শ্রী চৈতন‍্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের কারণ –


মহাপ্রভু শ্রীচৈতন‍্যদেবের আবির্ভাব এক যুগসন্ধিক্ষণে। ষোড়শ শতকের বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনে চরম বিশৃঙ্খলা, অন‍্যায় অবিচার অনৈতিকতা ধর্মের নামে শূন‍্যগর্ভ অহমিকা, অনাচার কুসংস্কার প্রভৃতির যাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ মানুষ যখন নিষ্পেষিত ও পর্যুদস্ত হচ্ছিল, সেই সঙ্কটমুহূর্তে যুগনায়ক শ্রীচৈতন‍্য আবির্ভূত হয়ে মানুষকে “অভীঃ” মন্ত্রে উজ্জীবিত করলেন। তিনি জানালেন, সব মানুষ সমান। তিনি নিষ্ঠুর সমাজ ব‍্যবস্থার যূপকাষ্ঠে আবদ্ধ, আচার সর্বস্ব ধর্মের কঠোর অনুশাসন নিগড় থেকে মানুষকে মুক্ত করে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। মহাপ্রভুর এই চিরন্তন মানবসাধনার বীজমন্ত্র ছিল “হরিনাম”। তাঁর দৃপ্ত ঘোষণা –

“হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামেব কেবলম্।
কলৌ নাস্ত‍্যেব নাস্ত‍্যেব নাস্ত‍্যেব গতিরন‍্যথা।”

‘অত‌এব কলিযুগে নামযজ্ঞ’ – সাধারণ মানুষকে তিনি এই শিক্ষা দিলেন। তাঁর অমৃতময় বাণীর ও জীবনাচরণের আদর্শে সমগ্র জাতিসত্তা এঅ অভিনব জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল।

বৈষ্ণবমতে, মহাপ্রভুর আবির্ভাবের দুটি কারণ –
৹ বহিরঙ্গ কারণ
৹ অন্তরঙ্গ কারণ

🔹 বহিরঙ্গ কারণ –
নবদ্বীপ পন্থীরা চৈতন‍্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের কারণ নির্দেশ করেছেন –

“পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনায় সম্ভবামি যুগে যুগে।”

নবদ্বীপপন্থীদের বর্ণিত কারণ অনুসারে সাধুদের পরিত্রাণের জন‍্য, দুষ্কৃতিদের বিনাশের জন‍্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন‍্য চৈতন‍্যদেবের আবির্ভাব।
●১) প্রেমভক্তির প্রচারক মাধবেন্দ্র পুরীর দীক্ষিত শিষ‍্য অদ্বৈত আচার্য নারায়ণ শিলা আশ্রয়ে কৃষ্ণ পুজো করতেন। প্রতিদিন ১০৮টি তুলসী পাতা গঙ্গাজলে অর্পণ করে অতিশয় অশ্রুব‍্যাকুল ভক্তি পরায়ণ চিত্তে কৃষ্ণের মর্ত‍্যে অবতারণের জন‍্য প্রার্থনা করতেন।

●২) শ্রীচেতন‍্যদেব অন্ত‍্যজ – অচ্ছুৎ মন্ত্রবর্জিত মানুষদের ওপর কৃপার হাত রাখলেন আবার মুসলমান যবন হরিদাসের মতো মানুষকেও উৎসাহিত করেছিলেন হরিনামে, হিন্দু শাসক – রাজারাও তাঁর ভক্তি আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। ব্রাহ্মণ নির্দেশিত অচল মন্থর শাস্ত্রের পরিবর্তে মানবধর্ম এবং তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর পরিবর্তে একমাত্র হরিনামের অবগাহনে মুক্তি সম্ভব বলে তিনি জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ নাম সংকীর্তনের মাধ‍্যমে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের কৃপা করার জন‍্য এবং ধর্ম আচরণগত আড়ম্বর দূর করার জন‍্য শ্রী চৈতন‍্যের আবির্ভাব।

অর্থাৎ শ্রীচৈতন‍্যের মুখ‍্য বহিরাঙ্গিক কারণগুলি হল –

  • ঈশ্বরের প্রতি সমগ্র মানুষকে একনিষ্ঠ প্রেমের পথে নিয়ে যাওয়া
  • নাম সংকীর্তনের মধ‍্য দিয়ে ছিন্নমূল জাতির শিকড়কে সুদৃঢ় করা
  • চৈতন‍্যদেব মধ‍্যযুগে প্রথম গণতান্ত্রিক সমন্বয় সৃষ্টি করলেন। স্বৈরাচারী পতনে সম্মিলিত গণ জাগরণের কথা তিনি বলেন।

🔹 অন্তরঙ্গ কারণ –


“প্রেম নাম প্রচারিতে এই অবতার।
সত‍্য এই হেতু, কিন্তু এহো বহিরঙ্গ।
আর এক হেতু আছে শুন অন্তরঙ্গ॥”


শ্রী শ্রী চৈতন‍্যচরিতামৃতের আদিলীলার চতুর্থ পরিচ্ছেদে কবিরাজ গোস্বামী সেই অন্তরঙ্গ কারণ বর্ণনা করেছেন –
দ্বাপর যুগে আবির্ভূত ব্রজধামের কৃষ্ণের রাধার সঙ্গে মিলিত হ‌ওয়ার পর তিনটি অপূর্ণতা জাগে, সেই তিনটি ইচ্ছা পরিপূর্ণতার কারণে শ্রী চৈতন‍্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব ঘটে। চৈতন‍্য মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ পার্ষদ স্বরূপ দামোদরের একটি শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণের তিনটি বাঞ্ছার কথা ব‍্যক্ত হয়েছে –

“শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কী দৃশো বানয়ৈবা –
স্বাদ‍্যো যেনাদ্ভুতমধুরিমা কী দৃশো বা মদীয়ঃ।
সৌখ‍্যং চাস‍্যা মদনুভবতঃ কীদৃশংবেতি লোভাৎ
তদ্ভাবাঢ‍্যঃ সমজনি শচীগর্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ॥”

অর্থাৎ – ★ ১) শ্রীরাধার প্রণয় মহিমা কিরূপ
★ ২) শ্রীরাধার প্রেম আস্বাদন করে কৃষ্ণের মাধুর্য কেমন
★ ৩) কৃষ্ণের প্রেম আস্বাদন করে শ্রীরাধা কেমন অনুভূতি
– তা জানার জন‍্য শ্রীরাধার ভাব ও কান্তি অঙ্গীকার করে কৃষ্ণচন্দ্র শচীগর্ভরূপে সিন্ধু থেকে আবির্ভূত হন।


প্রথম বাঞ্ছা –
স্বরূপ দামোদরের কড়চায় সূত্রাকারে রচিত এই তিন বাঞ্ছার বিস্তৃত ব‍্যাখ‍্যা কবিরাজ গোস্বামী তাঁর রচিত গ্রন্থের আদিলীলার চতুর্থ পরিচ্ছেদে  দিয়েছেন –

“তাঁহার প্রথম বাঞ্ছা করিয়ে ব‍্যাখ‍্যান।
কৃষ্ণ কহে – আমি হ‌ই রসের নিধান।।
পূর্ণানন্দময় আমি চিন্ময় পূর্ণ তত্ত্ব।
রাধিকার প্রেম আমায় করায় উন্মত্ত।।”

রাধাপ্রেম বিভু অর্থাৎ অনন্ত, সেই অনন্ত বিচিত্র প্রেমের স্বরূপ জানার জন‍্য কৃষ্ণ উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। সেই প্রেমের বিষয় তিনি স্বয়ং কৃষ্ণ, আর আশ্রয় শ্রীরাধা। কৃষ্ণ মহাভাবস্বরূপা সেবার দ্বারা যে সুখ পান, সেটা বিষয়জাতীয় সুখ। কিন্তু কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তিস্বরূপ শ্রীরাধা কৃষ্ণসেবার দ্বারা যে সুখ পান তা কৃষ্ণের অজানা। তাই প্রেমের বিষয় শ্রীকৃষ্ণ এখন প্রেমের আশ্রয় পেতে চান, তবেই তিনি শ্রীরাধার অনন্তপ্রমের মাধুর্য অনুভব করতে পারবেন। এটাই কৃষ্ণের প্রথম বাঞ্ছা –

“বিষয় জাতীয় সুখ আমার আস্বাদ।
আমা হৈতে কোটিগুণ আশ্রয়ের আহ্লাদ॥
আশ্রয় জাতীয় সুখ পাইতে মন ধায়।
যত্নে আস্বাদিতে নারি কি করি উপায়।”

দ্বিতীয় বাঞ্ছা
শ্রীকৃষ্ণ অসমোধমাধুর্যময়। তিনি নিজেই নিজের সৌন্দর্য ও মাধুর্যের মনোহারিত্বে মুগ্ধ হয়ে যান –

“অদ্ভূত অনন্ত পূর্ণ মোর মধুরিমা।
ত্রিজগতে ইহার কেহ নাহি পায় সীমা॥”

একমাত্র শ্রীরাধাই শুধু সেই মাধুর্যামৃত আস্বাদ করে থাকেন। রাধার প্রেমদর্পণের স্বচ্ছতা যত বাড়ে, তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কৃষ্ণের মাধুর্য‌ও তত বৃদ্ধি পেতে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ নিজের অনুপম মাধুর্য দর্শন করে নিজেই তা আস্বাদনের জন‍্য লালায়িত হয়ে পড়েন। কিন্তু কৃষ্ণ মাধুর্য আস্বাদ‍্য, তা আস্বাদনের জন‍্য প্রয়োজন আস্বাদকের। তাই আস্বাদ‍্য কৃষ্ণপ্রেম আস্বাদক রাধিকাই আস্বাদন করেন। কৃষ্ণ নিজের মাধুর্য আস্বাদনের উপায় খোঁজেন –

“দর্পনাদ‍্যে দেখি যদি আপন মাধুরী
আস্বাদিতে লোভ হয় আস্বাদিতে নারি।
বিচার করিয়ে যদি আস্বাদ উপায়।
রাধিকা স্বরূপ হৈতে তবে মন ধায়॥”

স্বমাধুর্য আস্বাদনের স্পৃহার কারণে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা স্বরূপ হতে চান – এই তার দ্বিতীয় বাঞ্ছা।

তৃতীয় বাঞ্ছা –
সৎ চিৎ আনন্দময় কৃষ্ণের স্বরূপ‘ – তিনি অপ্রাকৃত চিন্ময় সত্তা বিশেষ। কৃষ্ণের প্রতি প্রেমসেবন‌ই ব্রজগোপীর ভজন। গোপীপ্রেম স্বসুখ বাসনাগন্ধলেশশূন‍্য, একমাত্র কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা পূরণেই তাঁদের সুখ। গোপীপ্রেমের এই অপরূপ রহস‍্য সর্বাধিক ব‍্যঞ্জিত হয়েছে গোপীশ্রেষ্ঠ রাধার মধ‍্যে। কারণ তিনি কৃষ্ণের আনন্দদায়িনী হ্লাদিনী শক্তির সারভূতা অধিরূঢ় মহাভাব স্বরূপ। কৃষ্ণ সুখের জন‍্য তাঁর সেবাতেই প্রেমের সর্বোত্তম বিকাশ ঘটেছে। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রেমসেবাতেই সর্বাধিক বশীভূত হন। আর শ্রীরাধাও শ্রীকৃষ্ণকে প্রেম সেবনের দ্বারা সুখী করতে পেরে সর্বাধিক সুখ অনুভব করেন। শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার এই সুখ কিরূপ তা জানতে চান। এটি তাঁর তৃতীয় বাঞ্ছা –

“আমা হৈতে রাধা পায় যে জাতীয় সুখ।
তাহা আস্বাদিতে আমি সদাই উন্মুখ॥
নানা যত্ন করি আমি নারি আস্বাদিতে।
সে সুখ মাধুর্য ঘ্রাণে লোভ বাড়ে চিত্তে॥”

রাধা কৃষ্ণ এক আত্মা হলেও তাদের দেহ ভিন্ন। শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে বিজাতীয়ভাবে তা লভ‍্য নয়। তাই শ্রীকৃষ্ণ রাধাভাব অঙ্গীকারে সংকল্প করলেন –

“এই তিন তৃষ্ণা মোর নহিল পূরণ।
বিজাতীয় ভাবে তাহা নহে আস্বাদন॥
রাধিকার ভাব কান্তি অঙ্গীকার বিনে
সেই তিন সুখ কভু নহে আস্বাদনে॥
রাধাভাব অঙ্গীকরি – ধরি তার বর্ণ।
তিন সুখ আস্বাদিতে হব অবতীর্ণ॥”

আবার চৈতন‍্যের আবির্ভাবের কারণ হিসাবে চৈতন‍্য ভাগবতেঅংশ অবতার’ এর আভাস দেওয়া হয়েছে। বিষ্ণুপুরাণেও এই অংশবতারের কথাই স্বীকার করা হয়েছে। বিষ্ণুপুরাণেও এই অংশবতারের কথাই স্বীকার করা হয়েছে। শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর ‘লঘুভাগবতম‘ গ্রন্থে অবতারের স্বরূপকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন –

৹ পুরুষাবতার – মহাবিষ্ণুর অংশে ক্ষীরোদশায়ী বিষ্ণু, এঁর‌ই নাভিপদ্ম থেকে ব্রহ্মার উৎপত্তি।
৹ গুণাবতার – ঈশ্বরের গুণ যাদের মধ‍্যে – ব্রহ্মা – সত্ত্ব, বিষ্ণু – রজ, শিব – তম।
৹ যুগাবতার – সত‍্য, ক্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগে ঈশ্বরের অংশ অবতাররূপে আবির্ভাব।
৹ মন্বন্তরাবাদ – প্রতিটি মন্বন্তরে জগৎ ধ্বংস হয়, আবার সৃষ্টি হয়। ঈশ্বর ঋষিরূপে আবির্ভূত হয়ে মন্বন্তরের ঘোষণা করেন। স্বয়ম্ভু, স্বরচিষ প্রমুখ ঋষি।

নবদ্বীপের বিশিষ্ট জনেরা চৈতন‍্যের আবির্ভাবের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। মুরারি গুপ্ত গৌরাঙ্গকে যুগাবতার বলে স্বীকার করলেন। কবি কর্ণপূরের মতে, গৌরাঙ্গ সাক্ষাত কৃষ্ণ। আবার অদ্বৈত আচার্য এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীকৃষ্ণের চতুর্ব‍্যুহের প্রকাশের কথা বলেছেন – শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম, প্রদ‍্যুম্ন (শ্রীকৃষ্ণের পুত্র), অনিরুদ্ধ (প্রদ‍্যুম্নের পুত্র)। এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজ এই চতুর্ব‍্যুহের উপাসনার কথাও বলেছেন। যুগ প্রয়োজন মেটানো, কাজী দলন, জগাই মাধাই উদ্ধার এসব শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের বহিরঙ্গ বা গৌণ কারণ। শ্রী গৌরাঙ্গ‌ই শ্রীরূপ গোস্বামীকে সাহিত‍্যরচনা এবং শ্রীজীব গোস্বামীকে দর্শন রচনার নির্দেশ দেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মকে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিস্তৃত করার জন‍্য। আর এক‌ই শরীরে রাধাকৃষ্ণের আশ্রয় রূপে শ্রীচৈতন‍্যের আবির্ভাব হল মুখ‍্য বা অন্তরঙ্গ কারণ।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তগণের বিশ্বাস যে নাম প্রেম বিবরণ এবং রস আস্বাদনের জন‍্য সচ্চিদানন্দ রসময় শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার ভাব ও কান্তি অঙ্গীকার করে শ্রীচৈতন‍্যরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর অমৃতময় প্রকটজীবনে কথায় ও আচরণে অনুরূপ দৃষ্টান্ত‌ই দেখা যায় –

“প্রেমভক্তি শিখাইতে আপনি অবতরি।
রাধাভাব কান্তি দুই অঙ্গীকার করি
শ্রীকৃষ্ণ চৈতন‍্যরূপে কৈল অবতার।”

– – – –