শ্রীকান্ত উপন‍্যাস কি শরৎচন্দ্রের আত্মজীবনী ?


উপন‍্যাস সৃষ্টির আদিযুগে স্বাভাবিকভাবেই কাহিনির ওপর প্রাধ‍্যান‍্য দেওয়া হত কারণ গল্পের আকর্ষণ তখন পাঠকের কাছে প্রধান। এরপর যখন চরিত্রের আচরণ এবং তার অতলশায়ী মনস্তত্ত্ব আমাদের অভিভূত করে তখন গল্পের চেয়েও অনুভূতির এই দিক পরিবর্তন আমাদের আকর্ষণ করে বেশি। এই কারণেই উপন‍্যাসে কখনো গল্পের আকর্ষণ বেশি, কখনো চরিত্রের।

       শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ‍্যায়ের শ্রীকান্ত(১ম পর্ব) উপন‍্যাসটি কাহিনি ও চরিত্রের সংযোগ, বাস্তবতা, সত‍্যের সঙ্গে কিছু মিথ‍্যার সম্পর্ক এবং তথ‍্যের সঙ্গে সৌন্দর্য ও রসের মিলন। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত ঘটনামালাকে একসূত্রে গেঁথেছেন শ্রীকান্ত। উপন‍্যাসের গঠনশৈলীর মূল‍্যায়ণ করতে গিয়ে সমালোচক জয়ন্ত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় বলেছেন –

“বাংলা সাহিত‍্যে আত্মজীবনীমূলক উপন‍্যাসের প্রথম সৃষ্টিকর্তা শরৎচন্দ্র। বঙ্কিমচন্দ্র আত্মদর্শনকে বাইরে এনে এক নতূন চরিত্রের মধ‍্যে দিয়ে নতুন কিছু করার শুভ উদ‍্যোগ নিয়েছিলেন সত‍্য; কিন্তু শরৎচন্দ্র‌ই যে আত্মজীবনীমূলক উপন‍্যাসের প্রবর্তক তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি।”

এক‌ই অভিমত পোষণ করেছেন ড. অজিত কুমার ঘোষ তাঁর ‘শরৎচন্দ্রের জীবনী ও সাহিত‍্যবিচার’ গ্রন্থে। উপন‍্যাসের প্রাক্কালেই লেখক তার পরিচয় দিয়েছেন –
“আমার এই ‘ভবঘুরে’ জীবনের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়াইয়া ইহার‌ই একটা অধ‍্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে।”
একটা ফুল যেভাবে প্রতি মুহূর্তে ফোটে – সেই ফুটে ওঠাকে, পাপড়ি মেলাকে সুগন্ধ ছড়িয়ে ধরে রাখা হয় আত্মজীবনীমূলক উপন‍্যাসে। ঔপন‍্যাসিক উপন‍্যাসের প্রারম্ভে তার‌ই সংকেত দিয়েছেন।
ড. অজিত ঘোষ জানিয়েছেন, ডিকেন্স বরাবর‌ই শরৎচন্দ্রের প্রিয়, তাঁর আত্মজৈবনিক উপন‍্যাস ‘David Copperfield’ এর সঙ্গে শ্রীকান্তের সাদৃশ‍্য পাওয়া যায়। শরৎচন্দ্রের ব‍্যক্তিজীবন, ভাগলপুরের মামারবাড়িতে বাল‍্য কৈশোর জীবন ঐ সময়ের সঙ্গী মহাপ্রাণ রাজেন মজুমদারের আদর্শে ইন্দ্রনাথ চরিত্র, গঙ্গার প্রাকৃতিক দৃশ‍্য সবকিছুই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর উপন‍্যাসে। এ সম্পর্কে ড. সরোজ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের অভিমত প্রণিধানযোগ‍্য –

“আত্মজীবনীকল্প উপন‍্যাসে একদিকে যেমন মেলে নানা ব‍্যক্তির সাক্ষাৎ অপরদিকে সেই সমুদয়ব‍্যপ্তির সমাহারে, সমস্ত ঘটনার পুঞ্জ পুঞ্জ প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠে আত্মজীবনীর যিনি নায়ক তাঁর ব‍্যক্তিস্বরূপ।” (বাংলা উপন‍্যাসের কালান্তর)

অনেকের মতে, ‘শ্রীকান্ত’ উপন‍্যাসটি আত্মজীবনীমূলক উপন‍্যাস হলেও কেউ কেউ একে আত্মজীবনীর খাতে ফেলতে চাননি। এ প্রসঙ্গে সরোজ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় অন‍্যত্র জানিয়েছেন –
“শরৎচন্দ্র‌ই প্রথম আত্মকাহিনীর ছলে উপন‍্যাস লিখলেন।”
আত্মকাহিনির ছলে লেখা এবং আত্মকাহিনি লেখার মধ‍্যে প্রভেদ যথেষ্ট আছে। এই অভিমতকে সহজভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ড. মোহিতলাল মজুমদার –

“উপন‍্যাসখানি এক অর্থে শরৎচন্দ্রের আত্মকাহিনিই বটে। কিন্তু তাহা স্বলিখিত জীবন বৃত্তান্তের মতো নয়।…এই আত্মদর্শনের ভঙ্গিটি সাহিত‍্যে অতিশয় নূতন – আপনাকেই দেখা বটে, কিন্তু তাহাতে একটা আত্মনিরপেক্ষতা আছে।”

সমালোচক তাঁর বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে কতকগুলি যুক্তি স্থাপন করেছেন। প্রথমত, এখানে গল্প বা উপন‍্যাসের মতো কোনো আদ‍্যন্তযুক্ত প্লট নেই, লেখক এখানে নায়কের জীবনঘটিত কতকগুলি বিচ্ছিন্ন স্মৃতিকথার একটা সংকলনমাত্র বলেছেন। ওই নায়ক চরিত্রের এমন একটি বৈশিষ্ঠ‍্য আছে যে একগাছি ডোরের মতো অবিন‍্যস্ত ফুলরাশিকে একটি মালার আকার দান করেছেন।
       উপন‍্যাসের কাহিনি দুইভাগে বিভক্ত – একটি লেখকের আত্মজীবন বা আত্মচরিত, আর একটি সেই জীবন সম্বন্ধে চিন্তা বা তার সমালোচনা। আত্মপ্রকাশের মধ‍্যে যে আত্মদর্শন আছে তা আরো সত‍্য, আরো গভীর। শক্তি ও অশক্তি, মোহ ও দূর্বলতা, লোভ ও ত‍্যাগ সংস্কারের বশ‍্যতা এবং তার‌ই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এসকল‌ই তাতে অকপটে প্রকাশ পেয়েছে। এ যে স্ববিরোধী মনোভাব, দুই বিরোধী আদর্শের প্রতি সমান শ্রদ্ধা – এ সকল কারণে এটা নিশ্চিত হলেও যে ঐ কাহিনি লেখকের নিজের‌ই অন্তরঙ্গ জীবনের কাহিনি। কিন্তু উপন‍্যাসের সকল চরিত্রগুলি কি বাস্তব চরিত্র ? – এর সদুত্তর পাই শরৎচন্দ্রের লেখা একটি পত্রে –

“রাজলক্ষ্মীকে কোথায় পাব ? ওসব বানানো মিছে গল্প। ‘শ্রীকান্ত’ একটি উপন‍্যাস ব‌ই তো নয়।” (লীলারাণী গঙ্গোপাধ‍্যায়কে লেখা)

শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ আঙ্গিকের দিক থেকেও অভিনব, এ ধরণের উপন‍্যাস লেখার কথা কেউ ভাবেননি। রবীন্দ্রনাথ উপন‍্যাসে বিচিত্র রূপ রীতি পরীক্ষা করেছেন, কিন্তু এতদিন খোলামুঠি রীতি আশ্রয় করেননি। শরৎচন্দ্র‌ই এই অভিনব আঙ্গিকের প্রচলন করলেন যেখান থেকে বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র যাত্রা শুরু হয়।

         ‘শ্রীকান্ত’ উপন‍্যাসটি ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত হলে এর নাম দেন ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনি’, পরে ব‌ই হিসাবে প্রকাশ হবার পর ‘শ্রীকান্ত/চিত্র’ এইরকম পরিচয় দিয়েছিলেন প্রথমদিকে। আসলে লেখকের নিজের দেওয়া ওই দুটি পরিচয় এর রূপরীতির বিশিষ্টতার দিকে কিঞ্চিৎ তর্জনী তোলে। শ্রীকান্ত ; স্বভাবের বৈরাগীপনায় সে যেন সর্বদাই পথের যাত্রী। আর ‘চিত্র’ কথাটির মধ‍্য দিয়ে শিল্পরীতিঘটিত একটি বিশিষ্টতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই উপন‍্যাসে সমাজের জীবনের প্রকৃতির মানব চরিত্রের নানা রূপ যেন ছবির মতো ফুটে উঠেছে। কাহিনির টানাপোড়েনে, মূল গল্পের যদি তেমন কিছু থাকে যেসব প্রসঙ্গ অনিবার্য নয়, অচ্ছেদ‍্য নয় অথচ সেসব কোনোটাই অপ্রাসঙ্গিক নয়। তাই চিত্র কথাটির পরিচয় দিয়ে তিনি প্রথমদিকে তাঁর উপন‍্যাসের পাঠককে, বাংলা উপন‍্যাসের সাধারণ রূপরীতির সঙ্গে পরিচিত পাঠককে একটু সতর্ক করে দিলেন যেন এর স্বাতন্ত্র‍্য সম্বন্ধে।
          ‘শ্রীকান্ত’ ভবঘুরে, তার সংসার নেই, সমাজ নেই, জীবনের সর্ব্বত্র‌ই নিষ্ফলতা, সর্বত্র‌ই ফাঁকি, ক্ষুদ্রের আত্মপ্রবঞ্চনা এবং মহতের আত্মনিগ্রহ – এটাইতো জীবনের বাস্তবরূপ। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত তার জীবন্ত দলিল।

“গল্প উপন‍্যাসের মধ‍্য দিয়ে কবি সময়ে সময়ে নায়কের মারফতে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করিয়া লন, তাহাতেও একরূপ তৃপ্তি হয় কিন্তু তার স্বাদ এখানে নাই। ইহা একান্ত‌ই আত্মনিবেদন এবং তাহাও যেন অপরের নিকটে নয়, নিজের‌ই নিকটে – এ ক্রন্দন নিঃসঙ্গ আত্মার নিরুদ্দিষ্ট আর্ত্তরব।” (মোহিতলাল মজুমদার)

অর্থাৎ ছকে বাঁধা উপন‍্যাসের শ্রেণিবিন‍্যাসে আবদ্ধ নয় ; উপন‍্যাসটির গঠনরীতি সর্বাপেক্ষা স্বাতন্ত্র‍্য এবং অভিনবত্বমূলক।