক পাঠকের দিকে। কারা পাঠক ? অবশ্যই যারা বাংলা পড়তে পারেন এবং পড়তে ভালোবাসেন। পড়ার অভ্যাস তো গড়ে ওঠে ছোট থেকেই। যদি বাচ্চাটা বাংলা বর্ণমালাই না জানে ? না বোঝে ডানদিক – বাঁদিক ( সে লেফট রাইট জানে কিন্তু!)। প্রসঙ্গত বলি – মিত্র ও ঘোষ পাব্লিশার্সের Banglish Books এর যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘হাসিখুসি’র রোমানাইজড সংস্করণটা  দেখেছেন (শুধু হাসিখুসি কেন! দেখছিতো সহজ পাঠ,আবোল তাবোলও আছে ! ) বইয়ের নাম – HASIKHUSI-  Bengali Alphabets in Roman Script. উদ্দেশ্য মহৎ –
“ …designed for probasi Bengalis (as well as non-Bengalis residing in Bengal) who are not comfortable reading it.” ৩ 
সাধুবাদ জানাই তাদের কিন্তু গতিক সুবিধার নয়! কোনদিন বা ‘probasi Bengalis’এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়  ‘Bengalis’…who are not comfortable reading it’. কিন্তু এ কি শুধুই অন্য ভাষা অন্য সংস্কৃতির আগ্রাসন? কৌশলে চাপিয়ে দেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত ? নাকি  সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার প্রথম সফল পদক্ষেপ ! কোনটা? সবথেকে বেশি বোধহয় আমাদের (বাঙালিদের) উদাসীনতা –
“…আমাদের মধ্যে এমন একদল লোক আছেন বাংলার প্রতি যাঁহাদের অনুরাগ রুচি এবং শ্রদ্ধা নাই; তাঁহাদিগকে যেমন করিয়া যেদিকে ফিরানো যায় তাঁহাদের কম্পাসের কাঁটা ইংরাজির দিকে ঘুরিয়া বসে।“

           কবি বলেছেন –
“মোদের গরব মোদের আশা
                 আ মরি বাংলা ভাষা”
– সত্যিই এমন ভাষা যার জন্য প্রাণ দেওয়া যায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মানে শুধু কিছু নাম – যারা বাংলা ভাষার জন্য লড়ে শহীদ হয়েছিলেন? আজকের প্রজন্ম বুঝবে তাঁদের বলিদানের মর্ম ! প্রতিদিন যেভাবে বিকৃত করে চলেছি ভাষাকে – যেভাবে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি বিকৃত রূপের সাথে – যেভাবে গর্ববোধ করছি ‘বাংলাটা ঠিক আসেনা’ বলতে – যেভাবে দ্বিতীয় – তৃতীয় পাঠ্যভাষা হিসাবে বেছে নিচ্ছি ( হয়তো বা তাও নিচ্ছি না) – সন্দেহ হয় ভবিষ্যৎ বইবে কোন খাতে ! মিশ্রসংস্কৃতির অজুহাতে বিপন্ন করে চলেছি নিজেদের সংস্কৃতিকে। মানছি না বাংলা ধ্বনির নিজস্ব উচ্চারণগত বৈশিষ্ট্য – সংস্কৃত বা হিন্দির ছাঁচে ফেলে বদলে দিচ্ছি শব্দ, বাক্যের পদ্গুলোও কেমন যেন খাপছাড়া ভাবে বসছে ! আমরা ভুলে যাচ্ছি –
“… ভাষা জিনিসের জীবন ধর্ম আছে। তাকে ছাঁচে ঢেলে কলে ফেলে ফরমাশে গড়া যায়না। তার নিয়মকে স্বীকার করে নিয়ে তবেই তার কাছ থেকে সম্পূর্ণ ফল পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধগামী হলে সে বন্ধ্যা হয়।“

  আবার এই ভাষা সম্পর্কেই উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে –
“ Bengali is the fifth most-spoken native language and seventh most spoken language by total number of speakers in the world” ৫
জেনে ভালো লাগলেও এ শুধু সংখ্যার হিসাব, বিকৃতির যে পথে ঠেলে দিচ্ছি আমাদের ভাষাকে , তার খবর গুগল রাখে কী!

          আজকের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের তত্ত্বতালাশ করতে এসেও  প্রতি পদেই রবীন্দ্রস্মরণ অনিবার্য হয়ে পড়ছে (খুব স্বাভাবিক এই স্মরণ)। ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ প্রবন্ধে তিনি  উল্লেখ করছেন-
“…বিদেশী শাসনকালে বাংলাদেশে যদি এমন কোনো জিনিসের সৃষ্টি হইয়া থাকে যাহা লইয়া বাঙালি যথার্থ গৌরব করিতে পারে, তাহা বাংলা সাহিত্য।…ইহা আমাদের নিজের শক্তি হইতে, অন্তরের মধ্য হইতে উদ্ভূত হইতেছে।“

          নিশ্চয়ই গৌরবের – তখনো – এখনো। কিন্তু এই গৌরব এসেছে বাঙালির নিরলস সাহিত্য চর্চার মধ্যে দিয়ে। রাষ্ট্রীয় ভাষা ও ইংরাজি ভাষার আগ্রাসন বরাবর একরকমভাবেই প্রভাব ফেলেছে আঞ্চলিক ভাষাগুলোর ওপর, এখন হয়তো তা আর একটু ব্যাপক! কিন্তু সংস্কৃতি মনস্ক বাঙালি দেশে হোক বিদেশে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করে গেছেন। গেছেন বলা ভুল হল, এখনো করে চলেছেন। তাঁরা আমাদের গুরুজন। তাঁদের ভাষাশিক্ষা একপেশে নয়। তুখোড় ইংরাজি বলার জন্য বাংলাভাষাকে তাদের ‘ত্যাগ’দিতে হয়নি ! লেখালিখির ক্ষেত্রেও এক কথা প্রযোজ্য। বাংলা সাহিত্যচর্চার যে নজির বিশ শতকের বাঙালি রেখে গেছেন তার ধারাকে একুশ শতকেও সাবলীলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসিক দৃঢ়তা যদি পরবর্তী প্রজন্মের না থাকে, সেক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে বৈকি!

         বাংলা সাহিত্য – এপার বাংলা – ওপার বাংলা। আলোচ্য প্রবন্ধে খুব সচেতনভাবেই যে এপার বাংলার সাহিত্যিকদের নাম(বেশিরভাগ ক্ষেত্রে) উল্লেখ করা হয়েছে এমন নয়। বাংলা সাহিত্যের যে ব্যাপ্তি তাকে কোনো আলোচনার সীমায় বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়। সাহিত্য ছাড়াও  বাংলা ভাষার সামর্থ্য পরীক্ষায় ওপার বাংলার উদ্যোগ অনুসরণযোগ্য।খুব প্রাসঙ্গিক হয়তো নয়, তবু বলি – আমার মতো আপনারা অনেকেই হয়তো অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করে থাকেন। অভ্র বা অনেক বাংলা সফটওয়্যার যে ওপার বাংলার ফসল তা বোধহয় আজ সবাই জানে। আচ্ছা সফটওয়্যার প্রসঙ্গ থাক। ফিরে আসি সাহিত্যের আলোচনায় – সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শামসুর রহমান, হুমায়ুন আজাদ, হাসান আজিজুল হক, তসলিমা নাসরিন, সেলিনা হোসেন (আরো অনেকে) প্রমুখের সঙ্গে কম-বেশি পরিচিত আমরা সবাই। যে মজবুত ভিতের ওপর বাংলা সাহিত্যের স্থাপনা এবং বর্তমান সময়ে তার যে সমৃদ্ধি তার আলোচনায় ‘এপার’ বাংলা বা ‘ওপার’ বাংলা – এই বিভাজন কাঁটাতারের দৌলতে – সাহিত্যের পাঠক বর্ডার মানেনা।

           একটা বড় সমস্যার কথা  আমাদের আবার বাংলা ভাষার রোমানাইজেশন বিষয়টা প্রভাব ফেলছে বাংলা ভাষারই ওপর। বাংলাদেশের এক সমীক্ষা৭ জানাচ্ছে – বর্তমান প্রজন্ম ফেসবুক, টুইটারে ট্রান্সলিটারেশনের দিকে ঝুঁকছে। একই বাংলা শব্দের ট্রান্সলিটারেশন হচ্ছে বিভিন্ন ভাবে (যেমন – ‘ি’-  লিখতে কখনো i কখনো e, কখনো গুরুত্ব পাচ্ছে উচ্চারণ কখনোবা  সংশ্লিষ্ট শব্দের বানান ইত্যাদি )। আবার এই পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে আড়াল করা যাচ্ছে (বাংলা ও ইংরাজি দুটো ভাষার ক্ষেত্রেই ) ভাষা ব্যবহারকারীর নিজস্ব ত্রুটির জায়গা।  একই সঙ্গে বাংলার উপভাষার যে স্বাতন্ত্র্য তাও ট্রান্সলিটারেশনের ফলে শুদ্ধভাবে বোঝা সম্ভব হচ্ছেনা কারণ এই পদ্ধতিরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সমস্যাটা শুধু বাংলাদেশের নয় কিন্তু! একই অভিজ্ঞতা আমাদেরও। সমাধান – সচেতনভাবে ভাষা ব্যবহার ও প্রয়োগ এবং ট্রান্সলিটারেশনের ক্ষেত্র সীমায়িত করা।

বিবর্তনের পথ বেয়ে আসা বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে ‘বিবিধ রতনে’ – তৎসম, তদ্ভব, দেশি, আরবি, ফারসি থেকে শুরু করে ইংরাজি, তুর্কী – বিভিন্ন ভাষার শব্দ জেনে না জেনে প্রতিদিন ব্যবহার করি আমরা। আর বাংলা সাহিত্য’! প্রাচীন থেকে মধ্য হয়ে আধুনিক ক্রমে উত্তর আধুনিক  – কী বলছেন পাঠক – তর্কটা উস্কে দিলাম। (মতামত ব্যক্তিগত)।


★ তথ্যসূত্র –

১) নারায়ণ সান্যাল, অনির্বচনীয়া, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০১, পৃ.২৫১

২) শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, সুলভ সংস্করণ, পৌষ ১৪১৫, পৃ.৬৭৩

৩) Hasi Khusi Alphabets, Mitra & Ghosh Publishers Pvt. Ltd, Kolkata, 2017

৪) মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ বৈশাখ ১৩৯০, পৃ.৭২

৫) https://en.wikipedia.org/wiki/Bengali_language

৬) মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ বৈশাখ ১৩৯০, পৃ.১৯

৭) https://www.researchgate.net/publication/342452602_Romanization_in_Bangladesh_Common_Malpractices