ব‌ইমেলায় জীবন

কলমে: অদিতি সিংহ, স্নাতকোত্তর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়


১. ভূমিকা:
খোলা মাঠের মাঝে ভিন্ন রকমের সংস্কৃতির মানুষজন দলবদ্ধ হয় যা মেলার প্রধান উৎস। মেলা হলো বাঙালির প্রাণকেন্দ্র ও মিলন স্থান। এক সময় মেলাকে কেন্দ্র করেই বাংলার নবজাগরণ দেখা দিয়েছিল, সেটা নবগোপাল মিত্রের “হিন্দু মেলা”। বর্তমানে বইমেলাকে কেন্দ্র করেও নবজাগরণ দেখা দেয় গ্রামে ও শহরাঞ্চলে। সময় বিশেষে মানুষের মনের ভাব পরিবর্তিত হতে থাকে। সেইসব অব্যক্ত কথাগুলো নিজের মনের মত লিখে রাখা হয়, যা পরবর্তীতে এক বইয়ের আকার ধারণ করে। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর মতে, “গাছে প্রাণ আছে” ঠিক সেই মতে যদি ধরা হয় “বইতেও প্রাণ আছে”। শুধুমাত্র বেড়ে ওঠা ও হাঁটতে-চলতে পারলেই প্রাণ সঞ্চার হয় না, যাকে পাঠরত করে মানুষের বুদ্ধির সঞ্চার ঘটে তাতে তো অবশ্যই প্রাণের অস্তিত্ব মেলে।

২. ব‌ই কী?
জ্ঞানের বৃদ্ধি করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম “বইমেলা”। ৮ থেকে ৮০ সবাই বইয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়। বই পড়লে কোনদিন ক্ষতি হবে না, বরং আরো ভালো হবে। শিশুর বেড়ে ওঠা থেকে শৈশব-যৌবন, সবটা পার হয়ে আসে বই মুখর হয়ে। তাই বিদেশের প্রতিটি স্থানে বইমেলার প্রদর্শনী হয়ে থাকে। শিক্ষিত মানুষের বেঁচে থাকা দর্শন হলো বই। বই মানুষকে নিরাশ করে না বরং জ্ঞানের ভান্ডার বাড়ায়। বই হল এমন এক মাধ্যম যা মানুষের পরম বন্ধু। বই আয়নার মতো যা ভবিষ্যতে প্রতিবিম্ব রূপে কাজ করে, এবং আমাদের নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোকে ভরিয়ে তোলে।

৩. বইমেলা কী?
খোলা মাঠের প্রাঙ্গণে ভিন্ন সংস্কৃতিক ও ভিন্ন ভাষার বইয়ের সঞ্চার ঘটে, যা বইমেলা নামে প্রচলিত।ইংল্যান্ড, জার্মান, আমেরিকা প্রভৃতি স্থানে প্রতি বছর জাতীয় বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে একক স্বতন্ত্র মেলার রূপে কলকাতায় বইমেলার প্রচলন শুরু করা হয়। অন্যদিকে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২০শে ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের ঢাকায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত হল প্রথম বাংলাদেশ বই মেলা। মাত্র এই কয়েক দশকেই বইমেলা বাঙালির প্রাণের এবং গৌরবের বিষয় হয়ে উঠেছে। বঙ্গ সংস্কৃতির এই নব সংযোজন দেশের জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক  প্রশংসা অর্জন করেছে।  

৪. পশ্চিমবঙ্গের বইমেলা:
পৃথিবীর সব দেশেই বর্তমানে বইমেলা বসে। ঠিক তেমন ভারতের সব রাজ্যে বইমেলা নিজের স্থানাধিকার করেছে। এইসবের থেকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ কেন পিছিয়ে থাকবে, তাই পশ্চিমবঙ্গে এক বিপুল পরিমাণে বইমেলার উন্নতি দেখা দিয়েছে। সরকারি উদ্যোগে এবং সমস্তবিধি মেনে এই মেলা কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলেও বইমেলা হয়। প্রথমত যে সমস্ত পাঠক সচরাচর বই পড়ার তেমন সুযোগ পায় না, তারাও বইমেলায় এসে নিজের পছন্দ মত বই পড়তে পারে। কলকাতার বইমেলা প্রায় দু-যুগ ধরে চলে আসছে, বই পড়ার উৎসাহ বাড়ানোর জন্য বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক নামিদামি লেখক এর হাত থেকে বইমেলা উদ্বোধন করা হয়েছিল। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কয়েক বছর ধরে কলকাতা বইমেলা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করে চলেছে।

৫. ব‌ইমেলার প্রয়োজনীয়তা:
● জীবন সম্মুখের এক অন্যতম মাধ্যম হলো বই।
● শিশু-কিশোর এর কাছে বই দিক নির্দেশক।
● সব বয়সী মানুষের কাছে বই পরম বন্ধু।
● বইমেলার মাধ্যমে ভিন্ন ভাষার বই-এর সন্ধান মিলে।
● মন মত নিজের পছন্দ সহিত বই সংগ্রহ করা যায়।
● বইমেলার মাধ্যমে সামাজিক মেলবন্ধন করে ওঠে।
● নতুনদের নিজের লেখা প্রকাশ করার একটা মাধ্যম হয়।
● বইমেলা প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একত্রে অনেক মানুষকে আনা যায়।
● প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতারা বিশ্বের নানা ভাষা ও নানা ধরনের বই একত্রে আনার চেষ্টা করেন।
● বইমেলা অসীম জ্ঞানের ভান্ডার কে সকলের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়।
● শুধুমাত্র পাঠকের জ্ঞানভাণ্ডার বাড়ে হয় এমনটা নয়, এক বিপুল পরিমাণে ব্যবসা বাণিজ্যের সম্মুখীন হয় প্রকাশক ও বিক্রেতারা।
● নতুন লেখকদের সুযোগ করে দেওয়া।
● সম্পাদকদের নতুন কাজের সন্ধান করে দেওয়া।
● নামকরা বিভিন্ন লেখকদের সান্নিধ্য পাওয়া।
● একাকীত্ব দূর করে, নতুনের সঙ্গে পরিচয় ঘটায়।
● পারস্পরিক ভাব বিনিময় করে থাকে বইমেলা।

৬. ব‌ইমেলার অভিজ্ঞতা:
সকলের চোখে বইমেলা দেখার দৃষ্টিভঙ্গি একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কেউ নতুন বইয়ের সন্ধানে যায় আবার কেউ পুরনো বইয়ের সন্ধানে থাকে। কেউ কেউ তো আবার শুধু বইয়েরসূচি জমা করতে যায় কিংবা বুকমার্ক। একটা খোলা মাঠ যেখানে বয়স নির্ধারণ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের বই থাকে। নতুন যারা লেখালেখি শুরু করেছে তারা নিজের পরিচয় এর স্থান পায়। ভিন্নধর্মী মানুষ একত্র হয়ে নিজেদের পরিচয় এর আদান-প্রদান করেন।

৭. নিজস্ব মতামত:
যে সমস্ত শিশুরা সবেমাত্র হাঁটতে চলতে কিংবা পড়তে শিখেছে, তাদের জন্য এই বইমেলা আদর্শ রূপে কাজ করে। শুধুমাত্র জানা ও শেখার আগ্রহ নিয়েই পাঠকের ভিড় ক্রমাগত বেড়ে চলে। ভিন্ন সংস্কৃতি মানুষের পরিচয় এর মেলবন্ধন হয় এই বইমেলা। এটা যেমন ব‌ই তথা ব‌ইমেলার সদর্থক দিক আমার কিছু নেতিবাচক দিক‌ও আছে।
বইয়ের সমাহারের মাঝে পরিবেশ সচেতনতা কোথাও যেন মাঝেমধ্যে হারিয়ে যায়। বইমেলার প্রাঙ্গণে বইয়ের দোকান ছাড়াও খাবারের দোকান উপস্থিত থাকে, সেখানের আবর্জনা নোংরা অনেক সময় মাঠে পড়ে থাকতে দেখা যায়। অনেক সময় বইমেলায় এসে খবরের কাগজ পেতে মাঠে বসে থাকে এবং পরবর্তীতে নিজেদের আসন পরিত্যাগ করতে ভুলে যায়।

৮. উপসংহার:
আমাদের দেশেও বর্তমানে বইমেলার জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি অনেকাংশে গ্রন্থাগারগুলি বইমেলা থেকে বই সংগ্রহ করে কিনছে। জেলা গ্রন্থাগারগুলির ক্ষেত্রে এরকম সরকারি নির্দেশ রয়েছে।

তাছাড়া বই আমাদের জ্ঞানের ভান্ডার কে ক্রমশ বৃদ্ধি করে জানার আগ্রহকে বাড়িয়ে তোলে। সভ্যতার ধারাবাহিকতা রক্ষায় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সংরক্ষণের, সমাজ ও ব্যক্তির মুক্তি সাধনে মানুষের জীবনের লক্ষ্য, ব্যক্তি মনের সর্বপ্রকার সংকীর্ণতাকে উন্নত ও উচ্চতর ভাবলোকে প্রতিষ্ঠিত করে। শুধু তাই নয় ব্যক্তিসত্তা থেকে বেরিয়ে সমাজের মানুষের সঙ্গে সুন্দরের সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় বইমেলার প্রভাব অনস্বীকার্য।