বাংলা সাহিত্য : কেমন আছো তুমি?
কলমে: মধুরিমা চ্যাটার্জী
আমি যে সময়টার কথা বলতে চলেছি সেটা মূলত করোনা পরবর্তী সময়। তবে সময়ের দিক থেকে দেখতে গেলে ছবিটা ঠিক কতটা বদলাবে জানি না। আসলে মানসিকতাটাই যে বদলের মুখ দেখতে নারাজ। তাই সময়ের চাকা তরতর করে এগোলেও পরিবর্তনের চাকাটা উল্টোগামী। একটু ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করে আলোচনাটার সদর দরজাটা খোলা যাক। সকালবেলার রাস্তাটা বড্ড ফাঁকা লাগে এখন। সাইকেলের হাতলে চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনার স্তূপ সাজিয়ে যারা কাকভোরে বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেয় দৈনিক খবরের কাগজটা আজ সেই মানুষগুলো গাঁটে গোনা। এই ছবিটা মনে করিয়ে দেয় আমরা করোনার ঢেউয়ের আচমকা ঝাপটা সামলে 'আনলক ফেজ' এ আছি। হাতের অ্যান্ড্রএডটা কিন্তু অনেক কাজই সহজ করেছে। নানান উপায়ও বাতলে দিয়েছে। এটাই তো এখনকার স্মার্টনেসের সংজ্ঞা। এরই পাশাপাশি আরেকটা ছবি না তুলে ধরে পারছি না। করোনা অতিমারীর আক্রমণে বেশ অনেকটাই বদলেছে ছাত্রজীবন। বন্ধ স্কুল কলেজের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়েছে অনলাইন ক্লাস। পরীক্ষার চাপ আর নোটস্ বানানোর তাগিদে এখন ভাঁটা। কলেজস্ট্রীটের অলিগলিগুলোর মুখভার, বিক্রেতারা পাঠকদের অপেক্ষায়, সময় যেন কাটতেই চায় না। শুধু ক্লান্তি নয়, রয়েছে একপ্রকার অবসাদও। খবরের কাগজ এবং পাঠ্য বই দু-ক্ষেত্রেই আজকের জনজীবন বেশ পিছিয়ে। রাজনীতি, খেলাধুলা বা বিনোদন জগত নিয়ে যেটুকু জ্ঞান তা তো ট্রামে বাসে যেতে লোকমুখে কিংবা ওই সেলফোনের দাক্ষিণ্যে জুটে যায়। অতএব 'বাংলা সাহিত্য' ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 'জানেন দাদা আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না' ---- ঠিক এমনই একটা সময় সরণিতে আমরা দাঁড়িয়ে। আসলে বাংলা না আসাটাই তো একঅর্থে স্বাভাবিক। এর পিছনে বেশ কতকগুলো কারণ আছে।
প্রথমত, বিশ্বায়নের যুগ। পড়াশোনার মাধ্যম এখন ইংরেজি ভাষা। অলিতে গলিতে ছড়াছড়ি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের। নিজেদের অভিজাত বোঝানোর দৌড়ে বেশিরভাগ শিশুর শিক্ষার সূচনায় ইংরেজি ভাষা। ফলে বাংলাভাষা থেকে তারা ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ভীতি ও পাঠে অনীহা।
দ্বিতীয়ত, লেখকরা বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ পাচ্ছেন না। কারণ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্র। এছাড়া ফেসবুক এবং ইউটিউব এর ভিডিও গুলোও এই দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে।
তৃতীয়ত, পুঁজিবাদ মানুষের উপার্জনের খিদেটাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সামান্য লেখালেখি করে সংসার চালানো সম্ভব নয়। প্রযুক্তির জাদুতে এখন মজেছে সবাই। সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ কম। কবিতা পাঠ নয়, আইফোনের গান শুনতেই রাজি এখনকার উঠতি প্রজন্ম।
চতুর্থত, প্রকাশকরা গল্প, কবিতার বই ছাপিয়ে টাকা তুলতে পারছেন না। প্রোগ্রামিং এবং মোটিভেশনাল বইয়ে বিনিয়োগের পরিমাণের তুলনায় লাভ পরিমাণটা অনেকগুণ বেশি। দেখা দিচ্ছে সফলতালাভের সহজ উপায়। তাই কে আর গল্প-উপন্যাস পড়ে পিছিয়ে পড়তে চায়!
পঞ্চমত, এখনকার প্রজন্ম সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী। তাই সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শন এসব বিষয় মার খাচ্ছে।
ষষ্ঠত, আমরা এমন একটা সময় পর্বে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে সবাই প্রায় একপ্রকার লেখক। পাঠকের সংখ্যা হাতেগোনা। আর গ্লোবালাইজেশনের ফলে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। সেখানে কে আর বাড়ির বারান্দায় বাংলা সাহিত্য নিয়ে বসে থাকে! বাংলা সাহিত্যের চলার পথটা কিন্তু দীর্ঘ। এই যাত্রাপথে একাধিক বাঁকবদলের মধ্যে দিয়ে পরিবর্তনগুলো অতিক্রম করে আজ যে শরীরী রূপটা বাংলা সাহিত্য লাভ করেছে তার একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেব। পন্ডিতমহল মনে করছেন আনুমানিক সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে মাগধী অপভ্রংশ ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যকে প্রধানত তিনটি যুগে ভাগ করা হয় -----
ক. আদি যুগ (৮০০-১২০৩খ্রিস্টাব্দ)
খ. মধ্যযুগ(১২০৩-১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ)
গ. আধুনিক যুগ(১৮০০-বর্তমান কাল)
৮০০থেকে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দ । প্রাক্-তুর্কি আক্রমণ যুগ। অন্যদিকে এটাই আদিযুগের সময়সীমা। একমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়” বা “চর্যাপদ”। এরও আগে বাঙালির সাহিত্যচর্চার নিদর্শন পাওয়া যায়, যেমন- অভিনন্দের “রামচরিত”, গোবর্ধন আচার্যের “আর্যাসপ্তশতী”, কবি জয়দেবের “গীতগোবিন্দম্”, বিদ্যাধর সংকলিত “সুভাষিত রত্নকোষ” বা “কবীন্দ্র-বচন-সমুচ্চয়” এবং শ্রীধরদাসের “সদুক্তি-কর্ণামৃত” ইত্যাদি।
১২০৩ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ এই সময়পর্বে তুর্কি আক্রমণের ফলে বাংলার সমাজজীবনে যে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়,তা সাহিত্য সৃষ্টির প্রতিকূল ছিল। এই যুগকে “অন্ধকার যুগ” নামে অভিহিত করা হয়। এর পরবর্তীতে আমরা পাচ্ছি বড়ু চণ্ডীদাস রচিত রাধা-কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাব্য "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন"। আদিমধ্য যুগের সাহিত্যিক নিদর্শন। এরপরে আমরা পাচ্ছি অনুবাদ সাহিত্য, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীরাম দাসের মহাভারত এবং মালাধর বসুর "শ্রীকৃষ্ণবিজয়"। এরই পাশাপাশি মধ্যযুগেরই আখ্যানকাব্যে কীর্তিত হয়েছে হিন্দু দেবদেবীদের মাহাত্ম্য। এগুলি "মঙ্গলকাব্য" নামে পরিচিত। এইধরনের কাব্য রচনার ধারা বিস্তৃত ছিল ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। যদিও পরবর্তীতে আরও কিছু মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। বাঙালি সমাজজীবনে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব প্রভাবিত করছে বাংলা সাহিত্য জীবনকে। চৈতন্যদেব নিজে কোনো গ্রন্থ রচনা না করলেও তাঁকে নিয়ে একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কৃষ্ণদাস কবিরাজের "শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত", বৃন্দাবন দাসের "চৈতন্যভাগবত" ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৭৬০খ্রিস্টাব্দ। ভারতচন্দ্রের মৃত্যু। মনে করা হচ্ছে এরই মাধ্যমে মধ্যযুগের অবসান। এরপর আসছে উনিশ শতক। নবজাগরণ। বাঙালির মন পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে আসছে। ভাববিপ্লব ঘটছে। ১৮০০খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে "ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ"। বিকশিত হচ্ছে গদ্যসাহিত্য। এই আধুনিক যুগেই এরপর একে একে আসছে ছাপাখানা, সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র। এই আধুনিক যুগ এখনও বহমান।
" নূতন ঊষার স্বর্ণদ্বার,
খুলিতে বিলম্ব কত আর?”
উনিশ শতকের নবজাগরণ হয়ে বিশ শতকের যে দরজাটা খুলছে তার ভিতরের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক ছবিটা অনেকটা এইরকম যা তৎকালীন বাঙালির সাহিত্যচর্চাকেও প্রভাবিত করছে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব এবং সমগ্র বঙ্গদেশে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন। ১৯১১-এ বঙ্গভঙ্গ রদ।
১৯১৪সাল, আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এরপর ১৯১৯-এ গান্ধীজির নেতৃত্বে আইন অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলন। তাছাড়া জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড এবং রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগ। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। ১৯৪২-এ ভারতছাড়ো, ১৯৪৩ -এ বঙ্গদেশের ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ (পঞ্চাশের মন্বন্তর, ১৩৫০)। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৪৭ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও দেশভাগ। হঠাৎ এই ইতিহাসের সাল তারিখ নিয়ে কেন পড়লাম তা বলি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘মেবার পতন’ নাটক, রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস, বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ এবং তুলসি লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ নাটক, জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘১৯৪৬-৪৭’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা ‘ফ্যান’। উল্লেখিত রচনাসমূহে বিংশ শতাব্দীর সমকালীন সামাজিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর ব্যাপ্ত সৃষ্টি সম্ভারকে ব্যতিরেকে বিশ শতকের কিছু উল্লেখযোগ্য লেখক এবং তাঁদের সৃষ্টি সাম্রাজ্য নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। প্রথমেই আসা যাক কাব্য-কবিতা প্রসঙ্গে। যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, 'মেঘনাদবধ কাব্য' রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেন প্রমুখের হাত ধরে পাঠকরা পরিচয় করে নিয়েছিল মহাকাব্য ও আখ্যানকাব্যের সঙ্গে। এই মহাকাব্যের গুরুগম্ভীর আবহ কাটিয়ে 'ভোরের পাখি' হয়ে গীতিকবিতার জন্ম দিচ্ছেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। পরবর্তীতে 'সন্ধ্যাসঙ্গীত', 'প্রভাতসঙ্গীত', 'মানসী', 'সোনারতরী', 'গীতাঞ্জলী' হয়ে 'পুনশ্চ', 'নবজাতক' -এ বাঙালি একটা দীর্ঘ সময় ভেসে থেকেছে রবীন্দ্র কাব্যধারার উদ্দামস্রোতে। এরপর তৈরি হচ্ছে কবিদের দুই গোষ্ঠী। 'রবীন্দ্রানুসারী' এবং 'রবীন্দ্রেতর'। প্রথম সারিতে পাচ্ছি 'হাসির গান', 'ত্রিবেণী', 'মন্ত্র' ইত্যাদির রচয়িতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, মানকুমারী বসু, কামিনী রায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং 'নকসী কাঁথার মাঠ', 'রাখালী'র রচয়িতা জসীমউদ্দীন। রবীন্দ্রেতর কবিদের প্রসঙ্গে বলতে গেলে যাঁদের কথা বলতেই হয় তাঁরা হলেন 'দুঃখবাদী কবি' যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, 'ভোগবাদী কবি' মোহিতলাল মজুমদার এবং 'বিদ্রোহী কবি' কাজী নজরুল ইসলাম। এরপরবর্তী সময়ে স্পষ্ট হচ্ছে রবীন্দ্রোত্তর কবিদের হাত ধরে আধুনিক কবিতার স্বর। জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখ এই ধারার উজ্জ্বল নক্ষত্র। সময়ের চাকাটা আলোচনার সুবিধার্থে আর একটু এগিয়ে নিলে আমরা দেখি, বিশ শতকে কবিতায় ছবির মালা গাঁথছেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সাহিত্যে আত্মপ্রকাশের সূচনাকাল থেকেই তাঁর অসামান্য রোমান্টিক কবিপ্রতিভা এবং স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি পাঠকের হৃদয়ে দাগ কাটে। ফুল,পাখি, প্রেম,হতাশা,অব্যক্ত বেদনা ---- এইসব নিয়েই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'নীলনির্জন'। অন্যদিকে 'অন্ধকার বারান্দা' কাব্যে তিনি কিছুটা সংযত, সমসাময়িক পৃথিবী সম্পর্কে তাঁর আশা,বেদনা ও ভর্ৎসনা লিপিবদ্ধ হয়েছে সতেজ ও দ্বিধাহীন ভাষায়। এছাড়া 'নীরক্ত করবী', 'কলকাতার যীশু', 'উলঙ্গ রাজা', 'নক্ষত্র জয়ের জন্য', 'সত্য সেলুকাস' ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথে মগ্ন এবং অজস্র কবি সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও স্বতন্ত্র এক ঝংকার, এক অগ্নিশলাকার উদ্ভাস নিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যের পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। 'ছাড়পত্র', 'ঘুম নেই', 'মিঠে কড়া' ইত্যাদি তাঁর কিছু অমলিন রচনা। হতাশার আগুন থেকে ছিটকে আসা প্রকৃতিকে তিনি শুধু চর্মচক্ষু দিয়ে দেখেননি, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন 'দিনগুলি রাতগুলি'তে; পুরাণ হয়েছে যুগোপযোগী 'জাবাল-সত্যকাম'-এ; ইতিহাস শুধু রাজ রাজাদের জীবন বা তাদের উত্থান পতনের বিবরণ হয়ে থাকেনি, কথা বলে উঠেছে নতুন ভাষায়,প্রমাণ 'বাবরের প্রার্থনা'। রচনাগুলির নামই বোধহয় বলে দিচ্ছে আমি কবি শঙ্খ ঘোষের কথা বলছি। যদিও তিনি পঞ্চাশের কবি তবুও তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে ষাট ও সত্তরের দশকে। তিনি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। নিসর্গের বুকে আশ্রয় কামনা, অতীতের ম্লান ধূসরে শান্তির সন্ধান, নির্মোহ আত্মানুসন্ধান, স্বরোচিত বিষাদ, জীবনের অসংলগ্নতা এবং মৃত্যুভাবনা নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতাগুলি। কুরুচিকর গ্রাম্য অশিষ্ট শব্দের অজস্র ব্যবহার তাঁর কবিতাকে দিয়েছে এক জাতীয় সাধারণ মানুষের বাচনভঙ্গির প্রবণতা। 'হে প্রেম হে নৈঃশব্দ', 'ধর্মে আছো জিরাফেও আছো', 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো?' ইত্যাদি তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। একটু অন্যরকম লেখনীর সন্ধান পাই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতায়। যান্ত্রিক যুগেও মানুষকে খুব কাছে পেতে চেয়েছেন। মানুষের অবচেতনের অহং সত্ত্বাকে ধরতে কবির 'আমি' চেতনা উদ্বেলিত হয়েছে বারে বারে; প্রমাণ প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যৌবন বাউল'। এছাড়া রয়েছে 'ছোকাবুকির মুখোশ', 'গিলোটিনে আলপনা', 'জবাবদিহির টিলা', 'আয়না যখন নিশ্বাস নেয়' ইত্যাদি। 'হঠাৎ নীরার জন্য', 'নীরা হারিয়ে যেও না', 'সুন্দরের মন খারাপ মাধুর্যের জ্বর', 'মন ভালো নেই', 'ভালোবাসা খন্ডকাব্য' ইত্যাদি কাব্যে মূলত প্রেম রূপ ও রূপান্তরের মধ্যে বিধৃত। আধুনিক প্রেম কাব্যের নায়িকা নীরা যাঁর লেখনীর মাধ্যমে জীবন্ত তিনি কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা কাব্যের ছন্দোমুক্তির ইতিহাসকে স্মরণ করে মিলহীন গদ্যছন্দে কবিতা লিখে যথার্থভাবে তিনি আধুনিক কবি। সম্পূর্ণ নিজের কবিভাষায় দেশকাল স্পৃষ্ট কবিতা লিখতে চেয়েছেন কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত। ১৯৬২ র চিনভারত যুদ্ধ, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, নকশাল বাড়ি আন্দোলন ইত্যাদির সাক্ষী থেকেছেন অমিতাভ ; তাই কবিতা,জীবন ও রাজনীতি তাঁর কাছে সমার্থক। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল---- 'সমুদ্র থেকে আকাশ', 'মৃত্যুর অধিক খেলা', 'আগুনের ডালপালা', 'আমার নীরবতা আমার ভাষা', 'নীল সরস্বতী'। তাঁর শব্দ ব্যবহারে কোনো দুঃসাহসিক নতুনত্ব নেই, আঙ্গিকের আধুনিকতম পরীক্ষা নেই, পংক্তিগুলি নরম ও বিপন্ন, নিঃসঙ্গতাময় এবং বিরল কবিত্বে উদ্ভাসিত। তিনি কবি দেবারতি মিত্র। তাঁর সৃষ্টি 'অন্ধ স্কুলে ঘন্টা বাজে', 'আমার পুতুল', 'যুবকের স্নান' ইত্যাদি। কবিতা নিছক ছন্দমিলের কারুকর্ম নয়, সে ভাষায় রচিত বিশাল এক শিল্পকর্ম; কবিতা প্রসঙ্গে এই যিনি পড়াচ্ছেন তিনি কবি জয় গোস্বামী। তাঁর লেখা কবিতায় যেমন আছে রোমান্টিকতা ও নস্টালজিকতার ছোঁয়া, তেমনি শোনা যায় এক প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। আছে অপ্রচলিত শব্দ ও প্রতীক-চিত্রকল্পের ভিড়। উল্লেখযোগ্য রচনা--- 'ক্রিসমাস ও শীতের সনেট গুচ্ছ', 'পাগলী তোমার সঙ্গে', 'আলেয়া হ্রদ' ও 'ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা' ইত্যাদি। প্রাত্যহিক জীবন অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছে কবি সুবোধ সরকারের কবিতায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ--- 'ঋক্ষমেষ কথা', 'সোহাগ শর্বরী', 'মরুভূমির গোলাপ' ইত্যাদি। বিষয় ও আঙ্গিকে অভিনবত্ব প্রকাশের মধ্য দিয়ে নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনসমস্যা, প্রেম, ক্ষুধা ইত্যাদি জায়গা করে নিয়েছে বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় কবি মন্দাক্রান্তা সেনের কবিতায়। তাঁর রচনার মধ্যে 'হৃদয় অবাধ্য মেয়ে', 'বলে অন্যভাবে', 'ছদ্মপুরাণ', 'বর্ষাফলকে গাঁথা হাড়' ইত্যাদি বিশেষ কিছু সৃষ্টি। কবিতার অনুরণন থামিয়ে এবার কথা হোক হাল আমলের কিছু কথাকারদের নিয়ে। সংক্ষেপে আলোচনা একপ্রকার কঠিন কাজ , তবুও রইল বক্তব্যের অনুসারী একটা নীল নকশা। নারী জীবনের বিচিত্র অনুভূতি, ক্ষোভ, বঞ্চনার কথা লিখেছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস 'কাছের মানুষ' , 'কাচের দেওয়াল', 'গভীর অসুখ', 'দহন' ইত্যাদি। নকশাল আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মৌলবাদ এইসব কিছু জড়িয়ে থেকেছে কিন্নর রায়ের লেখায়। উল্লেখযোগ্য লেখা - 'কাছেই নরক', 'আগুনের সিঁড়ি', 'যক্ষ' ইত্যাদি।
আধুনিক জীবনের বিচিত্র অনুভূতি রয়েছে দেবর্ষি সারগীর কথাসাহিত্যে। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘গল্পকার’, ‘পাঁচপুরুষ’, ও ‘ভ্রমণসঙ্গী ঈশ্বর’ ইত্যাদি। 'তপস্যার রঙ', 'কুশপাতার দেউল', 'পালক', 'মেঘ উৎসব' ইত্যাদি উপন্যাস পাচ্ছি হর্ষ দত্তর লেখনী থেকে। বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের বিচিত্র অনুভূতির কথা শুনিয়েছেন তিনি তাঁর লেখায়। হর্ষ দত্তের মতোই মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি এঁকেছেন নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসগুলিতে। উদাহরণ- 'ঘুরে দাঁড়ানোই ভাল', 'মৃত্যুর দাগ', 'আলো আছে' ইত্যাদি। গ্রাম্য জীবনের সমস্যা, ঘাত-প্রতিঘাত, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার কথা বলছেন অনিল ঘড়াই তাঁর কথাসাহিত্যে। 'নুনবাড়ি', 'মুকুলের গন্ধ', 'নীল দুঃখের ছবি' ইত্যাদি উপন্যাস এবং 'কাক', 'কটাশ', 'লু','শ্বেতপদ্ম' ইত্যাদি গল্প সংকলন। 'গল্প অল্প স্বল্প', 'আজবখানা কলকাতা', 'সবুজ চিঠি' এবং 'ভালবাসার চোখ' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের রচয়িতা হলেন শুভমানস ঘোষ। আধুনিক জীবনের জটিলতা উঠে আসছে কঙ্কাবতী দত্তর লেখায়। যেমন- 'প্রেমে পড়ার গল্প', 'অথচ জীবন' ইত্যাদি এবং এরই পাশাপাশি মানবজীবনের অন্তর্লোককে উদঘাটন করেছেন তিলোত্তমা মজুমদার তাঁর উপন্যাসে। 'এসো সেপ্টেম্বর', 'একতারা', 'শামুক খোল', 'বসুধারা' ইত্যাদি তিলোত্তমার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। এছাড়া বাংলাদেশের বেশ কিছু কথাসাহিত্যিকের রচনা পাই যা বাংলা সাহিত্যের পথে মাইলফলক স্বরূপ।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়—-
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের ‘লালসালু’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, রশীদ করিমের ‘উত্তম পুরুষ’, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘ সারেং বৌ’, ‘সংশপ্তক’, আনোয়ার পাশার ‘নীড় সন্ধানী’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ‘খোয়াবনামা’, সেলিনা হোসেনের ‘নীলময়ূরীর যৌবন’, ‘চাঁদ বেনে’, এবং হুমায়ূন আহমেদের ‘ছায়াসঙ্গী’, ‘অন্যদিন’, ‘ফেরা’,’সৌরভ’ ইত্যাদি। এখনকার কিছু লেখক এবং তাঁদের লেখনীর স্বরূপ ধরার অভিপ্রায়ে রইল কিছু বিশেষ বিশেষ রচনার সুলুক সন্ধান। ইচ্ছা একটাই বজায় থাকুক পাঠের অভ্যাস। হৃদয় জুড়ে বাস হোক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের। শৈশবগুলো এখন আর দুরন্তপনার ফাঁকে অবাক হয় না রাজপুত্র আর রাজকুমারীর গল্পে। তারা চেনে না সুয়োরানী- দুয়োরানীকে, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীকে। তাদের জগতে এখন রাজত্ব করে 'ডোরেমন', 'ছোটাভীম', 'মোটু-পাতলু'। শুধু তাই নয়, মোবাইল আর ল্যাপটপের 'এক্সাইটিং গেমস্' কেড়ে নিয়েছে সবুজ মাঠের ক্রিকেট আর ফুটবলকে। বড্ড একা আর ফিকে এখনকার শৈশব। পড়ার বইয়ের ফাঁকে আর জায়গা পায় না 'বাঁটুল' কিংবা 'নন্টে-ফন্টে'রা। ইংরাজী ভাষার একটা শক্ত ঘেরাটোপে আটকা পড়েছে আজকের শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাভাষাটা আজ না জানলেও চলে। তাই ছোট থেকেই বাংলাভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে এক বিরাট দূরত্ব। বাংলাসাহিত্যের পাঠক সংখ্যাও এখন বেশ কম। কৈশোরগুলো এখন আর অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে গোয়েন্দা গল্পের সঙ্গে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করে না। ফেলুদা, ব্যোমকেশ কিংবা কিরীটী খুব কম কৈশোরকেই জাগিয়ে রাখে। বিমল করের 'কিকিরা', প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'পরাশর বর্মা', সমরেশ মজুমদারের 'অর্জুন', বুদ্ধদেব বসুর 'চঞ্চল' এই চরিত্রগুলো এখনকার পাঠকের কাছে খুব একটা পরিচিত নাম নয়। যদি আজকের কোনো বাঙালি গৃহস্থ বাড়ির অন্দরটা ঘুরে দেখা যায় তাহলে দুকামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটে পাতানো একান্ত নিজেদের সংসার। সেন্টার টেবিলে অবসর যাপনের জন্য শোভা পাচ্ছে 'স্ট্যাটাস' প্রকাশক 'দ্য টেলিগ্রাফ' আর বাংলা ম্যাগাজিন হিসেবে 'দেশ' বা 'কৃত্তিবাস' নয়; 'সানন্দা' অথবা 'উনিশ-কুড়ি'। বাংলা বিভিন্ন অন্য কোনো ভাষা বা সেই ভাষার সাহিত্য রচনাগুলোকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। প্রতিযোগিতাটা হোক সদর্থক দিক থেকে। বলার অভিপ্রায় শুধু এইটুকুই। এই প্রজন্মের ঠিক কজনের কাছে 'গল্পগুচ্ছ', 'সঞ্চয়িতা' বা 'গীতবিতান' আছে তা প্রশ্নচিহ্নর সম্মুখীন। কারণ, যদিওবা থাকে তা নিতান্তই বুকশেল্ফ ও ঘরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য। হয়তো সবারক্ষেত্রে এই মন্তব্য প্রযোজ্য নয়। আংশিক নির্বাচনে সামগ্রিককে দেগে দেওয়া অন্যায় হবে। সময়টা মার্চ, ২০২২। জায়গাটা পঁচিশতম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। যদি একটু চোখ খোলা রাখেন তাহলে দেখবেন মেলাটার নামই বইমেলা। হয়তো বইয়ের ছোট-বড় একাধিক স্টল এবং নামী-দামি কিছু প্রকাশনীর পসার সেখানে থাকে। থাকেন পাঠক-পাঠিকা এবং কিছু লেখক-লেখিকাও। তবে বইপ্রেমে এখন অনেকটাই ভাঁটা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে এগিয়ে রাখতে গিয়ে এখন বইমেলাগামী বেশিরভাগ মানুষের ফোকাস সাজগোজ, খাওয়া-দাওয়া, সেলফি তোলা আর ইউটিউব ভ্লগ বানানো। এই কাজগুলো করার পর যদি সময় থাকে তো বইমেলা আসার স্মৃতিস্বরূপ একটা-দুটো বই কেনা। আবারও বলি সমালোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে যদি আমরা একটু ভেবে দেখি তাহলে আমাদের অনেকের কাছেই এই ছবিটা নতুন নয়। আশা শুধু একটাই আগামী প্রজন্মের কাছে বই হোক ভালোবাসা। তৈরি হোক ভাষা নির্বিশেষে সাহিত্যপ্রীতি। আরও উজ্জ্বল হোক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। লেখকদের কলম না থেমে হেঁটে চলুক আরও অনেকটা পথ। এক ক্লান্তিহীন অপার আগ্রহে।
-----------------------