মননে ও চেতনে জীবনানন্দ দাশের বোধ

কলমে – অদিতি সিংহ, এম.এ, কলিকাতা বিশ্ববিদ‍্যালয়


আচ্ছা কখনো ভিড়ের মাঝে চলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেছেন? কখনো মাঝ রাতে ছাদে গিয়ে তারা গুনেছেন? কিংবা প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড়ের মাঝে, জানালায় দাঁড়িয়ে উষ্ণ কফি হাতে? বা আবার কখনো একা একা উদ্দেশ্যহীনভাবে ভ্রমণ করা… এইরকম পাগলামো অল্প একটু সবাই করে থাকে, কি তাই না? আমরা বাইরে থেকে যতই কঠিন আস্তরণে মেতে থাকি না কেন, মনের ভেতরে একটা অবুঝ শিশু সুলভ আচরণ লুকিয়ে থাকে; যা সময় বিশেষে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

“সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।”

   (জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ‘বোধ’)

সহজ লোক কাকে বলে? যারা প্রতিদিন নিয়মমাফিক কাজকর্ম করে! নাকি যারা, মনের ভেতর জন্ম নেওয়া নিজের শিল্পসত্তাকে সব পরিস্থিতিতে বাঁচিয়ে রাখতে জানে? কিছুটা ভাবুক, কিছুটা নির্বোধ, কিছুটা বেখেয়ালি, কিছুটা আকাশ ছোঁয়া ইচ্ছে, আর কিছুটা মন খারাপ-বিচ্ছেদ-কান্না। এই সব থাকে মনের ভেতর, যা জন্ম দেয় গভীর আঁধারের। শরীরের স্বাদ গ্রহণ করতে হলে শরীর প্রয়োজন, পেটের খিদে মেটাতে গেলে খাদ্য, আর মনের খিদের বেলায়?

এইরে কিছু ভুল বললাম মনে হয়, মনের আবার খিদে হয় নাকি? যদি বলি হ্যাঁ, হয়; কিন্তু তার প্রকাশ সবাই করতে পারে না। আবার অনেকে করতে পারে কিন্তু সাহস মেলে না। আমরা বড্ড সাধারণ জীবনযাপন করি, ১০:০০ – ০৫:০০ টা পর্যন্ত অফিস করে প্রচন্ড ক্লান্ত, তবুও বাড়ি ফিরে নিজের মনের খিদেকে আংশিক মেটানোর চেষ্টা করে থাকি। গান করি, ছবি আঁকি, কবিতা- গল্প- উপন্যাস লিখি, সব কিছুর মধ্যে নিজের ভালো লাগা- ভালোবাসার সন্ধান করি। আর রাতে আঁধারে ভালো থাকার একটা স্বপ্ন বুনি।

“সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?”

(জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ‘বোধ’)

চোখে বাধা! তা আবার হয় নাকি? চোখ তো স্বচ্ছ আস্তরনে ঢাকা, যে স্বচ্ছতা জলের সমান, যে স্বচ্ছতা আকাশের মত। অনেক স্বপ্ন দেখা যায়, যেগুলো পিষে যায় হঠাৎ আসা কান্নায়!

‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ ( ১৯৩৬) কাব্যগ্রন্থের একটি স্মরণীয় কবিতা হল ‘বোধ’। মানুষের মনে অবস্থিত চেতন-অবচেতন-অচেতন আবৃত হয়ে লুপ্ত থাকে, যা সময় অসময় প্রকাশ পায়। জীবনানন্দের কবিতায় আধুনিক যুগের দ্বিধাগ্রস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী মানুষের চিন্তা ভাবনার ভাষা পেয়েছে। মানুষের অন্তর লোককে তিনি শব্দ ধারায় উর্গাতে চেষ্টা করেছেন। T.S Eliot মানুষের অবচেতন মনে নির্জনতা ও একাকীত্বকে সেতু ভাঙার চাপের রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন, ‘London Bridge is falling down, falling down, falling down’ – আত্ম-চেতনে মানুষ তখন হয়ে ওঠে একাকির অধিকারী।

থাকার না থাকার মাঝে মনের অশ্লীলতার কেন্দ্রস্থলে জন্ম নেয় ‘বোধ’। পৃথিবীর সাধারণ মানুষের সঙ্গে কবি নিজেকে মেলাতে পারেন না, কবি কণ্ঠে প্রতিনিয়ত শোনা যায় নিবিড় কণ্ঠে আক্ষেপের স্বর। যা সর্বক্ষণ কবিকে তাড়া দিয়ে নিয়ে যায় এক অন্য জগতে। যেখানে আলোর উজ্জ্বলতায় স্বাভাবিক জীবনের বসবাস স্থাপিত হয়, সেখানে বোধের টানাপরেন লক্ষ্য করা যায় না। আর যেখানে অন্ধকারের জন্ম লগ্ন, সেখানে অহেতুক ভাবনারা সব মাথার ভেতর জমাট বেঁধে মনকে অস্থির করে দেয়। ‘স্বপ্ন-শান্তি-ভালবাসা’ সবটা বড্ড বেমানান। কবির মনে দু-রকমের প্রভাব কাজ করে চেতন ও অবচেতন। কবির ভীষণ ক্লান্তিতে নিয়ে ঠাই নিয়েছে এক গভীর অবক্ষয় যা তিনি কখনোই এড়াতে পারেননি। সেই অবচেতনের স্পর্শ যা, অনুভবে কবি মন কেবল শূন্যে ভরে গেছে। যেখানে বাস্তবতার ছোঁয়া মেলে না, কত বলতে চাওয়ার ইচ্ছেগুলো মাথার ভেতর সর্বক্ষণ লুকোচুরি খেলে। এই মহাজাগতিক পৃথিবীতে মনের ভাবনা কেবল ক্ষীন আশ্রয়হীন।

“এ যুগে কোথাও কোনো আলো_ কোনো কান্তিময় আলো
চোখের সুমুখে নেই যাত্রিকের;”

কবিতার পাতা জুড়ে ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়া এই বিষন্ন আক্ষেপ লক্ষ্য করেই হয়তো ড. দীপ্তি ত্রিপাঠীর মতো বিশিষ্ট সমালোচক তাঁর গ্রন্থে জীবনানন্দ প্রসঙ্গে বলেছেন_ “এক বিমূঢ় যুগের বিভ্রান্ত কবি জীবনানন্দ।” এমন বাক্যের আশ্রয়সাধন করে জীবনানন্দের সমকাল ছিল বিশ্বজোড়া ঘটনা-দুর্ঘটনার উথাল-পাতালে বিমূঢ়, কিন্তু জীবনানন্দকে এক কথায় বিভ্রান্ত বিশেষ চিহ্নিত করা হলে কবির প্রতি সুবিচার করা হয় না। চারপাশের বিশৃঙ্খলাতার ছায়া অনুসরণ করে কবি ভেবেছেন-

“তিমির হননে তবু অগ্রসর হয়ে
আমরা কী তিমির বিলাসী?
আমরা তো তিমির বিনাশ
হ’তে চাই।”

তার এই স্বাদ আমৃত্যু পর্যন্ত অপূর্ণই ছিল; মূল্যবোধের ভয়ানক সংকটে আর্থসামাজিক বিপর্যয় থেকে মানুষের পরিত্রাণের কোনো সহজ উপায় তিনি খুঁজে পাননি। তিনি বরং নিজেকে বারংবার হারিয়ে দিয়েছেন প্রকৃতির মাঝে। জীবনানন্দের কবিমানসে বিষণ্ণতাবোধ এক স্থায়ী এবং ক্রমসঞ্চারী অনুভূতি। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ থেকেই যার সূত্রপাত, কবি জীবনের শোচনীয় সমাপ্তি লগ্ন পর্যন্ত যার বিস্তার ছিল ধারাবাহিক। ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ’ ( দ্বিতীয় খন্ড)- এর ভূমিকার সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন-

“ঝরাপালক-এর কবিতাগুলি পড়লে বিশ্বাসই হতে চায় না, এই কবি কোনো একদিন বেলা অবেলা কালবেলার ভাষ্যকার হবেন। ঝরাপালকে আবেগময় কিশোর কবি জীবন ও পৃথিবী সম্পর্কে অনেক ভাবগর্ভ কথা উচ্চারণ করেছেন- যা আসলে চিরাচরিতের পুনরাবৃত্তি মাত্র। কবির নিজস্বতা নেই, শব্দের মায়া নেই, ভাবালুতায় দৃষ্টি আচ্ছন্ন।”

প্রবহমান সময়ের মধ্যে উঠে আসা সমসাময়িক জীবনের বহিঃপ্রকাশ নেমে আসে কবিতায়। প্রাচীন ও আধুনিক কবিতার সংমিশ্রণ গড়ে ওঠে, কবিতাস্বরূপ চারটি ভাগ। যথা- পাঁকের কবিতা, পোকার কবিতা, প্রলাপের কবিতা, পাকশালার কবিতা। “জল যাদের ফুরিয়ে পাক-ই তাদের একমাত্ৰ ভরসা”।

সকলে কবিতা লিখলেও সকলে কবি হয় না! আমরা শুধুই নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে লিখি, আদতে কোন কবিতা লিখি না। কবিতা লিখতে হলে কবিকে শব্দের মাঝে বসবাস করতে জানতে হয়। যে কোনো শিল্পী শীর্ষস্থান পেলে কবিতার রূপ নেয়; শ্রেষ্ঠ ও শীর্ষ সৃষ্টি একমাত্র কবিতা। কবিতা হলো অভিমানী শিল্প। আচ্ছা, এবার একটা প্রশ্ন করা যাক আপনাদের; কবিতা লিখতে কী লাগে? – কি ভাবছেন, কলম আর খাতা। আরে মশাই সেসব তো লাগে কিন্তু আর কি কি লাগে। শুনুন আমি বলছি, সেসব বাদে গুরুত্বপূর্ণ হলো কবি মানসিকতা। তাই ‘কবি’ কে লাগে। 

জীবনানন্দের “মাল্যবান” উপন্যাসে ফুটে উঠেছে এক সাধারণ জীবনের টানাপরেন সাংসারিক গল্প। কবি জীবনের সত্য থেকে বাইরে বেরিয়ে ভালো পিতা এবং স্বামী হওয়ার এক পরিহাস মাত্র। ভালোবাসার ভালোবাসার আলতো ছোঁয়া-স্পর্শ মনে দাগ কেটে যায়। সংসার চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব শুধু কি একা তার! রাতের আঁধারে, প্রকৃতির মাঝে, ভিড় চৌরাস্তায় লেখকের শুধু মননে কবিতা পায়।

সেকেন্ডের শব্দ শুনতে শুনতে কতগুলো রাত পার হয়ে চলেছে, মিনিট নামক কাঁটাটা ক্ষনিকের জন্য চুপ। ঘন্টা পেরিয়ে সন্ধ্যে নামে, আঁকড়ে ধরার অভ্যাসগুলো ভালোবেশে পাশে বসে। বেশি না, মাত্র দু-চার মিনিট। আর কিছুক্ষণ! বাস্তবে না কল্পনায়?

কতগুলো বছরের কথা জমে, ডাইরির সমস্ত পাতা খুব কান্ত, তবুও অদৃশ্য বিশ্রাম গ্রহণ করছে তারা। ক্ষতের দাগ আঁচড় কাটে, মনের অতর্কিতে কাকে সে ভালোবাসে? রাতের অন্ধকারে আঁধার নামে, নামবে সেটাই স্বাভাবিক। তবুও দিনের আলোর মাঝে হঠাৎ আঁধার নামে খুব গোপনে।

“জীবনানন্দও বিশ্বাস করতেন অস্থিবাদের আলোচ্য সমস্যাগুলি, প্রকৃত প্রস্তাবে দর্শন হিসেবে অস্তিবাদ আত্মপ্রকাশ করার আগে থেকে সমাজ ও সৃজনের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছিল। কবির ব্যক্তিগত বিশ্বাসের একটি ছবি হয়তো তার ভাবনার প্রতিনিধি স্থানীয় এই ‘বোধ’ কবিতার পাওয়া যায়।”

গ্রন্থপুঞ্জ:
১. জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা,
২. নোবেলের পান্ডুলিপি: গৌতম বসু
৩. আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস:
    তপন কুমার চট্টোপাধ্যায়
৪. আধুনিক বাংলা কবিতায় বিষন্নতাবোধ:
    হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৫. কবিতার ক্লাস: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
৬. কবিতা কি ও কেন: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
৭. মাল্যবান উপন্যাস: জীবনানন্দ দাশ
৮. ধূসর পাণ্ডুলিপি: জীবনানন্দ দাশ