সখীতত্ত্ব / গোপীতত্ত্ব
গোপী হল শ্রীকৃষ্ণের লীলা বিস্তারিকা এবং শ্রীরাধার প্রেমাভিব্যক্তির সহায়িকা। শ্রীকৃষ্ণের নায়িকাভেদে গোপীরা দ্বিবিধ – স্বকীয়া ও পরকীয়া। আবার পরকীয়াকে দুভাগে ভাগ করা হয় – কন্যোকা ও পরোঢ়া।
দেবী কাত্যায়নীর কাছে কঠোর তপস্যা করে যে সব গোপীরা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করেছিলেন তাঁরা হলেন স্বকীয়া। রুক্মিনী, সত্যভামা, কালিন্দী হলেন স্বকীয়া গোপী।
যারা কৃষ্ণের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ নয় তারা হলেন পরকীয়া গোপী। এঁদের মধ্যে যারা অবিবাহিত তাঁরা কন্যকা এবং যারা বিবাহিত ও স্বামী থাকতেও পরপুরুষ তথা পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আত্মনিবেদিত তারা হলেন পরোঢ়া।
পরকীয়া গোপীগণকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায় – নিত্যসিদ্ধা ও সাধনসিদ্ধা।
যারা অনাদিকাল থেকেই কান্তাভাবে ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণের সেবা করে আসছেন তাঁরা নিত্যসিদ্ধা, তাঁরা স্বরূপত হ্লাদিনী শক্তি ; আর যারা সাধন প্রভাবে সিদ্ধিলাভ করে ব্রজগোপীত্ব লাভ করে নিত্যসিদ্ধ পরিকরদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ সেবা করছেন তাঁরা হলেন সাধনসিদ্ধা।
আবার, সেবার প্রকারভেদ অনুযায়ী ব্রজগোপীদের দুভাগে ভাগ করা যায় –
১) সখী ও
২) মঞ্জুরী।
যাঁরা স্বীয় অঙ্গদানাদি দ্বারা শ্রীরাধার প্রায় সমজাতীয় সেবায় কৃষ্ণের প্রীতিবিধান করেন, তাঁদের সখী বলা হয়। ললিতা, বিশাখা এরা সখী, এরা সকলেই স্বরূপ শক্তি।
যাঁরা নিজঅঙ্গ দ্বারা কৃষ্ণের সেবা করতে প্রস্তুত নয়, পরন্তু রাধা গোবিন্দের মিলন ও সেবার আনুকূল্য সম্পাদনই যাঁরা নিজেদের প্রধান কর্তব্য বলে মনে করেন তাদের মঞ্জুরী বলা হয়। এঁরা শ্রীরাধার কিঙ্করী এবং অন্তরঙ্গ সেবার অধিকারিনী। শ্রীরূপমঞ্জুরী, শ্রীবিলাসমঞ্জুরী, শ্রীঅনঙ্গমঞ্জুরী প্রভৃতি মঞ্জুরী।
◆ মঞ্জুরীগণ সখীগণ অপেক্ষা ন্যূনবয়স্কা হয়।
◆ সখীদের সেবা স্বাতন্ত্র্যময়ী, মঞ্জুরীদের সেবা আনুগত্যময়ী।
◆ সাধারণত সখী ও মঞ্জুরী উভয়কেই সখী বলা হয় কারণ উভয়দ্বারা রাধাকৃষ্ণের লীলাবিস্তার সাধিত হয়। এবং লীলাবিস্তারই সখীত্বের বিশেষ লক্ষণ।
◆ গোপী / সখীর প্রয়োজনীয়তা –
চৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যলীলার অষ্টম পরিচ্ছেদে সখীতত্ত্বের কথা আছে। শ্রীকৃষ্ণকে ঐশ্বর্য জ্ঞানহীন মাধুর্যময়ভাবে আপন করে পাওয়া যায় বৃন্দাবনে। ব্রজে দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর এই চারভাবে কৃষ্ণসেবা প্রাপ্তির সম্ভাব্যতার কথা জানা যায়। মধুরভাবের সেবা অর্থাৎ কান্তাভাবের সেবা সর্বোৎকৃষ্ট। কান্তাভাবের সেবা বাসনা মহাভাব পর্যন্ত বিকশিত হয়। দাস্য, সখ্য, বাৎসল্যে মহাভাবের বিকাশ নেই। শ্রীরাধা ও সখীদের সকলের মধ্যেই মহাভাব বিরাজ করে। রাধাকৃষ্ণলীলায় তাই কেবলমাত্র সখীদের সেবার অধিকার থাকে। তাঁরা রাধাকৃষ্ণলীলাকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তোলেন –
“রাধাকৃষ্ণের লীলা এই অতি গূঢ়তর।
দাস্য বাৎসল্যাদি ভাবের না হয় গোচর॥
সবে এক সখীগণের ইহা অধিকার।
সখী হৈতে হয় এই লীলার বিস্তার॥”
বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণলীলায় সখীদের একটি প্রধান স্থান আছে। সখীগণ লীলাবিস্তারে সহায়িকা। শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের বিষয়স্বরূপ প্রেমের আশ্রয় হল রাধিকা। এই বিষয় ও আশ্রয়কে অবলম্বন করে সখীরা নিত্য লীলার অনন্ত বৈচিত্র্য ও মাধুর্য বিস্তার করেন। প্রেমের ভাঙাগড়ায় তাদের স্থান আছে ; সখীরা কখনো কৃষ্ণের পক্ষে কখনো রাধার পক্ষে – এই সখীগণ যেন শ্রীরাধার ক্রমবিস্তার। এজন্য রাধিকার কায়ব্যূহরূপে সখীরূপা গোপীদের গণ্য করা হয়। সখীরা রাধিকারূপ প্রেমকল্পলতা পল্লব বিশেষ –
“রাধার স্বরূপ কৃষ্ণের প্রেমকল্পলতা।
সখীগণ হয় তাঁর পল্লব-পুষ্প-পাতা॥”
লীলারস পুষ্টির জন্য যা করণীয় গোপীগণ তা করেন। রাধাকে বাদ দিয়ে গোপীদের মধ্যে প্রধান হলেন চন্দ্রাবলী, তারপর বিশাখা, ললিতা, শ্যামা, পদ্মা, শৈবা প্রমুখ। রাধার পূর্ণতা সখীরাই দেন। সখীশূন্য একক রাধা তাৎপর্যহীন। রায় রামানন্দ সখীদের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন –
“সখী বিনু এই লীলার পুষ্টি নাহি হয়।
সখী লীলা বিস্তারিয়া সখী আস্বাদয়॥”
মহাভাবময়ী সখী ছাড়া অন্য কারো রাধাকৃষ্ণের নিগূঢ় লীলার ক্ষেত্রে প্রবেশ অধিকার নেই। সখীরা যেমন রাধাকৃষ্ণ লীলা পুষ্ট করেন, তেমনি লীলা আস্বাদন করে আনন্দ অনুভব করেন। যিনি সখীদের আনুগত্য স্বীকার করে ভজন করেন, রাধা ও কৃষ্ণের কুঞ্জ সেবার অধিকার তিনি পেতে পারেন। সখীভাবের আনুগত্যের মধ্য দিয়েই রাধাকৃষ্ণের সেবা সম্ভব।
◆ সখীপ্রেমের স্বরূপ –
চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের আদিলীলার চতুর্থ পরিচ্ছেদে কাম প্রেমের পার্থক্য নিরূপণ প্রসঙ্গে কবিরাজ গোস্বামী গোপীপ্রেমের স্বরূপ প্রকাশ করেছেন –
১) “কামগন্ধহীন স্বাভাবিক গোপী প্রেম।
নির্ম্মল উজ্জ্বল শুদ্ধ যেন দগ্ধ হেম॥”
২) “গোপীগণের প্রেম অধিরূঢ় ভাবনাম।
বিশুদ্ধ নির্মল প্রেম কভু নহে কাম॥”
মহাভাবের দুটি অবস্থা – রূঢ় ও অধিরূঢ় ; মহাভাবের যে অবস্থায় সাত্ত্বিকভাবগুলি অনির্বচনীয় এক বিশিষ্টতা লাভ করে, তাকে বলে অধিরূঢ়। ব্রজগোপীদের প্রেমঅধিরূঢ় মহাভাবের অন্তর্গত।
কাম – প্রিয়তা – আত্মপ্রীতি
প্রেম – প্রিয়তা – কৃষ্ণপ্রীতি
ব্রজগোপীরা লোকধর্ম, বেদধর্ম বিসর্জন দিয়ে কৃষ্ণভজনা করেন, সমস্ত সুখ ত্যাগ করে অসম্মান সহ্য করে কৃষ্ণসেবা করে। কৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ তাদের সেবার কারণ ; এই অনুরাগ প্রেমের স্বরূপ শক্তির বৃত্তি –
“আত্মসুখ দুঃখ গোপীর নাহিক বিচার।
কৃষ্ণসুখ হেতু চেষ্টা মনোব্যবহার॥”
গোপীরা যে দেহপ্রীতি দেখান তাও “কৃষ্ণের লাগি জানিহ নিশ্চিত” ; ব্রজসুন্দরীরা মনে করেন যে কৃষ্ণ অর্পিত তাঁদের দেহ কৃষ্ণের সম্পত্তি, সেজন্য কৃষ্ণের সুখের কারণে ব্রজগোপীরা নিজেদের দেহকে মার্জিত ও ভূষিত করেন। শ্রীকৃষ্ণও বলেছেন – যে গোপীরা নিজদেহ আমাকে আমার সুখের জন্য সমর্পন করেন সেই গোপীগণ ছাড়া আমার নিগূঢ় প্রেমভাজন আর কেউ নেই।
জনৈক সমালোচকের দেহতত্ত্বের ব্যাখ্যায় আছে –
“ঊর্দ্ধ হতে নিম্নগামী তারে বলে ধারা।
নিম্ন হতে ঊর্দ্ধগামী তারে বলে রাধা।”
এই ঊর্দ্ধগামী প্রেম হল গোপীপ্রেম, এ প্রেম আত্মবাসনাশূন্য। রাধাগোবিন্দ নাথের মতে, এই লীলায় দর্শনালিখন, চুম্বনাদি কামক্রীড়ার মতো কতকগুলি ক্রীড়া লক্ষিত হয় কিন্তু এতে কোনো পশুবৎসম্মিলন নেই, দেহসর্বস্ব যৌন সম্ভোগ নেই। গোপীপ্রেমের ধর্ম হল প্রেমের সঙ্গে কৃষ্ণসেবা করলে এক অনির্বচনীয় আনন্দ জাগে। এদের প্রেমে কামগন্ধ আরোপ করা যায় না। তাদের প্রেম স্বসুখ বাসনাহীন। গোপীপ্রেমের স্বভাব হল প্রেমধর্মজনিত সুখ অনুভব। গোপীরা যখন কৃষ্ণ দর্শন করেন তখন বাসনা না থাকা সত্ত্বেও কোটিগুণ সুখ জাগে। গোপীপ্রেমের স্বভাবের এটাই মহিমা –
“গোপিকা দর্শনে কৃষ্ণের যে আনন্দ হয়।
তাহা হৈতে কোটিগুণ গোপী আস্বাদয়॥”
অর্থাৎ ব্রজগোপীদের কান্তাপ্রেমের যে গভীরতা সেই কৃষ্ণপ্রেমে তারা নিজেদের সুখ চাননা, কেবলমাত্র কৃষ্ণের সুখবিধান তাদের আকাঙ্ক্ষা, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীরাধার ক্রীড়াসংঘটনেই তাদের সুখ।
উজ্জ্বলনীলমণি মতে, সমস্ত ব্রজগোপীদের মধ্যে উন্নত হলেন চন্দ্রাবলী ও রাধা। আর এদের মধ্যে শ্রীরাধা শ্রেষ্ঠ। তত্ত্বগত ভাবে, কৃষ্ণ ও রাধা অভিন্ন, কেবলমাত্র ‘লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুইরূপ’। এই লীলায় রাধিকা পরকীয়া নায়িকা, কল্পনাতীতের প্রেমের অধিকারিণী, মহাভাবে একমাত্র রাধার অবস্থান, সেখানে কৃষ্ণেরও স্থান নেই।
সামগ্রিক আলোচনার নিরীখে সখীপ্রেমের স্বরূপগুলি হল –
৹ সখীদের নিজস্বতা নেই।
৹ তত্ত্বের দিক থেকে এরা শ্রীরাধার ওপর নির্ভরশীল।
৹ রাধার মনোবাসনার পরিতৃপ্তির জন্য সখীদের প্রয়োজন।
৹ গোপী/সখীপ্রেম কামনাবাসনাহীন।
জীবের প্রেম ব্যক্তিপ্রেম, দাম্পত্যপ্রেমের সঙ্কীর্ণতায় রুগ্ন হয়ে পড়ে, এর গতি ইন্দ্রিয় তৃপ্তির অভিমুখে ; গোপীপ্রেম ঊর্দ্ধমুখী, অন্তর্মুখী, স্বসুখবাসনাশূন্য, ব্যপ্ত প্রশস্ত, শাশ্বত। এ যেন – “গ্রহণ যত করেছ, ঋণী তত করেছ আমায়।”
– – – – –