ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ – নবপর্যায়ের লক্ষণ
বাংলা উপন্যাসের যে সৌধ আজ গড়ে উঠেছে, সেখানে বঙ্কিম বস্তুদেবতা হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম স্থপতি। তিনি তাঁর সমগ্র সাহিত্য জীবনে বিপুল সৃষ্টি সম্ভারের মধ্যে দিয়ে বিচিত্র ভাঙা গড়ার খেলা খেলেছেন। আত্মোপলব্ধি ও আত্মজিজ্ঞাসার সুর তাঁর দীর্ঘ (১৯০৩ – ১৯৩৪) বত্রিশ বছর ধরে লেখা উপন্যাসগুলিতে অনুরণিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপলব্ধি করেছিলেন ইতিহাস ও রোমান্সের ভিত্তির উপর বঙ্কিমচন্দ্রের স্থাপিত বাংলা উপন্যাসের সৌধের ভিত্তি দুর্বল। তিনি বুঝেছিলেন উপন্যাস সৌধকে বাঁচাতে হলে তাকে বাস্তবতার দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সেই শিল্পগত পালাবদল ঘটালেন।
পরবর্তীকালে রচিত উপন্যাসগুলির কালানুক্রমিক তালিকা করে পাই –
১) চোখের বালি (১৯০৩)
২) নৌকাডুবি (১৯০৬)
৩) গোরা (১৯১০)
৪) চতুরঙ্গ (১৯১৬)
৫) ঘরে বাইরে (১৯১৬)
৬) যোগাযোগ (১৯২৯)
৭) শেষের কবিতা (১৯২৯)
৮) দুই বোন (১৯৩৩)
৯) মালঞ্চ (১৯৩৪)
১০) চার অধ্যায় (১৯৩৪)
◆ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ –
রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের এই নবপর্যায়ের লক্ষণ সম্বন্ধে বলেছেন –
“সাহিত্যে নবপর্যায়ের পদ্ধতি হচ্ছে ঘটনা পরম্পরায় বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে দেখানো।”
অর্থাৎ, চরিত্রের সূক্ষ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে মনের চেতন অবচেতন অংশের বিক্ষেপণটিকে চিত্রায়িত করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ শতকের উপন্যাসগুলিতে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘বিষবৃক্ষ’, এর বড়ো রকম পালাবদল ঘটেছিল ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে। ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে কুন্দনন্দিনী স্বপ্ন দেখেছিল নগেন্দ্রনাথ ও হীরা থেকে তার সর্বনাশ, তবু সে তার প্রেমপিপাসাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি, সর্বনাশের টানে মৃত্যু পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনী কুন্দর মতো পেলব নয়। যে জটিল সংসারের নানা নিয়মের সম্পর্কে সে বাঁধা সেই সংসারেই তার বাসনা চরিতার্থ করার ন্যায়ত অধিকারকে সে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। যার জীবন সম্ভোগের সমস্ত সামর্থ্য আছে, সমাজ ও সংসার তার কাছ থেকে সমস্ত কেড়ে নেবে অথচ তাকে বিনিময়ে কিছুই দেবে না – এখানেই বিনোদিনীর বিদ্রোহ। আশার দাম্পত্যজীবনের প্রতি বিনোদিনীর ঈর্ষা, মহেন্দ্রর প্রতি ঈর্ষান্বিত আকর্ষণ, ধীরে ধীরে বিহারীর প্রতি অনুরাগ এবং অবশেষে বিনোদিনীর অভাবনীয় পরিণতি – সমাজ সংস্কারের সঙ্গে স্বাভাবিক প্রবৃত্তির সংঘাত মানবমনের চেতন অবচেতন মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে নিপুণভাবে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
বিশ শতকের গোড়ায় সৃষ্ট মুষ্টিমেয় শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সমস্যা, দায় ও কর্তব্য এবং ভবিষ্যত সম্বন্ধে সচেতন ঐতিহ্যবোধ রবীন্দ্রমানসের বিশিষ্ট লক্ষণ।
◆ স্বাজাত্যবোধ –
ঊনবিংশ শতকের শেষদিক থেকেই আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় বিক্ষোভ ধীরে ধীরে দানা বাঁধছিল। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ প্রভুত্বের ঔদ্ধত্য ও অবিচার ভারতবাসীর বিশেষভাবে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির মনকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এই রাষ্ট্রীয় বিক্ষোভ থেকেই স্বাজাত্যবোধ এবং জাতীয় আত্মানুসন্ধানের সূচনা দেখা দেয়। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস রাজসিংহ, দেবী চৌধুরাণী, আনন্দমঠ প্রভৃতিতে স্বাজাত্যবোধের অঙ্কুর দেখা যায়। বঙ্কিমের জাতীয়তাবোধ, স্বদেশপ্রেম, দেশচেতনা বাংলাদেশকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তা ছিল ব্যাপক। রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র ধর্মাদর্শ ও সংস্কৃতির মধ্যে যে ঐক্য তা সন্ধান পেয়েছিলেন প্রাচীন ভারতের ত্যাগ ও তপোবনের আদর্শের মধ্যে, মন্ত্র সাধনা, বৃহত্তর আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে। এরই প্রতিফলন পাই ‘গোরা’ উপন্যাসে, যেখানে সমসাময়িক সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আদর্শের সঙ্গে স্ত্রী পুরুষের ব্যক্তিগত সংযোগ অবস্থান চিত্রিত।
বঙ্কিমচন্দ্র যখন আনন্দমঠ লেখেন তখন দেশপ্রেম ছিল সুমহান আদর্শ, একটা অশরীরী ধ্যানবস্তু। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসে দেশ কাল সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তিনি উপন্যাসের প্রত্যক্ষ রূপকে বিচার করে বিশ্লেষণ করেছেন। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ আইরিশ সন্তান গোরা আনন্দময়ীর স্বরূপ বুঝে বলেছে –
“মা, তুমিই আমার মা। যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনি আমার ঘরের মধ্যে বসেছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই – শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ”
এমন মোহমুক্তির পর, ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্ধবিশ্বাসের নির্মোক খসে যাবার পর গোরা ব্রাহ্মঘরে পালিতা সুচরিতাকে আর উপেক্ষা করতে পারেনি। বরং পরেশবাবুর অসাম্প্রদায়িক আদর্শের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’র মধ্য দিয়ে জাতীয় আন্দোলনের সম্ভাব্য ত্রুটি বিষয়ে সকলকে সজাগ করেছেন। যথার্থ জাতীয়তার ধারক বাহক কে – তাও গোরা চরিত্রের পরিবর্তিত রূপের মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট ব্যক্ত করেছেন।
◆ প্রেমচেতনা –
প্রেম ধনতান্ত্রিকসমাজে অবাধ আত্মবিচরণের ক্ষেত্র। প্রেম ও সংঘাতের রূপকল্পনা রয়েছে চোখের বালি, ঘরে বাইরে, চতুরঙ্গ উপন্যাসে যদিও বিচিত্র মেজাজে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন অবদমিত প্রণয় ক্ষুধা। আবার, ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের প্রেমচেতনা ইচ্ছা ও অপরাধ চেতনার মধ্যে হয়েছে তরঙ্গায়িত। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে দামিনীর প্রতিবাদী মনের প্রণয় ইচ্ছা ছুঁয়ে গেছে বিতর্কে – বিবাহ বনাম প্রেম। যেখানে বিমলার প্রেম বিবাহের কক্ষপথেই পুনরাবর্তন করে অভ্যস্ত সামঞ্জস্যে বৈধ রূপটিকে ধরে ফেলে নিখিলেশের কাছে ফিরে আসার মধ্যে তর্কের অবসান ঘটিয়েছে, সেখানে দামিনী সামঞ্জস্যেও বহন করেছে আঘাতের ক্ষত। অর্থাৎ শ্রীবিলাসের সঙ্গে বৈবাহিক পরিচর্যায় আবদ্ধ থেকেও ভালোবাসাকে পুজোর নৈবেদ্য করে পাঠিয়েছে শচীশের পদপ্রান্তে। আবার প্রেম বিবাহের তার্কিক পটভূমি ‘শেষের কবিতা’য় অন্যস্বরূপে উদঘাটিত হয়েছে।
◆ ব্যক্তিত্বময়ী নারী চরিত্র –
পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষের সংযোগের ফলে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন বাঙালী নারীরা অর্ধেক জীবনযাপন করছে। তাই তিনি ইয়েটস, পাউন্ড, বার্ণাড শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁর উপন্যাসে নারীদের নতুন রূপে প্রকাশ করলেন। তাঁর উপন্যাসে নারীরা শিক্ষিত, রুচিশীল, মার্জিত, ব্যক্তিত্বময়ী, পুরুষের সমকক্ষ। ‘চোখের বালি’ বিনোদিনীর আত্মপ্রতিষ্ঠার দলিল। যে কাজের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র কুন্দনন্দিনী-রোহিনীকে শাস্তি দিয়েছেন সেই সমাজ অননুমোদিত ভালোবাসার জন্য রবীন্দ্রনাথ বিনোদিনীকে সম্মান করেছেন।
আবার, ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের বিমলার পূর্বে আর কোনো নায়িকা এত নিপুণভাবে আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মউন্মোচন করেনি। ‘যোগাযোগ’ এর কুমুদিনীর আত্মবিশ্লেষণ আমাদের শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। কুমুর কাছে বন্ধন যেমন সত্য, বন্ধনমোচনের জন্য তার সাধনাও তেমনি আন্তরিক। তাই সন্তানের জন্য সন্তানের সঙ্গে স্বামী গৃহে ফিরতে বাধ্য হলেও তার স্পষ্টোক্তি : “এমন কিছু থাকে যা সন্তানের জন্যও খোয়ানো যায় না“। কুমুদিনীর এই আত্মঘোষণা, আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভের জন্য এই সংগ্রাম, আত্মঅন্বেষণের আন্তরিক বিশ্লেষণ তাকে দিয়েছে অসামান্যতা।
অপরদিকে, ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের লাবণ্যর মধ্যে দেখি আত্মাবিষ্কারের আর এক চিত্র। লাবণ্য হৃদয় দিয়ে বুঝেছে সংস্কৃতিক ব্যবহারিকতাটাই মূল পরিচয় নয়, নারীত্বের অনন্যতা লুকিয়ে আছে সত্তার আরো গভীরে। লাবণ্যই রবীন্দ্র উপন্যাসের একমাত্র নারী যে স্নেহশীল পিতাকে ছেড়ে এসে পুরুষ নিরপেক্ষ আধাবৃত্তিতে দাঁড়িতে অর্থনীতিগতভাবে স্বনির্ভর হতে চেয়েছে। এই স্বনির্ভরতাই নারী প্রত্যাশিত সামাজিক মুক্তির সবচেয়ে শর্ত।
সাধারণত পুরাণে দেখা যায় মুনি ঋষিদের ধ্যানভঙ্গের কারণ হয় মেয়েরা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাসে দেখালেন নারী চিত্তশক্তিতে ভরপুর। সেইসব নারী পুরুষের ধ্যানভঙ্গ করে না, পুরুষের কাছে সহকর্মী হয়ে পতিব্রতা হয়। ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসে আদিত্য নীরজার মধ্যে তা দেখতে পাই। আবার, ‘দুইবোন’ উপন্যাসে উর্মিমালা নিজের সাধনায় মগ্ন হয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন – রবীন্দ্রনাথ দেখালেন নারী শুধু চার দেওয়ালের মধ্যে ভালোবাসা – সংসার – সম্পর্ক নিয়েই ব্যস্ত নয়, বিজ্ঞান সাধনাতেও সে ধ্যানী।
◆ নরনারীর প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের জটিলতা –
বঙ্কিম প্রদর্শিত নরনারীর প্রণয়ে ত্রিভূজ সম্পর্কের জটিলতা রবীন্দ্র উপন্যাসেও দেখা যায়। ‘ঘরে বাইরে’, ‘চতুরঙ্গ’ প্রভৃতি উপন্যাসে ত্রিভূজ প্রণয় সম্পর্ক নিখিলেশ – বিমলা -সন্দীপ, কিংবা শচীশ – দামিনী – শ্রীবিলাস জটিলতা বিস্তার করেছে।
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ নরনারীর প্রণয় সম্পর্কে চতুর্ভূজীয় সম্পর্কের জটিলতা আনলেন, যার চূড়ান্ত ব্যবহার দেখা যায় চোখের বালি উপন্যাসে – আশালতা – মহেন্দ্র -বিনোদিনী – বিহারীর মধ্যে। এছাড়া শেষের কবিতা, মালঞ্চ, দুইবোনেও চতুর্ভূজ সম্পর্কের জটিলতা দেখিয়েছেন।
◆ দ্বৈত নায়কের ভূমিকা –
উপনিষাদিতে যে ‘অর্ধনারীশ্বর’ এর প্রসঙ্গ পাই তার অবতারণা রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাসে করেছেন। সমাজে পুরুষের মধ্যে নারীর কোমলতা আবার নারীর মধ্যে পৌরুষিক কাঠিন্যের সমাবেশ দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ‘অর্ধনারীশ্বর’ এর ব্যাখ্যায় উপন্যাসের বন্ধু চরিত্রের আনয়ন করেছেন। সাদৃশ্যের বৈপরীত্যে কিংবা বৈপরীত্যের সাদৃশ্যে মহেন্দ্রের পাশে বিহারীকে, রমেশের পাশে যোগেনকে, শচীশের পাশে শ্রীবিলাসকে কিংবা নিখিলেশের পাশে সন্দীপকে বসিয়েছেন। ‘গোরা’ উপন্যাসে গোরার মধ্যেকার ব্যক্তিত্ব, কাঠিন্য এবং বিনয়ের মধ্যে কোমলতা ও লাবণ্য প্রকাশ অবিস্মরণীয়। আবার, ‘শেষের কবিতা’য় অমিত এবং শোভনলালের প্রত্যক্ষ দেখা না করিয়েও বৈপরীত্যের সহাবস্থান ঘটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের চিন্তনশক্তির মুন্সিয়ানার এটি একটি ব্যতিক্রমী চিত্র।
◆ ভাঙা জীবনের প্রসঙ্গ –
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারিবারিক জীবনের বাস্তব রূপ আঁকতে আঁকতে ঔপন্যাসিক নরনারীর সম্পর্কঘটিত জটিল সামাজিক সমস্যার দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। রবীন্দ্র উপন্যাসে বারবার এসেছে ভাঙা জীবনের প্রসঙ্গ, নিঃসন্তান স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ এবং দুর্বল দাম্পত্য জীবনে ফাটল। ‘চোখের বালি’ থেকে শুরু করে মালঞ্চ, দুইবোন সর্বত্র এ চিত্র ; ব্যতিক্রম যোগাযোগ উপন্যাস।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সৃষ্টিকে সর্বত্র ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। তাই উপন্যাসে নবপর্যায়ের লক্ষণ প্রকাশ করতে গিয়ে পদ্ধতিও হতে হয়েছে বুদ্ধিনির্ভর।
শুধু বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে নয় আঙ্গিকের দিক থেকেও তাঁকে আধুনিকতার আশ্রয় নিতে হয়েছে। এবং উপন্যাসগুলিকে ক্রমপর্যায়ে লক্ষ্য করলে শৈলীগত ক্রমপর্যায়ের অভিনবত্ব লক্ষ্য করা যায়।
মনোবিশ্লেষণ রীতি রবীন্দ্র উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, এই রীতি তাঁর উপন্যাসে ক্রমানুগ এবং ক্রমভঙ্গ দুইভাবে দেখা দিয়েছে। ক্রমানুগ মনোবিশ্লেষণ রীতি পাই চোখের বালিতে এবং ক্রমভঙ্গ মনোবিশ্লেষণ রীতি আছে ‘শেষের কবিতা’য়।
আত্মকথন রীতির প্রয়োগ পাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে, যেখানে প্রধান পাত্র পাত্রী (বিমলা, নিখিলেশ, সন্দীপ) নিজের মতো ঘটনা বিবৃত করে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে, আত্মবিশ্লেষণ করে, সংশ্লিষ্ট অন্য চরিত্রের ব্যাখ্যা করে।
চতুরঙ্গ উপন্যাসে লক্ষ্য করি একোক্তি রীতি, ডায়েরির আদলে লেখা উপন্যাস। আবার গদ্য ও পদ্যের যুগলবন্দি ঘটিয়েছেন ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে।
শৈলীগত অভিনবত্বের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সাধুভাষা ক্রমশই সাবলীল অথচ অলঙ্কার বহুল। ভাষার মধ্যে একধরণের বক্র রমণীয়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। প্রতীক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বুদ্ধি বৈদগ্ধ্যের দীপ্তি বিকীর্ণ হয়েছে। চতুর শাণিত এপিগ্রাম দীপ্ত ভাষা ও তির্যক বাকভঙ্গি চতুরঙ্গ ও শেষের কবিতার প্রধান আশ্রয়।
সামগ্রিক আলোচনার নিরীখে বলা যায়, বঙ্কিম প্রবর্তিত সূড়িপথকে রবীন্দ্রনাথ আপন চিন্তা চেতনার শক্তির গাঁথনিতে রাজপথে পরিণত করেছিলেন। তারপর সেই পথে হাঁকিয়ে বেরিয়েছেন পরবর্তী ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরা।
– – – – –