শ্রীকান্ত উপন্যাসের ইন্দ্রনাথ চরিত্র
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত শ্রীকান্ত (১ম পর্ব) উপন্যাসে শরৎচন্দ্র তাঁর বাল্যজীবনে স্মৃতিচারণা ভাব ভাবনা ব্যক্তিমানসকে প্রকাশিত করতে গিয়ে চরিত্রগুলিকে বিশেষভাবে আমাদের উপহার দিয়েছেন। মানব জীবনের অভিজ্ঞতা চরিত্রে বিচিত্র বর্ণাঢ্য প্রদর্শনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র হল ইন্দ্রনাথ চরিত্র পরিকল্পনা। এই প্রসঙ্গে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য –
“বর্ণপরিচয়ের রাখাল হইতে আরম্ভ করিয়া অনেক দুষ্ট লেখাপড়ায় অমনোযোগী বালকের কাহিনী সাহিত্যে বা ইতিবৃত্তে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু সমস্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তন্ন তন্ন করে খুঁজিয়াও ইন্দ্রনাথের জোড়া মেলে না।”
‘শ্রীকান্ত'(১) উপন্যাসের ইন্দ্রনাথ চরিত্র সম্পর্কে গোপালচন্দ্র রায় বলেছেন –
“শরৎচন্দ্র কলেজে পড়া ছেড়ে ভাগলপুরের আদমপুর ক্লাবে অভিনয় ও খেলাধূলা করে কাটাতে লাগলেন। এবং ভাগলপুরের নির্ভীক পরোপকারী মহাপ্রাণ এক আদর্শ যুবক রাজেন মজুমদারের সঙ্গে মিলে তার পরোপকারমূলক কাজে সঙ্গী হলেন। শরৎচন্দ্র পরে তার ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে একেই ইন্দ্রনাথ রূপে চিত্রিত করেছেন।”
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে প্রধান চরিত্র শ্রীকান্তের সঙ্গে ইন্দ্রনাথের পরিচয়ের প্রথম পর্বে সে শৈশব অতিক্রম করে কৈশোরে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই বয়সে যেভাবে সে রূপকথার নায়কে পরিণত হয়েছে তাতে বিস্মিত হতে হয়। ইন্দ্রনাথের কার্যকলাপের শুরু ফুটবল খেলার মাঠ থেকে। ইস্কুলের মাঠে ‘বাঙালি ও মুসলমান ছাত্রদের’ ম্যাচে মারামারির মধ্যে প্রবেশ করে যেভাবে ইন্দ্র শ্রীকান্তকে বাঁচায় তা দুর্লভ। ইন্দ্র অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বলে – “ভয় কি! ঠিক আমার পিছনে পিছনে বেরিয়ে এস।” জীবনের সেই মুহূর্ত থেকে শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথকে অনুসরণ করেছিল জীবনের প্রতিটি পথ চলার অভিজ্ঞতায়, উপলব্ধির আলোকে।
সাহসী ইন্দ্রনাথ। নিবিড় জঙ্গলে পরিপূর্ণ গোঁসাইবাগানে সাপের ভয়, কাঁটার ভয় – যে পথে মানুষের যাতায়াত নেই, গভীর রাতে সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গলের সরু পথ দিয়ে ইন্দ্রনাথ বাঁশিতে রামপ্রসাদী সুর বাজিয়ে যাতায়াত করত কারণ তার “প্রাণের মায়া নেই”।
বাঘের ছদ্মবেশে শ্রীনাথ বহুরূপী এক শ্রাবণের সন্ধ্যায় শ্রীকান্তের পিসির বাড়ি এলে বাচ্চা থেকে বুড়ো সমস্ত লোক ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সেইসময় ইন্দ্রনাথ একা লন্ঠন হাতে নেমে পরীক্ষা করে দেখে এ বাঘ নয়, ‘ছিনাথ বহুরূপী‘।
সহজ উদাসীন ইন্দ্র। গঙ্গার উজান ঠেলে জেলেদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মাছ নিয়ে পালানো, বিষধর সাপেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বুনো শুয়োরের ভয়কে অবহেলায় দূরে সরিয়ে রাখা ইন্দ্রের পক্ষেই সম্ভব। এক বুক জলের মধ্যে নৌকা টেনে নিয়ে গেছে, বিষাক্ত সাপ লাফিয়ে পড়েছে, গা ঘেষে পালিয়েছে। নির্লিপ্তভাবে জীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে মৃদু স্বাভাবিক কন্ঠে বলেছিল – “আর কামড়ালেই বা কী করব। মরতেএকদিন তো হবেই ভাই।” ইন্দ্র অকুন্ঠ চিত্তে ভয়াবহ অতি ভীষণ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে নৈশ অভিযানের সময় শ্রীকান্তকে একবারও নেমে যেতে বলেনি। শ্রীকান্তকে দিয়ে নৌকাও টানায়নি। সেদিন শ্রীকান্তর আত্মজিজ্ঞাসা ও উপলব্ধি –
১. “ঐ লোকটা কি! মানুষ ? পিশাচ ? কে ও ? কার সঙ্গে ঘুরিতেছি?
যদি মানুষই হয়,তবে ভয় বলিয়া কোন বস্তু যে বিশ্বসংসারে আছে,
সে কথা কি ও জানেও না!…”
২) “জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াইয়া এই স্বার্থত্যাগ এই বয়সে কয়টা
লোক করিয়াছে!…যাহার হৃদয়ের ভিতর হইতে এত বড় অযাচিত দান
এতই সহজে বাহির হইয়া আসিল – সে হৃদয় কি দিয়া কে গড়াইয়া দিয়াছিল!”
সাহস, নির্লিপ্ততা, চঞ্চলতা, সরলতা, পরোপচিকীর্ষার অপর নাম ইন্দ্রনাথ। ইন্দ্রর পরোপচিকীর্ষা শুধু জীবিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, অজানা শিশুর মৃতদেহের প্রতিও। ইন্দ্র যাত্রাপথে কলেরায় মৃত পরিত্যক্ত শিশুটির দেহ নৌকায় তুলে আবার স্নেহভরে জলে শুইয়ে দিয়েছে। নিচু জাতের লোকের মরা হতে পেরে শ্রীকান্ত ইন্দ্রকে প্রশ্ন করলে ইন্দ্রর নির্লিপ্ত জবাব – “মড়ার কি জাত থাকে রে?” এই হেন ইন্দ্রনাথ চরিত্রের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শ্রী সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন –
“…ইন্দ্রনাথের কার্যকলাপের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের এমন একটা ছাপ আছে যাহা অতিমানবের আচরণে পাওয়া যায়; কোনো সময়েই তাহাকে আপামর সাধারণের গন্ডিভুক্ত বলিয়া মনে করা যায় না।… … ইন্দ্রনাথের সবকিছুই বিস্ময়কর।”
ইন্দ্রের চরিত্রকে আলোকিত করেছে তার শিশুর মতো সরলতা। অহঙ্কার সে জানে না। ভূত প্রেতের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ইন্দ্রনাথ রামনাম জপ করে অক্লেশে সমস্ত কঠিন প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেছে। এই সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে শাহজী সাপ বশীভূত করা ও সর্প দংশনে মৃত ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে তোলার মন্ত্র শেখানোর প্রলোভন দেখিয়ে তাকে দোহন করেছে।
অন্নদাদিদিকে নিজের হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছে ইন্দ্র। আবার, কনকনে ঠান্ডার রাত্রিতে নদীর বুকে নৌকায় শ্রীকান্তের গায়ে র্যাপারটা নতুনদা পাটাতনের ওপর বসবে বলে চাইলে শ্রীকান্তর পাছে কষ্ট হয় তাই ইন্দ্র বলে – “আমি দিচ্ছি নতুনদা। আমার শীত করচে না – এই নাও।” ড. সরোজমোহন মিত্রের মতে,
“সে সাহসী, পরোপকারী উদার নিঃস্বার্থ এবং পরদুঃখে কাতর।…শুধু সহানুভূতি জানানো নয়, তার অংশভাগী হওয়া – এ বড় শক্ত কাজ। ইন্দ্রনাথ সেই কাজের লোক।”
শিশু কৃষ্ণের মুখগহ্বরে বিশ্বদর্শন করলে যেমন শ্রীদাম, সুদাম ভয় পেত আবার তার সেই শিশুপনা ও বালকপনাই তাদের আশ্বস্ত করত তেমনি ইন্দ্রনাথের বালকসুলভ চাপল্য, বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করার দুর্দ্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা এবং নিষিদ্ধ কর্ম গোপনে করার জন্য নানা উপায় উদ্ভাবনের কুশলতা এসকলই বালক শ্রীকান্তের গভীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল। তাই কিশোর ইন্দ্রনাথের চরিত্র মূল্যায়ণ করতে গিয়ে ড. মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন –
“বালকের মতো ইহার বিশ্বাস, যুবকের মতো ইহার বীর্য্য ও অকুতোভয়, মহাস্থবিরের মতো ইহার তত্ত্বজ্ঞান ; যেন সকল জ্ঞান, সকল প্রেম ও সকল শক্তি একটি চিরকিশোরের রূপে লীলা করিতে নামিয়াছে।…তাই যীশু বলিয়াছিলেন – “Blessed are the children for theirs is the kingdom of Heaven.”
পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের জীবনে – ভাবনায় – অনুভূতিতে – অভিজ্ঞতায় ইন্দ্রের প্রভাব ছিল গভীর ও সুদূর প্রসারী –
“তারপরে কত কাল কত সুখ দুঃখের ভিতর দিয়া আজ এই বার্ধক্যে উপনীত হইয়াছি।… কত প্রকারের মানুষই না এই দুটো চোখে পড়িয়াছে, কিন্তু এত বড় মহাপ্রাণ ত আর কখনও দেখিতে পাই নাই।”
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজের উপলব্ধির আলোকে চেতনার স্পর্শে ইন্দ্রনাথকে শুধু গ্রহণ করেননি; সমস্ত শরীরে রক্তের শিরার মধ্য দিয়ে জীবন পথের পাথেয় রূপে গ্রহণ করেছিল ইন্দ্র ঈশ্বরের অযাচিত দান।