শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য : কৃষ্ণ চরিত্র

কলমে – নম্রতা বিশ্বাস, এম.এ , বি.এড, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়


প্রাক-চৈতন্যযুগে বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রমাণিত গ্রন্থ হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য। এই কাব্যটি আদি-মধ্য যুগের বাংলা ভাষায় রচিত দ্বিতীয় প্রাচীনতম নিদর্শন। লোকায়ত প্রেমের প্রতিচ্ছবি সর্বপ্রথম ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের মধ্যেই ধরা পড়েছে। বাংলাসাহিত্যের প্রথম আখ্যানধর্মী প্রেমের দৃষ্টান্ত এই কাব্য।
এই গ্রন্থের রচনাকাল নিয়ে বিশিষ্টব্যক্তিদের মধ্যে অনেক মত পার্থক্য লক্ষ‌ করা যায়। বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মতে ১৩৮৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এই গ্রন্থটি রচিত অন্যদিকে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা করে দেখেছেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের ভাষা আদি মধ্যযুগের আদর্শরূপ। ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে, ১৪৫০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উক্ত কাব্যটি রচিত হয়েছে। বহু সমালোচক বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের তুলোট কাগজ ও লিপি দেখে এর প্রাচীনতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও কাব্যটির ভাব বিষয় ও ভাষা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে কাব্যটি চৈতন্যপূর্ববর্তী যুগের ।

     

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা গ্রামের শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির গোয়ালঘরের মাঁচায় অযত্নে রাখা কয়েকটি পুঁথির ভিতর থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের খণ্ডিত পুঁথিটি আবিস্কার করেছিলেন বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ। দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন রাজগুরু শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র বংশীয়। পরবর্তীতে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বল্লভ ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে পুঁথিটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত করেছিলেন। উক্ত কাব্যটির নামকরণ নিয়েও যথেষ্ট মতবিরোধ লক্ষ করা যায়। পুঁথিটিতে প্রথম ও শেষ কয়েকটি পৃষ্ঠা না থাকার কারণে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের পক্ষে পুঁথিটির নাম জানা সম্ভব না হওয়ায় তিনি বিষয়বস্তু অনুসারে নামকরণ করেছিলেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কিন্তু পরবর্তীতে পুঁথিটির মধ্যে একটি চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল তাতে লেখাছিল ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’ এই নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিল অনেকের মতে উক্ত গ্রন্থটির নাম এটি, আবার অনেকের মত প্রকাশ করেছিলেন যে এই ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’ নামটি শ্রীজীব গোস্বামীর রচিত গ্রন্থটিকে বলা হয়েছে। আলোচ্য কাব্যটি অবশ্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামেই অধিক প্রচলিত বাংলা সাহিত্যে।

    ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য তেরোটি খণ্ডে বিভক্ত, কাব্যের কাহিনী যে তিনজন ব্যক্তির উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে তাঁরা  হলেন কৃষ্ণ, রাধা ও বড়াই । মূলত এঁরাই কাব্যের মূল চরিত্র। আলোচ্য কাব্যের কৃষ্ণ চরিত্রটি বিশ্লেষণ করলে লক্ষ করা যায় যে অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে উক্ত চরিত্রটির কোনো সামঞ্জস্য নেই। বাঙালিদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ দৈব মহিমান্বিত, প্রেমিক অথচ সম্ভ্রম উদ্রেককারী ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত কিন্তু বড়ুচণ্ডীদাস তাঁর কাব্যে কৃষ্ণকে সেইভাবে একেবারেই দেখাননি‌। বরং বড়ুচণ্ডীদাসের কৃষ্ণ চরিত্রের মধ্যে কামপ্রবৃত্তির আধিক্য, বালসুলভতা, লঘুকৌতুক ও গ্রাম্যতা বৃত্তির মিশ্রণ ঘটেছে, তাঁর দেবমহিমার কোনো কিছুই লক্ষ করা যায়নি আলোচ্য কাব্যের মধ্যে। কবি তাঁর কৃষ্ণকে এখানে মধ্যযুগের এক রক্তমাংসের গ্রাম্য যুবক হিসেবে তুলে ধরেছেন।  কবি রাধা চরিত্রের মধ্যে যে বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন কৃষ্ণ চরিত্রে সেইরূপ বিকশিত করে তোলেন নি। অনেকের মতে কৃষ্ণ চরিত্রকে যদি এমন ভাবে গড়ে না তোলা হতো তাহলে রাধা চরিত্রের ক্রমবিকাশ লক্ষ করা যেত না।

অধ‍্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মতে,
“ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের শ্রেষ্ঠত্বের সবটুকু আত্মসাৎ করিয়াছে  রাধা । যাহার নাম  কীর্তন করিতে কাব্যটির রচনা সেই শ্রীকৃষ্ণই উহার দোষের আশ্রয় । কাব্যটির যত কিছু দুর্নাম কৃষ্ণের জন্য।”– (মধ্যযুগের কবি ও কাব্য ) ।

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কৃষ্ণ চরিত্রের পৌরাণিক কাঠামোই শুধু লক্ষ করা যায়। ‘জন্ম খণ্ড’-এ দেখা যায় কংসাসুরের নিধনের জন্য স্বয়ং বিষ্ণুকে স্বর্গলোকের দেবতারা মরতে প্রেরণ করিয়েছিলেন-
ব্রহ্মা সব দেব লআঁ গেলান্তি সাগরে । স্তুতীএঁ তুষিল হরি জলের ভিতরে॥
তোহ্মে নানা রূপেঁ কইলেঁ অসুরের খএ। তোহ্মার লীলাএ কঃসের বধ হএ॥”
কিন্তু এই কথা কাব্যের প্রথমে উল্লেখিত হলেও পরবর্তীতে কাব্যের মধ্যে কৃষ্ণের সেই কর্তব্য পালনের চিহ্নমাত্র দেখা যায়নি। অন্যদিকে দেখাযায় লক্ষ্মীর রাধা রূপে জন্মই হয়েছে “কাহ্নাঞিঁর সম্ভোগ কারণে”। সমগ্র কাব্যের শুধুমাত্র ‘জন্ম খণ্ডে’ এই পৌরাণিক বিষয় লক্ষ করা গেলেও পরবর্তী ‘তাম্বুল খণ্ড’ থেকে ‘রাধা বিরহ’ পর্যন্ত কোথাও এই পৌরাণিক দেবমহিমার লক্ষণ প্রকাশিত হয় নি। বরং ‘তাম্বুল খণ্ডে’ দেখা যায় বড়াই রাধাকে অন্বেষণ করতে গিয়ে কৃষ্ণের সাথে দেখা হলে বড়াইয়ের কাছে রাধার রূপ বর্ণনা শুনে কৃষ্ণ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বড়াইয়ের কাছে তাম্বুলসহ প্রেম প্রস্তাব পাঠান-
“পুনরপি যাহা: প্রাণের বড়ায়ি: তাম্বুলেঁ ভরাআঁ ডালী।”
কিন্তু রাধার সেই প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান এবং বড়াইকে প্রহার স্বরূপ, বড়াইয়ের প্ররোচনায় কৃষ্ণ তাঁর মান রক্ষার্থে রাধাকে কিভাবে জব্দ করা যায় তাঁরই সন্ধি করেন বড়াইয়ের সাথে।

এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক নরেশচন্দ্র জানা মন্তব্য করেছেন যে –
“তাম্বুল খণ্ডে বড়াইকে অপমান করার পর কৃষ্ণের তীব্র প্রবল ক্রোধের ‘উদগীরণ কৃষ্ণ সম্পর্কে আমাদের এতদিনের গড়ে তোলা সমস্ত ধ্যান – ধারণাকে ছিন্ন – ভিন্ন করে দেয়।”
[ “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: কৃষ্ণচরিত্র”; অধ্যাপক নরেশচন্দ্র জানা সম্পাদিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনচর্চা গ্রন্থভুক্ত; উল্লেখিত; ২৪০ পৃ. ]

দানখণ্ডে’ কৃষ্ণ মথুরায় যাওয়ার পথে দানী সেজে মহাদান চান রাধার কাছে আর সেই দান ছিল বারো বছরের দান –
“বারহ বরিষেকের মোর মাহাদান । শুন তোহ্মে আল রাধা পাঁজী পরমান॥”
এমনকি কৃষ্ণকে রাধার বিভিন্ন অঙ্গের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতেও দেখা যায়, যা কোনো ভাবেই রুচি সম্মত ছিল না। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কৃষ্ণের আত্ম অহমিকা প্রকাশের স্বরূপ অনেক যায়গাতেই লক্ষ করা গিয়েছে। –
“প্রাণে মারিবোঁ কংসাসুর মোএঁ হেলে। দান লইবোঁ তোক ধরিবোঁ বলে॥”
উক্ত খণ্ডে লক্ষ করা যায় রাধার সমস্ত অনুরোধ অনুনয় উপেক্ষা করে তাঁর সাথে জোর পূর্বক মিলিত হতে কৃষ্ণ বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হননি।

অধ্যাপক নরেশচন্দ্র জানার মতে,
“দানখণ্ডে অনিচ্ছুক রাধার অঞ্চল ধারণ করেছেন কৃষ্ণ। প্রান্তরে একাকিনী এক বালিকার প্রতি তাঁর এই আচরণকে কোনো মতেই ক্ষমা  করা যায় না। …. এই কি অবতার পুরুষের পরিচয় ? এতো এক উদ্ধত, জেদী, হৃদয়হীন অথচ নারীদেহলোলুপ গ্রাম্য, বর্বর, অসংস্কৃত যুবক।”
[ “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: কৃষ্ণচরিত্র”; অধ্যাপক নরেশচন্দ্র জানা সম্পাদিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনচর্চা গ্রন্থভুক্ত; উল্লেখিত; ২৪১ পৃ. ]

নৌকাখণ্ডে’ লক্ষ করা যায় অনেক দিন ধরে রাধার দেখা না পেয়ে কৃষ্ণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে ফলে তিনি বড়াইয়ের সাথে যুক্তি করেন, রাধার সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ করার জন্য। –
“আহ্মে রাধা লআঁ যাইব মথুরার হাটে। নাঅ লআঁ থাক তোহ্মে যমুনার ঘাটে॥
তোহ্মার বচনে আহ্মে হরষিত মনে। নাঅ বান্ধিতেঁ গিআঁ করিউ যতনে॥”
বড়াইয়ের অনেক অনুনয়ের পর রাধা অন্যপথ দিয়ে পুণর্বার মথুরায় যাওয়ার জন্য সম্মত হলে বড়াই তাঁকে যমুনার ঘাটে নিয়ে যান এবং সেখানে ঘাটিয়াল রূপী কৃষ্ণের দেখা পান। কৃষ্ণ রাধার সমস্ত সখীদের পার করে দেওয়ার পর শেষে একা রাধাকে নৌকায় নিয়ে যান এবং মাঝনদীতে ভয় দেখিয়ে নৌকা ডুবিয়ে তাঁর সাথে কৌশলে মিলিত হন। এই দৈহিক সম্পৃক্তির ফলে রাধার মনে ধীরে ধীরে প্রেম চেতনা মুকুলিত হলেও কবি কৃষ্ণ চরিত্রের মধ্যে তেমন কিছু ফুটিয়ে তোলেন নি।

ভারখণ্ডে’ এসে অবশ্য দেখা যায় কৃষ্ণ রাধার চাতুরির কাছে হার মেনেছিলেন। –
“ঝাঁট ভার লঅ কাহ্নাঞিঁ দৃঢ় করি দড়ী । দধি নঠ হৈলেঁ লৌবোঁ তিন গুণ কৌড়ী॥
এই খণ্ডে দেখা যায় রাধার রতিসুখ দেওয়ার আশায় কৃষ্ণ তাঁর দইয়ের পসরা বহন করেন ঠিকই –
“আল কাহ্নাঞিঁ সুনীএ বচন রাধারে । কান্ধে তুলী লৈল দধিভারে।।”
কিন্তু রাধার ছলকে লঙ্ঘিত করার জন্য কৃষ্ণ রতির আশায় রাধার সঙ্গ ছাড়েননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘ভারখণ্ডান্তর্গত ছত্রখণ্ড’-এ লক্ষ করা যায় রাধা রতিদানে সম্মতি দিলেও শর্ত প্রদান করেন যে কৃষ্ণকে তাঁর মাথায় ছাতা ধরতে হবে-
“আপণে মাথার ছত্র ধরু মোর মাথে । তবেঁ মো শৃঙ্গার বড়ায়ি দিবোঁ জগন্নাথে॥”
কিন্তু দেখা যায় কৃষ্ণ এই কাজে অপমানিত বোধ করেন এবং রাধাকে কটু কথা বলতেও তাঁর দ্বিধা বোধ হয়না –
“বিমতী তেজহ রাধা দেহ শৃঙ্গারে। আহ্মা ভণ্ডিবারে কেহ্নে পাত পরকারে॥”
পরবর্তী ‘বৃন্দাবনখণ্ডে’ কৃষ্ণ চরিত্রের মধ্যে লক্ষ করা যায় বিশিষ্টতা। জয়দেবর ‘গীতগোবিন্দে’ দেখা যায় কৃষ্ণ রাধাকে ত্যাগ করে অন্য সব গোপিনীদের নিয়ে বিহার করলেও বড়ু চণ্ডীদাসের  ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের’ কৃষ্ণ রাধার অনুরোধেই গোপিনীদের সঙ্গে বিহার করেছিলেন। কৃষ্ণ যে রাধার প্রতি আকর্ষিত সেই বিষয়টি এখানে তুলে ধরা হয়েছে, বলা যেতে পারে –
“মন ঝুরে তোর নামে ল সংসারত তোহ্মা কৈলোঁ সারে।
তোর বোলেঁ গোপীগণে ল তুষিআঁ তেজিলোঁ পরকারে॥”

যমুনান্তর্গত কালিয়দমনখণ্ডে’ দেখা যায় কৃষ্ণ তাঁর জলবিহারের ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার জন্য বিষধর সাপ কালীয়কে মেরে কালীয়দহ থেকে দূরীভূত করেছিলেন –
“কাহ্নের আদেশ হেন পাআঁ নাগ কালি । সাগরক গেলা সব পরিজন মেলী॥”
শুধু স্থল বিহারে নয় জলবিহারেও কৃষ্ণ তাঁর স্বাভাবিক পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন –
“জলে ডুবিল জনার্দ্দনে। আল রাধার ছুয়িল জঘনে চমকিলী রাধা উঠিআঁ দেখিল কাহ্নে॥”
যা একেবারেই প্রশংসাযোগ‌্য নয়। ‘যমুনান্তর্গত বস্ত্রহরণখণ্ডে’ কৃষ্ণ ছল করে রাধা ও তাঁর সখীদের বস্ত্রহরণ করেন এবং রাধাকে বলেন “ তড়াত উঠিআঁ রাধা করযোড়হাথ।”
এমনকি রাধাকে অশ্লীল কথা বলতেও তাঁর বাধে না। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর কৃষ্ণ বস্ত্রদ্বয় ফেরত দিলেও রাধার সাতেসরি হার নিজের কাছে রেখে দেন। ‘হারখণ্ডে’ দেখা যায় রাধা যশোদাকে গিয়ে কৃষ্ণের নামে অভিযোগ করলে কৃষ্ণ তাঁর সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং যশোদার কাছে নিজেকে ভালো প্রমাণিত করার জন্য রাধাকেই বরং অপমানিত করেন-
“বেআকুলী হআঁ রাধা মদনবিকার। দুইকান্ধ ফুলায়িল বহায়িআঁ দধিভারে॥”
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কৃষ্ণ চরিত্রের মধ্যে যে দিকটি সবচেয়ে বেশি করে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন সেটি হলো তাঁর প্রতিশোধস্পৃহা। আর এই প্রতিশোধস্পৃহার প্রবল নিদর্শন লক্ষ করা গিয়েছে ‘বাণখণ্ড’-এ। নিজের মায়ের কাছে নিন্দিত হয়ে, শাস্তিস্বরূপ রাধার উপর বাণ নিক্ষেপ করতে তাঁর বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ হয়নি –
“বাম হাথে ধনুক ডাহিণ হাথে বাণ। রাধার হিআত মাইল সুদৃঢ় সন্ধান॥”
এমনকি বড়াইকে এই কথাও তিনি বলেছেন যে-
“আহ্মার করিল বাধা বড়ায়ি খাঁখার। আবসি করিবোঁ প্রতিকার॥
আপণে করিব আহ্মে তেহেন উপায়। যেহ্ন রাধা পড়ে মোর পাএ॥
মরমে হানিবোঁ তারে মনমথবাণে। নিবেদিলোঁ তোহ্মার চরণে॥
সব লোকেঁ হাসে যেহ্ন দিআঁ করতালি। তেহ্ন তারে করায়িবোঁ বিকলী॥”
এই নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণের চেতনাহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। সমগ্র কাব্যের মধ্যে একাধিকবার দৈহিক সম্পৃক্তির উল্লেখ পাওয়া গেলেও কৃষ্ণের মধ্যে রাধার প্রতি কোনো মানবিক চেতনা জাগ্রত হতে দেখা যায়নি। উক্ত খণ্ডে লক্ষ করা যায় কৃষ্ণ পরবর্তীতে রাধার চেতনা যত্ন করে জাগ্রত করেছিলেন ঠিকই কারণ বাণের আঘাতে রাধা মূর্ছিত হয়ে পরলে বড়াই তীব্র ভাবে ভর্ৎসনা করেছিলেন –
“আছিদর কাহ্নাঞিঁ পথত  কৈলেঁ বলে। আপণার সুখে বসী কলমের তলে  ।।
পরাণে মারিআঁ রাধা পাঁচশরবাণে। এবেঁ কি বোলহ মো ছাড়িলোঁ সব দানে ।।”
এছাড়া তাঁকে বেঁধেও রেখেছিলেন –
“এবেঁ যাবত না কর রাধার জীবনে । তাবত বান্ধিআঁ তোকে রাখিলোঁ মো কাহ্নে।। ”
এরপর কৃষ্ণ নিজেকে বাঁচানোর জন্য বড়াইকে আশ্বাস দেন যে তিনি রাধাকে বাঁচিয়ে তুলবেন। –
যে বচন বোলোঁ মোঁঞ তাত নাহিঁ বাধা। জিআইআঁ দিবোঁ মো চন্দ্রাবলী রাধা।।
বংশীখণ্ডে” রাধা কৃষ্ণের বাঁশি লুকিয়ে রাখলে তাঁকে “নটকী গোআলী ছিনারী পামরী” প্রমুখ কটুক্তি করতেও তাঁর দ্বিধাবোধ লক্ষ করা যায়নি। এমনকি ভয় দেখানোর জন্য রাধাকে “পরাণ তোর লৈবোঁ অবিচারে” বলতেও তিনি পিছপা হননি। শেষে বাঁশি না পেয়ে তাঁকে শিশুর মতো “হাপুসনয়নে” কাঁদতেও দেখা যায়। তাঁর এই কান্না ভীরুতার নিদর্শন নয় বরং অপরিশীলিত মানসবৃত্তির ফল।

এই প্রসঙ্গে সত্যবতী গিরি মন্তব্য করেছেন – “বাঁশি হারিয়ে কৃষ্ণের কান্নাও তার ভীরুতার নয়- অপরিশীলিত মানসবৃত্তিরফল ।”

রাধাবিরহে” দেখা যায়, মথুরায় যাওয়া আগে বড়াইকে কৃষ্ণ বলেছেন রাধার যত্ন নিতে –
“তাক রাখিহ যতনে আপণ অন্তরে জাইব আহ্মে মথুরা নগরে ।। ”
এই অনুরোধ কৃষ্ণ চরিত্রের মধ্যে দেহলোলুপতার আড়ালে হৃদয়ানুভূতি উন্মেষের সাক্ষর বলা যেতে পারে।

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের কৃষ্ণ চরিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিচার করলে দেখা যায় তাঁর মধ্যে শূন‍্যগর্ভ আস্ফালন, উগ্র কামলোলুপতা এবং বাসনাপূরণে ব্যর্থ হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের কুটিল ইচ্ছা প্রমুখ রয়েছে৷ এমনকি রাধার প্রতি তাঁর প্রেমের তেমন কোনো নিদর্শনই লক্ষ করা যায়নি বরং যে ভাষায় তিনি রাধাকে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এবং শারীরিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়েছেন তাতে তাঁর দৈবিক প্রেম লঙ্ঘিতই হয়েছে। কিন্তু কাব্যে কবি এখানে কৃষ্ণের পৌরাণিক মহিমার উপস্থিতি ঘটিয়ে যেমন সাধারণ মানবজাতির মনে ঐশ্বর্যমিশ্র ভক্তিরস জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন তেমনি আবার কাব্যকে লোকরঞ্জক করার জন্য চরিত্রগুলিকে রক্তমাংসে গড়ে বাস্তবায়িত করে তুলেছেন। ফলে উক্ত কাব্যের কৃষ্ণ চরিত্র বিচার করার সময় এইকথা ভুললে চলবে না যে তিনি এখানে এক অমার্জিত গ্রাম্য গো-রক্ষক তরুণ। বড়ুচণ্ডীদাস কৃষ্ণ চরিত্র নির্মাণে পৌরাণিক সংস্কারের উর্ধ্বে লোকায়ত জীবন প্রবণতাকে জয়ী করেছেন জন্যই তাঁর কৃষ্ণ চরিত্রকে অসঙ্গত বলা চলেনা বরং তিনি কবির হাতে নির্মিত তৎকালীন সময়ের জীবন্ত মানুষের স্বরূপ।