॥ সংবাদপত্র পাঠের প্রয়োজনীয়তা ॥


ভূমিকা –
            নিত্যদিন সারাবিশ্বে নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে। সেসব ঘটনা-দুর্ঘটনা সম্পর্কে আমরা জানতে চাই বা জানতে পারি। আর তা-ই হলো খবর বা সংবাদ। যেসব উপকরণ মানবজীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত করেছে তার অন্যতম হচ্ছে সংবাদপত্র। আধুনিক জীবনে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিহার্য। সংবাদপত্র যে কেবল সংবাদ পরিবেশন করে তা নয়, জনমতের প্রতিফলন ও জনমত গঠনেও সংবাদপত্রের রয়েছে ইতিবাচক ভূমিকা। গণতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার সংবাদপত্রকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে সংবাদপত্র বহু দল ও মতের ধারক-বাহক হিসেবেও কাজ করে। এভাবে সংবাদপত্র সরকার ও জনগনের মধ্যে রচনা করে সেতুবন্ধন। কাজ করে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে।
আধুনিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ বাহন সংবাদপত্র। সংবাদপত্র সমস্ত বিশ্বের নতুন নতুন খবর নিয়ে প্রতিদিন সকালে আমাদের দ্বারা প্রান্তে এসে হাজির হয়। গণতান্ত্রিক যে কোনো দেশে তা সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজের দর্পণ। সমাজ গঠনে সংবাদপত্র শক্তিশালী গণমাধ্যম। জনমতের প্রতিফলনে ও জনমত গঠনে সংবাদপত্র পালন করে শক্তিশালী ভূমিকা, গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বহু দল ও মতের ধারক- বাহক হিসেবে সংবাদপত্র সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে।
     এখনকার যুগকে আমরা সহজেই বিজ্ঞাপনের যুগ বলতে পারি। সারা পৃথিবী জুড়ে গণমাধ্যমের ব্যাপক চাহিদা ও জনপ্রিয়তা সভ্যতাকে একটি নতুন পথের পথিক করে তুলেছে।
       ভারতেও গণমাধ্যম তার উপযুক্ত প্রভাব বিস্তার করেছে। এখন থেকে নিয়ত আমরা গণমাধ্যমের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি। এই প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের প্রসার, তার উদ্ভব ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোকপাত করা উচিত।
       সংবাদপত্র, আকাশবাণী, দূরদর্শন প্রভৃতি মাধ্যমকে গণমাধ্যম বলা হয়ে থাকে।কেননা, এইসব মাধ্যমগুলি জনগণের একটি বৃহৎ অংশকে নানাভাবেপ্রভাবিত করতে পারে।

সংবাদপত্র কী ?
      প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, বিরহ- ব্যথার বার্তা বহন করে যে কাগজটি ভোর হতে না হতেই আমাদের দ্বারে প্রবেশ করে, তার নাম সংবাদপত্র। প্রতিদিন সারা বিশ্বের বার্তাসহ কাগজখানি আমাদের দ্বারে দ্বারে উপনীত হয় বলে, মানবজীবনের সঙ্গে সংবাদপত্রের এত বেশি সম্পৃক্ততা যে সংবাদপত্র ছাড়া আধুনিক জনজীবন অচল হয়ে পড়ার উপক্রম হয়, বিশ্বের সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সংবাদপত্র হল সারা বিশ্বের একটা দর্পণ স্বরূপ। বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে এক পলকে ভেসে ওঠে আমাদের চোখের সামনে সংবাদপত্রের মাধ্যমে। অতি অল্প পয়সায় এর মত প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান বস্তু দ্বিতীয়টি আর নেই, এর সম্পর্কে সঙ্গত কারণেই বলা হয় “Newspaper is the storehouse of knowledge.” আধুনিককালে এটি সুস্থ গণতান্ত্রিক দেশের দর্পণ। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বহু দল ও মতের ধারক-বাহক হিসেবে সংবাদপত্র সরকার ও জনগণের রচনা করে সেতুবন্ধন।

সংবাদপত্র আবির্ভাবের ইতিহাস:
       সময়ের প্রয়োজনে আর্বিভাব ঘটেছে সংবাদপত্রের । সংবাদপত্রের প্রচলন প্রথম কোন দেশের শুরু হয তার সঠিক প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে জানা যায়, কগজ আবিষ্কারের পর একাদশ শতাব্দীতে চীনদেশে সর্বপ্রথম সংবাদপত্রের প্রচলন হয়। ভারতে মুঘল শাসন আমলে হাতে লেখা সংবাদপত্রের প্রচলন হয় ভেনিসে। তারপর রানি  এলিজাবেথের সময় ইংল্যান্ডে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ভারত উপমহাদেশে ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় ১৭৪৪ সালে। ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র সাপ্তাহিক সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হয়। তারপর ১৮২২ সালে সাপ্তাহিক সমাচার চন্দ্রিকা ১৮২৯ সালে সাপ্তাহিক ‘ বঙ্গদূত এবং ১৮৩৯ সালে সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর, ১৯২৩ সালে কল্লোল ১৯৪১ সালে সবুজপত্র প্রকাশের মধ্যে দিয়ে সংবাদপত্রের ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়ে উঠে।

সংবাদপত্রের প্রকারভেদ –
        প্রকাশের বৈশিষ্ট্য অনুসারে সংবাদপত্র নানা প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন: দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও বার্ষিক। তবে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক সংবাদ পত্রগুলোর মধ্যে সংবাদের চেয়ে গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনা, বৈজ্ঞানিক আলোচনা ইত্যাদি বেশি থাকে।

পৃথিবীর বিভিন্ন সংবাদ প্রতিষ্ঠান –
       গোটা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠান টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে পৃথিবীর সর্বত্র সংবাদ প্রচার করতে পারে। পৃথিবীর বৃহত্তর সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নাম রয়টার্স। বাংলাদেশের বড় সংবাদ সংগ্রহ ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ‘বাগল’ বা “বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থা” এছাড়া রয়েছে ইউ. এন. বি., এনা, ইরনা, এপিপি, পিটিআই ইত্যাদি।
        সংবাদপত্রের পরিধি বা পরিসর বর্তমানে ব্যাপক। আধুনিক সংবাদপত্রের পরিধি কেবল সংবাদ পরিবেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা সংবাদ ছাড়াও তা পরিবেশন করে বিচিত্র তথ্য প্রতিবেদন। শিল্প-সাহিত্যের আলোচনা, গণবিজ্ঞানের নানা তথ্য এবং সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও বিনোদন জগৎতে বিচিত্র কর্মধারা এখন সংবাদপত্রের  বিষয় হয়ে উঠেছে।

সংবাদ সংগ্রহ –
       সংবাদ সংগ্রহের জন্যে সারা বিশ্বে উপযোগী ব্যবস্থা রয়েছে। বিশেষ বিশেষ বার্তা সংস্থা সংবাদ সংগ্রহ করে সংবাদপত্রের জন্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। টেলিপ্রিন্টার যন্ত্রের সাহায্যে পত্রিকা অফিসে সংবাদ গ্রহণ করা হয়। সাম্প্রতিককালে সংবাদ আদান-প্রদানের জন্যে আরও উন্নত ধরনের পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে যোগাযোগের যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে তাতে খুব সহজেই মুহূর্তকালের মধ্যে সারা বিশ্বের খবর সংবাদপত্র অফিসে পৌঁছে থাকে। বিশ্বজুড়ে তথ্য প্রবাহের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা সংবাদপত্রকে সমৃদ্ধ করছে। তবে সংবাদ সংগ্রহের জন্যে রিপোর্টারের ভূমিকাটিই মুখ্য। প্রত্যেক সংবাদপত্রের নিজস্ব সংবাদদাতা রয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে পত্রিকা অফিসে পাঠায়। সেসব খবর রাতারাতি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয় পরের দিন সকালে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়।

সংবাদপত্রের আদর্শ –
       সংবাদপত্রকে অবশ্যই একটা আদর্শ মেনে চলা বাঞ্ছনীয়। আর এ আদর্শটা হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠা সংবাদ পরিবেশেন। সংবাদপত্রকে হতে হবে জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষায় অনন্য প্রহরী। জনগণের কল্যাণে সংবাদপত্র একদিকে যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, তেমনি ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠার জন্যও সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। সংবাদপত্রকে অবশ্যই ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা চিন্তা না করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে কাজ করতে হবে। আর তবেই সংবাদপত্র জনগণের আস্থা অর্জণে সক্ষম ও সার্থক হবে।

সংবাদপত্রের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভূমিকা –
        বিশ্বের রাজনীতি সমাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলো, আমোদ প্রমোদ সকল ক্ষেত্রেই সংবাদপত্রের অবাধ পদচারণা। দৈনন্দিন জীবনের নানা অপরিহার্য তথ্যও প্রতিদিন আমাদের সামনে তুলে ধরে সংবাদপত্র। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা রকম ভয়াবহ দুর্ঘটনার খবরাখবর সংবাদপত্র আমাদের জানিয়ে দেয়। এভাবে দেশ ও বিশ্ব বাসীকে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সংবাদপত্রে দুর্ঘটনার খবর পড়ে নিহত আহতের সন্ধানে ছুটে যেতে পারে তাদের আত্মীয় পরিজন। সম্রাজ্যবাদী কিংবা আগ্রাসী তৎপরতা যখন সভ্যতাকে গ্রাস করে, তখন সংবাদপত্র  তার বিরুদ্ধে মানবতার জাগরণ ঘটায় । পারমানবিক যুদ্ধ কিংবা স্নায়ুযুদ্ধের ভয়াবহতায় পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্খা দেখা দিলে সংবাদপত্র শান্তির সপক্ষে নেয় সচেতন দায়বদ্ধ ভূমিকা। দেশে সাময়িকতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, জনগনের ত্রুটি চেপে ধরলে সংবাদপত্র তার বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের পটভূমি রচনা করে।

গণআন্দোলনের পক্ষে নেয় কার্যকর অবস্থা। যেখানেই মানবতার লাঞ্ছনা মূল্যবোধের অবক্ষয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিবেকের কন্ঠরোধ, সেখানেই সংবাদপত্রের কন্ঠস্বর নেয় প্রতিবাদী ভূমিকা।

জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা –
     গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রকৃত ক্ষমতা থাকে জনগণের হাতে। ফলে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও ভূমিকা জাতীয় অগ্রগতির পক্ষে কতটা সহায়ক এবং কতটা জনস্বার্থের পরিপূরক তা নিয়ে জনগণের মধ্যে অনেক সময় দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ক্ষমতাসীনরা সবসময় তাদের পদক্ষেপকে জোর গলায় ইতিবাচক বলে প্রচার করে এবং বিরোধীরা তাকে একেবারেই প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সংবাদপত্র উভয় পক্ষের মতামত, যুক্তি ও তথ্যনির্ভর আলোচনা প্রকাশ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কারণে নিজেদের অভিমত গঠন করতে পারে। সংবাদপত্রের পাতায় জ্ঞানীগুণী বিশেষজ্ঞদের লেখা প্রবন্ধ সম্পাদকীয়, ও অভিমত, চিঠিপত্র,  লেখকদের তর্কবিতর্ক, যুক্তিপ্রদান ও যুক্তিখণ্ডন ইত্যাদি জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, দুর্নীতি দমন, সন্ত্রাস দমন, সড়ক দুর্ঘটনা, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ও প্রতিকার, সেনাবাহিনীর ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে জনমত গঠনে সংবাদপত্র অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
     অবশ্য কখনো কখনো কোনো কোনো সংবাদপত্র বিশেষ গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থে জনমতকে তাদের পক্ষে টানার জন্য সঙ্কীর্ণ উদ্দেশ্যপূর্ণ নানারকম প্রচারণায় লিপ্ত হয়। কিন্তু পাঠকসমাজ সচেতন হলে শেষ পর্যন্ত এসব সংবাদপত্রের অপপ্রচারের চেষ্টা ও হীন উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না।

সংবাদপত্রের উপকারিতা –
       আধুনিক সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা কেবল সংবাদই পরিবেশন করি না। দেশ-বিদেশের রাজনীতি ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংবাদ পরিবেশন ছাড়াও এতে থাকে বিচিত্র তথ্য প্রতিবেদন। পৃথিবীর পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক আলোচনা, গবেষণা, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি জানতে পারি। সংবাদপত্র পাঠে সাহিত্যের উন্নতি, শিল্পের অগ্রগতি, বাজার দর, যুদ্ধ বিগ্রহ, খেলাধুলা, আবহাওয়ার খবর ইত্যাদি জানা যায়। এতে নানা ধরনের বিজ্ঞপ্তি ও বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, ক্রীড়ামোদী ব্যবসায়ী সবাই সংবাদপত্র পাঠে উপকৃত হয়। শিশু-কিশোর ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য থাকে আলাদা বিভাগ, আলাদা পাতা। আসলে সংবাদপত্র এখন জনজীবনের প্রায় সব দিককেই তার আওতায় নিয়ে আসতে চাইছে। সংবাদপত্র বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পরিপূরক ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট পাঠক্রমভিত্তিক এবং পরীক্ষা- নির্ভর সার্টিফিকেট প্রদানের শিক্ষায় শিক্ষার্থীর জ্ঞানের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ছে।
       সংবাদপত্র এখন যেহেতু জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রকেই তার আওতায় এনেছে তার ফলে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠে বহুমুখী জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায়। এতে তাদের জ্ঞানের ক্ষেত্র যেমন সম্প্রসারিত ও বিকশিত হয় তেমনি বিষয়জ্ঞানের পাশাপাশি ভাষাজ্ঞানও বাড়ে। সংবাদপত্রের কল্যাণে বিশাল এ পৃথিবী ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। এছাড়া রাষ্ট্রের বিধিবিধান প্রচারের ক্ষেত্রে ও জাতি গঠনের কাজে সংবাদপত্রের অবদান অপরিসীম।

আধুনিক জীবনে সংবাদপত্রের প্রভাব –
    আধুনিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের গভীর ও ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সংবাদপত্র প্রতিদিন আমাদের সামনে কেবল জাতীয় বিষয়ই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনকেও উন্মুক্ত করে দেয়। সংবাদপত্রে প্রচারিত বিভিন্ন তথ্য, আলোচনা, সমালোচনা প্রভৃতি জনগণের সামনে দেশের প্রকৃত চিত্রকে উন্মোচন করে এবং জনগণ তাদের করণীয় স্থির করে নিতে পারে। জনমত সৃষ্টিতেও সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। জনশিক্ষা প্রচারেও সংবাদপত্র অগ্রগামী। সংবাদপত্রই সেই মাধ্যম, যা সমাজের নানা দুর্নীতি ও কুসংস্কার দূর করে মানুষের নৈতিক মান উন্নত করে তুলতে সহায়তা করে। আলোকিত জীবন গঠনে, জনগণ ও গণশিক্ষা প্রচার ও প্রসারে সংবাদপত্রই অগ্রনী ভূমিকা পালন করে।

সংবাদপত্রের ক্ষতিকর প্রভাব –
       সংবাদপত্র জনকল্যাণের একটি বস্তুনিষ্ঠ মাধ্যম কিন্তু আজকাল কিছু সংবাদপত্রের পরিচালক ও সংবাদিকগণ জনকল্যাণের মহান উদ্দেশ্যকে ভুলে গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা দলগত স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে সংবাদপত্রকে ব্যবহার করছেন, যার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে জাতীয় জীবনে। কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদপত্রের উস্কানিমূলক প্রচারণার জন্য দেশের মধ্যে  উগ্র  সাম্প্রদায়িকতা, মারামারি হানাহানি, হিংসা, বিদ্বেয়, কুৎসা ও মিথ্যা রটনা ব্যাপক আকার ধারণ করে । নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এসব সংবাদিকগণ জাতির বৃহত্তর কল্যাণের পথে বিরাট বাধ্য হয়ে দাড়াঁয় যা দেশ ও জাতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।

সংবাদপত্রের সীমাবদ্ধতা –
       সংবাদপত্রের গুরুত্বের পাশাপাশি দুর্বলতাও রয়েছে। সংবাদপত্র নির্দিষ্ট ব্যক্তি, সরকার, গোষ্ঠী বা দলের মালিকানায় প্রকাশিত হয়। সুতরাং মালিকের প্রভাব এখানে প্রাধান্য পায়। এরূপ অবস্থা অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থ বৃদ্ধি ও কলহের রূপ ধারণ করে এবং এর ফলে দেশবাসীকে ভুল পথে পদক্ষেপ নেয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

উপসংহার –
      শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি সংবাদপত্রের বিস্তার লাভ একটি দেশের নির্ভীক উন্নয়নকে ও সচেতনতাকে বৃদ্ধি করে। তাই সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশবাসীর সমস্যা ও প্রতিকারে ব্যবস্থা তুলে ধরে এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়ে দেশ ও জাতির উন্নতিকে তরান্বিত করা যায়। সভ্যতার এই চরম যুগে সংবাদপত্রবিহীন সময় ও দিনের কথা ভাবা শিক্ষিত সমাজের কাছে এক অস্বস্থিকর ব্যাপার। কারণ সংবাদপত্র ছাড়া চলে না তাদের একটি ক্ষণও।
      বর্তমানে সমাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। তাই আমাদের দেশে ব্যাপক নিরক্ষরতা, পশ্চাৎপদতা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে সমাজজীবনে আধুনিক ধ্যান ও বিজ্ঞানমূখী চেতনা বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা হতে হবে কল্যানমূখী । সেক্ষেত্রে জনস্বার্থ ও মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানই সংবাদপত্রকে সত্যিকার অর্থে জনগণের কন্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
        সংবাদপত্রের ক্ষমতা প্রচুর বলেই কোনো কোনো সম্পাদক বা মালিক সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহার করে চলেছেন। এই সংবাদপত্রগুলি আজ জনজীবনে এক ভয়ংকর রুচি-বিকৃতি এবং ভ্রান্ত-পথাদর্শের সন্ধান দিচ্ছে। জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী এবং বিকৃতরুচির পত্রিকাগুলির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এদের বিরুদ্ধে সচেতন জনগণের সংগঠিত হওয়াও দরকার। এই ধরনের সংবাদপত্রের মূল লক্ষ্য থাকে অর্থ উপার্জন। জনসেবা হল তার বাইরের খোলস। তাই বিজ্ঞাপন প্রকাশের সময় তারা রুচির কথা ভাবা বাহুল্য মনে করে। সংবাদপত্র কেবল পরিণত বয়স্ক মানুষের হাতে পড়ে না – তা শিশু-কিশোরদের হাতেও গিয়ে – পৌঁছোয়। এসব বিষয়গুলি শিশু-কিশোরের মনকে বিভ্রান্ত করে অথচ সত্য কথনের নামে বিকৃতরুচি প্রচার করে চলেছে কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্র। এদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা দরকার। পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বশক্তি বিত্তবানদের হাতে কেন্দ্রীভূত। সংবাদপত্র বিত্তশালীদের অর্থ ছাড়া প্রকাশিত হতে পারে না। তাই বৃহৎ পুঁজি সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। জনগণ এবং সরকারকে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে বৃহৎ পুঁজির হাত থেকে সংবাদপত্রকে মুক্ত করতে। তবেই সংবাদপত্র সৎ এবং বলিষ্ঠভাবে জনজীবনে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারবে।