করমন্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা রচনা
কলমে– শ্রেয়সী মিশ্র,এম.এ(বাংলা), মেদিনীপুর কলেজ
■ ভূমিকা :-
“মরিতে চাহি না আমি এ সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই”
জীবন আছে মানে মৃত্যু আবশ্যক, তবুও কী কেউ চায় নিজেকে মুছে ফেলতে? চায় না। পৃথিবীতে অবস্থিত সকল জীবই এক ছন্দের সঙ্গে জীবন অতিক্রম করে।যেমন ভাবে সুন্দর এক ছান্দিক গতির সঙ্গে অতিক্রান্ত হতে থাকে আমাদের সবার জীবন। কিন্তু এই ছন্দময় জীবনে যদি আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনা এসে মুহূর্তেই আলোকিত জগৎকে পরিণত করে অন্ধকারময়, তখন আমাদের জীবন হয়ে ওঠে ছন্দহীন। কবে, কখন, কোথায় আমাদের সাথে কী ঘটতে চলেছে তা আমরা কেউই জানি না, জানতে পারলে হয়তো দুর্ঘটনার এত ভয়ঙ্কর রূপের সাক্ষী মানুষ কে থাকতে হতো না। ‘বিপুলা এ পৃথিবী’তে প্রতিনিয়ত না জানি ঘটে চলেছে কতই না দুর্ঘটনা। বাস, ট্রেন, মোটরগাড়ি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় যাই হোক না কেন, ক্ষয়ক্ষতি টা প্রবল ভাবে মানুষদের ই হয়।জীবন টাকে যে আর কয়ঘন্টা উপভোগ করতে পারব সেটাও আমাদের কাছে অজানা । হাজারো মানুষ হাজারো রকমের স্বপ্ন নিয়ে দুর দুরান্তে যাত্রার জন্য বেছে নেন ট্রেনে অভিযান কে। কিন্তু এইরকম নানান দুর্ঘটনা এসে একনিমেষেই তছনছ করে ফেলে সকল স্বপ্ন। কতই অদ্ভুত না আমাদের জীবন, তবুও কী আমরা একে অপরের সহায় হতে পারি? পারি না, মেতে থাকি হিংসা, দ্বেষ আর আত্ম অহংকার নিয়ে। যে মানুষটার সাথে কয়েক মুহূর্ত আগে খারাপ ব্যবহার করে আসি, কী জানি হয়তো সেই মানুষটাই চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। কেউই আমরা নিজেদের জীবন নিয়ে নিশ্চিত নই, ঠিক যেমন একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে – ‘আজ আছি,কাল নেই’।
সত্যিই তাই , সেই অভিশপ্ত দিনটিতে করমন্ডলে এক্সপ্রেসে যাত্রা করা মানুষগুলো কি কখনোই কল্পনা করতে পেরেছিল যে দিনটা বা অভিযানটা তাদের কাছে এতটা ভয়াবহ হয়ে যাবে, প্রান হারাবে এত এত মানুষ, বিকলাঙ্গ হয়ে থেকে যাবে বহু সংখ্যক মানুষ, না না তারা কেউই জানতো না। জীবনটা বড়ই অনিশ্চিত।
■ দুর্ঘটনার সময় ও স্থান :-
দিনটি ছিল ২ জুন,২০২৩ । ভয়ঙ্কর এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে করমন্ডল এক্সপ্রেস সহ দুটি ট্রেন। শুক্রের কালবেলা! এক নয়,দুই নয়, তিন তিনটি ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে। করমন্ডল এক্সপ্রেস, যশবন্তপুর হাওড়া এক্সপ্রেস এবং একটি মালগাড়ি। ঘটনাটি ঘটেছিল বালেশ্বরের বাহানগা নামক একটি বাজার স্টেশনে।
■ দুর্ঘটনার কারণ –
রেলওয়ে বোর্ডের মতে, লুপ লাইনে দাঁড়িয়েছিল দুটি ট্রেন। ট্রেনগুলিকে সেখানে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে বাকি লাইনের এক্সপ্রেস ট্রেন গুলো যেতে পারে। বেঙ্গালুরু দিয়ে চেন্নাইয়ের দিক থেকে আসছিল যশবন্তপুর এক্সপ্রেস। শালিমার রেলওয়ে স্টেশন থেকে হাওড়া দিয়ে চেন্নাই যাওয়ার জন্য আসছিল করমন্ডল এক্সপ্রেস। স্থানীয় সময় অনুযায়ী সময়টা ছিল আনুমানিক সন্ধ্যা ৭ টার দিকে।কেউ হয়তো আপনজনের সাথে কথা বলছিলেন,কেউ বা ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন, আবার কেউ সন্ধ্যার টিফিন সারছিলেন। হঠাৎ করে এক অস্বাভাবিক ঝাঁকুনি অনুভব করেন যাত্রীরা । ততক্ষনে তছনছ হয়ে লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে কয়েকটা কামরা ,তার সাথে চাপা পড়ে যান অসংখ্য মানুষ।
■ ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা অভিশপ্ত :- একবিংশ শতাব্দীর শুরুর পর থেকে দেশের সবচেয়ে গুরুতর রেল দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে করমন্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা কে। কিন্তু তার আগে ও শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে ঘটে আসছে বহু মর্মান্তিক দুর্ঘটনা যা রেল দুর্ঘটনার ইতিহাসের পাতায় এখনও জ্বলজ্বল করছে , ধ্বনিত হয়ে চলেছে আহত মানুষ গুলোর আর্তনাদ। ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা গুলির মধ্যে আরও কিছু মর্মান্তিক ঘটনা হল —
১. বিহার রেল দুর্ঘটনা – ভারতের রেল দুর্ঘটনার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াব দুর্ঘটনা ঘটেছিল বিহারে, ১৯৮১সালে। একটা প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে যাত্রীবাহী ট্রেন ব্রিজ পেরোনোর সময় লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে যায় নদীতে। এর ফলে মৃত্যু হয় ৮০০ জনেরও বেশি মানুষের। এছাড়াও –
২. গাইসেল রেল দুর্ঘটনা – উত্তর দিনাজপুরের গাইসোলে ২ আগস্ট, ১৯৯৯ সালে ঘটেছিল এই ঘটনাটি। স্থানীয় সময় অনুযায়ী সময়টা ছিল মধ্যরাত্রি অর্থাৎ রাত ২ টার সময়। ভুল সিগন্যালের কারনে এক লাইনে চলে এসেছিল অবধি অসম এক্সপ্রেস ও ব্রহ্মপুত্র মেল। সরকারি মতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০ , বেসরকারি মতে আরও বেশি। গাইসেলের ২৪ বছর পর প্রায় একই দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি করমন্ডল দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে। মাসের এদিক ওদিক হলে ও তারিখ টা ছিল একই।
৩.জ্ঞানেশ্বরী রেল দুর্ঘটনা— আরও এক ভয়ঙ্কর ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন পশ্চিম বঙ্গের, পশ্চিম মেদিনীপুরের লোকেরা সহ বহু যাত্রী। ২০১০ সালের ২৮ মে , স্থানীয় সময় অনুযায়ী সময়টা ছিল ১:৩০ । খড়গপুরের কাছে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত বগিতে একটি মালগাড়ি এসে ধাক্কা লাগায় ঘটে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি । প্রানহানি ঘটেছিল মোট ১৪১ জনের সাথে আহত হয়েছিলেন ২০০ জন।
পৃথিবী সাক্ষী রয়েছে এরকম বহু দুর্বিষহ ঘটনার। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যার হাত থেকে রেহাই ঘটেনি।
■ দুর্ঘটনার ভয়াবহতা – করমন্ডলের দুর্ঘটনার ভয়াবহতা বিহার গাইসেলের আতঙ্ককে মনে করিয়ে দেয়। সহস্রাধিক মানুষের তীব্র আর্তনাদ, চিৎকার রীতিমতো ভেদ করে যায় অন্ধকারের নিস্তব্ধতা। একরাশ হতাশা, প্রানের ঝুঁকি ও ভয়াবহতা নিয়ে ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায় পুরো এলাকা জুড়ে।কী ভাবে নিজেকে এবং সঙ্গে থাকা নিজের প্রিয়জনেদের উদ্ধার করবেন এই ভয়ঙ্কর করালগ্ৰাসের মুখ থেকে,তাই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সকলেই। নিজের আপনজনা দের রক্ষা করতে গিয়ে হয়তো অন্যের আপনজন কে ফেলেছিলেন বিপদের মুখে। একা যারা ছিলেন তারা হয়তো বা নিজেকে বের করে আনতে পেরেছিলেন। কিন্তু যারা পরিবার নিয়ে গেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই সেই স্থানেই মারা গেছিলেন, সেই প্রিয় মানুষদের নিথর দেহ ফেলে রেখে, মন না চাইলেও মন কে শক্ত করে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল নিজেদেরকে।এর মধ্যে ও এমন অনেক মানুষ ছিলেন যারা নিজেদের জীবন তোয়াক্কা না করে, নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে ও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অন্যকে উদ্ধার করতে। কতই না করুণ দৃশ্য, তার বর্ণনা দিতে গিয়েও চোখে জল চলে আসে। সেই স্থানেই সঙ্গেসঙ্গে প্রাণ হারিয়ে ফেলেন শতাধিক মানুষ। ক্রমে সেই সংখ্যা পৌঁছাতে থাকে হাজারের দিকে। আবার যাদের একটি একটি অঙ্গ বিকল হয়ে পড়ে তারাও পড়ে থাকেন মৃত দেহের ভিড়ে। অন্ধকার, রক্তারক্তির মধ্যে তারা করুণভাবে অনুরোধ করতে থাকেন ‘আমি বেঁচে আছি ,আমাকে উদ্ধার কর’।
রীতিমতো মূর্ছা যাওয়ার অবস্থায় এসে পড়েন সেদিনের ট্রেনযাত্রীর পরিবারের লোকজনেরা। কেউ বা যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন কেউ বা আজ অবধিও কোনো খবর পাননি। নিজের স্বামীর খবর না পেয়ে একা স্ত্রী বেরিয়ে পড়েছিলেন স্বামী কে ফিরিয়ে আনতে। হয়তো বিবাহিত জীবনের কোনো স্বপ্নপূরণ করার তাগিদে স্বামী পাড়ি দিয়েছিলেন ট্রেন অভিযানে, কোনো এক কাজের সন্ধানে। কিন্তু তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল।
■ দুর্ঘটনার ফলে ক্ষয়ক্ষতি :-
অভিশপ্ত করমন্ডল কেড়ে নিয়েছিল প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষের প্রাণ। আহত এবং অঙ্গহীনদের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় উপস্থিত থাকা মানুষদের যা ক্ষতি হয়েছিল তার প্রভাব রয়ে গেছে আজ অবধিও । এক একটি অঙ্গ যাদের কেটে বাদ দিতে হয়েছে, যারা সারাজীবনের জন্য এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখার ক্ষমতা হারিয়েছেন, তাদের জীবনে যা সহ্য করতে হচ্ছে তার মাশুল কী কেউ দিতে পারবে? দুর দুরান্তে যাত্রা করা মানুষদের সাথে কত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও থাকে, যা মানুষগুলোর সাথে সাথে হারিয়ে যায়। এমন অনেক মানুষ,যাদের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না কিন্তু অনবরত বেজে চলেছিল তাদের মোবাইল। মোবাইলের ওপারে থাকা মানুষগুলো একটু স্বস্তির খবর পাওয়ার জন্য করে চলেছেন অনবরত ফোন। বহু সন্তান হারিয় ফেলেছিল তার মা- বাবা কে, বহু মা-বাবা হয়েছিলেন সন্তানহারা, কত মানুষ খোঁজ পায়নি প্রিয় মানুষটিরও। নিজের প্রিয়জনেদের চিরতরে হারিয়ে যারা একার জীবন নিয়ে ফিরেছিলেন তাদের কাছে এর থেকে বড় ক্ষতি আর কী ই বা হতে পারে? এক বৃদ্ধ বাবা গিয়ে হাজার মৃতদেহের ভীড়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন নিজের ছেলের দেহ। চিরতরে হারিয়ে যাওয়া হাজারো মানুষগুলোকে ফিরিয়ে আনা তো আর সম্ভব নয়। ওই করমন্ডল এক্সপ্রেসে বহু পরিযায়ী শ্রমিক পাড়ি দেন, পরিবারের মানুষদের মুখে আহার যোগানোর জন্য। বিভিন্ন কোম্পানীতে কাজ করে সংসারে একটু স্বচ্ছল অবস্থা ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু সংসার কে বাঁচাতে গিয়ে সেদিন প্রান হারিয়ে ফেলেন বহু পরিযায়ী শ্রমিক। ছোট্টো বোনটির বিয়ের দায়িত্ব সহ, বিয়ের নানা সামগ্ৰী নিয়ে ফিরছিলেন যে দাদা। এক পলকেই বোনের লাল টুকটুকে বেনারসির সাথে রক্ত মাখামাখি হয়ে রাঙ্গিয়ে ওঠেন নিজেই। ট্রেনে খাবার বিক্রি করা লোকটি, সেদিন একটু বেশি বিক্রি হচ্ছে দেখেই ভেবেছিলেন এই স্টেশনে না নেমে নামবেন পরের স্টেশনে। হায় রে কপাল, একেবারেই চলে গেলেন জীবনের শেষ স্টেশনে। বেশি বিক্রি হওয়া টাকা নিয়ে ঘরে ফেরার আনন্দ টা স্বপ্নই রয়ে গেল। এত ভয়াবহতার মধ্যে, টাটকা প্রান হারানো মানুষ গুলোকে দেখে ও মনে হতাশার লেশমাত্র না এনে কিছুদল মানুষ লেগে পড়েছিলেন নিজের স্বার্থসিদ্ধির কাজে। তাঁরা ব্যস্ত সমস্ত দামি জিনিসপত্র বস্তা বস্তা করে ঘরে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। দুঃখে- কষ্টে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষগুলো কে দেখেও পর্যন্ত তাদের মানবিকতা বোধ জন্মে নি।
■ উপসংহার :-
মৃত্যু অনিবার্য। তবুও কী মানুষ চায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে। জীবনে যতই দুঃখ দুর্দশা থাকুক না কেন সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে কেউই চায় না নিজেকে হারিয়ে ফেলতে। আবার অকালে মৃত্যু, যার মতো বেদনাদায়ক আর কিছুই হতে পারে না। বিপদের সম্মুখ হয়ে ও, মানুষ প্রানপনে চেষ্টা করে নিজের জীবন রক্ষা করতে কিন্তু হাতের বাইরে চলে গেলে তো আর করার মতো কিছুই থাকে না। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কত কত মানুষ যাত্রা করছে ট্রেনে, এসব ঘটনার পর তাদের ও অনেক ভয় থাকে, সাথে থাকে নিজের গন্তব্য স্থলে পৌঁছতে পারার আশঙ্কা । কিন্তু তা সত্ত্বে ও তাদের যাত্রা করতে হয় দূরদূরান্তে।ঘরে বসে থাকলে তো আর কেউ তাদের চাহিদা পূরণ করে দেবে না। এরকম কিছু কিছু অসাবধানতা ই প্রান কেড়ে নেয় লক্ষাধিক মানুষের। সকল নাগরিকের কথা মাথায় রেখে রেল কর্তৃপক্ষের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। যাতে করে অকালে এতগুলো প্রান হারাতে না হয় । এতগুলো প্রান নিয়ে যারা ক্রমাগত চলছে তাদের কাছে সতর্কতার যেন কোনো কমতি না থাকে। মানুষ যাতে নিশ্চিত হয়ে ঘরে ফেরার দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে পারে।