একটি বটগাছের আত্মকথা

কলমে – সোমা রানা (বাংলা অর্নাস – সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয়)


★ ভূমিকা :-
আরে আরে করছো কি! আমার ঝুলে পড়া বৃদ্ধ ঝুরিতে এত টানাটানি ! আমার বুঝি ব্যথা লাগে না ৷ এদিকে এসো আজ শুধু খেলা নয় ৷ তোমাদেরকে নিয়ে কিছু গল্প করবো ৷ আমার নিজের গল্প , নিজের কথা ৷ আত্মকথা ৷ আমার জন্ম থেকে আজ অবধির কথা ৷

★ পরিচয় :-
আচ্ছা, তবে শোনো | নাম আমার বট | গ্রামের লোকেরা বলে বটগাছ | তোমরা বল বটদাদু ৷ আমার বয়স হয়েছে তাই হয়তো এমন বল ৷ তবে বৈজ্ঞানিক মহলে আমার খ্যাতি Ficus benghalensis নামে ৷ সেটা তোমারা নিশ্চয়ই জানো ৷ এবার বলি আমার জন্মকথা ৷ আমার জন্ম কত বছর আগে সেটা আমি নিজেই জানি না ৷ তবে আমি মোঘল আমল, ইংরেজদের আমল, তোমাদের দাদুদের আমল ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছি ৷

এমনকি তোমাদের সাথেও হেসে খেলে দিন কাটাচ্ছি ৷ পরবর্তীকালে তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সাথেও দিন কাটাবো ভেবেছিলাম কিন্তু সেটা মনে হয় আর হবে না ৷ এটার কথা পরে বলছি ৷

★ কর্ম ও জীবনযাত্রা :-
আমার ঝাপসা মনে পড়ে সেই ছোটোবেলার কথা যেদিন আমি দুটো সবুজ পাতা মেলে তাকিয়ে ছিলাম সূর্যের দিকে ৷ সূর্যের সোনালি আলোয় দেখেছিলাম পৃথিবীর রূপ ৷ এত বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে জন্মে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম ৷
তারপর মাটির উৎসাহে, বাতাসের ভালোবাসায় আর জলের জোগানে ধীরে ধীরে আমি বড় হতে লাগলাম | স্নেহ, মায়া-মমতায় বাঁধতে লাগলাম এই পৃথিবীকে ৷ কত পাখি এসে আশ্রয় নিল আমার শাখাতে ৷ তারা গুনগুন করে গান গাইত আমি শুনতাম ৷ শুনে ভালো লাগত আমার ৷ তাদের সুখ-দুঃখের সাথে আমি নিজেকে বিলিয়ে দিতে লাগলাম ৷ মনে এক অদ্ভূত শান্তি এসে বাসা বাঁধলো ৷ কত কাঠবিড়ালি, সাপ, গিরগিটিকে আশ্রয় দিয়ে বড় করতে লাগলাম ৷ কত পাখির বাসা নিজের গায়ে পরলাম ৷
ধীরে ধীরে আমার বয়স বাড়তে লাগলো ৷ গ্রামের মানুষেরা আমাকে শ্রদ্ধা করতে লাগালো ৷ ভক্তি করতে লাগলো ৷ তাই তো তারা মাঝে মাঝে আমার গায়ে মানতের ঢেলা বেঁধে দিয়ে যায় ৷ আমার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যায় , পুজো করতে ৷ প্রথম প্রথম খুব রাগ ধরতো তারপর নিজেকে মানিয়ে নিতে লাগলাম ৷ এই ভেবে আমার পাতা তাদের উপকারে লাগছে ৷
সময় গড়াতে লাগলো ৷ আমি দাঁডিয়ে দাঁডিয়ে দেখতে লাগলাম মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন – গড়ন ৷ ইংরেজদের শাসন, তাদের রাজত্বকাল ৷ ভারতবাসীর প্রতি তাদের অত্যাচার, শোষণ ও নিপীড়ন | বিপ্লবীদের বিদ্রোহ |
ছোটো রবি এসেছিল আমার কাছে ৷ সে বড় হল ৷ তার স্মৃতিচারনে কলমেব ডগায় উঠে আসলো আমার কথা ৷
লিখলো আমাকে নিয়ে –

” নিশিদিশি দাঁড়িয়ে আছ মাথায় লয়ে জট,
ছোটো ছেলেটি মনে কি পড়ে ওগো প্রাচীন বট ৷”

গ্রামের কত সভা-মিটিং বসেছে আমার মাথার তলায় ৷ ডাকাতেরা ভাগ করেছে তাদের লুন্ঠিত সম্পদ | আমি সবার সাক্ষী। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে রাখাল, পথিক, ভিখেরি কত জনকে আমার ছায়ায় আশ্রয় দিয়েছি ৷ স্পঞ্জের মতো শোষন করে নিয়েছি তাদের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট, একঘেয়েমি, হতাশা | সবাইকে আপন করে নিয়েছি ৷ জাতিভেদ, ধর্মের কথা ভুলে সবাইকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছি ৷ তোমাদের দাদু - ঠাকুমাদের আমলে যখন ওই প্রাইমারী স্কুলটা ছিল না ৷ তখন আমার ছায়ায় পাঠশালা বসত ৷ কত ছেলে মেয়েরা জ্ঞানের ভান্ডার অর্জন করতো৷ দেখে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠত৷ মানছি আমার ফল তোমাদের কোনো উপকারে লাগে না, তবুও তো আমি তোমাদের ছায়া দেই, অক্সিজেন দেই, কার্বন-ডাইঅস্কাইড শোষন করে বায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করি, মাটিতে আমার শেকড় জড়িয়ে ভূমিধ্বস, বন্যা রোধ করি, বৃষ্টিকে আমন্ত্রন জানাই | তোমাদের খেলার সঙ্গী হই ৷ আর পাখি-পোকা, সরিসৃপ ,জোনাকিদের আশ্রয় দেই।

★ উপসংহার :-

আজ এত গুলো কথা বলতাম না ৷ বললাম , ওই যে কাল সকালে একদল লোক এসেছিল তারা আমাকে দেখে গেছে ৷ মাপ-জোক করে গেছে আমার পায়ের জমি | আমাকে কেটে ফেলবে তারা৷ মারা পড়ব আমি, এত দিন ঝড় - বৃষ্টি - বজ্রপাতের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছিলাম ৷ আর বুঝি পারব না ৷ আমার বাসস্থানের জায়গায় হোটেল হবে, নগর গড়ে উঠবে, কৃত্রিম সভ্যতার নগর | তোমরা তোমাদের খেলার সঙ্গী বটদাদুকে হারাবে, বৈজ্ঞানিকরা তাদের Ficus benghalensis কে , গ্রামের মানুষেরা হারাবে তাদের ভক্তি-বিশ্বাসকে ৷

পৃথিবী হবে আরো উষ্ণতম | বিশ্ব উষ্ণায়ন হবে ৷ গ্রীষ্মের রোদে রাখাল পাবে না ছায়া ৷ পশুপাখী পাবে না বাসা |
আমার চোখে দেখা সমস্ত ঘটনা নিমেষেই মুছে যাবে ৷ সুখ – দুঃখের সাক্ষী থাকবে না কেউ |
তোমরা কি আমাকে রক্ষা করতে পারো না? আমার আরো অনেকদিন বাঁচার ইচ্ছে ছিল ৷ দেখার ইচ্ছে ছিল এই সুন্দর পৃথিবীকে ৷ বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে ছিল প্রকৃতি মা’কে ৷