প্রিয় সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলমে -পূজা দাস এম.এ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
■ ভূমিকা:
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের ধারায় ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায় আমরা কে না জানি। তাঁরা হলেন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র , রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের পর বাংলা সাহিত্যে প্রান সঞ্চার করেছিলেন এই ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভূতিভূষণ তাঁর সাহিত্যে প্রাধান্য দিয়েছেন প্রকৃতি ও মানুষকে। তারাশঙ্করের সাহিত্যে এসেছে রাঢ় বাংলার জনজীবন। আর মানিকের সাহিত্যে ফুটে উঠেছে বিঞ্জান মনস্কতা ও ম্যাক্সিয় ভাবনা। এই ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। তাঁর রচনায় মানব জীবনের পাঁচালী যেমন জীবন্ত হয়ে উঠেছে তেমনি প্রকৃতি তাঁর রচনায় অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্র সূর্য যখন সায়াহ্নে তখন বাংলা সাহিত্যের আকাশে অনন্যগতিতে যে নক্ষত্রের আবির্ভাব হয় তিনি হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
■ জন্ম ও বংশ পরিচয় :
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল প্রতিভাধর ব্যক্তি বিভূতিভূষণ পৃথিবীতে পদার্পণ করেন ২৮শে ভাদ্র , ১৩০১বঙ্গাব্দে (12ই সেপ্টেম্বর, 1894 খ্রিস্টাব্দে)। তাঁর জন্ম স্থান বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া- মুরাতিপুর গ্রামে নিজের মামার বাড়ীতে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল উত্তর 24 পরগনা জেলার বনগাঁর কাছে বারাকপুর গ্রামে। তবে মূলত তাদের আদিনিবাস ছিল উত্তর 24 পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমা অন্তর্গত পানিতর গ্রামে। তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন স্থানীয় কবিরাজ এবং তিনি বনগাঁর নিকট বারাকপুর গ্রামে কবিরাজি করতে আসতেন। পিতা ছিলেন মহানন্দবন্দোপাধ্যায় ও মাতা মৃনালনী দেবী। সুকন্ঠের অধিকারী মহানন্দ ছিলেন সংস্কৃত ভাষা এবং সাহিত্যের পন্ডিত। তিনি কথকতাও করতেন। পান্ডিত্য ও কথকতার জন্য তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। বিভূতিভূষণ ছিলেন মহানন্দ ও মৃনালিনী দেবীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ সন্তান। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পড়াশোনা চলাকালীন সময়ে পরিবারের অমতে তেইশ বছর বয়সে গৌরী দেবীকে বিবাহ করেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে বিয়ের একবছর পরেই নিউমোনিয়ায় গৌরী দেবী মারা যান। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর বাইশ বছর পর রমা চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের সাত বছর পরে তাঁদের একমাত্র সন্তান তারাদাস বন্দোপাধ্যায়ের জন্ম হয়।
■ শিক্ষাজীবন :
মহান ব্যক্তির প্রথম শিক্ষার পাঠ শুরু হয় বাল্যকালে পিতা মহানন্দের পাঠশালায়। বাল্যকাল থেকেই তিনি একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বাল্যকালে খুব দারিদ্র্যের মধ্য দিয়েই জীবন কাটাতে হয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাই কিছুদিন নিজের গ্রামে বা অন্য গ্রামের কয়েকটি পাঠশালায় পড়াশোনা চালাতে হয় তাঁকে। তারপর তিনি বনগাঁ উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তিনি অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসাবে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। অষ্টম শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থায় তিনি পিতৃহারা হন। পিতৃশোক কাটিয়ে তিনি 1914 সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তার ঠিক দুই বছর পর 1916 সালে কলকাতার রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) আই.এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঐ কলেজ থেকেই ডিস্টিংশনসহ বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনা এম.এ দর্শন ও আইন বিভাগ দুটি বিষয়ে ভর্তি হন। 1919 সালে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন।
■ কর্মজীবন:
সাধারন ঘরে জন্ম গ্রহণ করে সারাজীবন স্কুল মাস্টারি করে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ জায়গাই উপনীত হয়েছেন। প্রথম জীবনে তিনি হুগলি জেলার অন্তর্গত জাঙ্গিপাড়া মাইনর স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এরপর তিনই সোনার পুর হরিনাভী স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি ‘গো রক্ষনী সভার’ ভ্রাম্যমান প্রচারক হিসাবেও কিছুদিন চাকরি করেন। এরপরে তিনি জমিদার এস্টেটে সেক্রেটারি ও গৃহশিক্ষক পদে নিয়োগ হন। এবং তার এস্টেটে বিহারের ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজার নিযুক্ত হন। পরে কলকাতার ধর্মতলায় খেলাতচন্দ্র ক্যালকাটা ইনস্টিটিউশন মেমোরিয়াল বিদ্যাতয়নে আবার শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন।
সাহিত্যজীবন: তিনি কল্লোলের যৌবনদীপ্ত উদরোলের মধ্যে দিয়ে পদচারণা করেছেন সাহিত্যে। ১৩২৮ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মেঘমল্লার’এ প্রকাশিত ‘উপেক্ষিতা ‘নামক গল্পের মধ্যে দিয়ে তিনি সাহিত্য জীবনে প্রবেশ করেন। ভাগলপুরে চাকরীরত অবস্থায় তিনি 1925 সালে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের রচনা শুরু করেন এবং তা সমাপ্ত করেন 1928 সালে। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় 1929 সালে। তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হল ‘অপরাজিত'(1ম ও 2য় খন্ড ,1932), ‘দৃষ্টিপ্রদীপ'(1935), ‘আরন্যক'(1939), ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ (1940),’ বিপিনের সংসার’, (1941), ‘দেবযান’,(1944),’ ইছামতী’, (1950) ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর স্নিগ্ধ মধুর সরস গল্পগ্রন্থগুলি হল: ‘মেঘমল্লার’,(1931), ‘মৌরীফুল’,(1932), ‘যাত্রাবদল’,(1934), ‘জন্ম ও মৃত্যু’, (1937),’কিন্নর দল’,(1938),’তালনবমী’,(1944), প্রভূতি। ভ্রমণকাহিনী ও দিনলিপি গুলি হল: ‘অভিযাত্রিক’, (1940), ‘স্মৃতির রেখা’,(1941),’তৃনাঙ্কুর’,(1943), ‘উর্মিমুখর’,(1944) , প্রভূতি। অনুবাদ উপন্যাস হল ‘আইভ্যান হো’।এছাড়াও অন্যান্য রচনা গুলি হল : ‘বিচিত্র জগৎ’,(1937), ‘টমাস বাটার আত্মজীবনী’, (1943), ‘আমার লেখা’,(1968 বঙ্গাব্দ)।
■ সাহিত্যিক হিসাবে বিশিষ্টতা :
কল্লোলীয় যুগে রাবীন্দ্রিক বিরোধিতায় যখন চারপাশ মুখরিত তখন বিভূতিভূষণ নিঃসঙ্গ থেকে সৎ আধ্যাত্মিক মানুষের মতন এক ধ্যান তন্ময় জগৎ সন্ধানে নিরব ও উন্মুখ। বিভূতিভূষণ বাংলা দেশের ভূপ্রকৃতির বুকে যে সমস্ত বালক, শিশু, যুবক, বৃদ্ধের ছবি এঁকেছেন তার মূল রস হল রূপকথার রস। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘অশনিসংকেত’ পর্যন্ত তাঁর সাহিত্য পরিক্রমায় গ্রাম জীবনের রূপকার রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। শিশুর মতো কৌতুহল , কবির মতো কল্পনার প্রলেপ দিয়ে বিভূতিভূষণ তাঁর সাহিত্যে অনুকরনীয় ভাষায় এমন গ্রামীন চিত্র এঁকেছেন যে, চিত্র হিসাবে তা অনবদ্য ও অনতিক্রমনীয়। দুঃখদারিদ্যের ছবি তিনি এঁকেছেন কিন্তু সে ছবি কোনো সমাজ বা অর্থনীতি ঘটিতপ্রখর প্রশ্ন উত্থাপন করেনা। কিছু কিছু প্রেমের চিত্রও এঁকেছেন কিন্তু তাতে উত্তপ্ত কামনা ও রোমান্টিক বৈচিত্র্যর চেয়ে স্নিগ্ধ মধুর শান্ত ও গাহস্থ্যের রূপটিই বেশি প্রকাশ পেয়েছে।এককথায় তিনি বাংলা সাহিত্যেকে নানা দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন।
■ পচ্ছন্দের বিষয় ‘পথের পাঁচালী’ :
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বপ্রথম উজ্জলতম উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’। এই উপন্যাসটি ‘বিচিত্রা’পত্রিকায় 1929 সালে (1336 বঙ্গাব্দে) মহালয়ার দিন প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি একবছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ভাগলপুরে থাকাকালীন সময়ে তিনি উপন্যাসটি লেখেন। উপন্যাসটি পিতা মহানন্দ বন্দোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেন। উপন্যাসটি বল্লালীবলাই,আম আঁটির ভেঁপু ও অক্রর সংবাদ তিনটি অংশে বিভক্ত। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অপু ও তার দিদি দূর্গা। ‘পথের পাঁচালী’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী মূলক উপন্যাস।উপন্যাসে তিনি শিশু মনের সুন্দর ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। অপুর মা সর্বজয়া সম্পর্কে তিনি বলেছেন “সর্বজয়ার একটা অস্পষ্ট ভিত্তি আমার মা” (তৃনাঙ্কুর)। বিভূতিভূষণের ছোটো বোন মণি এখানে দূর্গার চরিত্রে ফুটে উঠেছে। উপন্যাসের দূর্গার মতো মনিও অল্প বয়সে মারা যায়। তাছাড়াও উপন্যাসে নিশ্চিন্দিপুর হল বিভূতিভূষণের স্বগ্রাম বারাকপুর আর অপু হলেন স্বয়ং বিভূতিভূষণ। অপুকে মাধ্যম করেই তিনি তাঁর জীননের স্মৃতি মন্থন করেছেন। এই উপন্যাসে তিনি বেঁধে দেওয়া পথ অবলম্বন করেননি, একটি বালক চিত্ত কিভাবে রূপকথার রূপলোকে বিচরন করতে করতে অগ্রসর হল,জীবনের নানা ক্ষয় ক্ষতি তার সেই রূপকথার জগত হারিয়ে গেল না – এইসব কাহিনী বিভূতিভূষণ অসাধারন শিল্পের দ্বারা ফুটিয়ে তুলেছেন।
■ পুরস্কার ও সম্মান:
জীবিতকালে তিনি তাঁর সাহিত্য কৃতির জন্য বিশেষ কিছু না পেলেও মরনোত্তর কালে তিনি যথার্থ সম্মানে সম্মানিত হন। ‘ইছামতী’ উপন্যাসের জন্য তিনি 1951 সালে রবীন্দ্র পুরস্কার পান। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমায় পরমাদান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের নাম লেখকের সম্মানার্থে রাখা হয়েছে ‘বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য’।
■ উপসংহার : চেনা পৃথিবীর মধ্যে, পরিচিত মানুষের মধ্যে, দৈনন্দিন জীবনধারণের মধ্যে ,অচেনা অরূপ জগতের মধ্যে সৌন্দর্যময় ইঙ্গিত, রহস্যময় ব্যঞ্জনা। সেদিক থেকে বিভূতিভূষণ শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও বিশেষ স্থান অধিকার করবেন। এই মহান ব্যক্তি ঝাড়খন্ডের ঘাটশিলাতে ১৩৫৭ বঙ্গাব্দে ১৭ই কার্তিক(1950 সালে 1 নভেম্বর) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরের দিন মধ্যাহ্নে সুবর্ণরেখা নদীর পাড়ে পঞ্চপান্ডব ঘাটে তাঁর শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়।