চরিত্র গঠনে খেলাধূলার ভূমিকা


ভূমিকা –
      ছাত্র জীবন স্বপ্নময়। এই পর্বেই জীবনের শুভ আর আশাবাদের দিকগুলি বিকশিত হয়ে ওঠে ছাত্র দের  সামনে। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শৃঙ্খলা, লড়াই করার মানসিকতা, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা, সুস্থ নীরোগ শরীর সবই গড়ে ওঠে এই সময়। আর গুণগুলি তৈরি হবার শ্রেষ্ঠ স্থান খেলার মাঠ। তাই ছাত্র জীবনে খেলাধূলার ভূমিকা সর্বাধিক।
      মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে বেড়েছে মানুষের ব্যস্ততা। মানুষ তার জীবনের মান উন্নয়নের জন্য সব সময়ই হচ্ছে ক্লান্ত। প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছে অধিক সাফল্যের পেছনে। মানুষের এই কর্মময় জীবনে তাকে একটুখানি বিরতি এনে দেয় খেলাধূলা। জীবনের সাথে সংগ্রামরত মানুষকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য জীবনকে উপভোগ করতে শেখায় এই খেলাধূলা। মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধূলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেলাধূলা একদিকে মানুষকে যেমন শক্তি ও সাহস দেয় অন্যদিকে তা প্রেরণারও উৎস। নিয়মিত ও পরিমিত খেলাধূলা মানুষকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে। খেলাধূলার জয় পরাজয় থেকে মানুষ খুব সহজে জীবনের জয়-পরাজয়গুলোকেও মেনে নিতে শেখে।
      মানসিক বিকাশের জন্য যেমন পড়াশুনা দরকার, তেমনি শারীরিক বিকাশের জন্য চাই খেলাধূলা। খেলাধূলায় যে কেবল শরীরের বিকাশ ঘটে তা নয়, খেলাধূলায় মনোনিবেশ, শৃঙ্খলাবোধ ও সহযোগিতার মনোভাবও গড়ে ওঠে। আমরা কোনো কিছুতে ব্যর্থ হলে হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু খেলায় হারলে কেউ হতাশ হই না, বরং পরের বার জেতার জন্য চেষ্টা করি। ব্যর্থতায় যে নৈরাশ্যবোধ আসে, খেলাধূলায় যারা অভ্যস্ত তারা সহজেই এই নৈরাশ্যবোধকে কাটিয়ে ওঠে। চলতি কথায় একে বলে খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব। খেলা দুরকম হতে পারে। একরকম খেলা ঘরের বাইরে খেলতে হয়, যেমন- ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেটবল, হকি, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, কবাডি ইত্যাদি। আর একরকম খেলা ঘরের ভেতর খেলতে হয়, যেমন—লুডো, তাস, পাশা, দাবা, টেবল টেনিস ইত্যাদি। খেলাধূলা বললে ধূলার সঙ্গে খেলার সম্পর্কের কথা এসে যায়। অর্থাৎ খেলাধূলা বলতে ঘরের বাইরের খেলাকেই প্রধানত বোঝায়। খেলাধূলায় শারীরিক শ্রম হয় প্রচুর। ফলে দেহ যেমন বলিষ্ঠ ও সুগঠিত হয়, তেমনি ক্ষুধা ও পরিপাক শক্তিও বৃদ্ধি পায়। তবে সুখাদ্যও যেমন অত্যধিক খেলে শরীরের ক্ষতি করে, তেমনি অত্যধিক পরিমাণে খেলাধূলা করলেও শরীরের ক্ষতি হয়।

“Health is wealth”

সভ্যতার আদিতে মানুষ যে বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্ব দিত সেটি হচ্ছে তার স্বাস্থ্য। কারণ মানুষ জানত সুস্থ সবল স্বাস্থ্য ছাড়া কোনো কাজই করা যায় না। সে যখনই খাদ্যের সন্ধান করেছে তখনই সে স্বাস্থ্যের কথাকে উপেক্ষা করেনি। তাই এর আকর্ষণ কারও কাছেই কম নয়। যাই হোক খেলাধূলা সেই শরীর ও মন গঠনের অন্যতম উপায় বলে স্বীকৃত। খেলাধূলা মানুষকে অসাধারণ মনের উপযোগী করে গড়ে তোলে। আর সেই মন নিয়ে মানুষ জীবনের চরম সাফল্যকে জয় করতে পারে অনায়াসে। সে ভয় পায় না। জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার মানসিকতাও তার মধ্য থেকেই জন্মলাভ করে। এছাড়াও খেলাধূলার মধ্যে থেকেই ভ্রাতৃত্ববোধের জন্ম নেয়। খেলাধূলা মানুষে মানুষে বন্ধনকে দৃঢ় করে, প্রত্যয় আনে, প্রীতির সম্পর্ককে বাড়িয়ে তোলে। আর সেই চেতনাই বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের যে জন্ম দেবে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।

খেলাধূলার উদ্ভব ও বিকাশ –
      সভ্যতা শুরুর কিছুকাল পর থেকেই খেলাধূলার উদ্ভব হয় এবং ধীরে ধীরে তা ক্রমবিকাশ লাভ করে, এখনো করছে। অনেকে মনে করেন প্রাচীন মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ বর্তমান ইরাকে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ বছরেরও আগে প্রথম খেলার সূচনা হয়। আর তা হলো কুস্তি খেলা। একই সময়ে মুষ্টিযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ ও দৌড়ের মতো খেলাগুলোরও জন্ম হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে মিশরে খেলা হিসেবে শিকারের প্রচলন ছিল। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ এর দিকে মল্লযুদ্ধের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে প্রাচীন গ্রিসের অলিম্পিকের সূত্রপাত হলো খেলাধূলার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। সেই অলিম্পিকই নতুন রূপে এখনও বিশ্বের সর্ববৃহৎ খেলাধূলার আসরের নাম। এখন সারাবিশ্বে বিভিন্ন ধরণের খেলা প্রচলিত। পোলো, স্কেটিং, সাঁতার, টেনিস, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল, রাগবি, হ্যান্ডবলসহ বিভিন্ন খেলা নানা দেশে জন্ম নিয়েছে।

শরীরচর্চার উপযোগিতা –
         মানুষের প্রথম পরিচয় যে শরীর তা নানাভাবে বোঝা যায়। ভূমিষ্ঠ হবার পর যে কোনো শিশুর তাই প্রথম শরীরের যত্ন নেওয়া শুরু হয়। কারণ এটা প্রতিটি মানুষই জানে অসুস্থ দুর্বল দেহ কখনও সুস্থ মনের অধিকারী হতে পারে না। শরীর শীর্ণকায় হলে মেজাজ বড়ো অস্থির হয়। কোনো কিছুই সহনীয় হয় না। পরিশ্রমের ক্ষমতাও বড়ো কম হয়। প্রতিটি পদক্ষেপে ভয় তার মনে আশ্রয় করে। কিন্তু একজন সুস্থ সবল দেহধারী মানুষ কোনো কিছুকেই ভয় পায় না। তার মনে দুর্বার মনোবল কাজ করে। সে একটার পর একটা সাফল্য পায়। আরও এগিয়ে যেতে পারে নিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।  তবে এই শরীরচর্চার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে এবং তার প্রকারভেদ ও বর্তমান। সব বয়সে বা সব সময়ে সব রকমের শরীরচর্চা উচিত নয়। সেটা নিশ্চয়ই বৈজ্ঞানিক, হবে এটা আশা করা যায়। আর তাছাড়া নিয়মিত শরীরচর্চা যেমন একান্ত প্রয়োজন তেমনি তার জন্য নির্দিষ্ট খাদ্যেরও প্রয়োজন হয় অবশ্যই। তবে এটা ঠিক শরীরচর্চার উপযোগিতা নিশ্চয়ই দেখা যায় যখন সে প্রকৃষ্ট সময়ে প্রকৃষ্ট উপায়ে তাকে কাজে লাগাতে পারে। প্রকৃষ্ট শরীরচর্চা অনুশীলন ও যত্নের মানসিকতাও গড়ে তোলে মানুষের মধ্যে।
         খেলাধূলার সঙ্গে শরীর গঠনের একটা ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। শরীর যদি ঠিকভাবে গড়ে না ওঠে তাহলে মনের গঠনও ঠিকমতো হয় না। কথায় বলে মনই শরীর। তাই শরীর ঠিক রাখতে হলে নিয়মিত খেলাধূলা করা দরকার। আবার একথাও মনে রাখতে হবে যে, অতিরিক্ত খেলাধূলা করাও শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক। শিশুদের তো এই কথাটি বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত। কারণ আমরা জানি যে, স্বাস্থ্যই সম্পদ। স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে ভবিষ্যৎকে ঠিকভাবে গড়ে তোলা যায় না। কোনো বাধাবিঘ্নের সামনে নিজেকে অসহায় মনে হবে এবং মনের জোর কমে যাবে। কোনো কিছুই নিজের ইচ্ছামতো করাকেই বলা হয় খেলা। সে ফুটবল খেলাই হোক, ব্যায়াম করাই হোক আর হা-ডু-ডু খেলাই হোক। বড়োরা যে খেলায় মনে আনন্দ পান, যেমন– তাস খেলা বা পাশা খেলা, ছোটোদের সে খেলায় ততটা উৎসাহী হওয়া উচিত নয়। দৈহিক পরিশ্রমে যেসব খেলা হয় সেইসব খেলাই খেলা উচিত। এর ফলে প্রচুর পরিমাণে বিশ্রামের দরকার, আর দরকার কিছু পুষ্টিকর খাবার। খেলাধূলা যেমন শৃঙ্খলাবোধ শেখায়, তেমনি আবার মনের বিকাশও ঘটায়।

শৃঙ্খলাবোধ ও চরিত্র গঠন –
       এটা ঠিক, শৃঙ্খলাবোধ যে কোনো দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। তাই ছোটোবেলা থেকেই মানুষকে শৃঙ্খলাবোধ শেখানো হয়, আদর্শ নাগরিক তৈরি করার জন্য। আর বোধ করি খেলাধূলাই হচ্ছে তার প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র যেখান থেকে শৃঙ্খলাবোধের চরম উন্মেষ ঘটে। তাকে উপলব্ধি করা যায়। সমষ্টিবোধ জেগে ওঠে এই প্রাঙ্গণ থেকেই। মানুষের ঐক্য চেতনাই সমষ্টি কল্যাণের সহায়ক হয়। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে সেখানে ব্যক্তিস্বার্থ নয় সমষ্টি স্বার্থকেই বড়ো করে উপলব্ধি করা দরকার। যখন খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষকে জয় করার প্রচেষ্টায় দলগত ঐক্যকে একত্রে উৎসর্গ করে তখনই বোধ করি তার চরম বিকাশ উপলব্ধি করা যায়। খেলাধূলা মানুষকে শিষ্টতা দান করে। পরকে সহা করার যে সহনীয়তা তাও খেলাধূলা থেকেই পাওয়া যায়। খেলার মাঠে ‘Sports man spirit’ কথাটা খুব শোনা যায়। কথাটার অর্থই হচ্ছে খেলোয়াড় সুলভ মন নিয়ে সব কিছুকে মেনে নেওয়া।  খেলাধূলা তাই শুধু শরীর গঠনই করে না, স্বভাব চরিত্রও গঠন করে। খেলাধূলার সংযম শাসনে জীবনে শৃঙ্খলা অনেক সাহায্য করে। খেলাধূলা সংকল্পগঠনের দৃঢ়তা আনে, প্রতিযোগিতার একাগ্রতা আনে। পরাজয় স্বীকারের মন নিয়ে সামাজিক হবার প্রবণতাও গড়ে তোলে নিশ্চিতভাবে। বহুকাল ধরে আমাদের মনুষ্য সমাজের দেহে মনে জমে উঠেছে অনেক ক্লেদ ও গ্লানি। খেলাধূলা তাকে অনেকটাই দূর করে। আর গড়ে তোলে এক সুস্থ নির্মল মানসিকতা। তাই খেলাধূলাকে শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে ধরলেও খুব একটা ভুল হবে না।

খেলাধূলা ও শিক্ষা –
      “Education is the manifestation of perfection” যদি হয় তবে সেই perfection বা পরিপূর্ণতা অবশ্যই শিক্ষাদান করে। আর সেই শিক্ষা খেলাধূলা থেকেই আসে। মহাত্মা গান্ধি যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন তখন একটি বিদ্যালয় স্থাপনের কালে তাঁর সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে ছাত্রদের জন্য একটা কথা বলেছিলেন, যেটা খুবই  জরুরি বলে মনে হয়। তিনি বলেছিলেন, ছাত্রদের শিক্ষা তখনই পরিপূর্ণ হয় যখন দুটি শিক্ষা একত্র বদ্ধ হয়। সে দুটি শিক্ষা হল— Physical training and spiritualtraining। আমাদের আলোচনার বিষয় Physical training বা দৈহিক শিক্ষা। অবশ্য এমন একদিন ছিল যখন শিক্ষার সঙ্গে খেলাধূলার সম্পর্ক একেবারেই ছিল না। কিন্তু আজ সেদিন আর নেই। যুগের পরিবর্তন হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এসেছে। তাই শিক্ষা যুক্ত হয়েছে খেলাধূলার
সঙ্গে আর খেলাধূলা যুক্ত হয়েছে শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে।

জাতীয়তাবোধ তৈরিতে খেলাধূলা –
      খেলাধূলা মানুষের ভেতর জাতীয়তাবোধ তৈরি করে। কারণ খেলাধূলা এমন একটি বিষয় যা একটি দেশের সকল মানুষকে এক বিন্দুতে এনে দাঁড় করাতে পারে । আমরা আমাদের নিজেদেরকেই এর উদাহরণ হিসেবে আনতে পারি। আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের যেকোনো খেলায়, তাদের সাফল্যে, ব্যর্থতায়, জয়-পরাজয়ে আমরা সবাই এক হয়ে যাই। ধর্ম, বর্ণ, জাত, রাজনৈতিক পরিচয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা এক পতাকার নিচে চলে আসি । নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা, টান উপলব্ধি করি। যখন একজন খেলোয়াড় অন্য দেশের বিরুদ্ধে খেলতে নামে তখন সে তার দেশের সকল মানুষের আশা- আকাঙ্ক্ষা কে হাতের মুঠোয় নিয়ে নামে । ফলে তার খেলার মধ্যে তার জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠে ।

বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ তৈরিতে খেলাধূলা –
      অতীতকাল থেকেই একটি দেশের সাথে অন্য একটি দেশের সুসম্পর্ক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে খেলাধূলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান সময়েও বিশ্বভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিতে খেলাধূলা কার্যকর একটি মাধ্যম। আন্তর্জাতিক পরিমলে আয়োজিত বিভিন্ন খেলাধূলা যেমন, আন্তঃদেশীয় টুর্নামেন্ট, দ্বি-জাতীয় অথবা বহুজাতীয় সিরিজ, অলিম্পিক গেমস, ফুটবল, ক্রিকেট, হকি বিশ্বকাপ প্রভৃতির ফলে একদেশের মানুষের সাথে অন্য দেশের মানুষের যোগাযোগ বাড়ে, জানাশোনা বাড়ে । মানুষে মানুষে বিভিন্ন সম্পর্ক তৈরি হয় । এমনকি দুটি দেশের মধ্যে চলমান কোনো দ্বন্দ্ব বা সংকট নিরসনে ও বন্ধুত্ব তৈরির লক্ষ্যে অনেক সময় সেই দেশ দুটির মধ্যে নানা রকম খেলার আয়োজন করা হয় । খেলাধূলা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন করে। কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রিসভার সদস্য যখন অন্য কোনো দেশে নিজের দলের খেলা দেখতে যান তখন স্বাভাবিক নিয়মেই দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক গাঢ় হয় । ফলে দুটি দেশের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় ভ্রাতৃত্ববোধ ।

খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক বিনিময় –
     খেলার মাঠ পুরো বিশ্বকে এক জায়গায় নিয়ে আসে । একটি দেশের দল শুধু খেলাধূলাই করে না বরং ঐ দেশের প্রতিনিধি হয়ে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেও সকলের সামনে উপস্থাপন করে । যে দেশগুলো খেলার আসরের আয়োজন করে তারা পুরোদমে নিজেদের সংস্কৃতিকে গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরে । এর ফলে তার দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অন্যদেশের মানুষের কাছে পরিচিতি পায় । কিছু সাংস্কৃতিক বিষয় মানুষের মধ্যে অনুকরণীয় ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে এসময় মেলবন্ধন তৈরি হয় বলে তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান হয় ।

অতিরিক্ত খেলাধূলার কুফল –
     অতিরিক্ত কোনো কিছুই মানুষের জন্য ভালো নয়। অতিরিক্ত খেলাধূলা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে । অনেক সময় শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা রেখে শুধুমাত্র খেলাধূলায় মগ্ন হয়ে পড়ে। এতে করে তাদের শিক্ষাজীবন ব্যহত হয় । অতিরিক্ত খেলার ফলে সময়, অর্থ, শ্রমের অপচয় হয়। খেলার নেশায় কারো কারো জীবন থেকে মূল্যবান বিষয় হারিয়ে যায় । আবার খেলাধূলায় অতিরিক্ত উত্তেজনা কারো কারো শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হয় ।

বর্তমান পরিস্থিতি ও খেলাধূলার প্রাসঙ্গিকতা –
        “ছুটবো খেলবো হাসবো, সবারে ভালাবাসবো -এই হল শৈশব, কৈশোরের আসল কথা। নিছক পুস্তকনির্ভর শৈশব কখনও ভালো হতে পারে না। তা জীবনের সর্বস্তরে বিপদ ডেকে আনে। বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ মানুষের জীবনকে সম্পূর্ণ করে, সঠিক ভারসাম্য এনে দেয়। তাই আমরা কেউই শুধুমাত্র ‘বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই” চাই না। আমরা চাই পূর্ণ মানুষ। যে বুদ্ধি, বিদ্যা, জ্ঞান, শক্তি ও দূরদর্শিতায় নিজেকে ভরিয়ে তুলবে, আর হবে নীরোগ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। আর তাই খেলাধূলা চিরপ্রাসঙ্গিক।
      তবে, সমস্তটা জেনে বুঝেও আজ আমাদের সমাজ ছুটছে এক ভুল পথে। বাবা-মা সবাই মিলে দিনরাত শিশুকে আবদ্ধ করছেন পড়াশোনায়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা না করলে শিশুটি নাকি পিছিয়ে পড়বে। আসলে যে তা সঠিক ভাবনা নয় তা অভিভাবকেরা বুঝতে পারবেন নিজেদের জীবনের সাফল্যের দিকে তাকালেই। তারাও কিন্তু শৈশব কৈশোর কাটিয়েছেন পড়াশোনার পাশাপাশি প্রচুর খেলাধূলা ও আনন্দের মধ্যে দিয়ে। আজও তাই প্রয়োজন। অন্যথায় শিশুরা দুর্বলচিত্ত, রোগগ্রস্ত, স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়বে। যা কখনোই কাম্য নয়। কারণ, এই ধরনের মানুষের দ্বারা কখনও পরিবার, সমাজ বা জাতির মঙ্গল হয় না। তারা শুধু সমস্যাই বাড়িয়ে তোলে।

মুক্তির উপায় : খেলাধূলার মাধ‍্যমে শিক্ষা –
        প্রাথমিক স্তর থেকেই ছাত্রছাত্রীকে খেলাধূলায় উৎসাহ দিতে হবে। পাঠ্যসূচিতে রাখতে হবে শারীরশিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধান। অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
    খেলাধূলার মাধ‍্যমে শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে জোর দিতে হবে। আর চাই খেলার মাঠ। সরকারি স্তরে এ বিষয়ক আইন প্রণয়ন করতে হবে, প্রত্যেক বিদ্যালয়ের জন্য যেন খেলার মাঠের ব্যবস্থা থকে। আমাদের জাতীয় ” শিক্ষানীতি ” অনুসারে শিক্ষা প্রসারের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ জরুরি। বিদ্যালয়গুলিতে শুধু খেলার ক্লাসই নয়। মাঝেমাঝে বিভিন্ন খেলায় কৃতী, বিখ্যাত খেলোয়াড়দের বিদ্যালয়গুলিতে আমন্ত্রণ করে আলোচনা সভার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে উৎসাহিত হবে ছাত্ররা। ছাত্রদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পড়াশোনার সঙ্গে সমমর্যাদা দিতে হবে খেলাধূলাকে।

উপসংহার –
       খেলাধূলার সঙ্গে নানা ধরনের প্রতিভার সম্পর্ক আজ বর্তমান। খেলাধূলা নিজেকে মহিমান্বিত করে, জাতিকে উদ্‌বুদ্ধ করে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায় সাফল্যের দিকে। ক্ষুদ্রতাকে দূরে সরিয়ে রেখে পৌরুষের পদচিহ্ন এনে দেয় মানুষের মনে। দৃঢ় করে তার আগামী পদক্ষেপ। তাই কবিগুরুর কথা স্মরণে আনতে হয়, “চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু, সাহস বিস্তৃত বক্ষপট।”
        অতীতে মানুষ তার নিজের আনন্দ খোঁজার জন্যই খেলাধূলার আবিষ্কার করেছে। খেলাধূলা যেমন নির্মল আনন্দ দেয় তেমনি জীবনকে উপভোগ্য করে তোলে। শুধু তাই নয় খেলাধূলা ব্যক্তিকে নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ এনে দেয় । মানুষকে বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে । পারস্পরিক তিক্ততা দূর করে মনে প্রশান্তি এনে দেয়। খেলার মাধ্যমে খেলোয়াড়রা দেশের প্রতিনিধি হয়ে বিশ্বের কাছে নিজের দেশকে উপস্থাপন করে। দেশের জন্য সুনাম ও সম্মান বয়ে নিয়ে আসে । তাই এখন জাতীয় জীবনে খেলাধূলার ভূমিকা অপরিসীম ।
       খেলাধূলার মাধ্যমেই একটি জাতির চরিত্র গঠিত হয়। স্বদেশি আন্দোলনের যুগে বিপ্লবীরা লাঠিখেলা, কুস্তি, ব্যায়াম ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরচর্চা করতেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত বসত কুস্তির আসর। রবীন্দ্রনাথ নিজে কুস্তি করতেন। স্বামী বিবেকানন্দ বেশ কিছুদিন কলকাতার ক্লাবে ফুটবল খেলেছিলেন — শুনে অবাক লাগলেও একথা সত্যি। তাই খেলাধূলাকে বাদ দিয়ে আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে না। বিদ্যার্জনের সঙ্গে সঙ্গে খেলাধূলাই পারে আমাদের যথার্থ শিক্ষার আলোকবৃত্তে নিয়ে যেতে।