চরিত্র গঠনে খেলাধুলার ভূমিকা
কলমে:- অভিজিৎ ঘোষ (বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়)
★ ভূমিকা:-
একটি বিরাট বড় বাড়ি যেমন দাঁড়িয়ে থাকে সেই বাড়ির ভিতের উপর কেন্দ্র করে। তেমনি একজন মানুষের জীবনও দাঁড়িয়ে থাকে তার ব্যক্তিগত চরিত্রের উপর ভর দিয়ে। কেবলমাত্র পড়াশোনাই ভালো অর্থাৎ পুঁথিগত বিদ্যায় পারদর্শী মানেই মহান কিছু, তা কিন্তু নয়। একজন মানুষের চরিত্র নির্ভর করে তার দৈহিক ও মানসিক দিকগুলির ওপর ভিত্তি করে। কোন মানুষের দৈহিক এবং মানসিক চরিত্র গঠনের একমাত্র সহায়ক উপাদান হলো শরীর চর্চা। শরীর চর্চা অর্থাৎ খেলাধুলার মাধ্যমে যেমন আমাদের দৈহিক সুস্থতা আসে তেমনি খেলাধুলার মাধ্যমেই আসে মানসিক সুস্থতা যা একজন মানুষের চরিত্র গঠনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
“আমাদের শরীর যদি সম্পুর্ণ সুস্থ না থাকে
তবে মানসিক একাগ্রতা আসিবে কোথা থেকে”।
কোনও যন্ত্রকে যদি আমরা দীর্ঘদিন ব্যবহার না করে নিথর ভাবে ফেলে রেখে দিই, তাহলে যেমন সেই যন্ত্রটিতে জং ধরে এবং ধীরে ধীরে তা নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের শরীরও ঠিক সেই রকমই এক ধরনের যন্ত্রের মতোই। তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করার ফলে বিভিন্ন রোগ বাসা বাধে এবং চিন্তাশক্তিও ক্রমে ক্রমে লোপ পেতে থাকে। এই সমস্ত সমস্যাগুলি থেকেই মুক্তির জন্য একমাত্র প্রয়োজন হলো দৈহিক চর্চা করা। যার মধ্যে খেলাধুলা হলো এক অন্যতম দৈহিক চর্চার মাধ্যম।
★ খেলাধুলা ও তার প্রকারভেদ:-
খেলাধুলা হলো একপ্রকার ঔষধের মতোই যা শরীর চর্চার বিকাশের সাথে সাথে সমাজের বুকে নিয়ে আসে নতুন প্রাণের জোয়ার। একজন বধির ও বোকার মুখে ও আনন্দের হাসি এবং নতুন ভাষা ফুটিয়ে তোলে। একজন শিশুর দেহকে সুস্থ ও সবলভাবে গড়ে তোলার জন্য খেলাধুলার ভূমিকা অপরিসীম। পাঠ্যপুস্তক পঠন এর সাথে সাথে শরীর চর্চার আলোকেই একজন শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক ও তার আত্মার বিকাশ সাধন হয়ে থাকে। গ্রন্থকীট অর্থাৎ কেবলমাত্র পুস্তক পাঠ করে যদি কোন শিক্ষার্থী তার শরীর ও স্বাস্থ্যের দিকটিকে উপেক্ষা করে চলতে থাকে, তাহলে তার জ্ঞানের বিকাশই তার ভগ্ন স্বাস্থ্যের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন তাদের জীবনে নেমে আসে ব্যবহারিক জীবনের ক্লান্তি বৈচিত্রহীনতা এবং একঘেয়েমি যা তাদের চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে কুপ্রভাব ফেলে।
সমগ্র বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। যেমন কিৎকিৎ, কবাডি, হাডুডু, আলু দৌর, গুটি খেলা প্রভৃতি। এইসমস্ত খেলা গুলি সেই প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। কিন্তু আজ আমাদের নতুন সমাজে নতুনত্বের ছোঁয়া লেগেছে। আজ মানুষের আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে খেলাধুলার মধ্যেও এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। প্রাচীনকালে কুস্তি, মল্ল যুদ্ধ এবং লাঠি খেলার প্রচলন লক্ষ্য করা গেলেও বর্তমানে ক্রিকেট, হকি, ফুটবল, সাঁতার প্রতিযোগিতা, টেনিস, টেবিল টেনিস, গালপ বল, হর্স রেসলিং কেরাম প্রভৃতি।
★ খেলাধূলা ও শিশু মনস্ততত্ত্ব :-
একতা, সংঘবদ্ধতা ও জনজাতির ওপর সহানুভূতিশীলতা এবং বড় ও গুরুজনদের প্রতি আনুগত্যবোধের শিক্ষা দীক্ষা পাওয়া যায় খেলাধুলা থেকেই। গোষ্ঠীগত খেলাধুলার মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতার শিক্ষা বিশেষভাবে পায় শিশুরা। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা পায় তাদের জীবনে একাগ্রতা এবং শুভাশুভর চিন্তা। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা তাদের হিংসাত্মক মনোভাব ত্যাগ করে ব্যক্তিসত্তার জীবনে অগ্রসর হতে শেখে। তাছাড়াও প্রতিযোগিতার সূত্রপাত যা একজন ব্যক্তি চরিত্রের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে থাকে তার মধ্যে রয়েছে খেলাধুলার এক বিশেষ ভূমিকা। এছাড়াও খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বের স্নেহ ও মায়ার জাল কে প্রসারিত করতে শেখে। সভ্যতার সেই প্রাচীন যুগ থেকেই তাই সুস্থ ও স্বাভাবিক দেহ মন গড়ে তোলার জন্য খেলাধুলার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তাই শিক্ষা ক্ষেত্রেও খেলাধুলাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রকের দ্বারা।
★ খেলাধুলার উপকারিতা:-
একজন ব্যক্তি চরিত্র গঠনে ও শিশু মানষ গঠনে এবং বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক শিক্ষার জন্য ধুলার গুরুত্ব অপরিসীম-
1. মানসিক চরিত্র গঠন:- মনের থেকে একাকীত্ব দূরীকরণ করার জন্য সাহায্য করে খেলাধুলা। খেলাধুলা করলে যেমন শরীর চর্চা হয়, তেমনই হয় মানসিক বিকাশও। মানবিক একাগ্রতা যা একজন মানুষের জীবনের মূল্যবান সম্পদ। সেই মানসিক একাগ্রতা আসার একটি উন্নতমানের রাস্তা হল খেলাধুলা।
2. শরীর সুঠাম:- খেলাধুলা করলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলির খুব ভালো এক্সারসাইজ হয়, যার ফলে মানব শরীর সুঠাম হয়। কোনো জিনিসকে আমরা যত বেশী ব্যবহার করি তা তত বেশি ফলপ্রসূ হয়। সেই ভাবেই খেলাধুলার মাধ্যমেও আমরা আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলি যত ব্যবহার করি তারা ততো বেশি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে এবং তাদের কর্মপ্রবণতাও অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
3. বিভিন্ন প্রকার শিক্ষণ:- খেলাধুলার মাধ্যমে একজন শিশু প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। যার ফলে সে ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রগুলিতে নিজেকে এগিয়ে রাখার জন্য সর্ব সচেষ্ট হতে শেখে। খেলাধুলার থেকে শিশু মনে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ জন্মায় যা একজন শিশুকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে উপকার করে। বিভিন্ন খেলায় বিভিন্ন প্রকার নিয়মাবলী থাকে সেই নিয়মাবলী মেনে চলতে চলতে সে নিজের বাস্তবিক জীবনে নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা পায়। বিভিন্ন খেলায় বিভিন্ন নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ থাকে সেই নির্দিষ্ট সময় মেনে চলতে চলতে একজন শিশু সময়ানুবর্তিতা শেখে।
4. দেশের গৌরব:- শিশুরা খেলাধুলায় উন্নতি সাধন করলে বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক খেলা গুলিতে যোগদান করে সম্মাননা পেয়ে দেশের গৌরব বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আন্তর্জাতিক খেলাধুলাগুলিতে দেশের খেলোয়াড়গণের অংশগ্রহণ এবং সম্মাননা প্রাপ্তির জন্য দেশের গৌরব অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
5. জাতীয়তাবোধ:- খেলাধুলার মাধ্যমে দলের প্রতি ভালোবাসা, দেশের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান এবং জাতীয়তাবোধ জাগরিত হয়, যা একজন পরিপূর্ণ মানুষের মধ্যে থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই জাতীয়তাবোধের জাগরণের সূত্রপাত ঘটে থাকে খেলাধুলার মাধ্যমেও।
6. সংস্কৃতির বিনিময়:- জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খেলা গুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গার সাংস্কৃতি ও পারিপার্শ্বিক শিক্ষার মিলনের ফলে সংস্কৃতি ও শিক্ষার বিনিময় ঘটে।
7. চরিত্র গঠনের সহায়ক:- খেলাধুলা বাস্তবিকভাবে সুস্বাস্থ্য গঠনের সাথে সাথে চরিত্র গঠনের উপর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এক্ষেত্রে সর্বদাই এই ছড়াটি মনে পড়ে –
“চরিত্র আগে চাই গড়া
তাই প্রয়োজন
খেলাধুলা আর লেখাপড়া”।
খেলাধুলা মানুষের আত্মবিশ্বাস কে বাড়িয়ে ছাত্র জীবনে নামিয়ে আনে সাফল্যের বর্ষা। একজন মানুষের জীবনে সফলতা ও ব্যর্থতাকে মানানসই করে গ্রহণ করতে সাহায্য করে। খেলোয়াড় তার সার্বিক সাফল্যে যেমন উল্লসিত হয় তেমনি তার ব্যর্থতাকেও একটি প্রত্যাশিত ও সম্ভাব্য ফসল হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষমতা ও মানসিকতা উভয়ই অর্জন করতে শেখে। এছাড়াও খেলাধুলা মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন ঘটানোর এক বিশেষ সহায়ক। কেননা খেলাধুলা থেকে একজন ব্যাক্তি সততা নিষ্ঠা ও ন্যায় পরায়নতার দীক্ষা পেয়ে থাকে।
★ খেলাধুলা ও পেশা:-
খেলাধুলা যে শুধুমাত্র দৈহিক ও মানসিক বিকাশ সাধন করে তাই নয়। খেলাধুলার উপর কেন্দ্র করে আজ সমাজে বিশিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ তাদের নিজেদের জীবনকে খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিস্থাপিত করতে পেরেছেন। তাদের জীবনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার মাধ্যমে। খেলাধুলাকে পেশাগত দিকে কাজে লাগিয়েছে সমাজের বিশিষ্ট খেলোয়াড়গণ। যেমন কুস্তি ক্ষেত্রে জনসিনহা, এন্ডারসন প্রমুখ। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে শচীন তেন্ডুলকার, কে এল রাহুল প্রমুখ। ফুটবলের জগতে নেইমার, মেসি রোনাল্ডো প্রমুখ বিশিষ্ট খেলোয়াড়গন। এছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরেও খেলাধুলার খ্যাতি জড়িয়ে রয়েছে যেমন অলিম্পিক।
★ উপসংহার :-
সমগ্র পৃথিবীব্যাপী আজ খেলাধুলার ব্যাপক প্রচলন পরিলক্ষিত হয়। খেলাধুলার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সাফল্যতা একটি দেশের মান-সম্মান ও গৌরব বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, এবং অপরদিকে ব্যক্তিগত দক্ষতার ক্ষেত্রেও বিশেষ মূল্য এবং সম্মান প্রদান করা হয়ে থাকে একজন বিশিষ্ট খেলোয়াড়কে।
খেলাধুলার মধ্যে সুফল থাকলেও বিভিন্ন কুফলও বর্তমান যেমন তাস, দাবা, পাশা এবং জুয়া প্রভৃতি খেলাগুলিতে যাতে বাচ্চারা জড়িয়ে না পড়ে সেদিকে নজর রাখতে হবে। এছাড়াও মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার এবং বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস গুলির মাধ্যমে যে গেমিং সফটওয়্যার আছে সেগুলোতেও যেমন বাচ্চারা জড়িয়ে না পড়ে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন গেমিং যেমন ফ্রী ফায়ার পাবজি প্রভৃতি গেমগুলোর উপরেও যেন তাদের দৃষ্টি না পড়ে সেদিকে নজর রেখে একজন শিশুর মনস্তত্তে খেলাধুলাকে তার চরিত্র গঠনের সম্পূর্ণ সহায়ক করে তুলতে সাহায্য করতে হবে।