বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী
কলমে: অদিতি সিংহ, স্নাতকোত্তর বাংলা, (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
● ভূমিকা:
উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য বাঙালি উপন্যাসিক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিশেষত তিনি কমলাকান্ত ছদ্মনামে সাহিত্য রচনা করতেন। বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস ও গদ্যে তিনি অমরত্ব লাভ করেন। প্রথম বাংলা আধুনিক উপন্যাসিক হিসেবে গৌণ করা হয়। বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয়, এবং বাংলা সাহিত্য সম্রাট হিসেবেও তিনি পরিচিত।
● জন্ম ও বংশপরিচয়:
জন্মসূত্রে তিনি বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি তারিখ ২৬ জুন, ১৮৩৮ অর্থাৎ ১৩ আষাঢ় ১২৪৫ জন্মগ্রহণ করেন। রামহরির পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, মাতা দুর্গাসুন্দরী দেবী। বঙ্কিমের পূর্বে তার আরও দুই পুত্রের জন্ম হয় – শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের জন্মকালে তিনি সদ্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের পুত্র সন্তান ছিলনা। তাঁর তিন কন্যা সন্তান ছিলেন শরৎকুমারী, নীলাজকুমারী ও উৎপলকুমারী। বড় মেয়ে শরৎকুমারীকে খুব ভালোবাসতেন বঙ্কিমচন্দ্র। আর তাই বড় জামাই রাখালচন্দ্রকে ‘প্রচার’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার দিয়েছিলেন। শরৎকুমারীর ছেলেদের সাথে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেতেন।
শরৎকুমারীর ছেলে শুভেন্দুসুন্দরের সঙ্গে বিবাহ হয় স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে কমলা দেবীর। তাঁর মেজ মেয়ে নীলাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে হয়, উত্তরপাড়ার জমিদারবাড়ির ছেলে সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আর ছোটো মেয়ে উৎপলকুমারীর বিয়ে হয়েছিল উত্তর কলকাতার এক ধনী পরিবারের ছেলে মতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
কিন্তু ছোটো মেয়ের সুখ টেকেনি। মতীন্দ্রনাথ ওষুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে উৎপলকুমারীরকে মেরে ফেলে।
● শিক্ষাজীবন:
শিক্ষাজীবন শুরু হয় মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই। কুল পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে হাতেখড়ি; এরপর ১৮৪৪ এ তাঁর বাবার মেদিনীপুরে বদলি হলে, সেখানে ইংরেজী স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করেন। আবার ১৮৪৯ সালে কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন। তারপরে শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বাংলা এবং সংস্কৃত শিক্ষা গ্রহণ করেন।
১৮৪৯ সালে হুগলী কলেজিয়েট স্কুলে ( অধুনা হুগলি মহসিন কলেজ) ভর্তি হন। এখানে ৭ বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন। এই স্কুলে থেকেই তিনি লিখেছিলেন জীবনের প্রথম কবিতা। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের “সংবাদ প্রভাকর” এবং “সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য” রচনা করেন। এই একই বছরে আইন নিয়ে পড়বার জন্য কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। তখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন লাভ করে নি। ১৮৫৭ তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়। এরপর ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্টস নিয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৮৫৮ তে প্রথমবারের মতো বি.এ পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেই পরীক্ষায় ১০ জন ছাত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে যদুনাথ বসু ও বঙ্কিমচন্দ্র উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
● কর্মজীবন:
পিতার আজ্ঞা মেনে তিনি সাব-অর্ডিনেট এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে যোগ দেন। দক্ষতার সঙ্গে সরকারি কাজকর্ম নির্বাহ করার জন্য ১৮৯১ সালে ‘রায়বাহাদুর’ এবং ১৮৯৪ সালে ‘Companion of the Most Eminent Order of the Indian Empire’ (CMEOIE) উপাধি প্রদান করে। পরবর্তীতে ১৮৯১ সালে সুদীর্ঘ ২৩ বছরের চাকরি থেকে অবসর নেন এবং এই বছরেই বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হয়। তিনি ব্রিটিশ রাজের কর্মকর্তা ছিলেন। তাই বিভিন্ন প্রান্তে তাঁকে যেতে হত। নীচে রইল তালিকা – যশোর (বর্তমানে বাংলাদেশ) – ১৮৫৮
নেগুয়া (মেদিনীপুর) – ১৮৬০ এর ফেব্রুয়ারি
খুলনা (বর্তমানে বাংলাদেশ) – ১৮৬০ এর নভেম্বর
বারুইপুর (দক্ষিণ ২৪ পরগনা) – ১৮৬৪
মুর্শিদাবাদ – ১৮৬৯ থেকে ১৮৭১
কোলকাতা – ১৮৮১
আলিপুর – ১৮৮২
জাজপুর (কটক) – ১৮৮৩
হাওড়া -১৮৮৩
ঝিনাইদহ – ১৮৮৫
● বাংলা সাহিত্যে অবদান:
১৮৬৪ সালে খুলনা ছেড়ে বারুইপুরে চলে আসেন, চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। আর তখনই তিনি লেখেন, ‘Rajmohan’s Wife’ । এরপর ১৮৬৫ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস “দূর্গেশনন্দিনী”। এই উপন্যাসের তিলোত্তমা চরিত্র তাঁর প্রথম স্ত্রী মোহিনীর আদলে গড়া। এরপর ১৮৬৬ সালে প্রকাশ পায় “কপালকুণ্ডলা”। এই উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর মেজদাদা সঞ্জীবচন্দ্রকে। চাকুরীতে কর্মরত অবস্থায় ১৮৬৭ সালে তিনি আবার আইন কলেজে ভর্তি হন। ১৮৬৮ সালে আবার ফিরে আসেন বারুইপুরে, প্রস্তুতি নেন আইন পরীক্ষার। ১৮৬৯ সালে আইন পরীক্ষায় পাশ করে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। এই একই বছরে “মৃণালিনী” প্রকাশ পায়। পাশাপাশি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর ১৮৭০ সালে ইংরেজি “Buddhism and the Sankhya Philosophy” প্রকাশ হয়। ১৮৭২ সালে প্রকাশ পায় তাঁর সম্পাদিত “বঙ্গদর্শন” পত্রিকা।
এর পাশাপাশি বহু বিবাহ, ব্রাহ্ম আন্দোলন, সমাজসংস্কার সহ ভিন্ন রকম আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৮৮২ সালে প্রকাশ পায়, তাঁর বিখ্যাত “আনন্দমঠ” উপন্যাসটি। এই উপন্যাসের “বন্দে মাতরম” গানটি ১৯৩৭ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
এরপর ১৮৮৫ সালে ‘ঈশ্বর গুপ্তের জীবনচরিত কৃতিত্ব’ প্রকাশ পায়। এছাড়াও লিখেছেন, লোক রহস্য, দেবী চৌধুরানী, বিবিধ প্রবন্ধ, কমলাকান্ত, সীতারাম, মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত, কৃষ্ণ চরিত্র, ধর্ম্মতত্ত্ব ইত্যাদি। “দেবী চৌধুরাণী” উপন্যাসে ব্রজেশ্বরের মায়ের চরিত্রটি তাঁর মা দূর্গাসুন্দরীর আদলে তৈরি করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সব উপন্যাস ইংরেজি, জার্মান, হিন্দি, কানাড়া, তেলেগু প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মোট ১৫টি উপন্যাস লিখেছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল ইংরাজীতে – rajmohan’s wife.
‘দুর্গেশনন্দিনী'(১৮৬৫)
‘কপালকুণ্ডলা'(১৮৬৬)
‘মৃণালিনী'(১৮৬৯)
‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩)
‘ইন্দিরা'(১৮৭৩)
‘যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৮৭৪)
‘রাধারাণী’ (১৮৭৫)
‘চন্দ্রশেখর’ (১৮৭৫)
‘রজনী’ (১৮৭৭)
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮)
‘রাজসিংহ’ (১৮৮১)
‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২)
‘দেবী চৌধুরাণী’ (১৮৮৪)
‘সীতারাম’ (১৮৮৭)
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধগুলি ছিল,
ললিতা তথা মানস (১৮৫৬)
লোক রহস্য (১৮৭৪)
কমলাকান্তর দপ্তর (১৮৭৫)
বিজ্ঞান রহস্য (১৮৭৫)
কৃষ্ণচরিত ( ১৮৮৬)
ধর্মতত্ত্ব (১৮৮৮)
দেবতত্ত্ব (মরণোত্তর প্রকাশিত)
● অজানা তথ্য:
• বঙ্কিমচন্দ্রের বাসস্থান সংস্কারের পর তৈরি হয়েছে বঙ্কিম ভবন। সেখানে রয়েছে একটি সংগ্রহশালা একটি হলঘর। সেখানে রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত লেখার টেবিল ও চেয়ার।
• বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তীব্র সমালোচক ছিলেন। বিদ্যাসাগরের প্রতি এতটাই তিনি সমালোচক, শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগর বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নীচে তাঁর স্থান।
• দ্বিতীয় স্ত্রী রাজলক্ষী ছিলেন তাঁর বন্ধু, তাঁর সঙ্গীনি। কিন্তু অবচেতনে ছিলেন প্রথম স্ত্রী মোহিনীদেবী। আর তাই তো মৃত্যুর আগেও রোগশয্যায় শুয়ে বলেছিলেন, ‘মোহিনী! মোহিনী! আমি এবার তার কাছে যাব’।
• শৈশব জীবনে বঙ্কিমচন্দ্রের খেলার নেশা ছিলনা, ছিলনা খেলা দেখার নেশা। বরং ছিল তাস খেলার নেশা। তাই স্কুল ছুটির পর বন্ধুদের নিয়ে তাস খেলতেন।
• বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠ উপন্যাস লেখার আগেই লিখেছিলেন ‘ বন্দেমাতরম’। আসলে লেখার সময় ম্যাটার কম পড়ত, আর তাই পাতা ভরানোর জন্য গানটি সংযোগ করেছিলেন।
• বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষ জীবনটা কেটেছিল, এই কলেজ স্ট্রিটেই। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উলটো দিকে প্রতাপ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে থেকে জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেন। বর্তমানে সেই ভগ্নপ্রায় বাড়ি ভেঙে করা হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি গ্রন্থাগার। ২০০৬ সালে এটির উদবোধন হয়।
• আফিম মেখে ঢুলু ঢুলু চোখে লিখে ফেলতেন বঙ্গদর্শনের পাতা।
• বঙ্কিমচন্দ্র রোদ সহ্য করতে পারতেন না, তাই কোথাও যাওয়ার হলে, ভোরবেলা বেড়াতেন, নয়ত বিকেলবেলা।
• ১৮৯১ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পেয়েছিলেন রায় বাহাদুর খেতাব।
• নবীনচন্দ্র দাসের কাছে তিনি ইংরেজি শেখেন। সংস্কৃত ও গণিত শাস্ত্রে বিশেষ দক্ষতা ছিল।
• বঙ্কিমচন্দ্র শুধু ঔপন্যাসিক নন, তিনি গীতার ব্যাখ্যাদাতা , সাহিত্য সমালোচক হিসাবেও দেশে দেশে জনপ্রিয়।
• বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষাকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে এসেছিলেন, আর তাই তাঁর রচনা ‘বঙ্কিমী শৈলী’ বা ‘বঙ্কিমী রীতি’ নামে পরিচিত।
• অনেকের মতে বাংলাসাহিত্যের প্রথম সার্থক রোমান্টিক উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’।
• বেগম রোকেয়ার আগে পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নারীবাদী লেখক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
● উপসংহার:
বাংলা সাহিত্যে আদর্শমান পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি প্রতি মুহূর্তে নিজের সাহিত্য ভাবনা ও চেতনাকে সকলের মাঝে প্রচার করেছেন। তিনি নিজের উপন্যাসের নারী চরিত্রদের খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতেন রক্তে মাংসময় এক একটা মানবী চরিত্রে গড়ে তুলতেন। সমসাময়িক জীবনে বাংলা সাহিত্যের একজন আদর্শ মান ব্যক্তি, যিনি সাহিত্য সম্রাট নামে পরিচিত।