॥ রথের মেলা ॥
কলমে – পূজা দাস এম.এ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
■ ভূমিকা ~
‘মেলা’ একটি এমন প্রাসঙ্গিক শব্দ যার সাথে আমারা কোনো না কোনোভাবে জড়িত বা সম্পর্কিত।বাংলাদেশের সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মধ্যে মেলা হল অন্যতম।আর এই সংস্কৃতি হল যেকোনো জাতির বহুগুণের বিকাশের মার্জিত মানসিকতা।
■ মেলা কী ~
আক্ষরিক অর্থে মেলা শব্দের অর্থ হল ‘মিলন’। যেখানে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং ভাববিনিময় ঘটে। বাংলায় প্রাচীনকাল থেকে মেলার আনন্দ প্রচলিত হয়ে আসছে।তবে কোথাও ক্ষুদ্র পরিসরে মেলা বসে আবার কোথাও বৃহৎ পরিসরে। তবে মেলার আনন্দটা আমরা একইভাবে অনুভব করি।
বাংলায় মেলা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই সংগঠিত হয়। যেমন- বাঙালিদের দূর্গা পূজা উপলক্ষে, দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে, চড়ক মেলা,গাজন মেলা, বই মেলা ইত্যাদি। মুসলিম ধর্মের মহরম উপলক্ষে মেলা। এমনকি বৌদ্ধদের বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষেও মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
■ রথের মেলার উৎস ~
হিন্দুশাস্ত্র মতে,আষাঢ় মাসের শুক্ল দ্বিতীয়া তিথিতে মহাপ্রভু জগন্নাথ দেব এবং তার বড় ভ্রাতা বলরাম ও ভগিনী সুভদ্রা নদীতে পুন্য স্নান করে শুদ্ধচিত্তে রথে করে মাসির বাড়ি যাত্রা করেন। মাসির বাড়িতে সাতদিন থাকার পর আবার ঐ রথে করেই নিজের ভবনে ফিরে যান তাঁরা। সেই তথ্য অনুযায়ী সাতদিন ব্যাপী রথের মেলা অনুষ্ঠিত হয়।সাতদিন রথযাত্রার পরের দিন বলা হয় ‘উল্টো রথযাত্রা’।
গ্রামের সবথেকে আয়তনে দীর্ঘ মাঠেই রথের মেলা বসতে দেখা যায়।এমন কয়েকটি অঞ্চল আছে যেগুলো রথের মেলার জন্য বিখ্যাত।অঞ্চল গুলি হল- পুরী যেখানের রথ বাংলায় শ্রেষ্ঠ। এছাড়াও রয়েছে- মায়াপুর, মাহেশ, গুপ্তিপাড়া, মহিষাদল, আমোদপুর ইত্যাদি।
■ পুরীর রথযাত্রা ~
রথযাত্রার দিনে পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দির থেকে জগন্নাথ ,বলরাম ও সুভদ্রাকে জনসমক্ষে আনা হয়। তার পর তিনজন দেবতাকে তিনটি আলাদা আলাদা সুসজ্জিত রথে বসিয়ে দেবতাদের পূজা সম্পন্নপূর্বক রথ টানা হয়। পুরীতে রথ টানতে প্রতি বছর প্রায় লক্ষাধিক ভক্তের আগমন হয়। রথ টেনে ভক্তরা জগন্নাথদেব,বলরাম দেব এবং সুভদ্রাদেবীকে ‘গুচিন্ডা মন্দিরে’ জগন্নাথদেবের মাসীর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। পুরীতে রথের উচ্চতা প্রায় পঁয়তাল্লিশ ফুট। প্রতিটি রথের আলাদা আলাদা নাম রয়েছে ,যথা-বলরামদেবের রথের নাম ‘তালধ্বজ’, সুভদ্রাদেবীর রথের নাম ‘পদ্মধ্বজ’ আর জগন্নাথদেবের রথের নাম ‘কপিধ্বজ’। ‘পুরুষোত্তম’ বা ‘শ্রীক্ষেত্র’ বলতে পুরীকেই বোঝায়। জ্যৈষ্ঠের স্নান যাত্রা ও আষাঢ়ে রথের সময় বিশেষ জাঁকজমক করে পুজিত হন। নীলাচলে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব ভক্তিবাদের প্রবর্তন করেন।তিনি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অবতার। তিনি বিশ্বাস করতেন মানব ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। মহাপ্রভুর জীবন দর্শন ও জগন্নাথদেবের জীবনদর্শন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। তাই পুরীকেই ‘বৈষ্ণবীয় ধান’ নামেও আখ্যা দেওয়া হয়।
■ রথের মেলার বর্ননা ~
রথের মেলার নাম শুনলেই সকলের মন আনন্দে মেতে ওঠে।একদম ছোট্ট থেকে আবালবৃদ্ধবনিতা পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়-
‘রথযাত্রা লোকারন্য মহাধুমধাম/ ভক্তরা লুটায়ে পথে করিছে প্রনাম।”
রথের মেলার একদৃশ্যে দৃশ্যায়িত হয় রথের রশি টানা চলছে, কেউ রশি ধরে টানছে, কেউ জগন্নাথ দর্শন করে প্রনাম করছেন, কেউ প্রভুর চরনামৃত পান করছেন।
আর অন্য দৃশ্যে আছে,নানারকমের দোকান। মানুষজন নানারকমের রঙিন পোষাক পড়েমেলায় প্রবেশ করছে। ছোটো বাচ্ছাদের চোখে মুখে আনন্দের উচ্ছলতা আর বৃদ্ধরাও ভিড় এড়িয়ে মেলায় প্রবেশ করছে।প্রতিটি দোকানে প্রচন্ড ভিড় আর কোলাহল। কেউ গাছ কিনছে,বাচ্ছারা খেলনা ,মাটির পুতুলের দোকানে ভিড় জমিয়েছে,মহিলারা ভিড় করেছে নানারকম প্রসাধনী আর অলংকারের দোকানে।এছাড়াও রয়েছে গৃহে ব্যবহৃত নানারকম নিত্য সামগ্রীর দোকান। রথের মেলা আর খাওয়া হবেনা তা তো হয়না। আর খাবার কথা বললে সবার প্রথমে আসে জিলিপি ,পাঁপড়ভাজার কথা। আরোও আছে ছোলা ভাজা,বাদাম ভাজা,ভুট্টা, হাওয়াই মিঠাই, ঘুগনী,ফুচকা ইত্যাদি। ফলের দোকানও আছে। রথের মেলার আকর্ষণীয় জিনিস হল নাগর দোলা,সার্কাস, ম্যাজিক। তাছাড়া নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
■ রথের মেলায় আমার অভিজ্ঞতা ~
রথের মেলার কথা বর্ননা করতে করতে আমার নিজের একটা রথের মেলার অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল। দশম শ্রেণিতে পড়ি তখন আমাদের শিক্ষক মশাইয়ের সাথে রথের মেলাতে গিয়েছিলাম। সাথে ছিল অনেক বন্ধুবান্ধব। তবে মেলাটা খুব বড়ো ছিল না, ছোটো গ্রামের মেলা। সবাই মিলে হইহই করতে করতে মেলায় ঢুকে পরা গেল। প্রথমেই জগন্নাথ দর্শন তারপর মেলার ভেতর প্রবেশ করলাম। অনেক দোকান বসেছে।যেই দোকানগুলোতে দিনের বেলা ফাঁকা ছিল, সন্ধ্যের পর দোকান গুলো লোকজনে ভরে উঠেছিল। সবাই দোকান ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। বিশেষ করে বান্ধবিরা মনোহারির দোকানে বেশি ভিড় জমাতে লাগল,এতে আমিও অবশ্যই আগ্রহী ছিলাম। এরপরে গেলাম বইয়ের দোকানে সেখান থেকে বেছে বেছে একটা গল্পের বই নিলাম। যেহেতু আমার গল্পের বই পড়তে খুব ভালো লাগে। আমার সাথে সাথে অনেকেই কিনলো। তার পরে সবাই গেলাম খাবার দোকানে সেখানে কেউ ফুচকা,কেউ ঘুগনি খেলাম। খাওয়ার পর আসা গেল মনোরঞ্জন বিষয়ক জায়গাই যেখানে রয়েছে নাগরদোলা। আমার প্রথম নাগর দোলা চরা।এর অনুভূতি ছিল বেশ কিছুটা রোমাঞ্চকর। এককথায় মেলায় গিয়ে প্রচুর মজা করেছিলাম। মেলায় আমার সব থেকে ভালো লেগেছিল নাগরদোলা চরা সেই অনুভূতি আজও আমার মনে অম্লান হয়ে আছে।আর মেলার মধ্যে সবথেকে খারাপ লেগেছিল সাপের খেলা। এটা সত্যি যে সাপের খেলা দেখতে আমাদের খুব ভালো লাগে কিন্তুু ওদের বন্দি করে রেখে স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে যা দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছে।
■ রথের মেলার উপকারিতা ~
মেলা যেমন মানুষে মানুষে বন্ধন সৃষ্টি করে। তেমনি হস্তশিল্পের প্রদর্শনী হয় মেলায়।তাই মানুষ মেলাতে এসে তাদের শিল্প সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে।এছাড়াও মেলাতে অর্থনৈতিক লেনদেনও দেখা যায়। যেখানে একদল মানুষের রুজি রোজগার এই মেলার ওপর নির্ভর করে। আর একদল মানুষ তাদের দরকারি জিনিসপত্র এই মেলা থেকেই কেনার পরিকল্পনা করে।
■ বাংলা সাহিত্যে রথের মেলা ~
রথের মেলা শুধু আমাদের বাংলা সংস্কৃতিকেই সমৃদ্ধ করেনি,বাংলা সাহিত্যেও এই মেলা প্রভাব বিস্তার করে সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছিল।তার প্রকৃষ্ট উদাহরন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নাট্যসাহিত্য দেখতে পাওয়া যায় ‘রথের রশি’ বা ‘কালের যাত্রা‘ নাটকে। সমাজ বদলের ইঙ্গিত রথের চাকার ঘর্ঘর শব্দের মধ্যে দিয়ে আনতে চেয়েছিলেন তিনি। এই নাটকটি একটি সাংকেতিক নাটক। যেখানে নাট্যকার দেখাতে চেয়েছেন অর্থনৈতিক বিভাজনে যারা শীর্ষ তাদের খুঁজে পান নিচু মানসিকতার মানুষকে,তাই তাদের স্পর্শে রথের চাকা গড়াই না। আর যখনই কোনো শূদ্র নিচু জাতির লোকেরা হাত লাগালো তখন রথের চাকা গড়াতে আরম্ভ করল। রবীন্দ্রভাবনায় রথের চাকায় সুখী মানুষ আর দুখী মানুষ উভয়ের ছবি আঁকা। যখন স্পর্শের সঙ্গে শুদ্রের খেটে খাওয়া মানুষের হাতের স্পর্শ এক হয়ে যায় তখনই রথ এগিয়ে চলে সাম্যের পথে। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের ‘রথ যাত্রা’ গল্পে তিনি রথের প্রসঙ্গ এনেছেন।তাছাও সুখ কবিতাতেও রথের মেলার প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয় সাহিত্যে সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনীতেও রথের দৃশ্য পাওয়া যায়। তাঁর সৃষ্টি ‘রাধারানী‘ হল এর যথাযোগ্য উদাহরন। এই গল্পের প্রধান চরিত্র রাধারানী যে কিনা তার মায়ের পথ্য কেনার জন্য বনফুলের মালা গেঁথে রথের মেলায় বিক্রি করতে যায়। সেখান থেকেই এই গল্পের সূত্রপাত। এই গল্পে দেখানো হয়েছে রাধারানী ও তার মা দরিদ্র হলেও তারা তাদের আত্মসম্মান বিক্রি করেনি। এছাড়া ঈশ্বর গুপ্তের ‘স্নানযাত্রা’ কবিতায় মাহেশের রথের মেলা সম্পর্কে জানা যায়। এটি একটি সমাজ সচেতনামূলক মূলক কবিতা।যেখানে কবি খুব শানিত ভাষায় ধর্ম নিয়ে কিছু মানুষের গোঁড়ামিকে রথযাত্রার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
■ উপসংহার ~
বাংলার সংস্কৃতির একটা বড়ো জায়গা জুড়ে রয়েছে এই মেলা।এর সাথে জড়িত আছে বাঙালির প্রথা,ইতিহাস আর ঐতিহ্য।
“আজকের দিনে মেলা মেশা যত খুশি ততই নেশা
সবার চেয়ে আনন্দময় ওই মেয়েটির হাসি।”
ধনী দরিদ্র জাতিধর্ম নির্বিশেষে রথের মেলায় অংশ নিয়ে মেলাকে মিলন ক্ষেত্র করে তোলে।শুধু গ্রামেই নয় ,শহরেও মেলা আনন্দ বয়ে আনে।মানুষকে আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে সমবেত করে তুলতে মেলার অবদান অপরিহার্য।তাই বর্তমানে মানুষের ব্যস্ত জীবনে এই মেলার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।