গণনাট‍্য – নবান্ন নাটক

কলমে – দীপান্বিতা ঘোষ, এম.এ(স্বর্ণপদক প্রাপ্ত), বি.এড, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ‍্যালয়


বিজন ভট্টাচার্য গোড়ায় শুরু করেছিলেন গল্প দিয়ে। পরে নাটকে এলেন। তখন এটা এক হিসেবে সহজ ছিল; একই সংঘের মধ্যে লেখক ও শিল্পী দু'দলই ছিলেন; ফলে দু দিকের যোগাযোগ ছিল সহজ, অবাধ। বিজন ভট্টাচার্যের নাট্য অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু কলম-টা চলত। নাট্য-অভিজ্ঞতা ছিল মহর্ষির, শম্ভু মিত্রের। সুতরাং মণিকাঞ্চন যোগ হলো।

‘আগুন’ ও ‘জবানবন্দী’র মধ্য দিয়ে বিজন ভট্টাচার্য এলেন ‘নবান্নে’। ‘নবান্ন’-ই সাধারণ লোকের কাছে গণনাট্য ব্যাপারটা স্পষ্ট করল। অন্তত, ‘গণনাট্য’ কথাটা শুনলে সাধারণ লোকের প্রথম যে নাম মনে আসে, সেটা হচ্ছে ‘নবান্ন’। কিন্তু তাত্ত্বিকেরা গণনাট্য বলতে কী বোঝেন? গণনাট্য কাকে বলে? এ নিয়ে মত- পার্থক্যের অবকাশ রয়েছে। তবে মোটের ওপর চিন্তা-টা এইরকম : জনগণের আশাআকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং সর্বোপরি তার সংগ্রাম—এটাই গণনাট্যের উপজীব্য। মার্কসীয় দৃষ্টি থেকে জীবনকে দেখা ও দেখানো—এটাই তার করণীয়। মার্কসবাদে সম্পূর্ণ জ্ঞানী হয়ে তবে লেখা সুরু করা যাবে এমন নয়। নাট্যকার তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সুরু করতে পারেন, কিন্ত মার্কসবাদে শিক্ষা ও সচেতনতা তাঁর বোধকে উন্নত ও প্রথর করবে। গণনাট্য কথাটা কিন্তু আগে প্রচলিত ছিল না। বেশি চলত'অননাট্য'কথাটা। গণনাট্য সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার পরে গণনাট্য কথাটার চল বেড়েছে।

‘নবান্ন’ কি গণনাট্য? কয়েক বছর আগে কম্যুনিস্টদের একাংশ এই প্রশ্ন তুলেছিল, এবং তাদের কাছে এটি বিপ্লবের অনুকূল বা সহায়ক বলে মনে হয়নি, সুতরাং তাদের মতে এটি যথার্থ গণনাট্য নয়। তাদের বক্তব্য ছিল, এই নাটকে জনগণের সংগ্রাম তেমন স্থান পায়নি, এখানে বড়ো হয়ে রয়েছে হতাশা। ‘নবান্ন’ যখন প্রথম অভিনীত হয়, তখনও এ কথা উঠেছিল। কয়েকজন কম্যুনিস্ট নেতা ‘নবান্ন’ বন্ধ করে দিতেও বলেছিলেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল। আন্দোলন সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, যথেষ্ট সংগ্রামী না, হতাশা- সঞ্চারী ইত্যাদি। নবান্ন অবশ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়নি, তার কারণ তখনকার কম্যুনিস্ট পার্টি- সম্পাদক পি. সি. জোশী এই মতের বিরোধী ছিলেন। তাঁর মত ছিল, গণনাট্যের আদর্শ যারা মেনে নিয়েছে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। প্রথম দিকে কাজ করতে গিয়ে তাদের ভুল ত্রুটি যদি হয়, তবে তা তারাই কাজ করতে করতে বুঝবে এবং সংশোধন করবে। ওপর থেকে কিছু চাপিয়ে দিলে তাদের কর্মপ্রেরণা নষ্ট করা হবে। (এই তথ্য একাধিক সূত্রে শুনেছি। একটি সূত্র স্বয়ং পি. সি. জোনী)।

যে ‘নবান্ন’ পরে গর্বের বিষয় হয়েছে, তার বোধনেই বিসর্জন হয়ে যেতে পারতো। অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। তাহলে দেখা হচ্ছে, ‘নবান্ন’ সঠিক গণনাট্য নয়, এ মত সুচনা- পর্বে ছিল এবং আজও আছে। তার সপক্ষে কিছু জোরালো যুক্তিও আছে। তা সত্ত্বেও এটা ঘটনা যে ‘নবান্ন’ অত্যন্ত জন-সমাদৃত, কম্যুনিস্টদের বৃহৎ অংশের দ্বারা স্বীকৃত এবং গণনাট্য আন্দোলনের উৎসভূমিতে সবচেয়ে বড়ো নাম। তাহলে এ কথাটা বুঝতে হবে যে, কিছু রাজনৈতিক দুর্বলতা যদি তার থেকেও থাকে, বড়ো কোন শক্তিও তার নিশ্চয়ই ছিল। কোথায় এই শক্তি? যাঁরা রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করেননি, নাটকের দিক থেকে বিচার করেছেন, তাঁরা নবান্নের অনেক ত্রুটি দেখতে পেয়েছেন। এ নাটক অত্যন্ত আলগা, বাঁধুনি নেই, এবং *এর শেষ অংশ পূর্ববর্তী অংশগুলি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, ওই অংশগুলিতে ঘটনা বিবর্তনের যে সূত্র পাওয়া যায় শেষ দৃশ্যে এসে তা একেবারে তালগোল পাকিয়ে গেছে, ফলে নাটকটির স্বাভাবিক পরিণতি হয়েছে একেবারে পশু। কিন্তু শেষ দৃশ্যটি বাদ দিলে যা বাকি থাকে তাকে যদিও নাটক বলা চলে না।' (পরিচয়' পৌষ, ১৩৫১)। এত দুর্বলতা সত্ত্বেও নাটক দাঁড়াল, এবং প্রায় একটা যুগ তার নামে চিহ্নিত হলো। তাহলে

নাটক হিসেবেও ‘নবান্নে’র কোনো গুণ নিশ্চয়ই আছে। সে গুণটা কী? পেশাদারী মঞ্চে যখন জীবনবিচ্যুত নাটকের একছত্র একঘেয়েমি, তখন 'নবান্ন' গিয়েছিল জনজীবনের কাছে, তাদের সুখদুঃখকে বোঝবার চেষ্টা করেছিল। পেশাদার মঞ্চের নাট্যরথীরা বলেছিলেন—এ নাটক কী করে চলবে? এই নোংরা একদল ভিখিরি স্টেজে নামালে সে নাটক দেখতে কে আসবে? কিন্তু নাট্য-রথীদের কথা ব্যর্থ প্রমাণিত হলো, নাটক দেখতে লোক এল, পরবর্তী কালের ওপর বিশেষ প্রভাব রাখল। নাট্যরথীরা বুঝতে পারেননি যে 'নবান্ন' তার জনজীবন-ঘনিষ্ঠতার জন্যই দর্শক মনে একটা স্থান করে নেবে। শুধু 'নবান্নে' নয়, বিজনদা বার বার গেছেন বাংলার লোকজীবনে, গ্রামীণ জীবনে, কৃষক জীবনে। এইখানেই তাঁর শক্তির প্রধান উৎস। এই জোরেই রাজনৈতিক বা সাহিত্যিক দুর্বলতা যদি তাঁর কিছু থেকেও থাকে, তাকে ছাপিয়ে ওঠবার মতো এক ধরনের ক্ষমতা নাটকগুলি পেয়ে যায়।

এই জোরেই ‘নবান্ন’ একটা যুগের পথিকৃৎ নাটক হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। এই জনঘনিষ্ঠ নাটক লেখা মধ্যবিত্ত নাট্যকারদের পক্ষে কত কঠিন তার প্রমাণ পরে পাওয়া গেছে। ‘নবান্ন’ এই জাতীয় নাটক লেখার যে রাস্তাটা দেখিয়েছিল, সে পথে পরে অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেখানে ব্যর্থতার স্বাক্ষরই বড়ো হয়ে আছে।
‘নবান্নে’র ত্রুটির কথা বলতে গিয়ে সে আমলে অনেকে বলেছেন যে এটা ঠিক নাটক নয়। এটা ক্রনিকূল, ঘটনাপঞ্জী, ইতিহাস। এই ধরনেও যে নাটক লেখা সম্ভব, তা কিন্তু আন্ত দেশে-বিদেশে স্বীকৃত। একটা কালকে ধরে নিয়ে, পর পর ঘটনা সাজিয়ে সেই কালকে জনজীবনের পদক্ষেপগুলিকে চিহ্নিত করেও নাটক লেখা হতে পারে। তাছাড়া আমাদের দেশজ ধরনের সঙ্গেও এর মিল আছে। সুতরাং পাশ্চাত্যের একটি বিশেষ মডেল অনুসারে রচিত নয় বলেই এটি অপাংক্তেয় নয়। এর পংক্তি আলাদা, একে সেই মানদণ্ডেই বিচার করতে হবে। এছাড়া 'নবান্ন'র আরো দু' একটি দিকে আমাদের নজর পড়া উচিত -

৹ এই নাটকে সাধারণ মানুষের সরল প্রাণবন্ত মুখের ভাষার ব্যবহার আছে। পেশাদার মঞ্চে বক্তৃতাধর্মী অথবা কৃত্রিম সেন্টিমেন্টাল ভাষা শুনে শুনে আমাদের নাটক স্বাভাবিক মুখের কথা ভুলে যাচ্ছিল। ‘নবান্নে’ সেখানে এনেছে গ্রামীণ মানুষের মুখের সজীব ভাষা। এই ভাষা কতগুলি সময়। কবিতাকে প্রায় ছুঁয়ে যায়। পরে অন্যান্য নাট্যকারও লোকভাষাকে ধরতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে এখানেও ব্যর্থতার স্বাক্ষরই বেশি!
৹ বিষয় নির্বাচনেও ‘নবান্ন’ অসাধারণ অনুভব শক্তির পরিচয় দিয়েছিল। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে আঘাত করেছিল। বহু হাহাকার বহু মৃত্যু দেশের অন্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। অথচ কার্যত কোনো প্রতিরোধ করা যায়নি। দুর্ভিক্ষের আগেই ইংরেজ-বিরোধী বিয়াল্লিশের সংগ্রাম ব্যর্থ হয়েছে; সেই ব্যর্থতা দেশ-চিত্তকে অসাড় ও দিশেহারা করে ফেলেছে : নতুন কোনো শক্তিও তেমনভাবে মাথা তুলতে পারেনি। কাজেই দুর্ভিক্ষ যখন এলো, তখন সমগ্র দেশ সেই হাজার হাজার করাল মৃত্যুকে, সেই বর্বর হত্যাকে চোখের ওপর দেখছিল, কিন্তু কিছু করতে পারছিল না। বিয়াল্লিশের উত্থান, পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধের বিস্তৃতি এই পটভূমিতে ইংরেজ তার লৌহ শাসন কঠিনতর করেছিল। তাই রাস্তায় ও দরজায় যখন মৃত্যুমুখী ক্ষুধা আর্তনাদ করে ফিরছিল, দেশব্যাপী অমানুষিক হত্যা সংগঠিত হচ্ছিল, তখন দেশ-চিত্ত অসহায় অবস্থায় পড়ে ছিল, তাদের বেদনা কোনো দিকেই কোনো মুক্তি পথ পাচ্ছিল না। এই অসহায় অক্ষম বেদনা জাতির মধ্যে আকণ্ঠ জমে ছিল। ‘নবান্নে ‘র ছিন্নভূমি পথবাসী মৃত্যুপথযাত্রী মানুষেরা সেই বেদনাকে একটা ভাষা দিয়েছিল। অবশ্য অনেকগুলি ঘটনার যোগাযোগে 'নবান্ন' নাট্যাভিনয় তার এই উত্তুঙ্গ বিন্দুতে এসেছিল, অসাধারণ প্রযোজনা, গণনাট্য সংঘের সাংগঠনিক উদ্যম, পেশাদারী মঞ্চের দেউলিয়া অবস্থা, জাতির দুর্ভিক্ষোত্তর মনোভাব—এ সবই 'নবান্নে'র সাফল্যের মূলে কমবেশি কাজ করেছে।

নতুন নাট্যকালের সূচনা ‘নবান্ন’ দিয়ে। পেশাদারী মঞ্চের বাইরে, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল, শিল্পসমৃদ্ধ, এই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ নাট্যকাল চিহ্নিত হয়েছে ‘নবান্ন’কে দিয়ে। এর থেকে বড়ো গৌরব একটা নাটকের পক্ষে আর কী হতে পারে।

*গ্রন্থপঞ্জি*

আকর গ্রন্থ:
১) ভট্টাচার্য বিজন,’নবান্ন’,দেজ পাবলিশিং, কলকাতা ৭০০০৭৩, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৪।
সহায়ক গ্রন্থ:
১) সুধী প্রধান, ‘নবান্ন: প্রযোজনা ও প্রভাব’, পুস্তক বিপণি, কলকাতা ১৯৮৯।
২) অভিনয় পত্রিকা।
৩) এপিক থিয়েটার পত্রিকা।