বাংলা উপন্যাসে কল্লোল যুগের অবদান
রবিতাপের বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসা যখন রাজদ্রোহের শামিল তখনই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিশান উড়িয়ে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। রাবীন্দ্রিক বন্ধন ছিঁড়ে বার হলেও বাংলা সাহিত্যের স্থবিরত্বে জঙ্গমত্ব সঞ্চার করলেও নজরুলের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিদ্রোহ ততখানি নয়। যে প্রক্রিয়া অবচেতনভাবে তাঁর মধ্যে শুরু হয়েছিল তা সচেতন স্তরে আসতে দেরি হল না। এই যে সচেতনভাবেই সাহিত্যিক বিদ্রোহের যুগ একেই বলা যেতে পারে ‘কল্লোল যুগ’।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালীন দেশ ও কালের পটভূমিতে পাশ্চাত্যের ভাবাদর্শ ও সাহিত্যের অভিঘাতে যে সাহিত্যধারার বিকাশ, রবীন্দ্রনাথের ইতিবাচক জীবনদর্শনকে অতিক্রম করে যাওয়াই যার লক্ষ্য, সেই সাহিত্যকে ‘কল্লোল যুগের সাহিত্য’ বলা হয়।
তবে, কল্লোল যুগের সাহিত্য কেবলমাত্র কল্লোল পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি। কালিকলম, প্রগতি, ধূপছায়া, উত্তরা ইত্যাদি সমকালীন অনেকগুলি পত্রিকায় লেখা সাহিত্য কল্লোল যুগের সাহিত্যের গোত্রভূক্ত। এই সাহিত্য সম্পর্কে বলা যায় –
“এ একটা প্রবাহের বিচিত্র গতি, এর নাম কল্লোল, এর নাম আনন্দধারা, এর নাম আর্তনাদ, এর নাম বিদ্রোহ, এর নাম শান্তিকামনা, প্রেমের সন্ধানে যাত্রা।”
(কল্লোল যুগ : অচিন্ত্য সেনগুপ্ত)
◆ কল্লোল গোষ্ঠীর উপন্যাসের বৈশিষ্ঠ্য –
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত, ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন তত্ত্ব, অবক্ষয় ও বিজ্ঞানচেতনা – রাবীন্দ্রিক বলয়ের ঈশ্বর এবং প্রেমমাধুর্যের বদলে যুগের অবক্ষয় সম্পর্কে সাহিত্যিকদের সচেতন করে তুললো। শুধু কবিতা নয়, কথাসাহিত্যিকের দর্পনেও ধরা পড়ল এই যুগান্তরকারী বাঁক বদলের ছবি। জীবনানন্দের ভাষায় –
“একদিন শুনেছি যে সুর
ফুরায়েছে, পুরানো তা,
কোন এক নতুন কিছুর আছে প্রয়োজন।”
কল্লোল গোষ্ঠীর সাধনা ছিল নবীনতার সাধনা, অনন্যতার সাধনা –
“যেমনটি আছে তেমনটি ঠিক আছে এর প্রচন্ড অস্বীকৃতি। যা আছে তার চেয়েও আরো কিছু আছে বা যা হয়েছে তা এখনো পুরোপুরি হয়নি তার নিশ্চিত আবিষ্কার।”
এই আবিষ্কারের প্রথম সহায় হলেন প্রমথ চৌধুরী, সমস্ত সবুজ ও সজীবের উৎসস্থল। তিনি লিখেছেন –
“প্রবাসে চলিয়ে গিয়েছেন রবি
এই ফাঁকে হও নূতন কবি
নূতনের আজ জরুর বড়ো
এই বুঝে নব সাহিত্য গড়ো।
* * * * * * * * * * * *
প্রকৃতি কাহারো রক্ষিতা নয়
সবারি গলেতে জড়ায়ে রয়।
সে রস তাহার পরশে পাও
নিজের জবানি কবুল খাও। (নূতন কবি)
উনিশ শতকের সুস্থির প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধগুলি বিশ শতকের প্রথমদিকে একটা বড় আঘাতে ভীষণভাবে নাড়া খাবার ফলে আবার নূতন করে সেগুলি সম্পর্কে সচেতনতা এল, এল নতুন দেশ ও কালের প্রেক্ষিতে তাদের উপযোগিতা ও তাৎপর্য নতুন করে বিচার করার অবকাশ।
● প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর নেতিবাচকতা –
স্বদেশি আন্দোলন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সংশয়, হতাশা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে বাঙালি যুবচিত্ত গভীর হতাশায়, ক্ষোভে পরিপূর্ণ হয়েছিল। কল্লোল গোষ্ঠীর লেখক যাঁরা অথবা তাদের সমকালীন সকলেরই যৌবন কৈশোর কেটেছে প্রথম মহাযুদ্ধের সূচনাপর্বের ও তার অব্যবহিত পরবর্তী বাংলাদেশে। দারিদ্র্যের তান্ডব নৃত্যের নিষ্ঠুর পদাঘাতে উড়ে যাচ্ছে ধর্ম, সমাজ, স্বাস্থ্য, আনন্দ, মূল্যবোধ। জীবনের প্রচলিত মূল্যবোধ সম্পর্কে বিশ্বাস হারিয়েছে, নেতিবাচক সংশয়বোধে ভরে গেছে তাদের মন। আর এর মূলে হচ্ছে রোমান্টিক ভাবনা। পুরানো বিশ্বাস বা মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত রোমান্টিক যৌবনের অনিকেত নিরুদ্দেশ রূপটি কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের কয়েকটি গ্রন্থের নামে আভাসিত হয়েছে যেমন – ‘পথিক’, ‘বেদে’, ‘বেনামী বন্দর’, ‘যাযাবর’ ইত্যাদি। এ যুগের গল্প উপন্যাসে যে রোমান্টিক তরুণের সাক্ষাৎ পাই তার সাধারণ রূপটির বর্ণনা প্রসঙ্গে অচিন্ত্যকুমার বলেছেন –
“আদর্শবাদী যুবক প্রতিকূল জীবনের প্রতিঘাতে নিবারিত হচ্ছে – এই যন্ত্রণাটা সেই যুগের যন্ত্রণা।” (কল্লোল যুগ)
● রবীন্দ্র বিরোধিতা –
বিশ শতকের প্রাক্কালেই যে প্রবল ঘূর্ণাবর্তে সে যুগের তরুণ মন আন্দোলিত হয়েছে, যে অনিশ্চয়তা ও নাস্তিক্যবুদ্ধির অভূতপূর্ব মানস পরিবেশ তাঁদের সৃজনশীল মনের চারপাশে রচিত হয়েছে তার সামগ্রিক ফলশ্রুতি হিসাবে তরুণ কবি ও কথাসাহিত্যিকদের প্রথাবিষ্ট শিল্পচেতনা বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। একালের শিথিল প্রত্যয় অস্থির চিত্ত, বেপরোয়া ‘বিদ্রোহী’ যুবমানসের কাছে রবীন্দ্রনাথের জীবনদৃষ্টি ও শিল্পচেতনা ‘যুগোপযোগী’ বলে মনে হল না। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কাছে ছিল ক্লাসিক্যাল। কল্লোল যুগের লেখকগণ মনে করলেন রবীন্দ্রনাথের কাব্যে বাস্তবতার পরিবর্তে আছে রোমান্টিকতা, তাঁর সুচিত্রিত চরিত্রগুলির সকলই যেন শুচিতায় ভরা, তাঁর কথাসাহিত্যে জ্বালা যন্ত্রণার চিহ্ন নেই, নেই সংরাগের তীব্রতা। তাই ‘রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে এসেছিল কল্লোল’। অচিন্ত্যকুমারের ভাষায় –
“সম্মুখে থাকুন বসে পথ রুধি রবীন্দ্র ঠাকুর
আপন চক্ষের থেকে জ্বালিব যে তীব্র আলো
যুগ সূর্য ম্লান তার কাছে। মোর পথ আরো দূর।” (কল্লোল যুগ)
● পাশ্চাত্য প্রভাব –
প্রথম যুদ্ধোত্তর কালে বাংলাদেশের তরুণ কথাশিল্পী গোষ্ঠীর মানসিকতায় যে বিপুল পরিবর্তনের আভাস লক্ষিত হয়, যে মূল্যবোধ ও জীবনদৃষ্টির রূপান্তরের অন্যতম প্রকাশ ঘটেছে রবীন্দ্র বিরোধিতায় – সেই মানসিকতার রূপান্তরের নেপথ্যে এ যুগে এক বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করেছে পাশ্চাত্য সাহিত্য।
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বাঙালির মানস চিন্তায় ও দৃষ্টিভঙ্গিতে এক মৌল পার্থক্য এখানে লক্ষ্য করা যায়। বিগত শতাব্দীর সাহিত্যে শিল্পে ধর্মচিন্তায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনে, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে পাশ্চাত্য অনুসরণ পরিলক্ষিত হয়েছিল এবং সেখানে মনে হয়ে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী অপেক্ষা রোমান্টিক ভাবোচ্ছাস অধিকতর স্পষ্ট রূপে প্রতিভাত হয়েছিল। কিন্তু বিশ শতকের গোড়া থেকে প্রকৃতপক্ষে সমরোত্তর কাল থেকে তাদের ভাব আন্দোলনে একটা আমূল পরিবর্তন হলো ; বিশেষ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও মার্কসবাদের বাস্তব রূপায়ণ পাশ্চাত্য সমাজ ও চিন্তাধারায় যে পরিবর্তন এনেছিল তার প্রভাব বাঙালির বুদ্ধিজীবী মহলে সংক্রমিত হয়েছিল ; কল্লোল গোষ্ঠীর সাহিত্যে এই প্রভাব লক্ষ্যণীয়। বিশ্বাসভঙ্গ ও মূল্যবোধের বিপর্যয়ের দিনে গোর্কি, টলস্টয়ের রচনা, রোমা রল্যাঁর উপন্যাস, বোয়ারের সাহিত্য, এলিয়টের কাব্য বাঙালি তরুণ লেখক গোষ্ঠীর কাছে নতুন আশ্বাস ও প্রত্যয়ের বাণী বহন করে এনেছিল।
সজনীকান্ত দাস লিখছেন –
“বিশ্বযুদ্ধের আলোড়ন শেষ হইলে দেখা গেল, ইউরোপীয় সাহিত্যের উদগ্র বস্তুবাদ উগ্রমূর্তি লইয়াই বাঙলার অঙ্গনে প্রবেশ করিতেছে।….ইবসেন, মেটার্লিঙ্ক, টলস্টয়, বোয়ার, ক্লুট, হ্যামসুন – বঙ্গবাণীর নিরামিষ অঙ্গনে তাজা রক্তের ছাপ পড়িতেছে। সে কি উত্তেজনা, কি উন্মাদনা। সেই ঢেউই চলিল কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি, উত্তরা পর্যন্ত।”(আত্মস্মৃতি ২য়খন্ড)
● বাস্তব প্রবণতা –
‘ভারতবর্ষ’, ‘প্রবাসী’, ‘বসুমতী’, বঙ্গবাণী’ ইত্যাদি সমকালীন পত্রিকায় যে বাস্তব প্রবণতার পরিচয় ফুটে উঠেছিল ‘কল্লোল গোষ্ঠী’ তাকেই আরও তীব্র করে তুলল। এই বাস্তব প্রবণতার একদিকে যৌন মনস্তত্ত্বের অসঙ্কোচ রূপায়ণ, অন্যদিকে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের অভাব অভিযোগজনিত দুঃখবোধের প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ এঁদের এই বাস্তবতার দুটি উপাদানকে ভৎসর্নার সুরে বলেছিলেন, ‘লালসার সংযম’, ও ‘দারিদ্র্যের আস্ফালন’ এই দুয়ের মিশ্রণে নবীনরা যা প্রস্তুত করেছেন তাকে রবীন্দ্রনাথ সত্যকার রিয়ালিজম বলেননি, বলেছেন রিয়ালিটির কারি পাউডার। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী অনুসরণ করে ‘নিরাসক্ত’ভাবে সমগ্রজীবনকে নিরীক্ষণ করার নামে অনেকক্ষেত্রেই এঁরা কেবল জীবনের পঙ্কিল কদর্য ঘৃণ্যদিকটাই একমাত্র বাস্তব সত্য বলে মনে করেছেন। ‘বাস্তবতা’র সংজ্ঞা নিয়ে প্রচলিত বিতর্কের মধ্যে প্রবেশ না করেও স্বীকার করতে হয় যে, পূর্বতন আদর্শবাদের বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় এ যুগের লেখকদের হাতে, অন্তত বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছুটা বাস্তবতার পরিচয় অবশ্যই ফুটে উঠেছে।
● গণতান্ত্রিক চেতনা –
কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের রচনায় বাস্তবতার হাত ধরে এসেছে গণতান্ত্রিক চেতনা। অতি নগণ্য মানুষ – বেকার মধ্যবিত্ত যুবক, পথের ভিখারী, নগণ্য বস্তিবাসী, কুলি সাহিত্যের বিষয় হয়ে উঠেছে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ভাষায় –
“রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে এসেছিল ‘কল্লোল’। সরে এসেছিল অপজ্ঞাত ও অজ্ঞাত মনুষ্যত্বের জনতায়, নিম্নগত মধ্যবিত্তের সংসারে। কয়লাকুঠিতে, খোলার বস্তিতে, ফুটপাতে।”
(কল্লোল যুগ)
গোকুল নাগের ‘পথিক’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘বেদে’, ‘আসমুদ্র’, বুদ্ধদেব বসুর ‘ধূসর গোধূলি’ ইত্যাদি উপন্যাস এই চেতনার সাক্ষ্য বহন করছে।
● নগরচেতনা –
প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকাল বাংলাদেশের পক্ষে মোড় ফেরানোর কাল – জীবনচর্যায় ও মানসিকতায়। সেদিনের তাদের সংস্কৃতিতে যে পূর্ববহিত গ্রামীণ সুর ছিল তাকে ছাপিয়ে বড়ো হয়ে উঠল আধুনিক যুগের নাগরিক সুর, আমাদের বদ্ধজল জীবনের প্রাঙ্গণে বিশ্বের স্রোত আরও বেশি অর্থবহরূপে এসে পৌঁছালো।
শরৎচন্দ্রের মধ্যে পল্লীবাংলার পটভূমিই মুখ্য হয়ে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথের শেষপর্বের উপন্যাসে অনেকক্ষেত্রে নগর জীবনের পটভূমি হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু কল্লোলের গল্প উপন্যাসে যেখানে চাকুরীজীবী মধ্যবিত্ত মানুষের ভিড়, সেখানে নগর বিশেষভাবে কলকাতা শহরের ছবিই মুখ্য পটভূমি রচনা করেছে। ভূমিহীন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষ দলে দলে কলকাতায় ভিড় করেছে, আর সেইসব নরনারীর বিচিত্র সমস্যায়, আশায়, বিক্ষোভে, আলো আঁধারি অন্তর্দ্বন্দ্বের জটিলতায় ও অবক্ষয়ে কলকাতা শহর আধুনিক জীবনের যথার্থ প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় –
“জীবন ফেনিল হয়ে উঠেছে শহরে – স্বার্থের সংঘাতে সংঘাতে, বিলাসিতার লাস্যে, দারিদ্র্যের ভয়াবহতায়;…” (হঠাৎ আলোর ঝলকানি)
কল্লোল গোষ্ঠীর অন্যতম প্রেমেন্দ্র মিত্র নগরের সঙ্গে আধুনিক জীবনের এক অন্তরঙ্গ গূঢ় সংযোগের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন –
“আমার সঙ্গে এস মহানগরের পথে, যে পথ জটিল দূর্বল মানুষের জীবনধারণার মতো, যে পথ অন্ধকার মানুষের মনের অরণ্যের মত…এ মহানগরের সংগীত রচনা করা উচিত ; ভয়াবহ বিস্ময়কর সংগীত।” (মহানগর)
প্রেমেন্দ্র মিত্রের মিছিল, উপনয়ন, পাঁক প্রভৃতি উপন্যাসে জটিল নগর চেতনার প্রকাশ পাই।
● যৌনবাস্তবতা –
কল্লোলের তরুণ লেখকেরা প্রাচীন সমস্ত ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নরনারীর যৌন সম্পর্কে রক্ষণশীল মনোভাব ও শুচিতাবোধ।
পূর্বতন মনস্তত্ত্বমূলক কথাসাহিত্যের সঙ্গে কল্লোল গোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক কথাসাহিত্যের মৌল পার্থক্য হল – পূর্বসুরীরা যেখানে মনস্তত্ত্ব উদঘাটনে অনেকক্ষেত্রে ব্যক্তিসত্তার বাস্তবসত্যকে প্রকাশ না করে সমাজসত্তার প্রভাব, নৈতিক আদর্শ ও রক্ষণশীল মনোভাব ইত্যাদি অস্বীকার করেন নাই কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকেরা সেখানে পূর্বসুরীদের বিপরীত পথ অবলম্বন করেন এবং মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে তাঁদের কথাসাহিত্যে যৌন বিদ্রোহ ও যৌনবাস্তবতাকে প্রকাশ করতে শুরু করেন।
ফ্রয়েডীয় গবেষণা ও মনস্তত্ত্ব তরুণ দলের মনকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করলো। সেই মনস্তাত্ত্বিক আলোক সম্পাতের ফলে স্বপ্নের আকাশ নতুন অর্থে আত্মপ্রকাশ করল ; নারী পুরুষ, জননী সন্তান, দেহ মন প্রেম কাম ইত্যাদি সম্পর্কে পুরানো ধারণা বদলে গেল। নর নারীর সম্ভোগের চিত্রের নিরঙ্কুশ উদঘাটন, কামাতুর শব্দের ব্যবহার, নারীর অঙ্গ যৌন পীঠের বর্ণনা কল্লোলীয় রচনায় তীব্র ও তপ্ত হয়ে উঠেছিল।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘বেদে’, বুদ্ধদেব বসুর ‘বাসরঘর’, ‘অভিনয় নয়’, ‘রজনী হল উতলা’, মনীশ ঘটকের ‘ভুখা ভগবান’ প্রভৃতি উপন্যাসে অবচেতন মনের যৌবন চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। ‘রেখাচিত্র’ নামক গল্পের শেষে বিরহী নায়ক অলক্ষ্য নায়িকার উদ্দেশ্যে বলেছে –
“তোমার যৌবনের একটি উজ্জ্বল শুভক্ষণ আমাকে দিয়াছিলে, তাহাই আমার যথেষ্ট। তাহাই আমার আজীবনের স্মৃতিমন্থন উপহার। যে বিচ্ছেদকে অভিশাপ বলিয়া এতদিন জানিয়াছি, আজ তাহাকেই আশীর্বাদরূপে বরণ করিয়া লইলাম।”
কল্লোলকে নিয়ে যে প্রবল প্রাণোচ্ছ্বাস এসেছিল তা শুধু ভাবের দেউলে নয়, ভাষারও নাটমন্দিরে। অর্থাৎ কল্লোলের বিরুদ্ধতা শুধু বিষয়ের ক্ষেত্রেই ছিল না, ছিল বর্ণনার ক্ষেত্রে, ভঙ্গি ও আঙ্গিকের চেহারায়, রীতি ও পদ্ধতির প্রকৃতিতে। ভাষাকে গতি ও ভাবকে দ্যুতি দেবার জন্যে ছিল শব্দসৃজনের পরীক্ষা নিরীক্ষা, রচনাশৈলীর বিচিত্রতা। গল্পরসের আকর্ষণ এ যুগের লেখকদের কাছে হ্রাস পেয়েছে। নরনারীর মনোজীবনের বিশ্লেষণ – রবীন্দ্রনাথের ভাষায় –
“ঘটনা পরম্পরার বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে দেখানো” – সাহিত্যের এই নবপর্যায়ের পদ্ধতির প্রতি আকর্ষণ কল্লোলের কালে ক্রমশ পরিস্ফুট হয়েছে।
কল্লোলীয় অনেক রচনায় কথাসাহিত্যে কাব্যরীতি প্রকাশ পেয়েছে। এযুগে অনেক কথাসাহিত্যিকই ছিলেন একসঙ্গে কবি ও কথাশিল্পী। তাই তাঁদের অনেক কাহিনিই বাস্তব জীবনের objective আখ্যান হয়নি, কবি মনের subjective অনুভূতির রোম্যান্টিক লিপিচিত্র হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধদেব বসুর ‘বাসরঘর’ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন –
“এ কবির লেখা গল্প। আখ্যানকে উপেক্ষা করে বাণীস্রোত বেগে বয়ে চলেছে।”
উপরোক্ত বৈশিষ্ঠ্যর নিরীখে মনে হতে পারে কল্লোল পন্থী লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গীর যেন একটা স্ববিরোধ ছিল। উগ্র বাস্তবতা আবার স্বপ্নাতুর রোমান্টিকতা, স্পর্ধিত বিদ্রোহ আবার অন্যদিকে করুণ ব্যর্থতার মাধুরী একদিকে সুগভীর আশা অন্যদিকে অতল নৈরাশ্য। আসলে এ সবই জটিল ও আধুনিক জীবনের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বময় রূপেরই প্রকাশ। ‘কল্লোল’পত্রিকায় কল্লোলের বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে যে উক্তি করা হয়েছিল এ প্রসঙ্গে সেটি স্মরণীয় –
“এ একটা প্রবাহের বিচিত্র গতি। এরই নাম কল্লোল। এরই নাম আনন্দধারা, এরই নাম আর্তনাদ, এরই নাম বিদ্রোহ, এরই নাম শান্তির কামনা, প্রেমের সন্ধানে যাত্রা।”
🔺 সীমাবদ্ধতা –
১) কল্লোল গোষ্ঠীর প্রধান লক্ষণ ছিল বিদ্রোহ, আর সেই বিদ্রোহের লক্ষণ ছিল রবীন্দ্রনাথ। কল্লোলের কথাকাররা রবীন্দ্র বিরোধিতা করেছেন তবে সেই বিদ্রোহ যতটা আবেগধর্মী ছিল ততটা বুদ্ধিদীপ্ত ছিল না। তা ছিল ছদ্মবিদ্রোহ। বুদ্ধদেব বসু লিখছেন –
“অন্তত একজন যুবকের কথা আমি জানি, যে রাত্রে বিছানায় শুয়ে পাগলের মতো পূরবী আওড়াত, আর দিনের বেলায় মন্তব্য লিখত রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করে।”
(রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক)
‘কল্লোল’ গোষ্ঠী রবীন্দ্র রচনার যে ইতিবাচকতার বিরোধিতা করতে চেয়েছিলেন পরবর্তীকালে তাদের রচনায় তার প্রভাব পাওয়া যায়।
২) ‘কল্লোল’ গোষ্ঠী পাশ্চাত্য ভাবধারা এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই পাশ্চাত্য সাহিত্য অনুসরণ করে তারা সাহিত্যকর্মে ব্রতী হলেও তাঁদের রচনা দেশজ ভাবনায় পরিপুষ্ট হতে পারেনি।
৩) কল্লোলীয় কথাসাহিত্যে গণতান্ত্রিক চেতনা এলেও তাঁদের রচনায় সামাজিক পটভূমিতে এইসব ব্যক্তির সমস্যা তেমন ফোটেনি, সমাজ নিরপেক্ষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাহিনিই তাঁদের কল্পনাকে অধিক উত্তেজিত করেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন –
“বস্তিজীবন এসেছে কিন্তু বস্তি জীবনের বাস্তবতা আসেনি – বস্তির মানুষ ও পরিবেশকে আশ্রয় করে রূপ নিয়েছে মধ্যবিত্ত রোমান্টিক ভাবাবেগ” (লেখকের কথা)
৪) সর্বোপরি, কল্লোল গোষ্ঠীর সাহিত্যে তৎকালীন যুগপটভূমিতে বাস্তবতা এবং বাস্তবতার হাত ধরে জটিল জীবন সমস্যা রূপায়িত হলেও তা তাদের রোমান্টিক মনের স্পর্শে সুরভিত। নগরের জটিল ক্ষতবিক্ষত আত্মার রূপ তাঁদের রচনায় সামগ্রিকভাবে পরিস্ফুট নয়, নগরজীবনের খন্ডিত অনতিগভীর উপলব্ধির পরিচয় সেখানে ফুটেছে বেশি।
সমসাময়িককালে জটিল জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ লেখক সাহিত্যক্ষেত্রে এলেও তাঁরা কল্লোলতের গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। কল্লোল গোষ্ঠীর কথাসাহিত্যে যে বিচিত্র প্রবণতা প্রকাশ করেছে তা পরবর্তীকালের লেখকদের মধ্যে ক্রমশ বিবর্ধিত হয়ে পুষ্টলাভ করেছে, বহু বিচিত্র বর্ণরাগে রক্তিম হয়ে উঠেছে।