পুরী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা


   কলমে – বন্দনা সাহা, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ‍্যালয়


ভূমিকা –
ব্যস্ত শহর ঘড়ির কাঁটায় ছুটছে প্রতিক্ষণে
  ক্লান্ত চোখে অলস বেলায় ফিরছি ঘরের কোনে।
নিত্যদিনের একঘেয়েমি জমাট বাঁধা মেঘ
খাঁচার পাখি চাইছে ছুটি চলার পথের বেগ।

আমার প্রাণের শহর কলকাতা, রঙিন স্বপ্নে ভরা, তার হৃদয়জুড়ে ভালোবাসার হাজারো ঘুড়ির উড়ান, পড়ন্ত বেলায় তার উদাসী চোখে বিদায়ী সূর্যের লাল আভা, ভিক্টোরিয়ার সবুজ গালিচা, ময়দানে একসঙ্গে কয়েক পা চলা, সন্ধ্যা বেলায় হাওড়া ব্রিজের আলোকসজ্জা, প্রিন্সেপ ঘাটে রাতের গঙ্গার নিস্তব্ধতা এইসব কিছু আমাকে বিভোর করে তোলে, মদির নেশায় মুগ্ধ করে। তবু কর্মময় নিত্যযাপনে ‘অবসন্ন মানুষের শরীরে দেখি ধুলোর কলঙ্ক’প্রতিদিনের অভ্যাসে সব রঙও যেন কেমন বিবর্ণ হয়ে যায়। তাই কলকাতার কঠিন খোলস ছেড়ে মন বাঁধ ভাঙা কোনো আনন্দ স্রোতে ভেসে যেতে চায়। চার দেওয়ালের বদ্ধ ঘরে ক্লান্ত মন গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে— 
আমিও ছুটে যাই সে দিগন্তে
আমিও ধেয়ে যাই কী আনন্দে
তুমি কি, ভুলে যাওয়া কবিতারা?
তোমায় ছুঁতে চাওয়ার…’
কোলাহলমুখর কলকাতায় বসে তাই রক্তের শিহরণে তোমায় অনুভব করি, মাঝরাতে একলা রাতে তোমার উতলা ঢেউয়ের স্পন্দন শুনতে পাই, তোমার আভিমানী মুখখানি আমাকে কাতর করে তোলে। তাই তোমার জন্য ঘরছাড়া হই গহীন রাতে, বেড়িয়ে পড়ি পুরীর সমুদ্র ও জগন্নাথ দর্শনে।

যাত্রার বিবরণ –   
  প্রতিদিনের হাজারো কাজের চাপে অসংখ্য মানুষের ভিড়ে কোথাও যেন নিজের সত্তাটাকে হারিয়ে ফেলি। তাই নিজেকে খুঁজে পেতে ছুটে যাই প্রকৃতির কাছে। এ কারণে আমি সোলো ট্রিপে যেতে পছন্দ করি। কারো প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই, কারো মন রক্ষার দায় নেই, নেই কোনো পিছুটান। আছে কেবল নিসর্গ প্রকৃতির বুকে নিজেকে নতুন করে পাওয়া, নিবিড় গভীরতায় ডুব দিয়ে জীবনকে নতুন রূপে দেখা। সে কারনেই দীর্ঘদিনের শহুরে জীবনের ক্লান্তি মোচনে উঠে পড়লাম হাওড়া টু পুরী স্পেশাল ট্রেনে। রাত তখন ১১:৫০। খানিকটা ইচ্ছে করেই রাতের ট্রেনে যাত্রা শুরু করলাম কারণ আমি নীরবতা চাই। রাতের নিস্তব্ধ কামরায় বাইরের নৈঃশব্দ অন্ধকারের অতল গহ্বরে অবগাহন করতে করতে এগিয়ে চললাম কোনো এক অচীনপুরের বেনামী রাজ্যে। এই অনন্ত অসীম পথচলায় আমার একমাত্র সঙ্গী শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ার চাঁদ। ক্ষীণ আলোয় ভেসে চলা এই অভিসারের চঞ্চলতায় চোখের পাতায় ঘুম এলো না। মনের রেডিওতে বাজতে লাগলো আমার একান্ত প্রিয় গান— ‘আমার একলা আকাশ/ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে/ শুধু তোমায় ভালোবেসে।…আমার বেসুর গিটার/ সুর বেঁধেছে তোমার কাছে এসে/ শুধু তোমায়ভালোবেসে’ – এমন করেই গানের স্রোতে চাঁদের ভেলায় পৌঁছে গেলাম পুরীর কাছে।

পুরীর সমুদ্র বর্ণনা  –
তখনও ভোরের নরম আলোর তাপে সূর্যের ঝাঁঝ লাগেনি। দূর থেকে দেখলাম অভিমানিনী নাসায় সে ফুঁসছে, বারংবার এলোপাথাড়ি ঢেউ আছড়ে পড়ছে উন্মত্ততায়, ফেরার পথে নিয়ে যাচ্ছে কয়েক মুঠো বালি। আমি খুব কাছেই একটা হোটেলে ঢুকে নরম বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে পথশ্রান্ত চোখ দুটিকে বিশ্রাম দিলাম। দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদের পর মিলনের মধুর মুহূর্তের পূর্বে প্রিয়তমার রক্তিম অভিযোগের উত্তর দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলাম। খানিক পরেই ক্লান্তি মুছে ছুটে গেলাম তার কাছে। কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে গেলে এক ছুটে সে পালিয়ে গেল। যেন গভীর নিঃশ্বাসে গুমরে কেঁদে উঠে কত কি বলে গেল আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এমন সময়ে রবি ঠাকুরকে মনে পড়ে গেল—
অব্যক্ত অস্ফুট বানী ব্যক্ত করিবারে
শিশুর মতন সিন্ধু করিছে ক্রন্দন
…আছাড়ি চূর্ণিতে চাহে সমগ্র হৃদয়
             কঠিন পাষাণময় ধরণীর তীরে।’ (‘সমুদ্র’ কবিতা)
আমি এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম, স্পর্শ করলাম, ভালোবাসলাম। দেখলাম তার আভিমানী জলপূর্ণ চোখদুটো বিরহ জ্বালায় কাতর। অবনত মুখে যেন নববধূর সাজে সে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন কত মানুষ তার কাছে আসে, সে তাদের উদার আহ্বানে কাছে টেনে নেয় কিন্তু মনের মানুষের জন্য সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। তাই হাজারো ভিড়েও সে একাকীত্ব অনুভব করে। সে কারনেই এই জনসমাগমের মাঝেও তাকে আমি নতুন করে পেলাম, নিজের করে পেলাম, তার মাঝে নিজেকে খুঁজে পেলাম। পুণ্যতীর্থ পুরীর সমুদ্র সৈকতে অসংখ্য মানুষের উল্লাস আনন্দ। কেউ পুণ্য অর্জন করার সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগাতে বারবার প্রনাম করে স্নান করছেন, কেউ আবার পরিবারের সঙ্গে নিছক জলকেলিতে মগ্ন, কেউ কেউ দূর থেকে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দর্শন করছেন  আবার অনেকেই সমুদ্রের হাতছানিকে উপেক্ষা করে মন্দির প্রাঙ্গনে ভিড় জমিয়েছেন। কিন্তু কেউ  ওই ছুটে আসা উত্তাল ঢেউকে ভালোবেসে নিবিড় বন্ধনে তাকে জড়িয়ে ধরেনি, তার মায়াভরা মুখে এঁকে দেয়নি কোনো চুম্বন, বোঝার চেষ্টা করেনি তার মনের মাঝের অনুভুতির তোলপাড়কে। হয়তো বা কেউ করেছেন চোখের আড়ালে ঠিক আমরই মতন। সমুদ্র সৈকতে দুপুরের ব্যস্ত কলরব আমাকে ক্লান্ত করে দিল, আমি ফিরে এলাম হোটেলে।

জগন্নাথ দর্শন ও স্থান মাহাত্ম‍্য –
খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম জগন্নাথ দর্শনে। অসংখ্য ভক্তদের ভিড়ে ভগবানের দেখা পাওয়া নিতান্তই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। পাণ্ডাদের লাঠির বাড়ির থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কোনক্রমে এক পলকে দেখলাম সেই অপূর্ব মূর্তি সেই মনোমুগ্ধকর বিগ্রহ। মনের চোখে এক ক্লিকে তুলে নিলাম কয়েকটি ফটো যা মনের ডায়রির পাতায় সযত্নে রেখে দিলাম। পুরীর জগন্নাথ মন্দির হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে এক বিখ্যাত পুণ্যতীর্থ। ইতিহাস ও রহস্যে পরিপূর্ণ এই ধাম এখন ধর্মীয় ভাবাবেগের পাশাপাশি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। প্রতিদিন বহু মানুষ এই মন্দিরসহ সমুদ্র দর্শনে আসেন। মন্দির নির্মাণের পিছনেও রয়েছে নানা ইতিহাস। চৈতন্য জীবনীকারদের বর্ণনা অনুযায়ী মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে ২৭ ফাল্গুন পুরীতেপৌঁছেছিলেন। এই নীলাচলে প্রভুর অনেক লীলা কাহিনিরও কথা জানা যায়। অনুমান করা হয়— এই ঐতিহাসিক  জগন্নাথ মন্দির ১০৭৮ সালে তৈরি হয়। ১১৭৪ সালে তা মেরামতের পর আজকের জগন্নাথ মন্দিরের রূপ ধারণ করে। এখানকার জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে প্রথম তৈরি হওয়া পুরী মন্দিরের অনেক তফাৎ। শুধু মূল মন্দিরটা তৈরিকরেছিলেন রাজা ইন্দ্রদুম্নু
     মন্দিরের বিগ্রহ, কারুকার্য আমাকে মুগ্ধ, মোহিত, আপ্লুত করেছে। এমন সৌন্দর্য যা দৃষ্টিকে ঋদ্ধ করে, মনকে অপার প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর‘শিল্পে অনধিকার’ প্রবন্ধে জাপানের শিল্পী শ্রীমৎ ওকাকুরার সম্পর্কে বলেছিলেন তিনি শঙ্কট রোগে শীর্ণ হয়ে পড়লেও মৃত্যুর পূর্বে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কারুকার্য দেখার একান্ত বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। প্রবন্ধে পাই- ‘দূর প্রবাস থেকে নিজের ঘরের মৃত্যুশয্যায় আশ্রয় নেবার পূর্বে একবার জগন্নাথের মন্দিরের ভিতরটা কেমন শিল্পকার্যদিয়ে সাজানো দেখে যাবেন এই তাঁর ইচ্ছা।
ভারতীয় শিল্পীর হাতের সূক্ষ্ম কারুকার্য দেখে বিদায় বেলায় তিনি বলেছিলেন— ‘ধন্যহলেম, আনন্দের অবধি পেলেম। এইবার পরপারে  সুখে যাত্রা করি।’
শিল্পীর শিল্প দৃষ্টি হয়তো আমার নেই, মৃত্যুর পূর্বে স্থাপত্য কারুকার্যে মনোনিবেশ করে যথার্থ সুখের অনুসন্ধানও আমার পক্ষে সম্ভব নয় কিন্তু এত সুন্দর কারুকার্য আমার হৃদয়কে সৌন্দর্য সুধায় তৃপ্ত করেছে। বেশ খানিকক্ষণ সেই অমৃত সুধায় স্নাত হয়ে বেরিয়ে এলাম মন্দির থেকে। বাইরে এসে দেখি সকলেই ব্যাকুল বিস্ময়কর দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝাঁকের কই-এর মতো আমিও সেদিক পানে তাকিয়ে দেখলাম এক ব্যক্তি পিছন ফিরে তরতর করে পাথরের খাঁজে পা দিয়ে উঠে চলেছেন মন্দিরের শীর্ষে এবং দ্রুত সেই চূড়ায় পৌঁছে সগৌরবে বিজয়ীর ভঙ্গিতে বদলে দিচ্ছেন পতাকা। অসামান্য দক্ষতায় আবার তিনি পুরনো পতাকা নিয়ে নিচে নেমে এলেন। সেই নামিয়ে আনা পতাকা মুহূর্তের মধ্যে মঙ্গল চিহ্ন স্বরূপ বিক্রি হল চড়া দরে।
পুরীর এই মন্দিরের প্রতিটা ইঁটে যেন রহস্য লুকিয়ে আছে। এমন কয়েকটি রহস্য নিজের চোখে দেখে যারপরনাই অবাক হলাম –
৹ এই পতাকা বায়ুর গতিবেগের বিপরীত দিকে উড়তে থাকে।
৹ মন্দিরের শীর্ষে রয়েছে সুদর্শন চক্র যা শহরের যে কোনো জায়গা থেকে দেখা যায়।
৹ মন্দিরের ওপর থেকে কোনো পাখি বা বিমান উড়তে কোনোদিন দেখা যায়নি
৹ এই মন্দিরের কোনো ছায়া মাটিতে পড়তে দেখা যায় না
এমন সব আশ্চর্য ঘটনার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ভগবানের অস্তিত্ব নিয়ে আজ পর্যন্ত অনেক বাদানুবাদ, মতান্তর, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে ভবিষ্যতেও হবে কিন্তু চোখের সামনে এমন কিছু অব্যাখ্যনীয় রহস্যময় আশ্চর্য ঘটনা দেখে স্বভাবতই মাথা নত হয়ে আসে। অদৃশ্য কোনো শুভ শক্তির কাছে নতজানু হয়ে বসতে ইচ্ছে করে। পুরীতে গিয়েছিলাম মূলত সমুদ্রের টানে কিন্তু জগন্নাথ মন্দিরের মোহনীয় মহিমায় অবিভূত হয়ে গেলাম। অনুভব করলাম আমার বুক জুড়ে সন্ধার কালবৈশাখী ঝড়ের পরে এক পশলা নির্মল শান্ত বৃষ্টিধারা ঝরে পড়ল। নিবিড় প্রশান্তিতে ভরে উঠল মন।
জগন্নাথ মন্দিরের অন্যতম আশ্চর্যের ও অবাক করা বিষয় হল মন্দিরের রান্নাঘর। একে পৃথিবীর বৃহত্তম রন্ধনশালা বলা হয়। নয়টি ভাগে বিভক্ত এই রান্নাঘরে ৭৫২টি মাটির উনান রয়েছে যার প্রত্যেকটি দৈর্ঘ্যে ৩ বর্গফুট ও উচ্চতায় প্রায় ৪ ফুটেরও বেশি। এক অদ্ভুত পন্থায় এখানে রান্না করা হয়। উনানে একটির পর একটি পাত্র বসিয়ে মোট ৯টি পাত্র পরপর সাজিয়ে রান্না চাপানো হয়। রান্নার কাজে প্রায় এক হাজার সেবক রয়েছেন যাদের মধ্যে ৫০০ জন কেবল রান্না করেন অন্যরা রান্নার আনুষঙ্গিক কাজে সহায়তা করেন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৫৬ রকমের ব্যঞ্জন রান্না হয় এবং হাজার হাজার ভক্ত প্রসাদ পান কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় প্রসাদ কোনোদিন কম পড়েনা আর কোনোদিন অতিরিক্ত থাকায় নষ্টও হয় না। এত বৃহৎ বড়ো আয়োজন ও ভোজন ব্যবস্থা দেখে বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। জগন্নাথ মন্দিরের বিগ্রহ সেবা ও নিত্যদিনের পূজো এক নয়নরঞ্জন দৃশ্য। কিন্তু সেই পূজো দেখার সৌভাগ্য সকল ভক্তদের হয় না। মন্দিরের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল প্রতিদিন বিমলা মায়ের পূজো না হলে জগন্নাথের পূজো আরম্ভ হয় না। তাই মধ্যরাত থেকে বিমলা দেবীর আরাধনা শুরু হয়ে জগন্নাথ দেবের পূর্ণসাজ পর্যন্ত তা চলতে থাকে। তবে ভোগ আগে জগন্নাথ দেবকে নিবেদন করে সেই নিবেদিত ভোগ মা বিমলাকে দেওয়া হয়।

আমার সমুদ্র দর্শন ও অভিজ্ঞতা –
পূর্ব রাত্রে উত্তেজনায় ঘুম আসেনি। তাই দুপুরে প্রসাদ পেয়ে সোজা ফিরে গেলাম হোটেলে নিজের রুমে। ক্লান্তিবশত ঘুমিয়ে পড়লাম। একটি লম্বা চওড়া ঘুম দিয়ে উঠে বাইরে বেরোলাম। তখন সন্ধ্যে নেমেছে আকাশে। বাইরের ফুরফুরে হাওয়ায় সকলে এদিক ওদিক ঘুরছে। আমি কিছু কেনাকাটা করলাম। এরপরেই চোখে পড়ল পুরীর বিখ্যাত গজা। লোভ সামলাতে না পেরে খান তিনেক গজা দিয়ে পেটপূজো সেরে সঙ্গে খানিকটা নিয়েও নিলাম। হোটেল খুব কাছাকছি থাকায় আমি সব জিনিসপত্র রুমে রেখে ঝাড়া হাতপায়ে হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের কিনারা বরাবর এগিয়ে চললাম। দূর থেকে দেখলাম সে যৌবনাবতী নারীর মতো উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা হয়ে এগিয়ে আসছে আমাকে ছুঁতে আবার ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যাছে মলিন বদনে।
আসা যাওয়ার চলছে খেলা অনন্তকাল ধরে
                                  তবুও তা নতুন লাগে বিবর্তনের স্রোতে।
মনে পড়ল অনেকদিন আগে পড়া জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘সমুদ্র’ গল্পটির কথা। ঢেউয়ের নেশায় মত্ত হয়ে বছরের পর বছর সেই টানে থেকে যেতে পারে সমুদ্রের কাছে এমন এক ব্যক্তির কথা জেনেছিলাম সেই গল্পে। সমুদ্রের বর্ণনায় সেই গল্পে পাই—
‘হাওয়ার বেগ বাড়ছে, সমুদ্র উত্তাল হয়েছে; সফেন তরঙ্গ ক্রুদ্ধ গর্জন করে তীরের দিকে ছুটে আসছে, গর্জন করছে, হাসছে, ভেঙে গুঁড়িয়ে রেনু রেনু হয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে অতল অন্ধকারে।’
প্রতি মুহূর্তে ঢেউ আসছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে, অনবরত একই খেলায় একই ছন্দে সে ছুটে চলেছে। কত পুরাতন অথচ নতুন। আমি নিত্যদিনের একঘেয়েমি কাটাতে সমুদ্রের কাছে এসেছি আর সেই সমুদ্র নিজেই অবিরাম একই খেলা খেলে চলেছে। নিজের থেকেও যেন সমুদ্রের জন্য আমার কষ্ট হল। কবিগুরু বোধহয় অনুভব করেছিলেন সমুদ্রের এই বৈচিত্রহীন নিত্যযাপন তাই পুরীর সমুদ্রকে দেখে তিনি লিখেছিলেন— 
‘… ধীরে ধীরে প্রভাত উঠিয়া এসে
শান্তদৃষ্টি চাহে তোমাপানে; সন্ধ্যাসখী ভালোবেসে
স্নেহকরস্পর্শ দিয়ে সান্ত্বনা করিয়ে চুপে চুপে
চলে যায় তিমির মন্দিরে; রাত্রি শোনে বন্ধুরূপে
গুমরি ক্রন্দন তব রুদ্ধ অনুতাপে ফুলে ফুলে।’ (সমুদ্রের প্রতি)

বেলাভূমিতে একাকী সমুদ্রের মুখোমুখি বসে রইলাম। আকাশে ক্ষীণ চাঁদের আলোয় পরস্পরের অস্পষ্ট মুখ দেখলাম। দিগন্ত প্রসারিত আকাশ ও অনন্ত সমুদ্রের কাছে আমি বিলীন হয়ে গেলাম। এক নিমিষে পৌঁছে গেলাম অন্য এক জগতে। জানিনা এভাবে কতক্ষণ বসেছিলাম। তারপর এক নিবদম্পতির কলহাস্যে চেতনা ফেরায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে পড়লাম। আমার প্রথম দিনের সফর পূর্ণতা পেল।
পরদিন অনেক ভোরে উঠলাম। পূর্ব দিগন্ত লাল আভায় সেজে সূর্য দেবের অপেক্ষা করছে। খানিকপরে অনেক মানুষের ভিড় জমে উঠল সূর্যোদয় দেখার জন্য। সকালের নতুন ও নরম আলোর তাপে কী অপূর্ব লাগছে প্রিয়তমাকে যেন বাসরঘরে নববধূর ঘোমটা সরিয়ে মুখাবলোকন, লজ্জায় রাঙা মুখখানিতে কী মাধুর্য। সদ্য স্নাত হয়ে কপালে লাল টিপ পরে সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। তার রূপ লাবন্যে মুগ্ধ হয়ে চোখ সরাতে পারলাম না। কিন্তু চারিদিকের এত কোলাহলে সেই সৌন্দর্য সুধা আমি আকণ্ঠ পান করতে ব্যর্থ হলাম। আমি চোখ নামিয়ে ফিরে এলাম।

অন‍্যান‍্য দর্শনীয় স্থান –
আজকের গন্তব্য পুরীর বিখ্যাত বিখ্যাত সব মন্দির দর্শন। প্রথমেই গেলাম গুণ্ডিচামন্দির, বাগানে সুসজ্জিত এই মনোরম মন্দিরে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে গেলাম মার্কেণ্ডেশ্বর মন্দিরে। এই মন্দিরের আকর্ষণীয় বিষয় হল দশহাত যুক্ত নটরাজের বিশালাকার মূর্তি। এরপর চলে গেলাম সাক্ষী গোপাল দেখতে। এছাড়াও যাওয়ার পথে পড়ল অসংখ্য ছোটো ছোটো মন্দির। একে একে সব মন্দির দর্শন করে রওনা দিলাম চিল্কা হ্রদের উদ্দেশ্যে। কতবার বদ্ধ ঘরের ক্লাসরুমে বইয়ের পাতায় চিল্কার কথা পড়েছি, ছবি দেখেছি। সেই বইয়ের পাতার নীরস ছবি যখন জীবনের খাতায় সজীব হয়ে ওঠে তার আনুভূতিই যেন আলাদা। সেই সময় যদি চিল্কা দেখতে আসতে পারতাম তবে বারবার জোরপূর্বক বইয়ের পাতা মুখস্ত না করেই পরীক্ষার খাতায় ভালো নম্বর নিয়ে আসতে পারতাম। ছাত্রছাত্রীদের যদি নীরস নোট বা বই না পড়িয়ে প্রকৃতির কাছে নিয়ে গিয়ে শেখানো হত তাহলে সত্যি হয়তো তারা চিরকাল সেই জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারত অন্তত ক্লাসের গণ্ডি পেরেয়ি বেমালুম ভুলে যেত না। চিল্কা পৃথিবীর দ্বিতীয় ও ভারতের বৃহত্তম লেগুন। প্রায় ৫২টি নদী এখানে এসে মিলেছে। এই হ্রদে পাঁচটির মতো দ্বীপ রয়েছে। ভাঁটার সময় দুএকটি দেখা গেলেও জোয়ারে এদের চিহ্নটুকুও থাকে না। সেই দ্বীপে লাল কাঁকড়া দেখতে পাওয়া যায় আর ভাগ্য যদি সুপ্রসন্ন থাকে তো দেখা মেলে ডলফিনের। আরো একটি কারণে এই স্থান সুপ্রসিদ্ধ তা হল পরিযায়ী পাখি। প্রায় ১৬০ ধরণের পাখি এখানে আসে। বোটে করে দুধারে জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ঘুরতে থাকলাম কিন্তু ডলফিনের দেখা মিললো না। কেউ কেউ হতাশ হয়েছেন তবে চারিদিকের সৌন্দর্য আমাকে সেই হতাশা থেকে মুক্তি দিয়েছে। এই সৌন্দর্যে মুদ্ধ হয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ‘পথে প্রবাসে’ নামক ভ্রমণ কাহিনিতে লিখেছেন—
“চিল্কার সঙ্গে এবার আমার দেখা আঁধার রাতের শেষ প্রহরে, সুন্দরী তখন স্বপ্ন দেখছে, তার দিগন্তজোড়া চোখের পাতায় যোগমায়ার অঞ্জন শ্বেতাভ হয়ে আসছে।” কত কাব্যময় তার দৃষ্টিভঙ্গি, কত মধুর সেই দেখা। এখানে আসা পর্যন্ত একটি দৃশ্য আমি সর্বত্রই দেখতে পাচ্ছি। সকলেই নিজের সেলফোনে নিজের সঙ্গে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ফ্রেমবন্দি করতে ব্যস্ত। যে খোলা আকাশের নীচে বাঁধনহারা পাগলপারা উচ্ছ্বল আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে থাকে তাকে কী এত সহজে মুঠোবন্দি করা যায়? নিজেকেও মুক্ত করে সেই আনন্দধারায় উজার করে দিতে পারলেই তো উপভোগ করা যাবে তার যথার্থ সৌন্দর্য। ছবি তোলার ব্যস্ততায় আমরা আসল জিনিসের পরবর্তীতে নকলকে দেখার উৎসাহে আসলকেই ফাঁকি দিয়ে বসে থাকি।
বুদ্ধদেব বসুও এই হ্রদ দেখে লিখেছিলেন—
সন্ধে হলো। চিল্কার প্রসার দুধের মত ম্লান। জলের উপরে পাখির ঝাঁক। স্বচ্ছ নীল আকাশে নতুন বাঁকা চাঁদ প্রকাণ্ড একটা মুক্তার মত জ্বলছে।’(আমি চঞ্চল হে)
কত প্রাঞ্জল গদ্যে শব্দচিত্র নির্মাণ করেছেন লেখক। তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে পাঠক অনায়াসে ভ্রমণ করে আসতে পারেন। চিল্কার যে রূপ আমি দেখেছি তা হয়তো আমি ভাষায় ব্যক্ত করতে অক্ষম তাই সেই খামতি পূরণে আমার দুই প্রিয় লেখকের স্মরণাপন্ন হলাম। 

উপসংহার : ফেরার পালা –
এবার ফেরার পালা। প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদের সময় মন বলে ওঠে— ‘যেতে নাহি দিব’ কিন্তু সময়ের স্রোতে যেতে দিতে হয়, চলে যেতে হয়। আমার মনে হয় মাঝে মাঝে এই বিচ্ছেদ ভালো। অপেক্ষার প্রহর গুণে পথের পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার মধ্যে ভালোবাসার উত্তাপ খুঁজে পাওয়া যায়। বিরহের কাঁটা একদিন মিলনের ফুল হয়ে ফোটে। আবার আসব ফিরে শহরের কংক্রিট ব্যস্ততায় ক্লান্ত হয়ে কোনো এক রাতে মুক্তির আলো পেতে আবার আসব ফিরে আর গাইব-
এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।’