মহাভারত অনুবাদের ধারায় কাশীরাম দাসের কৃতিত্ব –


সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেদব‍্যাসের মূল মহাভারত ভারতীয় জীবনে অবিচ্ছেদ‍্যভাবে সম্পৃক্ত। বাল্মীকি ব‍্যাসের অনূদিত বাংলা রামায়ণ ও মহাভারত বাঙালির ঘরে ঘরে মুদিখানা থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত সমান সমাদর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় মহাভারত হল – “একটি জাতির স্বরচিত স্বভাবিক ইতিহাস”।

বাংলায় মহাভারত অনুবাদের সূত্রপাত
রামায়ণ অনুবাদের পাশাপাশি পঞ্চদশ শতকের শেষ দিক থেকে মহাভারত অনুবাদের‌ও ঐতিহ‍্য গড়ে উঠেছিল। বাংলায় মহাভারত রচনার সূত্রপাত হয় পঞ্চদশ শতকে কবীন্দ্র পরমেশ্বরের দ্বারা। চট্টগ্রামের অধিবাসী কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী যথাক্রমে পরাগল খান ও তাঁর পুত্র নুসরৎ খানের রাজসভায় মহাভারতের দুটি বিশিষ্ট অনুবাদ করেন –
৹ কবীন্দ্র পরমেশ্বরের অনুবাদ ছিল সমগ্র মহাভারতের নির্যাস – যা পরাগলের নির্দেশে নির্মিত হয়েছিল। তাই এটি ‘পরাগলী মহাভারত’ নামে খ‍্যাত।
৹ অপরদিকে, শ্রীকর নন্দী মহামুনি জৈমিনী কর্তৃক রচিত অশ্বমেধিক মহাভারতের অনুবাদ করেছিলেন।
এছাড়াও সঞ্জয়, নিত‍্যানন্দ ঘোষ, বিজয় পন্ডিত, দ্বিজ অভিরাম প্রমুখ মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন।

অনুবাদক কাশীরাম দাসের পরিচয় –
সপ্তদশ শতকের গোড়ায় বাংলা মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাসের আবির্ভাব। তাঁর প্রদত্ত তথ‍্য থেকে তাঁর পরিচয় জানা যায় –

“ভাগীরথী তটে বাটী ইন্দ্রাইনি নাম
তার মধ‍্যে প্রতিষ্ঠিত গণি শিঙ্গিগ্রাম
অগ্রদ্বীপ গোপীনাথ রায় পদতলে
নিবাস আমার সেই চরণ কমলে।”

কাশীরাম দাসের পিতা ছিলেন কমলাকান্ত ; কবি জাতিতে কায়স্থ। কাশীরাম দাসের পিতামহ, পিতা, ভ্রাতা সকলেই কবিত্বশক্তি সম্পন্ন ছিলেন। কাশীরাম দাসের কুলোপাধি ছিল ‘দেব’। তবে এদেশে নামের সঙ্গে ‘দাস’ শব্দ ব‍্যবহারের প্রথা অত‍্যধিক প্রচলিত ছিল। বিশেষত: বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে মহান্তগণ‌ও দাস আখ‍্যা গ্রহণে গৌরববোধ করতেন। কাশীরামের পিতা ভ্রাতা এমনকি তিনি নিজেও বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। এজন‍্য নামের সঙ্গে বিনয়সূচক ‘দাস’ শব্দটি ব‍্যবহার করতেন।

গদাধরের ‘জগৎমঙ্গল‘ থেকে জানা যায়, কাশীরাম মেদিনীপুর জেলার আত্রাসগড়ের রাজার বাড়িতে শিক্ষকতা করতেন এবং সেখানে অভিরাম মুখুটীর কাছে মহাভারত শুনে প্রভাবিত হয়ে তাঁর আদেশে ও আশীর্বাদে কাশীরাম দাস মহাভারতের অনুবাদের কাজে লিপ্ত হন –

“হরিহরপুর গ্রাম সর্ব্ব গুণ ধাম।
পুরুষোত্তম নন্দন মুখুটী অভিরাম॥
কাশীরাম বিরচিল তাঁর আশীর্বাদে।
সদা চিত্ত রহে যেন দ্বিজ পাদপদ্মে॥”

তবে কাশীরাম দাস মহাভারতের সমগ্র অনুবাদ করেননি। তিনি মাত্র সাড়ে তিনটি পর্বতর্জমা করেছিলেন। ১৮৬৬ সালে কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রকাশিত মূল মহাভারতে আছে –

“আদি সভা বন বিরাটের কতদূর।
ইহা রচি কাশীদাস গেল স্বর্গপুর॥”

সমালোচকদের মতে, তাঁর মৃত‍্যুর পর ভ্রাতষ্পুত্র নন্দরাম বাকি সাড়ে চোদ্দটি পর্ব অনুবাদ করেন। তবে এ নিয়ে নানা মতভেদ আছে।

অনুবাদের ধারায় কাশীরাম দাসের মহাভারতের কৃতিত্ব –
       কাশীরাম দাস ব‍্যাস-ভারত এবং জৈমিনি ভারত এই গ্রন্থদ্বয় আদর্শরূপ গ্রহণ করে মহাভারত রচনা করেছিলেন। কাশীদাসের গ্রন্থের বিশিষ্টতা এই যে তিনি মহাভারতের আক্ষরিক অনুবাদ করেননি, কৃত্তিবাসের মতো মর্মানুবাদ করেছিলেন। সাধারণ মানুষের কথা ভেবে রসতৃষ্ণা চরিতার্থ করার জন‍্য তাদের উপযোগী করে কবি মহাভারত রচনা করেছেন। কাব‍্যে তিনি উল্লেখ করেছেন –

“যেই বাঞ্ছা করি লোক শুনয়ে ভারত।
গোবিন্দ করেন পূর্ণ তার মনোরথ॥”

        কাশীদাসী মহাভারতে অনেক আখ‍্যায়িকা পরিত‍্যক্ত হয়েছে এবং অনেক নতুনত্বের সমাবেশ ঘটেছে। সংস্কৃত মহাভারতে পৌষ‍্যপর্ব্ব থেকে উপাখ‍্যান আরম্ভ হয়েছে কিন্তু কাশীরাম দাসের মহাভারতে ভৃগুবংশের বিবরণ প্রথম দেখতে পাওয়া যায়। তবে উতঙ্গের আখ‍্যায়িকা তিনি সম্পূর্ণ পরিত‍্যাগ করেননি। আবার, সমগ্র অশ্বমেধ পর্বটি তিনি কাশীরাম দাসের জৈমিনি মহাভারত থেকে অনুসরণ করেছিলেন।

        কাশীরাম দাস ভগদ্ভক্ত কবি, তার কবিমানস বৈষ্ণব ভক্তির দ্বারা প্রভাবিত ছিল। মহাভারতের বিশিষ্ট চরিত্র কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে তার একটি ভক্তিপ্রাণতার বিকাশ। কেবল কুরুক্ষেত্র নয়, মহাভারতের সর্বত্র‌ই কৃষ্ণ পান্ডবগণের সারথি। ভাগবতের ন‍্যায় মহাভারত‌ও কৃষ্ণলীলাত্মক গ্রন্থমাত্র; এই কারণে কাশীদাসী মহাভারতের সর্বত্র‌ই কৃষ্ণকে যন্ত্রীরূপে চিত্রিত করা হয়েছে আর কবি নানাভাবে তার চরণ ভক্তির অর্ঘ্য প্রদান করেছেন। কাব‍্যের এক স্থানে তিনি লিখেছেন –
       “অলি হব কৃষ্ণপদে মনে অলি রাখি”
তিনি সভা পর্বে যুধিষ্ঠিরে কৃষ্ণ প্রণতিতে দাস‍্যভক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

       দ্রৌপদীর স্বয়ম্ভর সভার অর্জুনের লক্ষ‍্যভেদ প্রসঙ্গে কৃষ্ণমহিমা উল্লেখ কাশীরাম দাসের বৈষ্ণবীয় চিন্তার প্রকাশ। কৃষ্ণের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত রাজন‍্যকূল তার চরম বন্দনা করেছেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য প্রমুখ কৃষ্ণের প্রতি যে ভক্তি প্রকাশ করেন তা চৈতন‍্যোত্তর যুগের বঙ্গদেশের প্রবণতাকে চিহ্নিত করে।

      কবি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভক্তিরসের সঙ্গে গার্হস্থ‍্যরসকে মিশিয়ে এক‌ই পাত্রে পরিবেশন করেছেন। সমুদ্র মন্থনের কাহিনিতে হর পার্বতীর গার্হস্থ‍্য জীবনচিত্র বাঙালির পারিবারিক জীবনের অনুরূপ হয়ে উঠেছে। সুভদ্রা হরণ প্রসঙ্গে কাশীরাম গার্হস্থ‍্যের উপস্থাপনা করেছেন। এই কাহিনি যেন বাঙালির পারিবারিক রোমান্সে পরিণত হয়েছে। অর্জুনের প্রতি সুভদ্রার প্রেম, গোপনে বিবাহ, সত‍্যভামার সঙ্গে অর্জুনের রসালাপ বাঙালি পরিবারের রঙ্গরসকে চেনায়।

       সভাপর্বে প্রধানত দুটি নতুন উপাখ‍্যানের সাহায‍্যে কবি ভক্তিরস ও পারিবারিক জীবন রসের মধুচক্র নির্মাণে সমর্থ হয়েছেন –
১) রাজসূয় যজ্ঞে বিভীষণের আগমন
২) যজ্ঞসভায় দ্রৌপদী ও হিড়িম্বার একত্র উপস্থিতি
– এই দুই নারীর মধ‍্যে কবি চমৎকার সপত্নীদ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন, যা বাঙালি সমাজের তৎকালীন প্রাত‍্যহিক ঘটনা।
সভাপর্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ‍্য ঘটনা রাজসভায় রাজবধূ দ্রৌপদীর নির্যাতন ও বস্ত্রহরণ। এ কাহিনি বর্ণনায় কবি কৃষ্ণের মাহাত্ম‍্য পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন। মূল মহাভারতে যেখানে কৌরবদের পৌরুষহীনতার কথা বলা হয়েছে সেখানে এই কবি দ্রৌপদীর আর্তির দ্বারা কাব‍্যের করুণারস ঘনীভূত করেছেন।

      সত‍্যভামা চরিত্র অবলম্বনে কবি মহাভারতের বহির্ভূত দুটি কাহিনির অনুবাদ কাশীরাম দাস তার মহাভারতে এনেছেন –
১) পারিজাত হরণ কাহিনি
২) সত‍্যভামার তুলাব্রত
বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবত পুরাণ এ প্রথম কাহিনিটি পাওয়া যায় আর দ্বিতীয় কাহিনিটি কবির নিজস্ব নির্মাণ। এছাড়া কবি আর‌ও কিছু নতুন প্রসঙ্গ এনেছেন – শ্রীক্ষেত্রে মাহাত্ম‍্য, একাদশী মাহাত্ম‍্য, হরিমন্দির মার্জনের ফল ইত‍্যাদি।

       মূল মহাভারতে বহু দার্শনিক বিষয়, বিচার, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব নীতিকথা ও গুচ্ছসূত্র বর্তমান আছে। কাশীরাম দাস বাঙালি পাঠকের বোধগম‍্যতাকে মথায় রেখে এবং কাহিনিকে সহজবোধ‍্য ও মনোরম করতে গিয়ে এই তত্ত্বকথাগুলি বর্জন করেছেন।

এছাড়া সহজবোধ‍্য উপমার ব‍্যবহার গ্রন্থের আস্বাদনীয়তা বাড়িয়েছে। যেমন দুর্যোধন কন‍্যা লক্ষণার রুপ বর্ণনা প্রসঙ্গে –
“অনুপম মুখ তার জিনি শরদিন্দু
ঝলমল কুন্তল কমল প্রিয়বন্ধু॥
সম্পূর্ণ মিহির জিনি অধর রঙ্গিমা।
ভ্রুভঙ্গ অঙ্গন চাপ জিনিয়া ভঙ্গিমা॥”

কাশীদাসী মহাভারতের ভাষার গাঢ়বদ্ধতা ও পরিপাট‍্য সংস্কৃত জ্ঞানের সাক্ষ‍্য দেয়। কবি যে প্রাচীন অলঙ্কারিতা বিষয়ে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন তা প্রমাণিত –
“দ‍্যাখ দ্বিজ মনসিজ জিনিয়া মুরতি।
পদ্মপত্রে যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি॥
অনুপম তনুশ‍্যাম নীলোৎপল আভা।
মুখরুচি পটশুচি ধরিয়াছে শোভা॥”

কাশীরাম দাস মহাভারতে ঝংকারমুখর শব্দশৃঙ্খলকে অনুসরণ করেছেন। কৃষ্ণের বিশ্বরূপ বর্ণনায় তিনি তৎসম শব্দবহুল যে ঘনপিনদ্ধ বাকরীতি করেছেন তা প্রশংসনীয় –
“সহস্র মস্তক শোভে সহস্র নয়ন।
সহস্র মুকুটমণি কিরীট ভূষণ॥
সহস্র শ্রবণে শোভে সহস্র কুন্ডল।
সহস্র নয়নে রবি সহস্র মন্ডল॥”

মধ‍্যযুগীয় বাংলা সাহিত‍্যের অনুবাদের ধারায় কাশীরাম দাসের মহাভারত এক অনন‍্য সংযোজন। বাঙালি সুদীর্ঘকাল ধরে পান করে আসছে কাশীদাসী কাব‍্যমৃতা। বলাবাহুল‍্য, পরাগল, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, গঙ্গাদাস সেন কিংবা সঞ্জয় কেউই কাশীরামের সঙ্গে কবিত্বশক্তিতে তুলনীয় হতে পারে না। রামায়ণ অনুবাদের ক্ষেত্রে কৃত্তিবাস এবং ভাগবত অনুবাদের ক্ষেত্রে মালাধর বসু যে স্বাতন্ত্রের পরিচয় দিয়েছেন, মহাভারতের অনুবাদে কাশীরাম দাসের কৃতিত্ব তার‌ই অনুরূপ।

অবশ‍্য এ কথা সত‍্য, কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাঙালিয়ানা যতটা পরিস্ফুট, কাশীদাসী মহাভারতে তেমনভাবে বাঙালিয়ানা ফুটে ওঠা সম্ভব নয়। কারণ, রামায়ণ গার্হস্থ‍্য জীবনের কাব‍্য, এখানে রাম রাবণের যুদ্ধ অপেক্ষা রামের পিতৃভক্তি, লক্ষণ ভরতের ভ্রাতৃত্ববোধ, সীতার পতিপ্রেম, হনুমানের প্রভুভক্তি বাঙালি চিত্তকে সহজ হরণ করে। কিন্তু সমগ্র দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন মহাভারতকে বাঙালি জীবনের আদলে গড়ে তোলা অসম্ভব ব‍্যাপার। তা সত্ত্বেও কাশীরাম দাসের মূল কাব‍্যের কাহিনি ও রসকে যতখানি সম্ভব অক্ষুন্ন রেখেও যতটা সম্ভব স্বতন্ত্র বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। এই কারণেও অসংখ‍্য মহাভারতের অনুবাদের মধ‍্যে কাশীরাম দাসের মহাভারত‌ই বাঙালির ঘরে সুদীর্ঘকাল ধরে এত সমাদরের সঙ্গে গৃহীত হয়ে আসছে।

– – – – –