বাংলার উৎসব

কলমে : অনন্যা সাহা , বি.এ (বাংলা), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়


ভূমিকা :
প্রত্যেক মানব সম্প্রদায়ে সবের মাঝে উৎসব হলো এক অঙ্গবিশেষ । নানা আচার-বিচার ব্যতীত উৎসব তথা অনুষ্ঠান পালন , প্রতিটি সম্প্রদায়ের মুখ্য কার্যাবলীর মধ্যে অন্যতম। উৎসব কথাটি শ্রবণমাত্র সর্বঅগ্রে আমাদের সকলের মনে জনসমাগমের ছবিই উদিত হয়। এই জনসমাগম হতে পারে পারিবারিক অথবা সার্বজনীন। উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষের এই একত্রিকরণ বিশেষ তাৎপর্যবাহী। মানুষ একঘেয়েমিকে কাটিয়ে তোলার এক অভিনব পন্থা হিসেবে উৎসবের পরিকল্পনা করে বহু প্রাচীন কালেই। এবং সেই প্রাচীন পন্থার চল আজও রয়ে গিয়েছে। বলাবাহুল্য সারা পৃথিবী জুরে বিভিন্ন উৎসব বিভিন্ন সময় পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। এবার নির্দিষ্ট ভাবে যদি আমরা, আমাদের বাংলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ উৎসব সমূহকে এক জায়গায় আনার চেষ্টা করি , সেই চেষ্টা আমাদের বিশেষ ভাবে সাহায্য করবে, আমাদের স্থানীয় উৎসবের পটভূমিতে সারা বিশ্বের উৎসবের মূল তাৎপর্যকে বুঝতে।

উৎসবের প্রকারভেদ :
বিভিন্ন স্থানে উৎসব পালন করা হয় মূলত কোনো ঘটনা তথা বিষয়কে অবলম্বন করে অর্থাৎ উৎসব কখনো বিনা কারণে অনুষ্ঠিত হয়না। কোনো নির্দিষ্ট উপজিব্যকে উজ্জাপনের জন্যই উৎসবের অস্তিত্ব বিদ্যমান। প্রসঙ্গত আমাদের বাংলাও এর ব্যতিক্রম নয়, কোনো-না-কোনো বিষয়কে এবং সময়কে কেন্দ্র করে বাংলাতেও নানা উৎসবের সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়। উৎসব উদযাপনের উপজীব্য গুলিকে যদি সনাক্ত করা যায় তবে আমরা, এই উপজীব্যগুলির কিছু বৈচিত্রময় শ্রেণীবিভাগ লক্ষ্য করবো, যথা :
      ● সামাজিক ও পরিবারভিত্তিক উৎসব
      ● ঋতুভিত্তিক উৎসব
      ●  জাতীয় উৎসব
      ●  ধর্মকেন্দ্রিক উৎসব
      ● লোকবিশ্বাস প্রসূত উৎসব

সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে অঙ্গীকার করে যে উৎসব পালিত হয় তা সামাজিক উৎসবের অন্তর্গত। তবে ধর্মভেদে সমাজের নিয়মাবলীর পাশাপাশি, সমাজভিত্তিক উৎসবের মধ্যেও নানা বৈচিত্র দেখা যায়। বিশেষ করে ভারতের মতন স্থানে বৈচিত্রের অভাব চক্ষুগোচর হয়না। এই কারণবশত সারা দেশে হোক বা আমাদের বাঙালি সম্প্রদায়ে হোক, ধর্ম অনুযায়ী সমাজশৈলী বদলে যায়।
সামাজিক ও পারিবারিক উৎসব
তবে, সর্বোপরি সব ধর্ম নির্বিশেষে আমরা যদি কোনো সামাজিক উৎসবের উদাহরণ দিতে চায় , সেই উৎসব হবে “রাখী-বন্ধন” উৎসব। প্রকৃত ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধনের উদযাপন দিবস হলো এই রাখী বন্ধন। এ ছাড়াও নানা সামাজিক উৎসবের অস্তিত্ব বিরাজমান আছে আমাদের বাঙালি সমাজে যেমন : মেলা , নানা প্রকারের প্রদর্শনী ইত্যাদি এ সবই সার্বজনীন উৎসব।
অপরদিকে, পরিবার সম্মিলিত অনুষ্ঠান সমূহ, পরিবারভিত্তিক অনুষ্ঠানের অন্তর্গত। ভাইফোঁটা, বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি সবই পরিবার আয়োজিত উৎসবের অংশবিশেষ।
ঋতুভিত্তিক উৎসব –
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বৈশাখ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত নানা ধরণের উৎসব সংঘটিত হয় এবং মাস অনুযায়ী সংঘটিত এই উৎসব গুলি বস্তুত ঋতু ভিত্তিক। মাস বদলের সাথে ছয় ঋতুর যে পরিবর্তন হয় সেই পরিবর্তনই উৎসবগুলির মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। ঋতু ভিত্তিক উৎসবের কিছু উদাহরণ হলো যথা : পৌষপার্বন , সংক্রান্তি , শ্রীপঞ্চমী, দোলযাত্রা প্রভৃতি।
জাতীয় উৎসব –
কোনো মনীষীর জন্মতিথি / মৃত্যুতিথি , শহীদ ব্যাক্তিবর্গ এবং স্বাধীনতা সম্পর্কিত তথা সংক্রান্ত নানা দিবস ইত্যাদি জাতীয় উৎসবের তালিকাভুক্ত। যেকোনো দেশ এবং প্রদেশ ভেদে এই জাতীয় উৎসবের ধরণ ভিন্ন হয়। মূলত দেশের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে এই ধরণের উৎসব পালিত হয়। এই জাতীয় উৎসবে সকলে জাতি, ধর্ম ভেদে একত্রিত হয় এবং তারা একত্রিত ভাবেই নিজেদের, দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে এখানেই জাতীয় উৎসবের মূল গুরুত্ব।
ধর্মকেন্দ্রিক উৎসব –
যা মানুষকে ধারণ করে তাই হলো ধর্ম এবং এই ধর্মের নানা বৈচিত্র বর্তমান। এই কারণবশত ধর্ম অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের উৎসবের সমাবেশ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। বাঙালিদের প্রধান এক ধর্মীয়  উৎসবের নাম দূর্গা-পূজা । এছাড়া ঈদল ফিতর, পয়লা বৈশাখ,কালী-পূজা, ইস্টার ইত্যাদি ভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের অঙ্গ।
লোকবিশ্বাস প্রসূত উৎসব –
লোকবিশ্বাসের জন্ম হয় , নানা দৈব প্রতিমূর্তি, নানা লোককথা, প্রবাদকে কেন্দ্র করে। লোকবিশ্বাস জনিত কারণে বিভিন্ন প্রকারের লোক উৎসবের উৎপত্তি হয়। সম্প্রদায় ভেদে মানুষ নানা ধরণের লোক উৎসব পালন করে। লোকবিশ্বাস প্রসূত উৎসব গুলির মধ্যে অন্যতম ভাদু , চড়ক, হালখাতা, ইতুপূজা, শীতলা ষষ্ঠী, জামাই ষষ্ঠী , নীল ষষ্ঠী প্রভৃতি।

বাংলার বাইরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু উৎসব :
আমাদের ভারত হলো এমন এক দেশ যেখানে নানান বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য দেখা যায়। জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়ের ভেদ থাকলেও ভারতে মানুষজন একত্রিত ভাবে বসবাস করে। রাজ্যভেদে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের তালিকা প্রস্তুত নিম্নে করা হলো–

আসাম – অম্বুবাচী
ওড়িষ্যা – জগন্নাথদেবের রথযাত্রা
উত্তরপ্রদেশ – কুম্ভমেলা
বিহার – ছটপূজা
তামিলনাডু – পোঙ্গাল
পাঞ্জাব – বৈশাখী
সিকিম – লোসার
জম্মু ও কাশ্মীর – অমরনাথ যাত্রা
গুজরাট – মকরসংক্রান্তির ঘুড়ি উৎসব প্রভৃতি।

বাংলার উৎসবের ঐতিহ্য :
কালের প্রবাহে উৎসব নিজের সাথে ঐতিহ্যকে বহন করে। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি উৎসব হলো প্রাচীন ঐতিহ্য-এর অন্যতম বাহক। গ্রাম, রাজ্য,প্রদেশ ভেদে উৎসবের মাধ্যমে নানা ধরণের ঐতিহ্যকে উদযাপন করা হয়। দৈব বিশ্বাসে, বিশ্বাসী আমাদের বাংলা, প্রতিমা এবং মূর্তিকে বিশেষ প্রাধান্য প্রদান করে প্রাচীনকাল থেকেই। এই কারণে আমাদের বাংলায় মূর্তিশিল্পীদের অনবদ্য শিল্পের হদিস মেলে অতীব সহজে। মূর্তিশিল্পীদের এই শিল্পকর্ম স্বভাবতই হয়ে ওঠে, বাংলায় উদযাপিত নানান উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। উদাহরণ হিসেবে আমরা যদি দূর্গা পূজার কথা বলি তবে উক্ত বক্তব্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বাঙালির সর্ববৃহৎ উৎসব দূর্গা পূজো মাতা দূর্গার প্রতিমা বিনে অসম্পূর্ণ। প্রসঙ্গত দূর্গা প্রতিমা নির্মাণের ক্ষেত্রে, দুই প্রকারের ধ্রুপদী রীতির প্রচলন আমরা প্রত্যক্ষ করি, যা সত্যই আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য-এর ধারক ও বাহক।
শুধু তাই নয়, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে উৎসব হিসেবে রেড রোড কার্নিভাল হল বিশেষ উল্লেখ্য। দূর্গাপূজো উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তের সংস্কৃতির স্বরূপ সারা বিশ্ব দেখে কলকাতার রেড রোডের কার্নিভালের মাধ্যমে। এই কার্নিভাল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমার ঐতিহ্যকে তুলে ধরে অতীব সুন্দরভাবে। দূর্গাপূজা যে আসলেই হেরিটেজ তকমার যোগ্য দাবিদার এরই দৃষ্টান্ত বহন করে এই কার্নিভাল।
এছাড়া, স্থান ভেদেও নানানউৎসব নানান প্রকারের লোকপ্রসিদ্ধিকে বহন করে। স্থানভেদে উদযাপিত উৎসবের মধ্যে সর্বপ্রসিদ্ধ হল মেলা। এই মেলাকে কেন্দ্র করেই স্থানীয় ঐতিহ্যগুলি সার্থক ভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে – কেন্দুলীর জয়দেবের মেলা, নদিয়ার সতীমায়ের মেলা থেকে শুরু করে মাঘী পূর্ণিমায় বাঁকুড়ায় মুড়ির মেলা, হাওড়া হুগলির আলুরদমের মেলা এর উদাহরণ।

উৎসবের প্রয়োজনীয়তা :
কালের আবর্তন হলেও, মানুষ রয়ে যায় এবং তার পাশাপাশি রয়ে যায় মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি। যেকনো সংস্কৃতির সাথে উৎসব অতঃপ্রত ভাবে জড়িত থাকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষেরা নিজেদের সংস্কৃতিকে মূলত নানা উৎসবের পটভূমিতেই বুঝতে শেখে। একঘেয়েমি কাটিয়ে আনন্দে মেতে ওঠার অন্যতম এক পন্থা হলো উৎসব। এই উৎসব আমাদের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখে। তবে এর পাশাপাশিও, কার্যকরী হয়ে ওঠে নানান বিষয়। উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা মানুষের আয়ের পথ সুগম হয়। গতানুগতিক জীবনের বাইরে যখন উৎসবের মরশুম আসে তখন দোকান-পাট সেজে ওঠে। বেরে যায় উৎসবের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তু সকলের আমদানি-রপ্তানি। দিন এনে, দিন খায় যে মানুষেরা তাদের কাছে আসে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। উৎসবকে সাজিয়ে তুলতে যাদের কাজ মুখ্য,  তারা নিযুক্ত হয় নানান কাজে। এর ফলে অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও বদল আসে। আনন্দ – হইহুল্লোড় , মানুষের একত্রিকরণ এ সবের সাথে , অর্থাগমের দিকটাও বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

উৎসবের নেতিবাচক প্রভাব :
নানান রকমের ইতিবাচক দিকের সাথে , উৎসব সংক্রান্ত কিছু নেতিবাচক দিকও বর্তমান আছে। ধর্মীয় উৎসব গুলির কুপ্রভাব এক্ষেত্রে বিশেষ আলোচ্য। ধর্মের দোহায় দিয়ে উৎসবকে কাজে লাগিয়ে অনেক অসৎ ব্যক্তি,  অসৎ প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে ব্যাপৃত হয়। এছাড়া উৎসবের আয়োজনের জন্য চাঁদা তোলা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বর্তমানে এই চাঁদা তোলার নামেও অকথ্য অরাজকতা চলে। সাধারণ মানুষের কাছে অন্যায় ভাবে অধিক পরিমানে টাকা দাবি করা হয়। এবং দাবি করা টাকা দেওয়া না হলে সাধারণ মানুষকে চাঁদা আদায়কারীদের অসভ্যতামি সহ্য করতে হয়। এর পাশাপাশি আবর্জনার বাহুল্যতা লক্ষ্য করা যায়। রাস্তা-ঘাটে সঠিক ভাবে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা , না থাকায় যানবাহন সংক্রান্ত দুর্ঘটনা বাড়ে। সর্বোপরি দূষণের প্রাবল্যতা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাজি, যানবাহনের বিপুল যাতায়াত ইত্যাদির জন্য সংঘটিত হয় বায়ুদূষণ। এছাড়া বাজির অধিক আওয়াজের জন্য শব্দদূষণও ঘটে যার ফল বিশেষ করে ভোগ করতে হয় পশুজাতিকে ।

উপসংহার :
উক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা বলতে পারি উৎসবের সাথে নানান দিক জড়িত থাকে, যে দিক গুলির মধ্যে কিছু হয় ইতিবাচক আবার কিছু হয় নেতিবাচক। ইতিবাচক দিকের তুলনায়,নেতিবাচক দিকের ওজন অধিক হলেও আমরা উৎসবকে কখনো আমাদের যাপন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারিনা। উৎসব সংক্রান্ত নানান অসঙ্গতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দায়িত্ব আমাদেরই। তা বলে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে যেকোনো উৎসবকে বন্ধ করে দেওয়া কখনো যুক্তিসম্মত নয়। বরং অসঙ্গতি গুলির মোকাবিলা করাই হলো আমাদের মুখ্য কর্ম। আমাদের ঐতিহ্যকে বজায় রেখে অন্যায়ের বিরোধিতা করা এবং অন্যায়কারীদের শাস্তি দেওয়াই হলো কার্যত সঠিক পন্থা। অমোঘ আনন্দের বাহক হলো উৎসব। মানুষ এক জোট হয়ে এই আনন্দকে উপভোগ করে। এই কারণে উৎসবের শালীনতাকে বজায় রাখা প্রয়োজনসাপেক্ষ। বর্তমানে আধুনিকতার দোহায় দিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতিকে যে ভাবে ভূলুন্ঠিত করা হচ্ছে তা সত্যই পীড়াদায়ক। কুসংস্কারের বিরোধিতা অবশ্যই করণীয় তবে কুসংস্কারকে দূর করতে গিয়ে সমগ্র সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করা কাম্য নয়। আমাদের বাংলা তথা সারা বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে উৎসব একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। উৎসবের নানান অসঙ্গতিকে দূর করে সার্থক ভাবে তা উদযাপন করাই আমাদের মুখ্য দায়িত্ব।