টেলিভিশন রচনা

কলমে : অনন্যা সাহা, বি.এ ( বাংলা ), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়


ভূমিকা :
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সমস্ত কাজের মাঝে বিনোদনের একটি বিশেষ স্থান আছে তাই গতানুগতিক কাজের ফাঁকে এই বিনোদনপ্রিয় ব্যক্তিবর্গ কিছু সরঞ্জাম ব্যবহার করে থাকে , সেই সরঞ্জামগুলির মধ্যে অন্যতম হলো টেলিভিশন। সময়ের সাপেক্ষে বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে একটি বিশেষ উল্লেখ্য আবিষ্কার হলো এই টিভি। কারণ পূর্বে দৃশ্যমান চলচিত্রের দেখা মিলতো শুধুমাত্র রঙ্গমঞ্চেই , বিনোদনের জন্য মানুষকে ছুটে যেতে হতো রঙিন মঞ্চের , রঙিন তারকাদের অভিনয় দেখতে। তবে টিভি আসার পরে বিনোদন পৌঁছে যায় ঘরে ঘরে।

সময় যত এগিয়েছে সবের সাথে এই টিভির গুনুমান্যতাও বেড়েছে অধিক পরিমানে, উনিশ শতকের সময়ে টিভি কেনার সামর্থ সাধারণের কাছে ছিলোনা বললেই চলে তবে টিভি ধীরে ধীরে সহজলভ্য হতে শুরু করে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে। বিদ্যুৎ চালিত এই টিভি সহজলভ্য হওয়ার সাথে সাথে মানুষের জীবনে এনে দেয় তাৎক্ষণিক আমোদিত হওয়ার চাবিকাঠি, যে চাবিকাঠি মানুষ হাতছাড়া করেনি কখনো । বর্তমান সময়ে টিভির আকার , প্রকার দুই-ই বদলেছে। আধুনিক টিভির মধ্যে এসেছে অত্যাধুনিক বৈশিষ্ট্য । এই পরিবর্তনের কারণ একটিই সময়ের সাথে মানুষের মানসিকতা ও স্বাদের বদল ।

আবিষ্কার এবং ক্রমবিকাশ :
মূলত অনেকগুলি স্থিরচিত্রের সাহায্যে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অন্যতম স্থান হলো টিভি। টিভি বা টেলিভিশন শব্দটি মূলত গ্রিক ও ল্যাটিন শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। গ্রিক শব্দ ‘টেলি’ অর্থাৎ দূর বা দুরুত্ব এবং ল্যাটিন শব্দ ‘ভিশান’ অর্থাৎ দর্শন বা দেখা এই দুই শব্দ সহযোগে গঠিত টেলিভিশন। উনিশ শতকের ১৮৬২ সালে বিদ্যুৎচালিত তারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম স্থির ছবি সঞ্চারের পরীক্ষাকৃত গবেষণা সার্থকতা লাভ করে। এর পরে বিজ্ঞানী মে ও স্মিথ ১৮৭৩ সালে ইলেক্ট্রিনিক সিগন্যালের মাধ্যমে ছবি সঞ্চারের প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন ।এই প্রযুক্তি আসতে আসতে বিকাশ লাভ করতে থাকে এবং বিজ্ঞানী জন লগি বেয়ার্ড ১৯২৬ সালে প্রথাগত ভাবে সার্থক টেলিভিশন আবিষ্কার করেন। তিনিই প্রথম নির্বিঘ্নে সাদা-কালো ছবি বৈদ্যুতিক মাধ্যমে পাঠাতে সার্থকতা পান ।

১৯৩৬ সালে টিভি মাধ্যমে সম্প্রচারিত হতে থাকে ‘বিবিসি’। পরবর্তীতে নানা গবেষণার পরে টিভি যন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৪৫ সালে। এই ভাবেই টিভির ক্রমবিকাশ সূচিত হয় বিশ্বের দরবারে।  ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ১৯৫৯ সালে প্রথম টেলিভিশনের সম্প্রচার করা শুরু হয়। ১৯৭০ এর মাঝামাঝি সময়ে বাড়তে থাকে টিভি সম্প্রচারের খ্যাতি ‘সাইট’ প্রকল্পের মাধ্যমে। এর ফলে সাধারণ মানুষ টিভির সংস্পর্শে আসতে থাকে। প্রথমে টিভিতে ছবি আসতো সাদায় ও কালোতে ১৯৮২ সালে এশিয়ান গেমস এর আয়োজনের সময় থেকে টিভিতে রঙিন ছবির আগমন ঘটে। জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে উপগ্রহের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক পাঠানোর তোড়জোড়ও বাড়তে থাকে এবং নানা স্থানে তথা দেশে প্রভূত পরিমানে দূরদর্শন কেন্দ্রের স্থাপনা পরিলক্ষিত হয়।

টেলিভিশন-এর গুরুত্ব :
টেলিভিশন এর গুরুত্বকে আমরা কয়েকটি বিষয়ের আধারে ব্যাখ্যা করতে পারি যথা :

•টেলিভিশন এর সংবাদ চ্যানেলের মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তের ঘটে চলা ঘটনাকে তুলে ধরা হয় এছাড়া এর মাধ্যমে বাস্তব ঘটনা ও সমস্যা সম্মন্ধে অবগত হওয়া যায়।

•জনগণের জ্ঞানবৃদ্ধিতে টেলিভিশন এর বিশেষ ভূমিকা আছে। নানান জ্ঞান সম্মত চ্যানেল দেখলে মানুষের জ্ঞানের পরিধি সার্থক ভাবে বাড়ে।

•আধুনিক যুগের প্রেক্ষিতে নানা ধরণের সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে, জনগণের মধ্যে সামাজিক চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রেও টেলিভিশন বিশেষ সাহায্যকারী ।

• ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, বৈজ্ঞানিক পটভূমিতে নির্মিত বিভিন্ন তথ্যচিত্র শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

•বর্তমানে প্রকৃতির প্রতি মানুষের অত্যাচার বাড়ছে ফলে দূষণও বৃদ্ধি পাচ্ছে এই দূষণ রুখতে তথা পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতেও প্রতি চ্যানেলে পরিবেশ সচেতনতামূলক সতর্কতা জারি করা হয়।

•নান্দনিক রুচি, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ইত্যাদির বিকাশের ক্ষেত্রেও টেলিভিশন হলো অনন্য ভূমিকা পালনকারী।

গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন :
জনসাধারণের মধ্যে বৈদ্যুতিক মাধ্যমে হোক বা যেকোনো মাধ্যমে সঞ্চালিত সম্প্রচারকে বলা হয় গণমাধ্যম অর্থাৎ যে মাধ্যম গুলি জনতার সাথে যোগাযোগ ঘটাতে সাহায্য করে তাকেই মূলত বলে গণমাধ্যম। জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালনকারী যন্ত্র হলো টেলিভিশন। এই টেলিভিশন এর মাধ্যমে মানুষ প্রায় উনিশ শতক থেকে নানা ধরণের তথ্য পেয়ে আসছে অতীব সহজ ভাবে অর্থাৎ আমরা বলতে পারি এই টেলিভিশন দূর-দূরান্তের বিষয় কে খুবই নিপুনতার সাথে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম।

দেশ-বিদেশের নানা খবর স্যাটালাইট এর মাধ্যমে নেটওয়ার্ক পেয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় এবং টিভিতে তা প্রদর্শীত হয় এর ফলে মানুষ জানতে পারে অনেক কিছু। সম্প্রচার কেন্দ্রের কার্যাধিকারীরা খবর সংগ্রহ করে , এই গণমাধ্যমেই মানুষকে সূচিত করে এবং মানুষ নানা ধরণের ঘটনা সম্মন্ধে অবগত হয় । গণমাধ্যম হিসেবে মানুষের মধ্যে সৃজনশীল ও বৈচিত্রপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে টেলিভিশন এর এক বিশেষ ভূমিকা আছে। তথ্য সম্প্রচারের মাধ্যমে জনমত গঠন ও জনশিক্ষা প্রসার ঘটায় দূরদর্শন। এছাড়া সমাজের নানান ধরণের বাস্তবভিত্তিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও দূরদর্শনের নানা ধরণের চ্যানেলের কার্যক্ষমতাকে কোনোভাবে অস্বীকার করা যায়না।

শিক্ষাবিস্তারে টেলিভিশন-এর গুরুত্ব :
শুধু বিনোদন নয় নানা শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ও টেলিভিশনের প্রতিপাদ্য । জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে পুস্তকের এক অনন্য ভূমিকা থাকলেও এই টিভির মাধ্যমেও জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব কারণ শ্রবণ ও দর্শন এই দুইয়ের মাধ্যমে টিভিতে সম্প্রচারিত চ্যানেল আমরা প্রত্যক্ষ করি । বলাবাহুল্য টেলিভিশন-এ সর্ব প্রথম সম্প্রচারের বিষয়বস্তু ছিল শিক্ষামূলক  তবে এর সাথে কিছু বিনোদনের উপকরণও সংযুক্ত ছিল।

শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়কে বিনোদনের মোড়কে মুড়ে দর্শকের কাছে প্রচার করা হয় এই টিভির সম্প্রচারের মাধ্যমে। আমরা যদি ভারতীয় টেলিভিশনের আদিতম সম্প্রচার কেন্দ্র তথা দূরদর্শনকে ধরি, তবে আমরা দেখবো এই চ্যানেলে নানা ধরণের ধারাবাহিক সম্প্রচারিত হতো যেগুলির মধ্যে সচেতনতা প্রচারমূলক বিষয় ছিল বিশেষ তাৎপর্যবাহী । সমস্ত রকম বিনোদনের মাঝে জনস্বাস্থ্য,দেশে নাগরিক হিসেবে মানুষের কর্তব্য ও অধিকার,পথ চালনার নিয়মকানুন, নানা ধরণের জাতীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদির সম্প্রচার সেকালেও যেমন করা হতো একালেও তেমনি করা হয়। বর্তমানেও এই শিক্ষামূলক চ্যানেলের হার কমেনি বরং বেড়েছে। ডিসকভারি,ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, এনিম্যাল প্ল্যানেট, টি.এল.সি ইত্যাদি চ্যানেল গুলি এ সময়ে জ্ঞানমূলক তথা শিক্ষামূলক বিষয় সম্প্রচারের ক্ষেত্রে বিশেষ জনপ্রিয়তার অধিকারি।

অপব্যবহার :
প্রত্যেক বস্তুর কু-প্রভাব এবং সু-প্রভাব সময়ের সাপেক্ষে দুই-ই কার্যকর হয় সমান ভাবে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নানা বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম আছে যার মধ্যে টেলিভিশনকে বাদ দেওয়া চলেনা। এই টেলিভিশন প্রত্যেক বাড়িতেই প্রায় দেখা যায়। মানুষ বাড়িতে রাখা আসবাবের সাথে এই টিভিকেও সর্বদা বিবেচনার মধ্যে রাখে এর কারণ টেলিভিশন হলো   বিনোদনের এক বিশেষ ঠিকানা ।

টেলিভিশন এর অপব্যবহার এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো বিজ্ঞাপন। সচরাচর টিভিতে দেখানো নানান বিজ্ঞাপন বিভিন্ন ধরণের পণ্য প্রদর্শন করে যা মানুষের মনকে করে তোলে ভোগবাদী। উনিশ শতকে ঘটিত বিশ্বায়নের ফলে , মানুষের ভোগ বিলাসী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের যথেষ্ট ভূমিকা আছে। টেলিভিশন এই বিজ্ঞাপনেরই প্রচার করে প্রভূত পরিমানে যার ফলস্বরূপ মানুষের পণ্যের প্রতি ঝোঁক বাড়তে থাকে। এছাড়াও টেলিভিশন এর মাধ্যমে জনমত গঠন করা যায় অতীব সহজে,  যার সুবিধে নিয়ে অনেক সুবিধালোভী মানুষ ভুল খবর সম্প্রচার করে এবং মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করে। ভ্রান্ত ধারণা তথা কুসংস্কার ভীষণই ভয়ঙ্কর এর ফলে সমাজে নানান অসঙ্গতি দেখা যায় এই কারণে অসঙ্গতি ঠেকাতে টেলিভিশন এর সম্প্রচারের বিষয় সঠিক ভাবে নির্বাচন করা বিশেষ প্রয়োজনীয়।

বর্তমান সভ্যতা ও টেলিভিশন :
সময়ের প্রবাহ সর্বদাই বহমান। মানুষ সময়ের সাথে এগিয়ে চলে এবং নিজেদের চারপাশের বস্তুকেও এগিয়ে নিয়ে চলে।প্রসঙ্গত প্রযুক্তির কথা বিশেষ উল্লেখ্য। মানুষ সময়ের সাথে নিজেদেরকে ও প্রযুক্তিকে একই সাথে আধুনিক করে তোলে। আধুনিক যুগে মানুষের প্রচেষ্টায় গণমাধ্যম হিসেবে প্রথম বেতার যন্ত্র আত্মপ্রকাশ করে। এর পরে আসে টেলিভিশন। টেলিভিশন এর আবিষ্কার মানবজীবনে বিনোদনের এক বিশেষ পন্থা উন্মুক্ত করে এবং সময়ের সাথে আবার নতুন ভাবে এক নতুন প্রযুক্তি আসে যার নাম মোবাইল। এই মোবাইল মানুষের হাতের কাছে আরো সহজ ভাবে এনে দেয় বিশ্বকে।

টেলিভিশন ও বেতার এর যে গুরুত্ব ছিল তা আরো, আধুনিকতার সাথে আরোপিত হয় মোবাইলের উপর। এই কারণবশত মানুষের মোবাইল এর প্রতি ঝোঁক বাড়তে থাকে। এর পরে আরো একটি নতুন প্রযুক্তি মোবাইল এর সাথে সংযুক্ত করা হয় তা হলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেট এর দৌলতে মানুষ আরো মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে পরে এবং টেলিভিশন ধীরে ধীরে তুলুনামূলক বয়স্কদের বিনোদনের ঠিকানায় পরিণত হয়। তবে নব্য নির্মিত টেলিভিশন গুলিতেও ইন্টারনেট সংযোগ ঘটিয়ে অত্যাধুনিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তথাপি আমরা বলতে পারি যুগের প্রেক্ষিতে টেলিভিশন কিছুটা পিছিয়ে পরলেও,আবার নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে এর জয়যাত্রা এগিয়েই চলেছে।

উপসংহার:
পরিশেষে বলা যেতে পারে মানুষের বিনোদনের নানান স্তরের মধ্যে টেলিভিশন অন্যতম। টেলিভিশনের বিভিন্ন ধরণের গুরুত্বের আধারে আমরা নানা ধরণের জ্ঞান অর্জন করতে পারি যে জ্ঞান আসে শ্রবণ ও দর্শন এই দুইয়ের সাপেক্ষে। গণমাধ্যমের ধারক ও বাহক হিসেবে এই টেলিভিশন দেশ-বিদেশের লক্ষ্য কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয় নানান ধরণের খবর। অজানা অচেনা বিষয়ও মানুষের জ্ঞানের পরিধিতে আসে টিভিতে সম্প্রচারিত অগুন্তি চ্যানেলের মাধ্যমে। সময়ের সাথে টেলিভিশন এর দর্শকের হার কমলেও তা কখনোই তলানিতে গিয়ে ঠেকেনি কারণ এর গুরুত্ব মানুষের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।