বইমেলায় একদিন

কলমে- নম্রতা বিশ্বাস, এম.এ, বি.এড, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়


ভূমিকা :-
‘বই’ হল আমাদের হৃদয়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু। জ্ঞানের প্রসারের ক্ষেত্রে, আমাদের চিন্তা চেতনাকে বিকাশের জন্য বই অনেক ভাবে সাহায্য করে থাকে। বই  অনেকটা আয়নার মতো, যেখানে ধরা পরে মনের প্রতিবিম্ব। বিভিন্ন বয়সের পাঠক-পাঠিকা, বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থা, স্থানীয় বই বিক্রেতাদের সাময়িক মিলনের কেন্দ্রস্থল হলো ‘বইমেলা’। বইমেলাতে বিভিন্ন বই-এর সমাহার লক্ষ করা যায়। পৃথিবীর সকল দেশেই ‘বইমেলা’ বা ‘গ্রন্থমেলা’ হয়ে থাকে বা আয়োজন করা হয়।

বইমেলা কী :-
‘মেলা’ শব্দের অর্থ হলো মিলিত হওয়া, আর ব্যাকরণ গত উৎস খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গিয়েছে ‘মিল’ ধাতু থেকে মেলার উদ্ভব হয়েছে। বাঙালির মহামিলনের স্থান হলো মেলা। তাহলে বলাই যায় যে, যেখানে ‘বই’-এর প্রদর্শন বা বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে এবং অনেক মানুষ সেই উদ্দেশ্যে একত্র হয়ে থাকে,তাকে বলা হয় বইমেলা।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বইমেলার আয়োজন করা হয়। আমাদের কলকাতাতেও বইমেলার হয়ে থাকে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত এই বইমেলা নিজগুণে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে। বিশ্বের বৃহত্তম অবানিজ্যিক বইমেলা হলো কলকাতা বইমেলা। লন্ডন বইমেলা বা ফ্রাঙ্ক ফুর্টের মতো কলকাতা বইমেলাতেও গ্রন্থপ্রকাশনা, পরিবেশনা ও অনুবাদ সংক্রান্ত চুক্তি বা ব্যাবসাবানিজ্য চলে না। এই মেলায় প্রকাশক ও পুস্তকবিক্রেতারা  পাঠক-পাঠিকাদের তাদের প্রকাশিত বইয়ের প্রচার ও বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে মেলায় যোগ দিয়ে থাকেন। ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা’ কলকাতার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক বিশেষ স্থানের অধিকারী। বর্তমানে ‘বাঙালির চতুর্থ পার্বণ’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে উক্ত বইমেলাটিকে। প্রচুর ইংরেজি হিন্দি, উর্দু,সংস্কৃত প্রমুখ ভাষার গ্রন্থ মেলাতে পাওয়া গেলেও বাংলাবই-এর বিক্রয়ই বেশি হয়ে থাকে। সরকারি উদ্যোগেই কলকাতা বইমেলা হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে কলকাতা বইমেলা।  এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের জেলার জেলায় হয়ে থাকে বইমেলা। সাত থেকে দশদিনের মতো হয়ে থাকে এই বইমেলাগুলো । বই পড়তে উৎসাহ দেওয়ার জন্য এই মেলা উপযুক্ত।

বইমেলার প্রয়োজনীয়তা :-
বইমেলা এমনই এক উৎসব যেখানে বই-এর প্রতি পাঠকদের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। একটি দেশের সাহিত্য শিল্প সাংস্কৃতির সাথে পরিচয় ঘটে বইমেলার মাধ্যমে। তার পাশাপাশি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও জানা যায়, জানা যায় সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, ধর্মের কথা। বইমেলা হলো বিচিত্র এক জ্ঞানের সমাবেশ।
সমাজে এমন অনেকে আছে যাঁরা সবসময় বই কেনার ও পড়ার সুযোগ পাননা, কিন্তু বইমেলাতে এসে তাঁরা বিনাক্রয়েও বই পড়ার সুযোগ পেয়ে যাঁন। অন্যদিকে এখনকার দিনে বাচ্চা থেকে বয়স্ক সকলেই প্রায় সোশ্যাল মিডিয়া মোবাইলের দাস, সেখানে দাঁড়িয়ে বইমেলাই একমাত্র মাধ্যম যেখানে তাদের এই দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
বইমেলায় বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় বই যেমন পাওয়া যায় তেমনি বাচ্চাদের বই-এরও অনেক সম্ভার থাকে ঠাকুমার ঝুলি, রহস্যময় গল্পের বই, পঞ্চতন্ত্রের বই, ঈশপের গল্প, নীতিকথা মূলক গল্প, জাতকের গল্প, কমিকস্ -এর বই প্রমুখ । এছাড়া বিভিন্ন ধরনের আর্ট বই প্রজেক্টের খাতা ছড়ার বই-ও পাওয়া যায়, ফলে শিশুদের ছোটোবেলা থেকেই যদি বই-এর প্রতি আকর্ষণ গড়তে হয় তাহলে বইমেলাতে তাদের নিয়ে যাওয়াই হলো প্রথম পদক্ষেপ।

বইমেলার অভিজ্ঞতা :-
‘স্মৃতি’ এমনই এক বস্তু যেখানে নিজেকে নতুন ভাবে পাওয়া যায় । স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়েই মানুষ উদ্দীপ্ত হয় অনুপ্রাণিত হয়, মন ও মেজাজ দুটোই ভরপুর হয়ে ওঠে। তেমনি এক সুমধুর স্মৃতি হল, ৪৬তম সংস্করণের আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার স্মৃতি। উক্ত বইমেলাটি ২০২৩-এর জানুয়ারি মাসের ৩০ তারিখ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, চলেছিল ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত। সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্ক করুণাময়ী স্টেশনের পাশে এই মেলা আয়োজিত হয়েছিল। এই বছরের থিম ছিল ‘কান্ট্রি স্পেন’ ।
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকেই একদিন চলে যাই ব‌ইয়ের এই বৈচিত্র্যপূর্ণ সমারোহে, দুপুরের মধ্যেই ওখানে পৌঁছে যাই। সাত নম্বর গেট দিয়ে বইমেলার মধ্যে প্রবেশ করেই প্রথমেই দেখা পাই দূর্গামণ্ডপের উপস্থিতি। যা ‘UNESCO’ কর্তৃক দূ্র্গাপূজা উৎসবের আনুষ্ঠানিক উপস্থিতিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বীকৃতি প্রাপ্তির সম্মান জ্ঞাপনে নির্মিত হয়েছিল। এরপর একটি ম্যাপ সংগ্রহ করি যেখানে বিপণির সংখ্যা দেওয়া ছিল। অনেক বই-এর স্টলে ঘোরার পর এসে উপস্থিত হই ‘সুজন প্রকাশনী’ তে সেখান থেকে দুটি বই কিনে ফেলি। সেখান থেকে বেড়িয়ে ‘British Council’-এর স্টলে যাই । বিভিন্ন দেশের পুস্তকের বিপণি ছিল, সেখানে গিয়েও বিভিন্ন ধরণের বই-এর দেখা পাই।
বই ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের বস্তুর বিপণিও উপস্থিত ছিল, জলরঙ তেলরঙে আঁকা চিত্র, পোড়া মাটি শিল্পকর্ম, গহনার দোকান প্রভৃতি। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের মুখোরোচক খাবারের স্টলও ছিল, সেখান থেকে কিছু খাবারের রস আস্বাদন করে চলে যাই ‘দে’জ পাবলিশিং’ -এ সেখানে ছিল প্রচুর লোকের সমাগম । ‘মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স’-এও ছিল প্রচুর ভিড় অনেক কষ্টে ‘অচেনা-অজানা শান্তিনিকেতন’ নামক বইটি ক্রয় করি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনার বিপণিও ছিল বইমেলাতে। শেষে যাই ‘লালমাটি’ নামক একটি স্টলে সেখানে আঞ্চলিক সাহিত্য বিষয়ের প্রতিফলনের কোনো খামতি ছিল না। অনেক ঘোরাঘুরির পর ফিরে আসতে মন না চাইলেও বাড়ির জন্য পা বাড়িয়েছিলাম। আসার পথে চোখে পড়ে সাধারণ মানুষের মঞ্চে উঠে নাটকের বিভিন্ন ভূমিকায় তৎক্ষণাৎ অংশগ্রহণের চিত্র। আরো কতরকম সুন্দর সুন্দর দৃশ্যের দেখা পেয়েছিলাম তাঁর কোনো ঠিক নেই। বইমেলার অভূতপূর্ব দৃশ্য স্মৃতিতে এলে মনে হয় সত্যি এ যেন কোনো স্বপ্নের জগৎ।

নিজস্ব মতামত :-
বইমেলা ছোটো থেকে শুরু করে বড়োদের, সকলকের জন্য। এখানে সামাজিক ভেদাভেদ দূর হয়ে সবার মধ্যে সৃষ্টি হয় নিবিড় বন্ধন। বিখ্যাত লেখকদের স্বরচিত বইয়ে তাঁদের সাক্ষর দান, খ্যাতনামা কবিদের রচিত কবিতা আবৃত্তি স্বাভাবিক ভাবেই পাঠকদের পুলকিত করে তোলে। এছাড়া নতুন লেখকদের স্বরচিত বই প্রকাশিত হয় বইমেলাতে, তাঁদের বই প্রচারের জন্য এটি একটি অন্যতম স্থান। প্রকাশক ও বিক্রেতারাও বানিজ্যিক ভাবে লাভবান হয়ে থাকেন।
বিভিন্ন লেখকের বই-এর সাথে পরিচয় ঘটার পাশাপাশি নাট্যাভিনয়, গানবাজনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নানা বিষয় বক্তৃতা শোনার ও দেখারও স্বাদ নেওয়া যায়। বইমেলা এমনই একটি যায়গা যেখানে সবরকম সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় ঘটা সম্ভব।
আমাদের দেশে বইকে কেন্দ্র করে যে মেলা হয়ে থাকে এটি সত্যিই প্রশংসনীয় ব্যাপার কিন্তু বইমেলাতে অনেক সময় ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকার কারণে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বই-এর প্রতি আগ্রহীদের সংখ্যা নেহাত কম না হওয়ার কারণে মেলাতে সৃষ্টি হয় বহু মানুষের বিশৃঙ্খল সমাবেশ, ফলে অনেক সময় সব বই ভালো করে দেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না ।

উপসংহার :-
বই মেলাকে মানুষের চিন্তা-ভাবনার পরিমাপক হিসেবে ধরা হয়। মানুষের আদর্শ ও রুচিকে উন্নত করে তোলে বইমেলা। এই মেলার জন্য লেখকসমাজ তাদের সৃষ্টির সম্ভার নিয়ে জনগণের সামনে উপস্থিত হতে পারেন। এইভাবেই বইমেলা একসময় হয়ে ওঠে মিলনমেলা। শিক্ষা সংস্কৃতিতে সত্যিই বইমেলার অবদান অনস্বীকার্য।