রাজলক্ষ্মীর চরিত্র পরিচয়

কলমে – পূজা দাস, এম.এ (কলিকাতা বিশ্ববিদ‍্যালয়)


“ঘটনার বিকাশেই চরিত্রের বিকাশ, আবার চরিত্রের বিকাশেই ঘটনার বিকাশ”
(শ্রী ক্ষীরোদ কুমার দত্ত)।

       উপন্যাসের চরিত্র সৃষ্টি বা সৃজন করা উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বাংলা কথাসাহিত্যের  ধারায় যেকোনো গল্প বা উপন্যাসে চরিত্র একটি অপরিহার্য বিষয়। সেই চরিত্র হতে পারে কোন পুরুষ বা কোন নারী অথবা কোন নায়ক বা নায়িকা। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পাঠক মহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাস্তব সমস্যা ও বাস্তব চরিত্র চিত্রণের জন্য। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে তিনি বাস্তব চরিত্রায়নে যতটা আগ্রহী ছিলেন হৃদয়প্রাবল্যে ভালোলাগার মতো চরিত্র নির্মাণে উৎসাহ বোধ করেছেন আরও বেশি। তাঁর নায়ক চরিত্রের মধ্যে বেশিরভাগ দেখা যায় ছন্নছাড়া, ভবঘুরে, সাংসারিক জ্ঞানশূন্য উদাসীন চরিত্র, আবার অন্যদিকে নায়িকারা ব্যক্তিত্বময়ী, সেবাময়ী এবং ব্যক্তিগত জীবনে কোন সময় একবার স্তলিত হয়েছে।শরৎচন্দ্রই দেখিয়েছেন চিরাচরিত পথে নারীর বিচার না করলেও সাহিত্যে নারী চরিত্র সৃষ্টি করা চলে। শরৎসাহিত্যের নারীরা কোন দেবী নন, তারা যেমন আলোর পথে মর্ত্যের সাধারণ মানুষকে স্বর্গের রাস্তা দেখায় না, তেমনি আবার অন্ধকার এনে জগৎটাকে নরকের দ্বারেও পৌঁছে দেয় না। উপন্যাসে তিনি শুধু কল্পনার ওপর ভিত্তি করে নারী চরিত্র অঙ্কন করেননি এই কল্পনাকে সাথে নিয়ে তিনি বাস্তবকে মধুর থেকে মধুরতর করে তুলেছেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত একটি আত্মজীবনচরিত মূলক ও মনস্তাত্ত্বিক ‌ উপন্যাস হল ‘শ্রীকান্ত’। এই উপন্যাসটিকে চারটি খন্ডে তিনি সমাপ্ত করেছিলেন। প্রথম খন্ডটি ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী’ নামে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সময় কাল ছিল সময় কাল ছিল ১৩২২ বঙ্গাব্দের মাঘ মাস থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত মোট তেরোটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তিনি এই খন্ডটি ‘শ্রী শ্রীকান্ত শর্মা’ নামে লেখেন। পরের দুটি সংখ্যায় তিনি লেখকের নাম শ্রী শরচ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং অবশিষ্ট সংখ্যা গুলিতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামেই লেখেন। ‘ভারত বর্ষ’ পত্রিকার মালিক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স ১৩ টি সংখ্যায় রচনাটিকে ‘শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব’ নাম দিয়ে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ১২ ই ফেব্রুয়ারি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী আবার প্রকাশিত হয় ভারত বর্ষ পত্রিকায় ১৩২৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাস থেকে ১৩২৫ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাস পর্যন্ত। এই রচনা অংশটি নিয়ে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ২৪ শে সেপ্টেম্বর ‘শ্রীকান্ত দ্বিতীয় পর্ব’ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। ঠিক দু’বছর পর ১৩২৭ বঙ্গাব্দের পৌষ মাস থেকে ১৩২৮ বঙ্গাব্দে পৌষ মাস পর্যন্ত তৃতীয় পর্যায়ে প্রকাশিত হয়। ১৩২৮বঙ্গাব্দে পৌষ মাসে নবম পরিচ্ছেদ সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেবার কারণে বহুদিন ওই পর্বের অসমাপ্ত অংশ শেষ করেননি। এর ঠিক পাঁচ বছর পর আরো ছয়টি পরিচ্ছেদ লেখা হলে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ না করে সরাসরি শ্রীকান্ত তৃতীয় পর্ব নাম দিয়ে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ১৮ ই এপ্রিল পুস্তকালে প্রকাশ করেন গুরুদাস এন্ড সন্স। বিচিত্রা পত্রিকায় ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে ফাল্গুন মাস থেকে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ মাঘ মাস পর্যন্ত এই উপন্যাসের চতুর্থ পর্যায়ে প্রকাশিত হয়। এটি বারোটি সংখ্যা নিয়ে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ১৩ই মার্চ গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় পুস্তক আকারে প্রকাশ করে ভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় এটি পঞ্চম পর্ব রচনার জন্য মনোভাব করলেও তা তিনি করেননি।

          কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়  জীবনব্যাপী সাহিত্য সৃষ্টির বিভিন্ন পর্বে নানারকম চরিত্রের নির্মাণ করেছেন। তাঁর রচিত বিভিন্ন পুরুষ চরিত্রের মধ্যে “শ্রীকান্ত”  উপন্যাসের ‘শ্রীকান্ত’ চরিত্রটি নানা দিক দিয়ে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। উপন্যাস প্রথম পর্বে শ্রীকান্তের স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে তার নিজস্ব জাবানিতে, শ্রীকান্তের কৈশোর ও যৌবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা বর্নিত হয়েছে। স্মৃতির পাতা থেকে চলমান ছোট ও বড় ঘটনার বিশ্লেষণে শ্রীকান্ত যে জীবনের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করেছে শ্রীকান্ত চরিত্রে যা রূপ অস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। শ্রীকান্ত বাল্য থেকে পরিণত জীবনের উপর অনেক চরিত্রের সমন্বয় ঘটেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইন্দ্রনাথ চরিত্র। স্কুলের মাঠে খেলার ঘটনা থেকে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীকান্তের প্রথম পরিচয়, শ্রীনাথ বহুরূপীর আগমনে কৌতুক ও ভয়, ইন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীকান্তের গভীর রাত্রে নৌকার বক্ষে নৈশ অভিযানের ঘটনা শ্রীকান্তের চরিত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। শ্রীকান্তের বাল্যকালে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার সাক্ষী ছিল ইন্দ্রনাথ। শুধু সাক্ষী বললে হবে শ্রীকান্তকে নানা অ্যাডভেঞ্চার মূলক ঘটনার সাথে যুক্ত করেছিল এই ইন্দ্রনাথ।  স্কুলের খেলার মাঠে আকস্মিক প্রহারের হাত থেকে শ্রীকান্তকে বাঁচানো,গভীর রাত্রে গঙ্গায় মাছ চুরি, অন্নদা দিদি ও শাহজিকে নানাভাবে সাহায্য করার মধ্যে ইন্দ্রনাথের চরিত্রে যেমন অসীম সাহসী, নেতৃত্বদানে সক্ষম, নিঃস্বার্থ ত্যাগের পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি তার চরিত্রের মনের উদারতার পরিচয়ও পাওয়া যায়। ইন্দ্রনাথের মধ্যে যে গভীর হৃদয় ছিল তা তাকে মৃত্যুহীন ভয়হীন করে তুলেছে,তাই সে অনায়াসে বলতে পেরেছে – “মরতে তো একদিনহবেই ভাই”
       ঔপন্যাসিক ইন্দ্রনাথ চরিত্রকে নির্মাণ করে শ্রীকান্তের বাস্তব জাগতিক অভিজ্ঞতার পথে একধাপ এগিয়ে দিয়েছিল। তাই শ্রীকান্তের ভাষায় ফুটে ওঠে -“কিন্তু এত বড়মহাপ্রাণ আর তো কখনো দেখিতে পাই নাই”। উপন্যাসে খুব সীমিত সময় ধরে থাকলেও খুব বড় ভূমিকা নিয়েছে অন্নদাদিদি। উপন্যাসে তিনি যেমন হঠাৎ আবির্ভাব হয়েছেন, আবার তেমনি আকস্মিকভাবে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু সমগ্র উপন্যাসে তার চরিত্রে প্রভাবের রেশ রয়ে গেছে। অসাধারণ দুঃখের মধ্যে তিনি সংসার জীবন ত্যাগ করে সুখের সন্ধান করেছেন। তিনি বেঁচে থাকার রসদ পেয়েছেন দুঃখের মধ্যে। এখানেই অন্নদাদিদির চরিত্রটির সার্থকতা।
কিন্তু শ্রীকান্ত চরিত্রের সক্রিয়তা আরো দৃঢ় হয়েছে অন্নদা দিদি চলে যাবার পরে। মাঝে মাঝে ইন্দ্রনাথের পাশে শ্রীকান্তের মন নিষ্প্রভ মনে হলেও তার মধ্যে সূক্ষ্ম অনুভূতি প্রবনমন, প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ, মার্জিত স্বভাব ও হৃদয় মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।
       তবে,উপন্যাসের শুরুতে শ্রীকান্তের যে চিত্র নির্মিত হয়েছে, পিয়ারীর সাথে সাক্ষাতের পর তার চরিত্রে আমূল পরিবর্তন এনেছে। যৌবনের উশৃঙ্খলতা ও ভোগ বিলাসের স্বাদ পেলেও তার যথেচ্ছাচার করেনি সে। তাই পিয়ারীকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলেছে। ত্যাগ ও সংযমনে প্রেমের যে প্রকৃত গৌরব – এই সত্যকে লেখক শ্রীকান্তের চরিত্রের উপর প্রতিফলিত করেছেন। তাই প্রেমের নতুন রূপে উদ্বুদ্ধ শ্রীকান্ত অসুস্থ অবস্থায় পাটনা পরিত্যাগ করেছিল। যাবার সময় সে প্রেমের গৌরব প্রকাশে বলে “বড় প্রেম শুধু কাছেই টানেনা-ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে”।
    এছাড়া উপন্যাসে আরও প্রধান চরিত্রের পাশাপাশি কিছু অপ্রধান চরিত্রের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়, এই চরিত্রগুলি হল – মেজদা,শহজি,নতুনদা, রতন, পিসেমশাই, পিসীমা, ছিনাথ বহুরূপী, খানসামা রতন, গৌরী তিওয়ারির মেয়ে, রাম বাবু ও তার পত্নী, কুমার সাহেব প্রভূতি। “শ্রীকান্ত” উপন্যাসের প্রথম পর্বের প্রধান চরিত্র গুলির পাশাপাশি অপ্রধান চরিত্র গুলির প্রভাব কাহিনীর সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে চলেছে।

       উপন্যাসিক শরৎচন্দ্র যেসব নারী চরিত্রের সৃষ্টি করেছিলেন তাদের মধ্যে “রাজলক্ষ্মী” বা “পিয়ারী বাইজি” অন্যতম সৃষ্টি। শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রথম পর্বে ৮ নম্বর পরিচ্ছেদে পিয়ারী বাইজির নামধারী রাজলক্ষ্মীর পরিচয় পাওয়া যায়। রাজলক্ষ্মীর জীবনে শ্রীকান্তের আবির্ভাব বাল্যকালে হলেও তার পরিপূর্ণ প্রকাশ পেয়েছিল যৌবনকালে। উপন্যাসের শ্রীকান্তের সঙ্গে রাজলক্ষ্মী প্রথম আলাপ হয় কুমার সাহেবের তাঁবুতে “বাঈজী” রূপে‌। রাজলক্ষ্মী এই পিয়ারী বাঈজীতে পরিণত হওয়ার একটা কাহিনী উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। শৈশবের রাজলক্ষ্মীর পিতা দ্বিতীয় বিবাহ করে তার মাকে ত্যাগ করে চলে যাই।তারা দুই বোন রাজলক্ষ্মী ও সুরলক্ষী কুলরক্ষার তাগিদে একই পাত্রের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তাদের স্বামী যথারীতি ৭০ টাকা পণ  নিয়ে কোনদিন তাদের কাছে ফিরে আসেনি।এরপরে সুরলক্ষীর প্লীহাজ্বরে মৃত্যুর মৃত্যুর পর রাজলক্ষ্মী ও তার মা কাশিতে চলে যায়। কাশিতে গিয়ে রাজলক্ষী সংগীত বিদ্যা আয়ত্ত করে বাঈজীর জীবন বেছে নেয়। কিন্তু রাজলক্ষ্মীর  বাল্য জীবনে প্রথম প্রেম হিসাবে দেখা দেয়  শ্রীকান্ত। যদিও শ্রীকান্তের মনে রাজলক্ষ্মীকে নিয়ে তেমন কোন ভাবনা আসেনি, তবুও নাবালিকা রাজলক্ষ্মীর বাল্য প্রেমই ছিল তার জীবনের রক্ষাকবচ। এই প্রেম ভাবনা তার বাঈজী জীবনের অন্তরে পবিত্রতা জাগিয়ে রেখেছিল। গভীর প্রেমের আবেশে, কঠিন সংযমের প্রবল বুদ্ধিমত্ততায় এবং আন্তরিক পবিত্রতায় রাজলক্ষ্মী হয়ে উঠেছে অসাধারণ নারী।

       লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাসের রাজলক্ষ্মী চরিত্রকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। কখনো শ্রীকান্তকে বৈইচির মালা পরানোর মধ্য দিয়ে বাল্যপ্রণয়ী হিসাবে, কখনো কুমার সাহেবের শিকারের পাটিতে বাঈজী হিসাবে, আবার কখনো হয়ে উঠেছে স্নেহময়ী মমতাময়ী। সমাজের নারী হৃদয়ের দ্বন্দের চরম বিকাশ তিনি রাজলক্ষ্মী চরিত্রের মধ্যে নিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন।

      শৈশবের নিষ্ঠুর বিধানে এবং আপন খেয়াল বশে রাজলক্ষী এক ছড়া বৈচির মালা শ্রীকান্তকে পরিয়ে দিয়েছিল। শ্রীকান্তের মধ্যে তেমন কোন অনুভূতি না থাকলেও, রাজলক্ষ্মীর মধ্যে ছিল পরিপূর্ণ ভালোবাসার বন্ধন। পরিণত বয়সে এসে যা জানতে পেরে বিস্তৃত হয়েছিল শ্রীকান্ত –  “কবে যে এই পিলে রোগা মেয়েটা তাহার ধামার মতো পেট এবং কাঠির মতো হাত-পা লইয়া আমাকে প্রথম ভালবাসিয়াছিল এবং বৈইচির মালা দিয়া তাহার দরিদ্র পূজা সম্পন্ন করিয়া আসিয়া ছিল, আমি টের‌ও পাই নাই”। এখানে শ্রীকান্তরূপী লেখক অবাক হয়েছেন এই ভেবে যে, দীর্ঘকাল পরেও বাল্য প্রেমের স্মৃতি রাজলক্ষ্মী অন্তরে অবস্থিত রয়েছে অক্ষয় রূপে। এরপরে রাজলক্ষ্মীর বাঈজী জীবনে পদার্পণ করে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। পরপুরুষকে ভোলানোই যদি তার প্রেমের একমাত্র উদ্দেশ্য হত তাহলে রাজলক্ষ্মী বেঁচে যেত কিন্তু সে যে মরে ছিল ভালোবাসায়। তাই রাজলক্ষী অনায়াসে বলতে পারে – “ছেলেবেলায় একবার যাকে ভালোবাসা যায় ,তাকেকি কখনো ভোলা যায়?” রাজলক্ষ্মীর অটুট বিশ্বাসের কাছে পরাজিত শ্রীকান্ত বলতে বাধ্য হয়েছে – “তোমাকে মনেই বা কবে করেছিলুম যে ভুলে যাবো না,বরং আজ চিনতে। দেখে, নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছি।”
        রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে তার ভালোবাসায় কখনো বেঁধে রাখতে চাইনি, বরং শ্রীকান্তের সঙ্গে এমন আচরণ করেছে যাতে বাঈজীর প্রতি শ্রীকান্তের মন বিতৃষ্ণায় ভরে উঠতে পারে। কিন্তু যখন শ্রীকান্তের শশ্মান অভিযানে যাওয়ার কথা ওঠে তখন সে তার ভালোবাসার অধিকারের বলে ওঠে –“শ্মশানে-টশানে তোমার কোনমতেই যাওয়াহবে না, কোনো মতেই না”। তবুও নিষেধ অগ্রাহ্য  করে শ্রীকান্ত শ্মশানে গেলে পিয়ারী তার বিশ্বস্ত অনুচর রতন খানসামা ও অন্যান্যদের পাঠিয়েছিল শ্রীকান্তকে ফিরিয়ে আনতে।
       সে বহু পুরুষের মনোরঞ্জনকারী বাঈজী হলেও তার চরিত্রের সর্বপ্রথম ধরা পড়ে কোমলতা। তাই কুমার সাহেবের শিকার প্রসঙ্গে সে বলেছে- “কি নিষ্ঠুর এই পুরুষ মানুষ জাতটা অনর্থক জীব হত্যা করিয়া কি আমোদ পায়, তারাই জানে”। নিজের বাঈজী বৃত্তি করলেও শ্রীকান্তকে কখনোই মোসাহেবিগিরি করতে দিতে রাজি নয় রাজলক্ষ্মী, এখানেই তার ভালোবাসার পরিপূর্ণতা পায়।

এরপরে রাজলক্ষ্মী এক সেবাপরায়ণ মমতাময়ী রূপে আবির্ভূত হয় উপন্যাসে, শ্রীকান্ত জানিয়েছে একটা চিঠিতে রাজলক্ষী লিখেছে – “সুখের দিনে না হোক দুঃখেরদিনে যেন তাকে বিস্মৃত না হয়।” শ্রীকান্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে।  শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীর মাঝখানে বঙ্কুর মা সমাজরূপী  অভ্রভেদী হিমালয়ের মতো দাঁড়িয়েছে।  রাজলক্ষ্মীর মাতৃত্বে শ্রীকান্ত অভিভূত “মাতৃত্বের একটা ছবি আজকে চোখে পড়াই যেননতুন জ্ঞান লাভ করিলাম”। তবুও শেষে রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে ফিরিয়ে দিয়েছে।  লেখক ভেবেছেন- “আমি সমস্ত দেখিলাম, সমস্ত বুঝিলাম, যে গোপনে আসিয়া ছিল তাহাকে গোপনেই যাইতে দিলাম।” উপন্যাসের শেষে গভীর হৃদয় উপলব্ধি শ্রীকান্তের হয়েছিল- “বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে, না ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে।”
          রাজলক্ষ্মীর সতীনের ছেলে বঙ্কুর কথা জানা যায়‌ – রাজলক্ষী সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট সম্পর্কে সহানুভূতিশীল। গ্রামের আট- দশ জন ছেলের পড়াশোনার খরচ, প্রবল শীতে বহু মানুষকে কাপড় দেওয়া এবং জল কষ্টের জন্য গ্রামের পুকুর খনন করার মধ্য দিয়ে রাজলক্ষ্মী শুধু মুখে নয় কর্মেও মানব দরদী। রাজলক্ষ্মী অসুস্থ শ্রীকান্তকে দূরে সরিয়ে একদিকে মাতৃসত্তার মর্যাদা রক্ষা করেছিল, অন্যদিকে হৃদয়ের প্রেম বাসনাকে সচেতন ভাবে রক্ষা করেছে। শ্রীকান্তকে মুক্তি দিতে এবং নিজের ধর্ম রক্ষা করতে দুজনের মাঝখানে মাতৃত্বের প্রাচীর তুলে শ্রীকান্তকে অসুস্থ অবস্থাতেই বিদায় দিয়েছে। শ্রীকান্ত রাজলক্ষ্মীর স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরে বলেছে –
“তোমার ঋণ ইহজীবনে শোধ করিবার শক্তি আমার নাই।  কিন্তু যে জীবন তুমি দান করিলে সেই জীবনের অপব্যবহার করিয়া আর না তোমার অপমান করি – দূরে থাকিলেও এ সংকল্প চিরদিন অক্ষুন্ন রাখবো”।

        শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে প্রথম পর্বে অন্নদাদিদি,রাজলক্ষী চরিত্রের মধ্যে দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন সমাজে নারীর ‌একটা বিশিষ্ট স্থান ‌আছে। নারীর গৃহ সংসার, নারীর মাতৃত্ব, নারীর গৃহিনীপনার ভিতর দিয়েই নারী তার স্থানটি অধিকার করে আছে। তবুও এখানে সঞ্চিত ‌আছে তাদের অপরিসীম দুঃখ ও অনন্ত বেদনা।শরৎচন্দ্র ‌এই উপন্যাসে মুলত হিন্দু নারীর চরিত্র অঙ্কন করেছেন। অন্নদাদিদিকে প্রথম দিকে মুসলমান হিসাবে জানলেও শেষে জানা যায় তিনিও একসময়য় হিন্দু রমনী ছিলেন। পরিস্থিতির চাপে পড়ে তাকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে হয়েছে। এছাড়াও এই উপন্যাসে শরৎচন্দ্র নারীরা কেউ দুর্বল নয়, সবাই নিজের নিজের মতো স্বতন্ত্র , তবে তারা প্রেমের মোহৈ কিছুটা দুর্বল।যেমন রাজলক্ষ্মীকে দেখা যায় অন্য সময় সে অনেক শক্ত সামর্থ্য হলেও যখন শ্রীকান্ত শ্মশানে যাবার কথা ওঠে তখন সে কেঁদে ফেলেছে। আবার অন্যদিকে অন্নদাদিদিকে দেখা যায় দারিদ্রতার মধ্যেও তিনি তার আত্মসম্মানবোধ কখনো খন্ডিত করেনি। শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন নানা কারণে সমাজ যত পঙ্গু ও জীর্ন হয়েছে নারী হৃদয়ের বিরুদ্ধে তার শক্তি ততই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এই সময় শক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই চলেছে নারী শক্তির আত্মপ্রকাশ। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে শৈবলিনী, কুন্দনন্দিনী, রোহিনী এদের জীবনেও দ্বন্দ্ব ‌আছে কিন্তু এদের দ্বন্দ্ব সমাজের সঙ্গে নয়। কতকগুলি ঘটনা সংঘাতের ফলে এদের জীবনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে বঙ্কিম সাহিত্যে হৃদয়ের এই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শরৎ সাহিত্যে নারীর এই দ্বন্দ্ব চিরন্তন বিশেষ কোনো ঘটনার ‌ওপর নির্ভর করে না।

সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার  রাজলক্ষ্মীর প্রেম ধর্মের মহত্বের ব্যাখ্যায় বলেছেন ,-  “রাজলক্ষী তাহার ‌আত্মগত গভীর প্রেম পিপাসাকে নিজ অন্তরে ধারন করিয়া চিত্তকে সম্পূর্ণ বশীভূত করিয়াছিল। সেই প্রেম ‌একটা শক্তিরূপে রক্ষা কবজের মতোই সকল অনাচার ‌ও উচ্ছৃঙ্খলার মধ্যেও তাহাকে শ্রেয়ের পথ হইতে ভ্রষ্ট হইতে দেয় নায়। সেই প্রেমই তাহার গুরু,তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নাই।”